
উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন পর্ব-৬ কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন
৬
মুরলীর মাটির ঘর। আর দুয়ার বলতে যেটা রয়েছে সেটা আলকাতরা-লেপা হালকা কাঠের দুটো পাল্লা— তার নিচের অংশটুকু আবার হয় জলে ভিজে ভিজে পচে গিয়ে নয়তো উইপোকা লেগে খসে গিয়ে বড় একটা হাঁ হয়ে গেছে। সেই হাঁ -এর ভিতর দিয়ে অনায়াসেই কুকুর, বিড়াল, ছাগলছানা যাতায়াত করতে পারে। সেটিই বাড়ির সদর দুয়ার। তাতে শিকল তোলা ছিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুই পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হয়ে সেটা খুলে দিল মুরলী। ভিতরে ঢুকলাম।
সামনেই উঠোন— তকতকে, পরিষ্কার। তার একপাশে বেশ বড়সড় গোছের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। গাছের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে ঝরে পড়া ফুল। দুপুরের রোদের তাপে ফুলগুলি শুকিয়ে কালচে কালচে হয়ে উঠেছে।
উঠোন পেরিয়ে ঘর। একটাই ঘর, তাতে খড়ের ছাউনি। ঘরের সংলগ্ন মাটির দাওয়াটি বেশ চওড়া। পাশেই খুপরি মতো একটা চালা, সেখানে রাখা বাসনপত্র, শিল-নোড়া, কৌটো-কাটা দেখে সহজেই মালুম হয় সেটা মুরলীর রান্নাঘর।
উঠোনের থেকে দাওয়াটি বেশ উঁচু। খান তিনেক মাটির সিঁড়ি করা আছে উপরে ওঠার জন্যে। বিশুয়া তাড়াতাড়ি দাওয়ায় উঠে আমার জন্যে তালপাতার চাটাই পেতে দিল। নিজে বসল একটু দূরে মাটির উপর খুঁটিতে হেলান দিয়ে। মুরলী দেখি এলুমিনিয়ামের একটা ছোট থালায় খানকতক গুড়ের বাতাসা আর একঘটি জল এনে আমার হাতে দিয়ে, উৎসাহে উদ্দীপনায় মুখে খানিকটা আঁ আঁ শব্দ করে ইশারায় আমাকে সেগুলি খেয়ে নিতে বলল।
এ আতিথেয়তার ভিতর কোনও জৌলুস নেই, চাকচিক্য নেই—নিতান্তই সাধারণ, সাদামাটা। এর থেকে ঢের ঢের জমকালো ও মাত্রাছাড়া আয়োজনের নিমন্ত্রণ আমি পেয়েছি। গিয়েছি। কিন্তু সেসব জায়গায় গিয়ে আমার হৃদয় বোধহয় এতখানি আপ্লুত, এতখানি সিক্ত হয়নি যেমন আজকে হচ্ছে। কেননা খুব অল্প সময়ের পরিচয়ে একটা উটকো মানুষকে ঘর পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে নিজের যাবতীয় সাধ্যের ঊর্ধ্বে উঠে সৌজন্য দেখানোর মতো উদারতা ও একইসঙ্গে বোকামি শিক্ষিত শহুরে মানুষের নেই। সেখানে মানুষকে নানামুখী হিসেব রাখতে হয়। অথচ এই গ্রামীণ, দরিদ্র, অশিক্ষিত, মলিন পোশাক পরা সাঁওতাল দম্পতির খোড়ো মাটির ঘরে আমি এখন বসে রয়েছি আরামে, দ্বিধাহীনভাবে— বহু পরিচিত এক আত্মীয়ের মতো।
এই দুই মানুষের সহজ আন্তরিকতায় আমার ভিতরে এক অদ্ভুত অনুভূতির অনুরণন চলছে। মনে হচ্ছে এদের আমি অনেকদিন ধরে চিনি। এদের আমি সেই ছোটবেলায় আমার গ্রামে কয়লার আড়তের ধারে তেলু সাঁওতালের কুঁড়েঘরের পাশে ঘর বেঁধে থাকতে দেখেছি। জোয়ান বিশুয়া তখন ধান কাটতে যেত কোমরে কাস্তে ঝুলিয়ে আর সুগৃহিণী তরুণী মুরলী ঘরকন্নার কাজ সেরে ভর দুপুরে বাঁশবনের রাস্তার দিকে বড় বড় ভীরু চোখ তুলে তাকিয়ে থাকত, স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায়।
মুরলী চুপ মানুষ। বিশুয়া তার উলটো— সে কথার মানুষ। এটুকু সময়ে এটা আমি ঢের বুঝেছি। মানুষটার ভিতরে অনেক কথা আছে। তাছাড়া তার গল্পগাছার ঢঙে এমন একটা ছেলেমানুষী সারল্য আছে যে তা শুনতেও ভালো লাগে।
আমার জল খাওয়া হয়েছে দেখে সে চোখে মুখে অনেকটা উৎসাহ নিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘অ দিদিমুনি, তুমি কইলকাত্তায় থাকো বটে?’
