
শঙ্খদীপ মুসাফিরানার গল্প- অভিনয়ের অভিনয়
আমি সবসময় চেয়েছি লোকে আমাকে চিনবে, জানবে, মনে রাখবে! এই একটা স্বপ্ন একটা জিদ আমাকে আজ খ্যাতির এই চূড়ায় নিয়ে এসেছে। এই তেত্রিশ বছরের কেরিয়ারে আমার কাছে তিনটি জাতীয় পুরস্কার। আগের সপ্তাহেই শেষটির খবর এসেছে – সেটি হাতে পেতে এখনও সময় আছে। ওটাকে ধরলে চারটে। আমার খুশি হওয়ায় কথা। হয়ত আমি খুশি। এতই খুশি যে সেই প্রচন্ড আনন্দের অনুভূতিতে আমি পাথর হয়ে গেছি। আমার স্নায়ুগুলো উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বোধয় তুরীয় অবস্থায় চলে গেছে। আমি আয়নার সামনে যতই সেজে দাঁড়াই, নিজেকে আর দেখতে পাইনা ইদানীং। যাকে দেখি, তাকে আমি চিনি না। চিনতে চাইও না। আমি আর ক্যামেরা, লাইট, সাংবাদিকদের প্রশ্নের অবিরাম স্রোতের স্বপ্ন দেখিনা। ক্যামেরা দেখলে আমি এখন ভয় পাই। লুকিয়ে পড়তে চাই যেকোনোখানে, আড়ালে, অন্ধকারে। আমি জানি আপনারা ক্যামেরার সামনে আমাকে দেখলে সেসব বুঝতে পারেন না। আগে অভিনয় করায় দারুণ মানসিক কসরত লাগতো – এখনও লাগে, তবু এখন আমি এত সাবলীলভাবে আমার হোমওয়ার্ক করি, মনে হয় যেন আমি সবসময় জানতাম আমাকে কি করতে হবে। নতুনের কোনো উত্তেজনা আমার এখন আর আসেনা। সেই উত্তেজনাহীন মানসিক কসরতে আমি এতই সিদ্ধ হয়েছি যে ক্যামেরার সামনে লুকিয়ে ফেলতে পারি নিজেকে। অনায়াসে। অথচ আমার ভেতরে আমি ছুটতে থাকি পিছন দিকে – আলোর থেকে, মানুষের থেকে, ক্যামেরার কোলাহল থেকে বহু দূরে। আমার প্রথম ডিরেক্টর, স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক মলয় গুপ্ত, আমাকে বলছিলেন, প্রথমা, এমন ভালো অভিনেতা হতে হবে যাতে ক্যামেরার সামনে নিজের ভিতরটাকে লুকিয়ে ফেলতে পারিস। নয়ত শেষ হয়ে যাবি। মলয় দা এখন নেই। আগের বছর আগস্ট মাসে মলয় দা’র বাৎসরিক হয়ে গেলো। মলয় দা’র কথা আমি সেদিন বুঝিনি, এতদিন যখন আস্তে আস্তে এই খ্যাতির চূড়ায় উঠেছি, তখনও বুঝিনি, তবে ইদানীং যেন বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি আমি অজান্তেই নিজেকে ক্যামেরার সামনে লুকিয়ে ফেলার মুন্সিয়ানা রপ্ত করে ফেলেছি।
মলয় দা’কে আমি ভালোবেসেছিলাম। তখন আমি বয়েস উনিশের কিশোরী। আর মলয় দা মধ্য চল্লিশে। কালোফ্রেম চশমা কাঁচাপাকা চুল দাড়ি সব মিলিয়ে তিনি আমার কাছে যেন আমার বড় অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্নের মতই শ্রেষ্ঠলভ্য। তার প্রতিকটা কথা আমার কাছে যেন ছিল বেদবাক্য। ‘আকাশকুসুম’-র শ্যুটিং-র শেষ দিনে আমি গিয়ে মলয় দা’কে প্রণাম করলাম, উনি পাশে বসা এক ভদ্রলোককে আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই যে ছবির হিরোইন! পরে জেনেছিলাম সেই ভদ্রলোক চিত্রপরিচালক বিনয় মুখোপাধ্যায়। তিনি আমাকে তার ছবিতে নেবেন বলে কথা বলতে এসেছেন। নিয়েওছিলেন। এবং তার হাত ধরেই আমি আমার কেরিয়ারের দ্বিতীয় ছবিতেই প্রথম জাতীয় পুরস্কারটি