ধারাবাহিক উপন্যাস
কেদার ( বারোতম পর্ব)
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
“তত্ত্বেহনুকম্পাং সুসমীক্ষমাণো/ভুঞ্জান এবাত্মকৃতং বিপাকম্।//হৃদ্বাগ্বপুর্ভির্বিদধন্নমস্তে/জীবেত যো মুক্তিপদে স দায়ভাক্//”(শ্রীমদ্ভাগবত ১০/১৪/৮)(ভক্ত মনে করেন যে,ভগবান তাঁকে অল্প একটু কষ্ট দিয়ে পূর্বকৃত পাপকর্মের ফল থেকে মুক্ত করছেন।এই ভাবনায় সেই ভক্ত মনে করেন তিনি ক্রমশ জড়জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হচ্ছেন।)
-খেয়ে নে সুকুমারী। অমন করতে নেই।
জলভরা অলোকানন্দার দিকে তাকিয়ে থাকে সুকুমারী। বিড়বিড় করতে থাকে।”ওরা আমার ছেলেডারে লিয়ে লিবে গো”। ভাত মেখে খাইয়ে দিতে গিয়ে গা স্পর্শ করেই থমকে গেল অলোকানন্দা। সুকুমারীর গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। তার হাত পা মৃদুমৃদু কাঁপছে। তবে কি ওই মারণভাইরাসজ্বর সুকুমারীকেও ধরল? একদিকে শাশুরী, অন্যদিকে সই। কোনদিকে যাবে সে?
-খেয়ে নে লক্ষ্মীটি।
-লে যাবে আমার অচ্যুতরে।
-কে লে যাবে?
-ওই সাধুটা!
সুকুমারীর মুখেচোখে ভয়। অলোকানন্দা আলুমাখা ভাতের দলা ওর মুখে পুড়ে দিতে ও এবার অন্যমনস্ক হয়ে চিবোতে থাকে। রতনপুর থেকে গতকালই কাপড় পরিয়ে গোকুলঘরিয়ার ঘরে সুকুমারীকে নিয়ে এসেছে অলোকানন্দা। এসে দেখল কৃষ্ণেন্দুর ঘরের পাল্লা ভেজানো। আলতো করে খুলে একবার দেখেছিল চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। বুকের ভিতর আকুল করে উঠল। মনে হল একবার যায় কাছে। তারপরই অভিমান পায়ের উপর শিকল হয়ে আটকে দিল তাকে। সুকুমারীকে নিজের ঘরে এনে চান করিয়ে পোশাক পরিয়ে এই ঘন মাঝরাতেও সে খাওয়াবার চেষ্টা করে চলেছে। আর মনে মনে একবার ভাবছে কৃষ্ণেন্দুর কথা। একবার সুকুমারীর পোলা অচ্যুতের কথা। এতোগুলো বছর নিরুদ্দেশ। তবে কি সে ছেলে সত্যিই আবার ফিরে এসেছিল? বেনারসে কেন গিয়েছিল সুকুমারী? একা গিয়েছিল না কেউ নিয়ে গিয়েছিল? ভাবতে ভাবতে অলোকানন্দা দেখল সুকুমারী মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর। খাটের কোণায় সদ্য সেলাই করা শালটা হাতে নিয়ে যত্ন করে সুকুমারীর গায়ে মেলে দিল সে। আহা। কতোদিন ঘুমোয়নি হয়তো। শকুন শেয়াল ওর নগ্নতা ছিঁড়ে খেয়েছে। ঘুমাক। কাল একবির হাসপাতালে নিয়ে যাবে সে। আউটডোরে দেখিয়ে ওষুধ লিখিয়ে নেবে।
সুকুমারীকে ঘুম পাড়িয়ে কৃষ্ণেন্দুর ঘরে ঢুকল অলোকানন্দা। ছেলেটা এখনও ঘুমোচ্ছে! কতোদিন পর এল ঘরে! চোখমুখ ঢুকে গেছে। আহা। শহরে কী খায় কে জানে!ওই নতুনগ্রামের মাগীটা আসার পর থেকে ছেলেটা পর হয়ে গেল যেন। ভাবতে ভাবতেই বিব্রত লাগে তার। এ কী ভাবছে সে! অতো ছোট্ট একটি মেয়ে। কেন এমন ভয় হচ্ছে তার। কৃষ্ণেন্দু ঘুমোচ্ছে অঘোরে। কখন এল কে জানে! এতো ঘুমোচ্ছে কেন?শরীর খারাপ? কপাল স্পর্শ করে দেখল অলোকানন্দা। নাহ।জ্বর নেই। কপাল ছুঁতেই কৃষ্ণেন্দুর চোখের পলক কেঁপে উঠল। চোখ মেলে তাকাতেই অলোকানন্দা বুঝল তার বুকের ভিতর গোকুলিয়া নদীতে বান এসেছে। আর সে জল বাধ দেওয়া যাবে না।
-কেমন আছো মা?
