
ডুলসাইনার সুর
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার
একপাশে হন্ডুরাস, অন্যপাশে কোস্টারিকা, মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিকারাগুয়া – শ্বাসরুদ্ধ করে দেওয়া এক সৌন্দর্য । তার লাবণ্যময়, অথচ বিপজ্জনক শরীরের বাঁকে বাঁকে শব্দেরা ফিসফিস করে, আর তার বুকের গভীরে উথাল-পাতাল করে কবিতা।
নিকারাগুয়ার ডাকনাম কবিতার দেশ। রুবেন দারিও, আর্নেস্তো কার্ডিনালের মত কবির বৈভব এবং লিগ্যাসি যার তূণে, বিশ্বসাহিত্যের সম্ভ্রম সেই তো আদায় করে নেবে। নিকারাগুয়ার কবিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার রাজনীতি, বিপ্লব, সমাজ ও সংস্কৃতি। ২০০৫ এবং তৎপরবর্তী আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবের মূল কেন্দ্র গ্রানাডা নিকারাগুয়ার একটি ঔপনিবেশিক শহর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ভাষার কবি একহাতে অগ্নিদাহ আর অন্যহাতে প্লাবন নিয়ে জড়ো হন এখানে।
নিকারাগুয়ার সঙ্গে কবিতার এই আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠার যে ইতিহাস, সেটিও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। ১৯৭৯ সালের আগে পর্যন্ত নিকারাগুয়ার জনগণের একটি বিরাট অংশ, বিশেষত গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত মানুষেরা, ছিল সম্পূর্ণ নিরক্ষর। ১৯৮০ সালে যখন সোমোজা বংশের একচ্ছত্র আধিপত্যের এবং একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটল, তখন রেভারেন্ড আর্নেস্তো কার্ডিনালের নেতৃত্বে শুরু হলো স্বাক্ষরতা অভিযান। এই অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠল কবিতা। অন্ধকার আর আলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কবি ছাড়া এমন সেতুবন্ধন করার কথা আর কে ভাবতে পারে! জাতীয় সাক্ষরতা অভিযানের অঙ্গ হিসেবে গ্রামেগঞ্জে প্রায় ষাট হাজার তরুণ-তরুণী ও তিরিশ হাজারেরও বেশি বয়স্ক মানুষকে স্বাক্ষর করতে এই যে অভিনব উদ্যোগ, তার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠল কবিতা-কর্মশালা। এত বছরের স্বৈরতন্ত্রের নিচে চাপা পড়ে থাকা নিকারাগুয়া তার মুক্তির হদিশ পেল কবিতায়। এই উদ্যোগের দ্যুতি আজও ম্লান হয়নি।নিকারাগুয়ার শিশুরা এখনও তাদের দেশ এবং তার ইতিহাসকে চেনে কবিতার মাধ্যমে। পাঠদানের অঙ্গ হিসেবে দেশকে নিয়ে লেখা গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী কবিতাগুলি ক্লাসঘরের বেঞ্চে বসে দুলে দুলে আবৃত্তি করতে শেখা শিশু-কিশোরেরা এভাবেই ঢুকে পড়ে আবহমান একটি স্বপ্নের ভেতর ।
নিকারাগুয়ার কবিতার কথা বলতে গেলে যাঁর কথা প্রথমেই বলতে হয়, তিনি রুবেন দারিও (জন্ম ১৮ জানুয়ারি, ১৮৬৭, মৃত্যু ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬)। মধ্য আমেরিকায় স্প্যানিশ আমেরিকান সাহিত্য তথা “মর্ডানিসমো” র সূচনা হয় দারিওর হাত ধরে। রুবেন দারিওর কবিতা লাবণ্য, গাম্ভীর্য এবং সঙ্গীতময়তার এক আশ্চর্য চারুচিত্রায়ন।