আমি হেসে তাকে বললাম, ‘হ্যাঁ বিশুয়া। তুমি গেছো কখনও কলকাতায়?’
‘হ, কিন্তু আমি কইলকাত্তায় কিছুই দেখি লাই। পুলিশ কয়েদ কর্যা জেলে দিলি ত। অরাই কয়বার অদের গাড়ি কর্যা কইলকাত্তা নিয়্যা গেছিলি। খালি জেল চিনি। আর একখান বড় মোকা মতো বিজ দেখিলি। ওখান দিয়্যা কত্ত গাড়ি যায়।‘
আমি বুঝলাম বিশুয়া হাওড়া ব্রিজের কথা বলছে। কিন্তু সে জেলে গেছিল কেন? আগেও একবার সে একথা বলেছে বটে যখন মাঠে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার ভিতরে একটু ইতস্তত ভাবই কাজ করছিল— এ বিষয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে কিনা! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে নিজেই যখন একই কথা বারবার বলছে তখন আমার দ্বিধা রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। উলটে বরং তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে হয়তো খানিকটা কথা বলে বাঁচবে এবং তার কথায় কথায় আমাদের এই খোশ গল্প-পর্ব আরও খানিকটা এগোবে।
আমি কপালে জিজ্ঞাসার দু’তিনটে ভাঁজ ফেলে বললাম, ‘কেন? তোমায় পুলিশ জেলে নিয়ে গেছিল কেন? কী করেছিলে?’
‘শম্ভু রায়ের ছেইল্যেকে কাইস্তে দিয়্যা চোপ দিছিলি। কিন্তু জানো দিদিমুনি সে আমি দিতে চাই লাই। মাথায় রক্ত টগবগ করতেছিল ত। ঘরকে খাইতে পাতাম না। হাতে কুনো কাজ লাই। এক রাতকে রায়কত্তার ঘরকে গেলি চুরি করবক বলে। উর মরাইয়ে কত্ত ধান। শীত পড়ছে। আমি জানছি মনে মনে, সে রাতকে বড় জারাইব। চুরি হবেক ভালো। কিন্তু উ ছেইল্যে ত ঘুম থিক্যা উঠ্যা বড় ব্যাগড়া দিলি। খুন চাপ্যি গেল্যা মাথায়। দেল্যাম কাইসতে দিয়্যা হাতে ভুলুক কর্যা। উ মরে নাই বটে তবে হাতটা লষ্ট হয়্যা গ্যাচে। পুলিশ আমায় দুবচ্ছর হাজতে রাখিছিলি।‘ — কথাগুলো একটানে বলে বিশুয়া থামল।
কথার মাঝে মুরলী কখন আমার পাশ থেকে উঠে গেছে খেয়ালই করিনি।
বিশুয়া যা করেছে, সে তার অপরাধ, নিশ্চিত অপরাধ। তবু এই চৈত্র-দুপুরের ফটফটে উজ্জ্বল, তীব্র রোদের ছটায় মাটির দাওয়ায় বসে খাটো, ধুলোমাখা ধুতি পরা কালো মানুষটির সারল্য মেশানো মুখের দিকে তাকিয়ে আমার তাকে অপরাধী বলে মনে হল না। ভুখা পেটের জ্বালা মানুষকে দিয়ে কত কিছুই না করিয়ে নেয়!
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জেল থেকে ফিরে আর নিজের গ্রামে যাওনি?’
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘লা! আর গেলাম লাই। ই ইস্কুলের কত্তারা ভালো নোক বটে, ইখানে ধান চাষের কাজ দিলি। তাই করি। যত্ত চাল হয়, ইখানে সবাই খায় ত। তার উপ্রে জেল থিক্যা মুরলী বউ হয়্যা আসিছিলি আমার সাথে।‘
এ কথায় আমি বেশ খানিকটা অবাক হয়ে সাঁওতাল বুড়োর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, ‘মুরলীও জেলে ছিল নাকি?’
‘হ! আছিল ত! কিন্তু উ কুনো দোষ করে লাই দিদিমুনি। উকে আমি অ-নে-ক-বা-র শুধাইচি। উ কিছু করে লাই। উর দাদার মাইয়্যামানষে কোঁদল কর্র্যা শরীলে কেরাচিনি ঢেলে আগুন দিয়্যা মরছিলি। তাই ত উদের সবাইকে পুলিশ জেলে নিছিলি।‘
আমি বিশুয়ার কথা শুনছি। ও যেন এক গল্প বুড়ো। ওর জীবনের যত গল্প আছে, আজ দুপুরে ও আমাকে শুনিয়ে ফেলতে চায়। আমারও শুনতে বেশ লাগছে।
এবার আমি একটু মজা করে হাসতে হাসতে বললাম, ‘মুরলীকে জেলের ভিতরেই বিয়ে করে নিলে তুমি?’
