
অ য় ন চৌ ধু রী-র কবিতাগুচ্ছ
ঘূর্ণি
পাগলের মতো মৃদঙ্গ বেজেছে তোমার কনকলতার নীচে জমে থাকা অন্ধকারটুকুতে
ওইটুকুই আমার ফিরে দেখা আজ। তোমার ঘ্রাণ ম্লান হয়ে এল
কী ছিল আশ্চর্য আঁধার ঘনিয়ে আসা নিঃসঙ্গ ফুলের গাছে
কেন করবীর ডালে ডালে বিষণ্ণ চিলের ওড়াউড়ি, পাশেই কি মৃতদেহ একা শুয়ে আছে!
আমাদের কাটাকুটি সম্পর্ককথা, ঘোর লাগা তোমার ঠোঁটের মতো হাওয়ায় কেঁপে ওঠে পাতা
আমি রূপবতী শহরে বুভুক্ষু শ্রমিকের মতো বেঁচে থাকি
নিঃসন্তান রমণীর মতো আমিও উপোসী রয়েছি কতদিন,
উঠোনে খুদ ছড়িয়ে মিথ্যে বাৎসল্য খুঁজেছি পাখির ফেলে যাওয়া রুগ্ন পালকে
আমাদের রাত্রি কাটে না। খলখল করে হেসে ওঠে স্মৃতিকাতর এক একটি ভূত
তুমি তার পায়ের কাছে বসে খুলে ফেলেছ সামান্য অন্ধগলির মতো যেকোনো সুতো
আজ কোনো প্রার্থনা নেই, ঘর জুড়ে পড়ে আছে অস্থিসার বিকেল ভগ্নপ্রায় ঘূর্ণির মতো…
স্বর্ণমীন
শহরের কোলাহলে তোমার আনত স্পর্শটুকু রইল,
আমার সামান্য বোহেমিয়ায় সেটুকুই সঞ্চয়
তোমার ভ্রূ-এর উপর লেগে যায় আমার হাতের মাংসল গন্ধ
এরপর গড়িয়ে নামে, ঠোঁটের কাছে ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে
সেই ঘ্রাণ আরও নেমে এসে তোমার স্তনের চূড়া স্পর্শ করল
তুমি কীভাবে যেন রূপবতী মীন হয়ে গেছ সবুজ সাগরের জলে
আমার এটুকুই প্রজ্ঞা, এটুকুই শৈথিল্য
প্রগাঢ় ধ্যানীর মতো তোমার জানু ছুঁয়ে জাগিয়ে তুলি লবণাক্ত সাগরের জল
সেই ঢেউয়ের ফেনায় আমি ভিজে যাচ্ছি
আমার প্রপাতে তোমার নাভিকুণ্ড নয়, নিভে এল হৃদয়-পোড়া হাড়, হাড়ের দ্রোহ
তোমার শেষ উষ্ণতার মতো এই দূর প্রদেশে গায়ে রেখেছি সাহসী জল, জলের ক্রন্দন
সৈকতে নামিয়ে রেখেছি পোশাক, নিঃস্ব এই ধ্যানীর অভিশাপ নিজের শরীরে নেবে কোনো এক স্বর্ণমীন
জলের অতলে খেলা শুরু হবে বলে নগ্ন এ ধ্যানী নিজেকে ডুবিয়ে মারছে জলে
এসো হে মীন আমাকে নাও, আমার এই আশ্চর্য অভিশাপ শরীরে নিয়ে জন্ম দাও মৎসপুরুষ জলের অতলে…
তারপর সাগরের জলে কেঁপে কেঁপে হাওয়া কেটে যাবে
আমাদের ক্রীড়ায় ক্রীড়ায় জলেরও সঙ্গমে হঠাৎ কোনো এক শেষরাতে তার সন্তান হবে…
চিহ্ন
আজ রৌদ্র আমাকে পরিত্যাগ করেছে
পায়ের পাতার কাছে জমে উঠছে বরফ
এই দূর প্রবাসে জলের ছিন্নভিন্ন মায়ার মতো ঠোঁট ফাটে
শহরে সমস্ত পাতা খসে গিয়ে অস্ত্রের ধারালো পিঠের মতো হয়ে উঠছে প্রতিটি বৃক্ষ
সাপের কুণ্ডলীর মতো হিমপ্রবাহ উঠে আসছে দেওয়ালে আঁকা তোমার শেষ খণ্ডযুদ্ধটির কাছে…
পূর্ণ মাঘমাস… এই অন্তিম চিহ্নখানি ছাড়া আমার আর কোনও মানচিত্র ছিল না সেই রাতে
হিম এসে চোখ ঢেকে দিল, একাকী শরীর পুড়েছিল নিজস্ব শরীরের পাশে…
এই লেখা অথবা জন্মবৃত্তান্ত
আজ এই শহরে অগ্নিকাণ্ড, প্রতিশ্রুতি ভেঙে গেছে বলে
অচেনা কোনো এক শহরের দিকে তুমি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছ—