-একটা ফোন করতেও তোর এতো বাঁধা? এতো ব্যস্ত তুই?
-না। এবার কিছুদিন বাড়ি থাকব মা। পরীক্ষা শেষ?
-খেয়ে নিবি চল।
-তুমিও তো খাওনি!চলো।
খেতে খেতে কৃষ্ণেন্দু প্রশ্ন করতে থাকে ঘনঘন। অলোকানন্দা সাধ্যমতো উত্তর দেয়। মুরগীর খাঁচাগুলো খালি কেন? অলোকানন্দা ঝড়ের কথা বলে, অন্ধকার বৃষ্টি তুফানের কথা বলে। কিন্তু সিংহানিয়াকে টিপছাপ দেবার কথা চেপে যায়। কৃষ্ণেন্দু বলে, ঠাকুমা কোথায়? অলোকানন্দা আবার ফিরে যায় এক অন্য কালবৈশাখীর কথায়। কখনও কৃষ্ণেন্দু বলে, সুকুমারীমাসির কী হয়েছে? অলোকানন্দা আবার বলতে থাকে। মদন যেভাবে কীর্তন হলে পালাগান করে গল্প শোনায়, সেভাবেই বলে চলে। এ কথোপকথন যেন থামতেই চায় না। কৃষ্ণেন্দু ভাবে, এতোগুলো দিন তার মা একাএকা এতোগুলো ঝড়ঝাপ্টা সামলিয়ে চলেছে। কী করে পারল না। অপরাধবোধে বুকের ভিতর ভারি হয়ে আসে তার। একবার তো সে ফোন করতেই পারত! কেন কথা বলেনি? সহেলিকেও তো জানায়নি এই ঘরে ফেরার কথা। সুরঙ্গমা চৌহানের কথাগুলো গুনগুন করছে ভিতরভিতর। প্রকৃতি জীবন যাপন অনুভূতি, এ সবই তো নগ্নতায় ভরা। কৃষ্ণেন্দু সে সব স্পর্শ করে দেখেনি। দেখেনি বলেই তার ক্যানভাসে এতোদিন প্রাণসঞ্চার ঘটেনি। রামকিঙ্করের মতো সে অনুভব করতে চায়নি তার চারপাশ। এবার সে ফিরে এসেছে। সব ঠিক করে দেবে! মার সজল চোখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণেন্দু বলল,”চিন্তা করিস না। কাল থেকে আমি ঠাকুমাকে দেখতে হাসপাতাল যাব। তুই ঘর সামলে রাখ। সুকুমারী মাসিকে একবার নার্ভের ডাক্তার দেখালে ভালো হয়। আমি কলকাতায় দেখেছি। মনে আঘাত পেলে মানুষ যেমন পাগল বনে যায়, আবার তেমনই চিকিৎসা করলে সুস্থ হয়েও যায়। আমি সব ঠিক করে দেব। তুই চিন্তা করিস না।”
চোখ মুছতে মুছতে অলোকানন্দা বলে,”বেশ। সব করবি। এখন খেয়ে নে দেখি।”
হাসপাতালে ঢুকেই শরীরের ভিতরটা কেমন একটা করে উঠল কৃষ্ণেন্দুর। এতোগুলো বছর ক্যানভাসে কেটে গেল তার। তবু জীবনের এই একটুকরো ছবি এতোদিন অদেখা থেকে গিয়েছিল তার কাছে! গোলাপী কাগজ নিয়ে পার্টি মিটিংএর অপেক্ষা করছিল সে। নির্দিষ্ট সময়ে নদীতে বেঁধে রাখা জলের মতোই আর্ত পীড়িত রোগীর আত্মপরিজনদের রোগীদের কাছে যাবার অনুমতি দেওয়া হল। কৃষ্ণেন্দুর হাতের কাগজটায় কোনও নম্বর লেখা নেই। ঠাকুমার নাম ধরে সিস্টার টেবিলে জিজ্ঞেস করতেই ব্যস্ত সিস্টারদিদিমণি আয়ামাসিকে দেখিয়ে দিল। আয়ামাসি ভ্রু কুঁচকে আঙুল তুলে শুধু বলল,”ওদিকে চলে যান”।