১৮৮৬ সাল। উনিশ বছরের তরুণ দারিওকে তখন অস্থির করে তুলছে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। নিকারাগুয়া ছেড়ে দারিও বেরিয়ে পড়লেন অজানার সন্ধানে। এই অস্থিরতা, নতুনের জন্য এই উন্মাদনা সারা জীবন তাঁকে থিতু হতে দেয়নি সে ভাবে। অবশ্য চিলি ছিল এর ব্যতিক্রম, অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও ধরে রাখতে পেরেছিল তাঁকে। ১৮৮৮ সালে এই চিলি থেকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘আসুল’, ভাষান্তরে ‘নীল’। ছোট গল্প, বর্ণনামূলক চিত্রকলা এবং কবিতার এক আশ্চর্য সম্ভার, যা ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকা তথা স্প্যানিশ আমেরিকান সাহিত্যের স্থিতাবস্থায় একটি তীব্র ঘূর্ণনের সূচনা করেছিল। দারিও তখন সদ্য সদ্য পরিচিত হয়েছেন ফ্রান্সের পারনাসিয়ান কবিতার সঙ্গে। ফ্রান্সের কবিতাজগতে পারনাসিয়ান আন্দোলনের (১৮৬৬) সূচনা হয় রেনের হাত ধরে। এই আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে রোমান্টিক কবিতার আবেগধর্মীতা এবং অস্পষ্টতার বিরুদ্ধে নৈর্ব্যক্তিক নির্মেদ কবিতার একটি জেহাদ।’আসুল’ এর কবিতায় টলটল করছে তার ছায়া।
আর ‘আসুল’ এর গদ্য? দীর্ঘ ও জটিল বাক্য বিন্যাসের পুরনো আঁচল থেকে গাঁটছড়া খুলে নিয়ে দারিও ভাব জমালেন তন্বী ও সোজাসাপ্টা বাক্যদের সঙ্গে। ফ্রান্স এবং এশিয়ার পুরাণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ‘আসুল’ ঘোষণা করলো বিশ্বসাহিত্যে রুবেন দারিওর হিরণ্ময় আবির্ভাবের কথা। এর ঠিক দশ বছর পরে প্রকাশিত হল ‘অপবিত্র স্তোত্র এবং অন্যান্য কবিতা’। ‘আসুল’ এর অভিনব শৈলীর ছাপ আছে এখানেও। কিন্তু এই লেখা যেন অনেক বেশি প্রতীকী। ফরাসি সিম্বলিস্ট কবিদের ছায়া আছে এই কবিতায়। ততদিনে রুবেন দারিও হয়ে উঠেছেন তরুণ কবিদের নায়ক। আধুনিকতাবাদ আন্দোলন গড়ে উঠছে তাঁকে ঘিরে।
১০০ টির মতো গল্প লিখেছেন দারিও, কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন সাহিত্য সমালোচনা। তাঁর লেখার শৈল্পিক বৈভব তাঁকে স্প্যানিশ ভাষার সর্বকালের সেরা কবিদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে মান্যতা দিয়েছে। স্প্যানিশ ভাষার কবিদের মধ্যে তাঁর মতো করে ছন্দের নিরীক্ষা ও আবিষ্কার কজনই বা করেছেন! লাবণ্যে, সংগীতময়তায়, শব্দের লীলাখেলায় টইটুম্বুর কবিতা নিত্যনতুন ছান্দিক ছাঁচের মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন দারিও। তাঁর প্রথমদিককার কবিতায় ছিল উপাখ্যানধর্মীতা, পৌরাণিক চরিত্র রাজত্ব করত কবিতার ছত্রে ছত্রে, কাব্যময়তার মূর্ছনা বেজে উঠত পংক্তিতে পংক্তিতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশিষ্ট্য বদলে ফেললেন দারিও। তাঁর কবিতার গতিপথ বাঁক নিল দর্শন এবং সর্বশক্তিমান বিষাদের দিকে। সেই বদলের সূচনা হল ১৮৯৮ সালে, যখন ‘বুয়েনোস এইরেস লা নেশিঁও’ সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হিসাবে তাঁকে পাঠানো হল ইউরোপে।