পেয়েছিলাম। কথা হওয়ার পর মলয় দা বলেছিলেন, বিনয়বাবু, ওকে আপনার হাতে আমি দিচ্ছি, ও কিন্তু আমার মেয়ের মত। আপনাকে কথা দিতে হবে আপনি ওকে বেশি বকাঝকা করবেন না। আপনার তো সেদিকে একটু সুনাম আছে। বিনয়বাবু তাঁর নামের মাহাত্ম্য বজায় রাখার জন্যেই সেদিন গদগদভাবে বলেছিলেন, না না, আমি এখন আর বেশি বকাবকি করি না। কিন্তু তিনি কি করেন না করেন, সে তার সাথে কাজ করতে গিয়েই বুঝেছিলাম। ছবির শ্যুটিং শেষ হল, আমি ওনাকে প্রণাম করে বলে এসেছিলাম, আপনার সাথে এই আমার প্রথম ও শেষ কাজ। তিনি হেসেছিলেন কিন্তু আমাকে আর কোনোদিনও ডাকেননি। তিনি হয়ত বুঝেছিলেন, আমি মোটেই হাসিচ্ছলে কথাটি বলিনি। যাই হোক, মলয় দা’র ব্যাপারে যা বলছিলাম, মলয় দা’র কথাকে আমি এতই বেদবাক্য মানতাম যে সেদিন তার আমাকে কন্যাসমা দেখার অভিপ্রায়কেও নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। সময় লেগেছিল, কিন্তু মনকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে একসময় সত্যিই তাকে আমার পিতৃস্থানীয়ই মনে হতে শুরু করেছিল। মলয় দা যখন রোগশয্যায় শায়িত, শীর্ণকায়, একমুখ দাড়ি – খানিকটা দেখতে আমার বাবার মতই লেগেছিল। তখন আমার বাবাও অসুস্থ ছিলেন। দুজনের মধ্যে খুব একটা কিছু পার্থক্য খুঁজে পাইনি। আমার হাত ধরে শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন মলয় দা। বলেছিলেন, আমার জীবনে ক’টা ভালো ছবি করেছি আমি জানি না, কিন্তু আমি যে তোকে নিয়েছিলাম আমার ছবিতে, এই আমার সারাজীবনের পাওনা। তুই তিনটে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিস বলে শুধু না, এই এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে, আমার আজীবনের সঞ্চয় শুধু তুই। বৌদিও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তুমি ছাড়া ও পাড়ার আর কেউ আসেনা দেখা করতে।
মলয় দা যেদিন চলে গেলো সেদিন যেন ইন্ডাস্ট্রি ভেঙে পড়েছে ওর বাড়িতে। কতজনের চোখে জল। কতজন সারা টিভি জুড়ে বাইট দিল তাঁকে নিয়ে। আমি মলয় দা’কে বলে এলাম, কি করতে এই প্রফেশনে আসার স্বপ্ন দেখেছিলাম মলয় দা!
মলয় দা থাকলে কি বলত আমি হলফ করে বলতে পারিনা। হয়ত বলত, যেদিন এসেছিলি সেদিন কি এদের কাউকে দেখে এসেছিলি? সেদিন তো নিজেকে ছাড়া কাউকে দেখিসনি সেই স্বপ্নে। তাহলে আজ এদের দেখে হতাশ হচ্ছিস কেন!
মলয় দা’কে আমি বলতে পারিনি কোনোদিন, বেঁচে থাকলেও কোনোদিন পারতাম না হয়ত, আমি এদেরকে দেখে হতাশ নই। আমি এদের মধ্যে নিজেকে দেখে হতাশ। আমি নিজের মধ্যে এদেরকে দেখে হতাশ। আমি শুধু মলয় দা’কে মৃত্যুশয্যায় দেখতে যেতাম বলে, নয়ত আমার সাথে এই এদের কারোরই কোনো তফাৎ নেই। আমি সেদিন তাদের মত মিথ্যা চোখের জল দেখাইনি ঠিকই কিন্তু আমি তো আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অনেকের মৃত্যুতে গিয়েই এই ন্যাকাকান্নার নাটক করে এসেছি। হয়ত আবারও করব। করতে হয় যে। এটাও যে পি-আর!