সরু করিডর ভরা রোগী, স্যালাইনের সুতলী, ছড়িয়ে থাকা ওষুধের ফয়েল পেরিয়ে কৃষ্ণেন্দু অবশেষে তার ঠাকুমার কাছে পৌছোতে পারল। একটা ভাঁজ করে রাখা ইজেলের মতোই শুয়ে আছে ঠাকুমা। চোখ দুটো ঢুকে গেছে কোটরে। মার কাছে শুনেছে কৃষ্ণেন্দু। ঠাকুমার মানুষ চেনার ক্ষমতা নেই। চোখ আধবোজা। সেই চোখের কোণা দিয়ে মজে যাওয়া গোকুলিয়া নদীর মতোই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।
-ঠাকমা। ও ঠাকমা।
কয়েকবার স্পর্শ করেই সরে এল কৃষ্ণেন্দু। এই মানুষটিকে কোনওদিন কাছ থেকে দেখেনি সে। প্রতিটি মাংসপেশী, শুকিয়ে যাওয়া স্তন, ভেঙে ঢুকে পড়া চোয়ালদুটো, ঠিক যেন টেরাকোটার তৈরি কাঠের মূর্তি। মা একা লড়েছে ঠাকমাকে নিয়ে। কৃষ্ণেন্দু এতোটুকু দেখেনি। অপরাধবোধ ঘিরে ধরে তাকে।কেন দেখেনি সে? করিডর থেকে বেরিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে শুনতে হবে রোগীর কথা। ভাবতে ভাবতে মোবাইলে হাত চলে গেল কৃষ্ণেন্দুর। ভাইব্রেটরে ছিল। কাঁপছে তিরিতিরি। সহেলীর ফোন! কৃষ্ণেন্দু ধরল না। ভেসে এল মেসেজ।
-এভয়েড করছিস।
কৃষ্ণেন্দু দায়সারাভাবে লিখল,”না। ঠাকমা অসুস্থ। পরে বলব।”
ডাক্তারের বয়ানে নতুন কিছু খুঁজে পেল না কৃষ্ণেন্দু। যা উনি শান্ত স্বরে বোঝাতে চাইলেন, সে বুঝল তার অর্থ তার ঠাকমা আর বাঁচবে না। আয়ামাসির কাছে ফোন নম্বর রেখে যেতে হবে। ঠাকমার শ্বাস উঠে গেলে ওরা ডাকবে। বড় হাসপাতালে গিয়েও তেমন লাভ নেই। এখন শুধু অপেক্ষা।
বাবাকে তেমন মনে পড়ে না কৃষ্ণেন্দুর। বাইরে বাইরেই থাকত। ঠাকমাকেও তেমন কাছ থেকে দেখেনি সে। আজ এতো কাছ থেকে তাঁর মুখের প্রতিটা বলিরেখা দেখতে দেখতে তার মনে হল, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নগ্নতা লুকিয়ে আছে জীবনের ভিতর। এই মানুষটার জীবনে সেই সত্য উপছে পড়ছে যেন।
হাসপাতালের গেটের বাইরে মুড়ি মাখার দোকান। কৃষ্ণেন্দুর মাথাটা ঘুরছিল। সহেলী ফোন করছিল আবার। কৃষ্ণেন্দু ধরতেই উৎকন্ঠা ভেসে এল ওপার থেকে।
-কী হয়েছে ঠাকমা? কেমন আছে?
-বাঁচবে না বোধহয়। ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়েছে।
-ও। যাব আমি?