এখানে সমস্ত কাক আজ রক্ত মেখেছে, ছড়িয়ে রাখা ভাতের দিকে
অবজ্ঞা ছুড়ে দিয়ে পালকে লেগে থাকা রক্ত ছিটিয়েছে পথে
পুরনো স্মৃতি লেগে আমার ঠোঁট আজ বিষাক্ত নীল হয়ে আছে
হাতের আঙুলে লেগেছে মৃত পাখির সাংসারিক আলো,
ভাঙা গাড়ির মতো আওয়াজ তুলে ডুবে গেছে সন্ত্রাসপ্রিয় নক্ষত্র
অদূরে হাঁটছে হাওয়া তোমার শরীর ছুঁয়ে
দু’একটি পাতার মতো সামান্য স্পর্শ ঝরে গেল
একটি নতুন মানুষ উঠে আসছে কুয়োতলা থেকে
তার ভিতর থেকে উঠে আসছে যাবতীয় হোম ও বিসর্জনের শেষ আয়োজন
আমি ওই কুয়োর দিকে ঝুঁকে ফাঁকা অন্ধকারে খুঁজে চলি নিজের ছায়া
জলের ভিতর থেকে ডাক আসে, আমৃত্যু নেশার মতো সে ডাকে
আমি ঝাঁপ দিই ওই বুভুক্ষু খিদের ভিতর
সেখানে জলের গভীরে শ্যাওলায় ভরে উঠবে আমাদের শরীর,
আমাদের নতুন সংসারে জলমগ্ন সুর ভেসে উঠবে সন্তানপীড়িত আলোয়
কুয়োর ফুটোতে পূর্ণচাঁদ নেমে আসে, আগুনে আগুন ফেলে মায়া ঢেকে রাখে হরিদ্রাভ ঘুম
নিঃস্তরঙ্গ জলের কিনারে ক্লেদাক্ত মরীচিকা ফুল জেগে উঠে ঢেকে দিল চোখ
নিঃস্ব পড়ে থাকে এই লেখা, বুকের দস্তানা অথবা কোনো রাহুকেন্দ্রিক শোক…
দ্রোহ অথবা আত্মহত্যা
আজ কোনো অভিযোগ নেই এই গুমরে ওঠা দিনটির কাছে
এত যে নির্লিপ্ত হয়ে আছে সে, পথে পথে ছড়িয়ে রেখেছে মাটির দুঃখঘোর
তাকে আজ সম্মোহনে আবাহন করেছে আমার মনের মধ্যে জেগে ওঠা একটি দীর্ঘতম খাদ
আমি যে ঘুমোই না কতকাল, মায়ার রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে যত্ন করে সাজিয়ে রাখা
পাতাবাহারের শিরা উপশিরাগুলি গাঢ় নীল হয়ে এল। তাদের ধমনীর কাছে আজ জমে উঠেছে বাকলের অসুখ
নিথর বিকেলে দিকে জলের সর ভেঙে উঠে এল মাছের চিৎকার, মৃত্যুমুখী ফাঁদ
জলের কাছে আজ আমি নামিয়ে রাখছি কয়েকশো বছরের স্পৃহা। নিজেকে হত্যার মতো কোনো এক উৎসব
তবু ঘরের ভিতর আরও ঘর ভেঙে গিয়ে প্রতিটি দরজার কাছে বিষণ্ণ সিঁদুরের দাগ আমাকে ছিন্নভিন্ন করেছে
হিংস্র খেলায় মেতেছে আমার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে। রক্তের লবণাক্ত ঘ্রাণে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল
একটি বাঁশির মতো মিহি কোনো সুরের ভিতর বসে বসে একটি মরণাপন্ন যুবক তার অতিত নিয়ে খেলছে
অকারণে ভবিষ্যৎ ভেঙে ফেলে, অথবা বর্তমানকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিজেকে সে ধ্বংসস্তূপের যুবরাজ বানিয়ে রেখেছে
কেউ আসেনি কোনোদিন। পেরেক গাঁথা ভূমির সমস্ত দাহটুকু আজ নিজের অন্দরে পুরে রেখে শাণিত অস্ত্রের মতো
সে জ্বলে উঠছে। প্রজাপতির ডানায় শিশির বিন্দুর মতো আজ সফেদ আলোর ফুলকি লেগে ভেঙে গেছে মোহ
ঘরের ভিতর ঘরের শবদেহ নিয়ে শোকসন্তাপহীন একটি বিস্মিত জীবন জীবনেরই দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে দ্রোহ…