আমার বাবা মা দুজনেই ছিলেন নাট্যকর্মী। থিয়েটারের লোক। গণনাট্য আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। অভিনয় আমার রক্তে। আর অভিনয়ের বোধটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল বাবা মায়ের সচেতন অনাদর আর সক্রিয় পাঠদানে। অনাদর মানে আমাকে ভালোবাসা দেননি তা নয়, কিন্তু কোনোদিন এভাব আমার মনে উঠতে দেননি, আমি এই কাজ করলে আমার বাবা মা কি ভাববেন! একজন শিল্পীর পক্ষে, আর শুধু শিল্পী কেন, স্বাধীনতাকামী যে কোনো মানুষের পক্ষে বাবা-মায়ের এই সচেতন অনাদর বা সচেতনভাবে আদরের অপ্রকাশ যে কি ভীষণ মুক্তিদায়ী, আর কেউ না বুঝুক হয়ত বাঙালি পরিবারের ছেলে মেয়েরা বুঝবে। তারা কতকিছু করতে চেয়ে শুধু বাবা-মা কি ভাব্বে, বা আমার বাবা-মা’কে লোকে কি ভাব্বে ভেবে যে সাহস দেখাতে পারে না, তার ইতিহাস যদি কখনও লেখা হত!
মায়ের সাথে আমার ঝগড়া হল শেষ বয়েসে। সে ঝগড়া পারিবারিক নয়, রাজনৈতিক। আমি রাজনীতি যে বুঝিনা তা বলব না। তবু আমার মা বাবা এবং তাদের মত প্রচুর গণনাট্য কর্মীর প্রতি তাদের দলের অবজ্ঞা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে বারংবার যে রাজনীতিতে সবাই অকৃতজ্ঞ। তাই আমি চিরকাল দূরত্ব রেখেই চলেছি কোনো পার্টিগত সংস্রব থেকে। তবু কেন যে দিদির ডাকে সারা দিয়ে ওদের হয়ে ভোট প্রচারে গেলাম! টাকাও পায়নি কিন্তু সেরকম একটা। শুধু সৌজন্য রক্ষা করতেই গেছিলাম। দিদি এত আপনার করে ডাকল।
এরপর বাড়িতে যেতে মা আমাকে মা সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ওদের ভোটের প্রচারে কেন গেছিলে! প্রথমটা আমি ওনার সিরিয়াসনেসটা বুঝতে পারিনি কারণ আমার বাবা মা কোনোদিনও আমার কোনো কাজের জবাবদিহি চাননি। যখন বুঝলাম প্রশ্নটা সিরিয়াস, এবং আমার মা বিরক্ত, আমিও তখন সিরিয়াস হয়েই বললাম, দিদি ডাকলো!
রাজনীতিটা কি ফুর্তি করার জায়গা নাকি যে দিদি ডাকল ওমনি চলে গেলে! টাকা পেয়েছ?
কিছু!
কিছু? আমার মায়ের ভারী ব্যক্তিত্বময়ী গলায় সেই মেয়েলী “কিছু!”র শ্লেষ আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়।
কেন কি হয়েছে গেলে!
একটা দল, আপাতমস্তক চোর… দুর্নীতিতে ডুবে, আর সেই দলের হয়ে তুমি প্রচারে গেলে! এই প্রতিদান দিলে তুমি আমাদের শিক্ষার!
আমারও সাময়িক মাথা গরম হয়ে গেছিল। বলে ফেললাম, তোমার দল তোমাকে কি দিয়েছে যে তুমি এখন আমার ওদের হয়ে প্রচারে যাওয়া নিয়ে কথা বলছ? তোমাদের দল তো তোমাদের পুছেও দেখে না…
মা কিছুক্ষণ থতমত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যখন কথা বললেন তখন তিনি হাসপাতালে। চার পাঁচদিন পর তাকে আমি বাড়ি নিয়ে আসবো। বাড়ি আসার তেরোদিন পর তিনি মারা যাবেন। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে বললেন, দল আমাদের কি দেবে এই ভেবে আমরা রাজনীতি করতে যাইনি। আমি দলকে কি দিতে পারি, মানুষকে কি দিতে পারি, সমাজকে কি দিতে পারি, সেই দেখে… ভেবেই রাজনীতিতে গেছিলাম! আমার কাজ আমি করেছি। দলের কাজ দল করেছে।
আমি বললাম, বুঝেছি মা। তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না।
মা বাড়ি ফিরে তবু একদিন বললেন, পম্মা, রাজনীতিটা খুব সিরিয়াস একটা জায়গা। সেটাকে এইভাবে খেলো করে দিও না। অন্তত আমাদের সন্তান হয়ে তুমি এটা কোরো না। আমাদের দেখে হয়ত তোমার আমাদের দলের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে থাকতে পারে, স্বাভাবিক আসা, তবে এটা জানবে, বামপন্থা একটা আদর্শ। দল প্রয়োজন। তার থেকেও বেশি প্রয়োজন আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা। পারসোনাল ইজ পলিটিক্যাল, বাট্ পলিটিক্স ইজ নট্ ফর পারসোনাল!