স্প্যানিশ আমেরিকার স্বপ্ন ছত্রখান করে দিয়ে তখন ধসে পড়ছে স্পেনের সাম্রাজ্য। উত্তর আমেরিকার আধিপত্যের থাবা নেমে আসছে দক্ষিণ আমেরিকায়। এই বিপর্যয় ও অস্তিত্ব সংকটের ছায়া পড়ল দারিওর নতুন লেখায়। ১৯০৫ সালে সেই সব লেখা একত্রিত করে প্রকাশিত হলো ‘সংস অফ লাইফ এন্ড হোপ’ বা ‘জীবনগান ও আশাগীতি’। পরবর্তীকালে দারিওর এই গ্রন্থকেই পাঠক মাস্টারপিসের স্বীকৃতি দেবে।
‘জীবনগান ও আশাগীতি’ তার রঙের বিচ্ছুরণে, গ্রথিত ধ্বনির শিহরন আর অনন্য প্রকাশভঙ্গির দ্যুতিতে প্রমাণ করে দিল, দারিওর কবিতা জীবনের ক্লিন্নতাকে অস্বীকার না করেও ক্লিন্নতার ঊর্ধ্বে এক বিরল বর্ণচ্ছটা।
আমি
আমি সেই, যে গতকাল
নীল স্তোত্র আর অপবিত্র গান গেয়েছিল
যার নিশীথ-বুলবুল
সকালের আলোয় হয়ে উঠেছিল একটি লঘু চঞ্চল ভরতপাখি
আমার স্বপ্নোদ্যানের মালিক ছিলাম আমি
অজস্র গোলাপ, অলস রাজহাঁস
ঘুঘু পাখি, ঝিলে ঝিলে
ভেসে যাওয়া গন্ডোলা এবং বীণার রাজা ছিলাম
এই অষ্টাদশ শতাব্দীর ছিলাম , এবং প্রাচীন
আধুনিক ছিলাম, সাহসী
ও বিশ্বজনীন
শক্তিশালী হুগো ও রহস্যময় ভারলেন ছিলাম
এবং অসীম অনন্ত বিভ্রমের তৃষ্ণা
বেদনাকে আমি শিশুকাল থেকে জানি
তারুণ্য… সে তারুণ্য ছিল কি?
তার গোলাপের খুশবু এখনও আমার কাছে
বিষাদের গন্ধ রেখে যায়
আমার প্রবৃত্তির সূচনা হয়েছিল গতিরোধহীন অশ্বশাবকের মতো
তারুণ্য সওয়ার হয়েছিল উদ্দাম ঘোড়ায়
নেশাগ্রস্ত, কোমরে ঝুলন্ত ছোরা
তার যে পতন ঘটেনি, সেও ঈশ্বরের দয়া
আমার বাগানে একটি অপরূপ মূর্তি ছিল, পাথরের
শ্বেতপাথরের মনে হলেও আসলে সেটি ছিল রক্তমাংসের
তরুণ একটি আত্মা বাস করত তার মধ্যে
অভিমানী, অনুভূতিপ্রবণ, প্রতিক্রিয়াশীল
সে এতই লাজুক, যে পৃথিবীর মুখোমুখি হলে নৈঃশব্দের সিন্দুকে লুকিয়ে রাখত নিজেকে
শুধু বসন্ত এলে শুরু হত তার গানের সময়
সূর্যাস্তের মুহূর্তগুলি, সতর্ক চুম্বন
গোধূলি এবং ঘরে ফেরা
প্রেমগাথা আর বশীকরণের এক জাদু সময়
মাঝে মাঝে বলে ওঠা, “ভালো লাগে”, “এই!”, দীর্ঘশ্বাস
আর তারপর ডুলসাইনা বাঁশিতে সুর তোলা
রহস্যে মোড়া স্ফটিক শৈলশ্রেণী
গ্রিক মুদ্রা ঝালিয়ে নেওয়া নতুন করে
খুচরো ল্যাটিন সংগীত
এমনই তার ভাব, এমনই প্রাণবন্ত উদ্যম
আচমকা সেই মূর্তির শরীরে
তার পুরুষোচিত জঙ্ঘায় জেগে উঠত ছাগলের ক্ষুর
নরছাগের শৃঙ্গ জেগে উঠত তার কপালে
কবি এবং শান্ত সমুদ্রের দেবী গ্যালাটিয়ার মতোই
আমি মার্কুইসপত্নীকে ভালোবেসেছিলাম
স্বর্গীয় আবেগে ডুবে গেছিলাম