‘হ্যাঁ ত! করলি। আমাদের একটু ভাবসাব হল দেখ্যা দারোগা সাহেব বললি— বিশুয়া, তু ব্যাটা বিয়্যা কর্, আমরা সব্বাইকে ভোজ দিব। ভোজ হল। ভাত, মাছ, মিঠাই— সব হল।‘
‘তাহলে তো জেলে গিয়ে তোমার ভালোই হয়েছে বিশুয়া! পাত্রী দেখা, বিয়ে, বিয়ের ভোজ—ঝক্কি সব সেখানেই চুকে গেল।‘— আমার এ কথা শুনে সাঁওতাল বুড়ো হো হো করে হেসে উঠল।
বিশুয়ার দিক থেকে চোখ চলে গেল উঠোনের দিকে। দেখি আপাদমস্তক ভিজে মুরলী কোথা থেকে ভিজে কাপড়চোপড় পরে এসে দাঁড়িয়েছে। আটপৌরে ঢঙে পরা কাপড়ের আঁচলটা কাঁধের পাশ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে তা থেকে জলটুকু সে জোরে নিংড়ে নিজের পায়ের উপরেই ফেলছে। তার লম্বা চুল থেকেও টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে উঠোনের মাটিতে। পুকুরে ডুবে দিয়ে এলো নাকি ও? একথা ভাবতেই হঠাৎ মাথায় খেলে গেল— আরে তাই তো! এখন তো স্নানের বেলা। ভাত খাওয়ার বেলা। সেই কখন এদিকপানে আমি এসেছি। কতক্ষণ হয়ে গেল! এখন ফিরে যেতে হবে।
না! আমার হাতে ঘড়ি নেই, মোবাইলও বন্ধ করে ঘরে রেখে এসেছি। সাঁওতাল বুড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বেলা নিশ্চয়ই অনেক হয়েছে বিশুয়া, না! এবার তো আমায় উঠতে হবে।‘
বিশুয়া পিছন ফিরে উঠোনের রোদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তা বেলা খানিক হল বটে। আড়াইটো তো হবেক দিদিমুনি। ঘরকে আমার ঘুড়ি তো লাই। একটা মোবালি আছিল, তা সে খারাপ বটে। তুমি দেখ্যা কিছু বুঝতে পারবেক লাই।‘
মোবাইলের ঘড়ি কি ঘড়ির কাঁটার টিক টিক চলন—কোনওটাই বিশুয়া আর মুরলীর জীবনে আবশ্যক নয়। সময় ওদের এমনিই নিজের ছন্দে একবেলা থেকে আর এক বেলায় নিয়ে যায়, পৌঁছে দেয় আজ থেকে কাল -এ। ওরা প্রকৃতির কাছ থেকে সময়ের খবর পায়। আমরা যত শিক্ষিত শহুরে খুব বেশি কেজো লোকের দল, আমদেরই বরং সময়ের খবর নিতে গিয়ে দৌড়তে হয় সময়ের সঙ্গে। আমরা যত বেশি সময়ের হিসেব কষে নিজেদের গুছিয়ে নিতে চাই, দেখি, ঘড়ির কাঁটা ততই আমাদের দৌড় করায়। প্রকৃতির পানে চোখ রেখে মুহূর্তকে উপলব্ধি করার অবকাশ বা অভ্যাস কোনওটাই আমাদের নেই। আমাদের সময় চাই, সময়ের ঘড়িটিও চাই।
এ কথা সে কথার মাঝখান দিয়ে বেলা ঢের গড়িয়েছে।
এবার এই গল্পের আসর ভেঙে আমায় উঠতে হবে।
বিকেল চারটেয় সেই টোটোদাদা চলে আসবে। আশেপাশে ঘুরতে যাওয়ার কথা। স্নান খাওয়া এখনও হয়নি। বাকি।
‘বিশুয়া, মুরলী, বেলা অনেক হল, এবার উঠতে হবে তো, আসি’— বলে দাওয়া থেকে তরতরিয়ে উঠোনে নেমে কৃষ্ণচূড়া গাছটিকে পাশ কাটিয়ে একটু জোরে হাঁটতে শুরু করি।
শুনতে পাই পিছন থেকে মুরলী উত্তেজনায় আঁ আঁ করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। না বুঝে শুধু হাত নেড়ে বলি, ‘পরে, আবার পরে…’
তারপর সদর দরজার ভাঙা চৌকাঠ পেরিয়ে আবার খোলা মাঠে এসে দাঁড়াই। রোদের চলন এখন একটু বদলেছে যেন!
কী একটা বুনো ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগে।
(ক্রমশ)