এই পুরো বিতর্কে আমার বাবা ছিলেন মূক দ্রষ্টা। তিনি আমি প্রচারে যাওয়ার পরও কিছু বলেননি। মায়ের সাথে ঝগড়ায় মায়ের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরও কিছু বলেননি। মা চলে যাওয়ার পরও কিছু বলেননি। একদিন আমিই বললাম, বাবা, তোমার কি মনে হয় আমি মা’কে মেরে ফেললাম?
বাবা বললেন, সকলেরই মৃত্যুর বাহ্যিক একটা উপলক্ষ্য দরকার হয়। এসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিও না… মরতে তো হতই একদিন!
বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সেদিন আমার মনে আরো দৃঢ়ভাবে এই ধারণা গেঁথে দিলেন, আমিই আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
মা চলে যাওয়ার পর বাবাও চুপ করে গেলেন কেমন। বাবা বরাবরই মিতভাষী। তবু, আমি মাঝেসাঝে আসলে ভালোই কথা বলতেন। কাজের কথাই জিজ্ঞেস করতেন বেশিরভাগ সময়। তবু করতেন। মা চলে যাওয়ার পর তা করাও ছেড়ে দিলেন। আমি যেদিন যেতাম, আমার কাজ ছিল বাবার আর আমার জন্য দু’কাপ চা করা। বসে খাওয়া। জিজ্ঞাসা করা, সব ওষুধ ঠিক মত উনি খাচ্ছেন কিনা। কবে ডাক্তারখানায় যেতে হবে চেকাপের জন্য, যেন রেডি হয়ে থাকেন। জিতেন দা, যিনি আমাদের বাড়িতে থাকেন ও বাড়ির কাজকর্ম ও বাবার দেখাশোনা করেন, ঠিক মত রান্না করছে কিনা। কিছু কি খেতে ইচ্ছা করছে? বানিয়ে আনবো! এত কথায় বাবার উত্তর বাঁধাধরা ঃ হ্যাঁ, না, আচ্ছা, দেখবো, ঠিকাছে, আছে তো এখন! বুঝতে পারছিলাম বাবা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন আস্তে আস্তে।
সেই অভিমানী বাবাকে নিজের জীবনের কথা, আমার বিবাহিত জীবনের ভয়ংকর অসুখের কথা জানাতে আমার ভয় করেছিল। বলা ভালো লজ্জা করেছিল। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্তে ব্যতিব্যস্ত করে মা’কে হারিয়েছি, বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করতে আমার কুন্ঠাবোধ হয়েছিল। বাবা আরো কথা বলতেন না বলেই, আমার মনে হয়েছিল বাবাকে সহজেই বলা যাবে আমার আর কুনালের প্রাত্যহিক অশান্তির কথা, ওর আমার ওপর শারীরিক মানসিক নির্যাতনের কথা, ওর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা। তবু বাবা যতদিন সজ্ঞানে ছিলেন, কথা বলার অবস্থায় ছিলেন, আমি বাবাকে এসব কিছুই বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম, বাবা যদি ভাবেন তাদের মেয়ে তাদের রাজনীতি নেয়নি নেয়নি, এখন নিজের জীবনের সাথেও কম্প্রোমাইজ করছে, ন্যূনতম মূলবোধ তার মেয়ের নেই, এত ভীতু সে! নয়ত কিসের লোভে এখনও সে কুনালের মত একজনের সাথে এক ছাদের তলায় থাকতে পারছে! মায়ের চোখে আমি আগেই ছোটো হয়ে গেছিলাম। না, মা কখনও নিজে মুখে কিছু বলেননি আমায়। হাবভাবেও বোঝাননি। তবু হাসপাতালে বা হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসবার পরও মাঝে মাঝেই যেভাবে রাজনীতির কথা বলতেন, আমার মনে হত যেন মা কিছুতেই আমার এই রাজনৈতিক বালখিল্যতা মেনে নিতে পারেননি। বাবার চোখেও হয়ত আমি একই সাথে ছোটো হয়েছিলাম। তবু তিনি বুঝতে দেননি কোনোদিন। হাবেভাবেও না। কথাতেও না। কিন্তু আমার কষ্টের কথা শুনলে তিনি ঠিক থাকতে পারতেন না আমি জানি। আমি শেষ জীবনে তাকে কোনো উত্তেজনা দিতে চায়নি। ভেবেছিলাম আমি আগে সিদ্ধান্ত নি কোনো, তারপর জানাবো। তবু আমি বাবাকে জানিয়েছিলাম। কারণ বাবার এই অবস্থা, বাড়িতে এই অশান্তি, কাজের চাপ – সব মিলিয়ে আমি আর পেরে উঠছিলাম না। বাবা তখন স্ট্রোকের পর সম্পূর্ণ বিছানায়। বাঁদিকটা পড়ে গেছে! মাঝেসাঝে চিনতেও পারেননা আমায়। যখন যখন চিনতে পারেন, চোখটা চকচক করে ওঠে। আমি বাবার হাত ধরে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা! এই