ইন্দ্রিয়সর্বস্ব অনুভূতিপ্রবণতায়
আমি তখন শুধু অভিলাষ, শুধু জ্বলে পুড়ে যাওয়া,
পবিত্র সংবেদন আর পুরুষত্ব
আর কোন মিথ্যা নেই, হাসাহাসি নেই, সাহিত্য নেই
নিষ্ঠাবান বলে যদি কেউ থেকে থাকে, সে কেবল আমি
শ্বেতপাথরের সেই মিনার আমার আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তুলল
নিজের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখতে চাইলাম আমি
নিজস্ব নরকের ছায়া থেকে মুক্তি চাইলাম
বিস্তৃতি চাইলাম, আরও স্বর্গ
লবণ যাকে সম্পৃক্ত করে তোলে
সমুদ্রের জলে টইটম্বুর হওয়া সেই স্পঞ্জের মতো
মিঠে এবং পেলব আমার হৃদয়
পৃথিবীর প্রতি, মাংস এবং নরকের প্রতি বিতৃষ্ণায়
তিক্ততায় পূর্ণ আমার হৃদয়
কিন্তু, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার বিবেকের
ঈশ্বর জানতেন, কীভাবে শ্রেষ্ঠত্ব বেছে নিতে হয়
এছাড়া যদি আর কোনও তিক্ততা আমার অস্তিত্বে থেকে থাকে
শিল্প সেই তীব্রতাকে কোমল করেছে
আমার মেধা আমাকে হিংস্রতা থেকে মুক্তি দিয়েছে
কাস্টালিয়ার জল আমাকে দিয়েছে শুদ্ধ স্নান
হৃদয়কে তীর্থ ভ্রমণ করিয়েছে
পবিত্র অরণ্য থেকে এনে দিয়েছে সম্প্রীতি
আহ! সেই পবিত্র অরণ্য! সেই পবিত্র অরণ্যের
স্বর্গীয় হৃদয়ের গভীর উদগম
সেই ফলবতী উৎস, যার গুণাবলী
বিধিকেও পার হয়ে যায়!
আদর্শ অরণ্য বাস্তবকে জটিল করে তোলে
যেখানে শরীর দাহ্য হয়, জীবন এবং আত্মা উড়তে থাকে
নিচে নীল পান করে ব্যভিচারে মগ্ন হয় সেই নরছাগ
ফিলোমেলা উড়ে যায় তার হাত থেকে
সবুজ গুল্মের স্ফুটন উন্মুখ গম্বুজের ভেতর দেখা যায়
স্বপ্নালু মুক্তো আর মোহময় সংগীত
গোলাপ ফুলে ফুটে ওঠে পুরাণকন্যা হিপসিপাইলের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য
আর তার বৃন্তে এসে দাঁত বসায় নরছাগ
ওই দ্যাখো, নারীর অনুসরণ করছেন তাপবিদ্ধ দেবতা
কর্দমাক্ত মাটি থেকে উঠে আসছে তার বাঁশি
শাশ্বত জীবন বীজ বুনে দিচ্ছে
ঐকতান মাটির উপরে উঠে আসছে ঠিক ঝর্ণার মতো
[জীবনগান ও আশাগীতি]
১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, অসুস্থ দারিও তখন দারিদ্র্যের উপান্তে দাঁড়িয়ে। সম্ভবত কিছুটা অর্থনৈতিক সাফল্যের আশাতেই উত্তর আমেরিকার শহরে শহরে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন দারিও। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না দেশে ফেরার অল্পদিনের মধ্যেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন কবি মাত্র ৪৯ বছর বয়সেই নিভে গেল এক হিরণ্ময় জীবনের আলো। মৃত্যুর ঢেউয়ের নিচে এক অনন্ত সুড়ঙ্গপথে হাঁটতে লাগলেন দারিও, জীবননদীর মাথার ওপর নক্ষত্রের মতো ঝলমল করতে লাগল তাঁর কবিতাসমূহ।
(ক্রমশ)
শ্যামশ্রী দি,ধন্যবাদ দারিওকে নতূন করে তুলে আনায়।
ধন্যবাদ 😊🙏
খুব সুন্দর অনুবাদ। দারিও সম্পর্কে জেনে ঋদ্ধ হলাম।