-না। আমি সামলে নেব।
-আমাকে ডেকে নিবি কিন্তু। রাগ করেছিস আমার ওপর?
-না। রাগ করব কেন?
-তুই সামলে নে। বসন্ত স্যার আমাকে বলেছে, রেজাল্টের পর একটা হোটেলের ইন্টিরিয়ারের কাজ দেবে আমাদের। দুজনে মিলে করব। কেমন?
-আচ্ছা।
ফোন কেটে মুড়ি মাখা খানিক মুখে পুরেই ফেলে দিল কৃষ্ণেন্দু। মুখের ভিতরটা বিস্বাদ হয়ে রয়েছে। এখন এখানেই কোথাও বসে থাকতে হবে। ঘরে ফিরে গেলে দরীআর ওষুধবিষুধ কী করে আনবে। মা এতোগুলো দিন একা লড়ছিল! একা! ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কেউ যেন কৃষ্ণেন্দুর কাঁধ স্পর্শ করল।
-তুমি অলোকানন্দার ছেলে না?
মাঝবয়সী একটি বৌ। কোলে মাস আঠারোর বাচ্চা। চোখেমুখে ধকলের ছাপ স্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে সদ্য গভীর কোনও অসুখ কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু কিছুতেই মহিলাটিকে চিনতে পারল না। তার মনের কথা ভেবেই মেয়েটি বলল, “আমাকে তুমি চিনবে না। আমি তোমার মায়ের বন্ধু সুকুমারীর বাড়ির কাছে থাকি। সুকুমারী তো সেই কবে নিখোঁজ। কে এক তিলক গেরুয়া পরা উটকো দামড়া ছেলে এল কাশী থেকে।কতো বললাম। ছেলেটা সুবিধার নয়। ও তোর ছেলে নয়। কে শোনে কার কথা।
সুকুমারী মাসি যে এখন গোকুলঘরিয়ায় তার বাড়িতেই রয়েছে, কৃষ্ণেন্দু সে কথা মহিলাটিকে বলল না। সুকুমারীমাসির একটা ছেলে ছিল মায়ের কাছে শুনেছে সে। তারই বয়সী হয়তো। তার নাম অচ্যুত। যতদূর সে শুনেছে, ছেলেবেলা থেকেই প্রায়, সে নিখোঁজ। সে তবে ফিরে এসেছিল? নাকি তার নাম করে…। মহিলা বলে চলে।
-তোমার বুঝি কেউ অসুস্থ?
-হ্যাঁ। ঠাকমা।
-কী হয়েছে?
-ব্রেন স্ট্রোক বলছে।
-এখন কেমন আছেন?
-ভালো না।
-ও।
মহিলাটি অন্যমনস্ক হয়ে এবার চলে যেতে যেতে বলে,”তোমার মাকে বলো বিষ্ণুপ্রিয়া এসেছিল। বলো কিন্তু। আর বলো। সুকুমারীকে ওই চিটিংবাজটা মাথা চিবিয়ে নিয়ে গেছে বারানসি। বলো কিন্তু।
কৃষ্ণেন্দু মাথা নেড়ে জানায় সে বলবে। মহিলাকে চলে যেতে দেখতে দেখতে কৃষ্ণেন্দু ভাবে। নিখোঁজ ছেলের ভেক ধরে একজন সুকুমারীমাসিকে কতো সহজে বোকা বানিয়ে ফেলল। অথচ সে কিছুই বুঝল না। সম্পর্ক মানুষের জীবনে ভূষণের মতোই। ওরা ছাড়াও তো মানুষ নগ্নই। ওই নগ্নতা ক্যানভাসে ধরা যায় না। ওদের ধরতে গেলে জীবনের প্যালেট লাগে। ভাবতে ভাবতেই কৃষ্ণেন্দুর ফোন বেজে উঠল আবার। ওয়ার্ড থেকে ডাকছে তাকে।
-ফ্লোর চব্বিশের বাড়ির লোক বলছেন?
-বলছি।
-এখুনি আসুন।রোগীর অবস্থা খুব খারাপ।
একঝলক একটা ভাঙা ইজেলের মতোই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কৃষ্ণেন্দু। তারপর হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেল।
(ক্রমশ)