একটা হাত যেন তখন আমার কাছে মায়ের আঁচল, বাবার পিঠ, স্বামীর বুক! বাবা আমাকে চিনতে পারছে না ভেবে একদিন আমি ওনার কাছে সব কিছু বললাম। জানি বাবা আমাকে চিনতে পারছেন না, তবু কি এক লজ্জায় আমি বাবার মুখের দিকে, ঐ সিলিং-র দিকে খোলা অবাক চোখ দুটোর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমি যখন বলছি, বাবা ও আমায় মারেও! মনে হল বাবার হাতটা একটু যেন নড়ে উঠল। আমি অন্য কিছুর আশঙ্কা করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি বাবার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আমি কথা থামিয়ে, মুখের কাছে উঠে গিয়ে ডাকলাম, বাবা, কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? কিন্তু বাবার চোখ দেখে বুঝলাম, বাবা আমাকে চিনতে পারছেন। বাবা সজ্ঞানে সব শুনেছেন বলে আমার কান্না পেলো খুব। বাবার বুকের ওপর কাঁদছি, দেখি বাবা ডান হাতটা উঠাতে চাইছে। আমি ওনার হাতটাকে আলতো করে ধরলাম। ভাবলাম হাতের মুভমেন্ট বুঝে শুধু সাহায্য করব উনি কি করতে চাইছেন দেখার জন্য। দেখলাম উনি আমার মাথায় হাত রাখতে চাইছেন। যদিও বোঝার উপায় ছিল না। তবু হাতের কসরত দেখে ওনার হাতটা আমার মাথায় রাখাতে দেখলাম ওনার কসরত থেমে গেছে। বুঝলাম বাবা আমার মাথায় হাত রাখতেই চাইছিলেন। গোঁ গোঁ শব্দ শুনে আবার তাকালাম বাবার মুখের দিকে। ডানদিকের কষ থেকে লোল পড়ছে, কিছু বলতে চাইছিলেন। আমি আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে কষটা মুছিয়ে দিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম বার বার, কিছু বলবে? গোঁ গোঁ ছাড়া কিছু বেরোলো না। কেন জানি না, আমার মন সেই গোঙানির অর্থ পড়ল, ডোন্ট কম্প্রোমাইজ! ডোন্ট কম্প্রোমাইজ!
আমার কুনালকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরী হল কেন – এ’কথা এখন ভাবতে বসলে আমি নিজেই উত্তর খুঁজে পাইনা। তবু এত অপমান সহ্য করব, এত মার খাবো বলেই হয়ত থেকে গেছিলাম ওর বাড়িতে। কুনাল আমার সেই কোন ছোটোবেলার প্রেম। মলয় দা’র পর ওই আমার প্রথম ও শেষ প্রেম। তখন ও পাঞ্জাবি পরে কলেজে আসতো। কবিতা লিখত। ছবি দেখে বেড়াতো বিভিন্ন সিনে ক্লাবে, আর এসে রসিয়ে রসিয়ে সেই গল্প আমাদের শোনাতো। গানের গলাও ছিল বেশ। যে সিনেমা খুব ভালো লাগত, সেই ছবির কথা বলতে বলতে হাত কচলিয়ে কচলিয়ে বলত, কবে যে এরকম একটা ছবি বানাবো! আমরা সবাই বলতাম, বানাবি, নিশ্চই বানাবি। ও যখন সিগারেট খেত, ওর সুস্পষ্ট চোয়াল আর উন্নত ঠোঁট মিলে একটা দারুন আকৃতি তৈরি করত। আমি পাগল হয়ে দেখতাম। আমি কতদিন যে সেই স্বল্প দাড়িঘন চোয়ালকে মানসচক্ষে আমার শরীরে, আমার বুকে নেমে আসতে দেখেছি। দেখতাম মানসচক্ষে, তবু গায়ে কাঁটা দিত। সবার কাছে খালি শুনতাম, ও তোকে পছন্দ করে। ও জীবনে কখনও বলেনি নিজে মুখে। আমিই লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন বললাম, শোনো, তোমাকে আমার পছন্দ! ও সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিল। বলল, আমারও তোমাকে বেশ লাগে। তখন আমাদের কোনোকিছুকে খুব ভালো লাগলে ‘বেশ লাগল’ বলার রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে। এই নিস্পৃহ নৈর্ব্যক্তিকতার মধ্যে যে শৈল্পিক অভিঘাত আছে, তখন আমরা তাকে যাপন করতাম। যাই হোক, ও ওই কথা বলার পর আর কথা বাড়ায় না দেখে, আমিই আগবাড়িয়ে বললাম, চলো তাহলে প্রেম করি। সেই আমাদের সম্পর্কের শুরু। আমার প্রতি কথায় সেদিনকার সেই ঘন কালো চোখে লজ্জা নেমে আসা ছেলেটার মধ্যে এমন একটা দানব কিভাবে লুকিয়ে ছিল কে জানে? তবে কি আমি এর জন্যেও দায়ী? নাকি সময় সবাইকে সবে রূপান্তরিত করে দিতে পারে?
আমাদের বাড়িতে আমার বন্ধুবান্ধবদের যাতায়াত লেগেই থাকত। আমার অনেক বন্ধুই বাবার দলে থিয়েটারও করেছে। আমিও করেছি সময়ে সময়ে। কুনাল আমাদের মধ্যে সবথেকে অবিছিন্নভাবে বাবার সাথে কাজ করেছে। তারপর নিজের দল খুলেছিল, যদিও সেটা টেকেনি বেশিদিন। তারপর পলাশ দা’কে অ্যাসিস্ট করল কিছুদিন। আমাদের ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে, আমি আমার দ্বিতীয় জাতীয় পুরস্কারটাও পেয়ে গেছি। আমাকে কুনাল প্রায়ই বলত, আমাকে তোমাকে ম্যাচ করতে হবে! নয়ত লোকে কি বলবে! এত ট্যালেন্টেড বৌয়ের এত নিষ্কর্মা স্বামী!
আমি তখন হাসতাম। মনে হত না তা নয় যে ও হয়ত মাঝমাঝে আমাকে নিয়ে ইন্সিকিউরিটিতে ভোগে। তবে ওর সেই দাড়িঘেরা চোয়াল আর উন্নত ঠোঁটের স্মৃতি, হাসির সময় ওর চোখের সেই অনিমেষ নির্মলতা আমাকে কোনোদিন ভাবায়নি যে এই ইন্সিকিউরিটি জমতে জমতে একদিন একটা মানুষকে, যে শুধু ভালোবাসতে জানতো, ঘৃণায়, পাশবিকতায় পরিপূর্ণ করে দেবে।
যখন আমরা প্রেম করছি, আমাদের এক বন্ধুর গল্প ছাপা হল তখনকার এক বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা সাহিত্য-সংবাদে। ও এসে বলল, ওর গল্পটা পড়েছিস? কি দারুণ লিখেছে! আমরা যারা যারা পড়েছিলাম, জানালাম আমাদের মত। পরেরদিন আমাকে একা পেয়ে ওর ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা খাতা বার করে বলল, পড় তো এটা! কেমন হয়েছে বলো! দেখলাম একটা গল্প! সুন্দর গল্প। তবে তা যেন তখনও সম্পূর্ণ প্রস্ফূটিত হয়নি। আমি পড়ে বললাম, ভাল হয়েছে। কারণ ভালো লেখা কে ভালো ছাড়া কিই বা বলা যায়? তবু, তা ‘দারুণ’ হতে বাকি! আমার ভালো শুনে বলল, পাঠাবো সাহিত্য-সংবাদে? ছাপবে? কি মনে হয়! আমি ওকে নিরাশ করতে চাইনি। তাও বললাম, কিছুদিন ফেলে রাখো লেখাটা। এক দু’মাস যাক, তারপর একবার পড়ে দেখো, যদি কিছু বদল করতে হয় কোরো, আর তখন যদি মনে হয় সব ঠিক আছে পাঠিয়ে দিও! ও মুখে কিছু বলল না, কিন্তু গল্পটা পাঠিয়ে দিয়েছিল সাহিত্য-সংবাদে। ছাপা হলনা। এরই মাঝে, বাবার একটা নাটকের জন্য একটা গান প্রয়োজন। বাবা বললেন, একটা নতুন গান চাই। কে লিখবে? কুনাল বলল ও চেষ্টা করতে চায়। বাবা জানত ওর গানের গলা আছে, লেখেও খারাপ না। দীনেশ দা আমাদের গ্রুপের মিউজিক দেখতো। খুব মুখচোরা, বাবা জানতো। তাই বাবা তাগাদা দিয়ে বলল, কি দীনেশ তুইও চেষ্টা করবি নাকি? দীনেশ দা বলল, ঠিকাছে স্যার। এমন ভাব যেন ওকে অর্ডার করা হচ্ছে।
দু’তিনদিন পর কুনাল আমাদের একটা গান শোনালো। সত্যি বলছি, এটা লেখাটার মত না। গানটা বেশ ভালো বানিয়েছিল। আমাদের সবার পছন্দ হয়েছিল। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, বাবার গানটা পছন্দ হলে, ওর লেখা মনোনীত না হওয়ার কষ্টটা কমবে। আমরা সেদিন বাড়ি ফিরলাম। আমি সদর্পে ঘোষণা করলাম, বাবা তোমার গান রেডি!
বাবা হেসে বললেন, এরা তো খুব চটপট কাজ করেরে! দীনেশও গান শুনিয়ে গেলো একটু আগে। দেখি কুনাল তুমি শুনাও দেখি!
কুনাল সপ্রতিভ মুখ করে গীটার ধরল। বাবা চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে শুনলেন। কিন্তু আমি সেই মগ্নতাতেও বুঝতে পারছিলাম, বাবার গানটা মনে ধরছে না। গান শেষ হতে বাবা বললেন, দারুণ! কিন্তু আমাদের নাটকের সাথে এই গানটা যাবে না। তবে এই গানটা রেখে দাও, পরে কাজে আসবে!
আমি অনুযোগ করে বললাম, দীনেশ দা কি এমন গান লিখেছে যে তোমার এটা পছন্দ হচ্ছে না?
ও আসবে একটু পরে, শুনিস।
দীনেশ দা এসে আমাদের গান শোনালো। সত্যি বলতে, বাবাই ঠিক। নাটকের যে আবহ, সেখানে দীনেশ দা’র গানটাই বেশি মানায়। সবাই এক বাক্যে বললও তা। আমি শুধু মিথ্যা বললাম যে আমার কুনালের গানটাই পছন্দ! কুনাল আমাকে পরে বলেছিল, সবার সামনে মিথ্যা কথা না বললেই পারতে। তোমার আমার গানটা পছন্দ না’ই হতে পারে, মিথ্যা আশায় আমায় ভুলিও না!
কি বলছ তুমি? মিথ্যা আশায় ভোলাবো কেন? আমার সত্যিই তোমার গান ভালো লেগেছে।
আমি তোমার আর স্যারের মধ্যে ইশারায় কথা দেখেছি প্রথমা! আমাকে ভুলাবার দরকার নেই।
সত্যিই দীনেশ দা যখন গান গাইছিল তখন বাবা আমাকে ভ্রু’র ইশারায় জানতে চাইল, কি মনে হচ্ছে। আমিও চোখের ইশারায় বলেছিলাম যে দীনেশ দা’র গানটাই বেটার। সেটা কুনাল লক্ষ্য করেছিল। আমি তবু কুনালকে সেদিন, প্রথমবার, নিজে থেকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, আমি তোমার সকল কাজে তোমার পাশে থাকতে চাই! ওর রাগ পড়ে গেছিল। বাবাও সেদিন বুঝেছিল আমি কুনালকে ভালোবাসি।
কুনালের ইতিহাস যে আমার সাফল্যের ইতিহাসের সমান্তরালে এক ব্যর্থতার গল্প, তা কিন্তু না। ও লেখালিখির জগতে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারুক, ও কিন্তু চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। শুধু প্রতিষ্ঠা না, ওর বহুদিনের স্বপ্ন জাতীয় পুরস্কার পাবে, তা’ও পূরণ হয়েছে। গান লিখে। এমনিতে ছবি বানানো অনেকদিনই শুরু করেছে। চার পাঁচটি ছবি হয়েও গেলো। সেগুলো ভালো ছবি, উচ্চমানের নয়। অন্তত ও যেরকম ছবি বানাতে চাইত, সেরকম ছবি ও বানাইনি এখনো পর্যন্ত।
ওর ব্যবহারে বদল আসতে দেখেছিলাম ওর জাতীয় পুরস্কারটা পাওয়ার পরে। তার আগে ওর সাথে আমার একটা ঝামেলা যদিও হয়েছিল। কাজ নিয়েই। ওর প্রথম ছবিতে ও আমাকে নিতে চেয়েছিল। আমারও ইচ্ছা ছিল ওর প্রথম ছবিতে থাকার। কিন্তু, আমার আগে থেকে অন্য একটি কাজে কথা দেওয়া ছিল। পেমেন্ট নেওয়া হয়ে গেছিল অনেকটাই। এদিকে কুনাল যে এত তাড়াতাড়ি প্রোডিউসার পেয়ে যাবে, তা ও বা আমি কেউই ভাবতে পারিনি। আর ওর প্রোডিউসারের কিসের তাড়া ছিল আমি জানি না, ফলে আমার সাথে ডেট ম্যাচ করল না। আমারও ওর প্রথম ছবিতে অভিনয় করা হল না। আমি জানি না কেউ ওর কান ভাঙিয়েছিল কিনা, তারপর থেকেই ওর চরিত্রে একটা বদল লক্ষ্য করেছিলাম। রুক্ষ মেজাজ, কথাবার্তায় আগের পেলবতা নেই। এক ছাদের তলায় থাকার জন্যেই যেন থাকা। ভেবেছিলাম কাজের প্রেসার। আগে ডিরেক্টরদের অ্যাসিস্ট করেছে, এবার পুরো ছবিটা তার ঘাড়েই, তাই হয়ত পুরো ব্যাপারটায় ওর মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। কাজের অজুহাতে তখন দিনের পর দিন ও পড়ে থাকত রাতুলদের বাড়িতে। অন্তত বলত তাই। রাতুল ওর প্রিয় বন্ধু, ওর ছবির ডিওপি। মুখে চিনতাম, খুব একটা চেনাজানা ছিল না।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটা ছোটো। তাই কথা চাপা থাকেনা খুব একটা। একদিন আমার মেকাপ আর্টিস্ট মহুয়া দি আমাকে বলল, প্রথমা একটা কথা শুনলাম! মহুয়া দি আর আমি প্রায় একই সময় কাজ শুরু করেছিলাম, ও আমার থেকে একটু সিনিয়র। ‘আকাশকুসুম’-র সেটেই আলাপ। আমি মহুয়া দি’র কথা শুনে বললাম, কি হয়েছেরে মহুয়া দি?
শুনলাম কুনালের সাথে নাকি প্রিয়াঙ্কার চক্কর চলছে…
চক্কর চলছে মানে?
মানে, বুঝিসই তো… ভেঙে আর কি বলবো তোকে!
প্রিয়াঙ্কাটা কে?
ওর ছবির যে হিরোইন!
ও আচ্ছা! আমার জানা নেইরে!
সেদিন আমি ভীষণ নিঃস্পৃহতার ভান করেছিলাম মহুয়া দি’র কাছে। আমার আসলে জানা ছিল না এই ধরণের খবরে কিভাবে রিয়্যাক্ট করতে হয়। আমি যে আগে ইন্ডাস্ট্রির কারোর ব্যাপারে কেচ্ছা শুনিনি তা কিন্তু না। শুনেছি। পিএনপিসি করেছি। কিন্তু আজ নিজের স্বামীর নামে শুনে কি বলব, কিভাবে বলব, কিছুই যেন খুঁজে পেলাম না।
কুনালের প্রথম ছবিটা চলল মোটামুটি। ভালোই পাব্লিসিটি করেছিল। সব জায়গায় ইন্টারভিউতে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, প্রথম ছবি বানালেন, আপনার স্ত্রী দু’বারের জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী, ওনাকে নেওয়ার কথা মনে হয়নি?
ও কিন্তু একবারও বলেনি যে আমার সাথে ওদের ডেট ম্যাচ করছিল না তাই আমি ছবিটা করতে পারিনি। ও সব জায়গায় বলেছে, আমি খুব প্রফেশানাল। ও ভালো ছবি বানায় কিনা আগে দেখবো, তারপর নাকি আমি ওর ছবি করতে রাজি হবো! হাসতে হাসতেই বলেছে। তারপরও অনেকসময় অনেকে জিজ্ঞাসা করে, এবার কি তবে প্রথমা ম্যাম আপনার ছবিতে কাজ করবেন!
ও এক জায়গায় বলেছিল, প্রথমা ম্যাম যদি বোঝেন আমাদের ছবিতে কাজ করে উনি ওনার তৃতীয় জাতীয় পুরস্কারটা পেতে পারবেন, তাহলে নিশ্চই করবেন।
আমি জানি আপনারা পড়তে পড়তে ভাবছেন এদের জাতীয় পুরস্কার নিয়ে এত মাথা ব্যাথা কেন! বিশেষ করে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে। বিশ্বাস করুন আমিও জানিনা এবং আমার জাতীয় পুরস্কার নিয়ে কোনো মাথাব্যাথাও নেই। হ্যাঁ, যখন অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, তখন ভাবতাম জাতীয় পুরস্কার পাবো, দেশে বিদেশের নানা ফিল্ম ফেস্টিভেলে পুরস্কার পেলেও মন্দ হয়না। আমি জানি আমি বরাবর অ্যাম্বিসিয়াস। কিন্তু তারপরও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে আমি না কখনও ঢুকাতে চেয়েছি আমার প্রফেসনকে, না ঢুকাতে চেয়েছি জাতীয় পুরস্কারকে। আমি যে দুটো জাতীয় পুরস্কার তখনও পর্যন্ত পেয়েছিলাম, আমি কি আগে থেকে জানতাম আমি পাবো? আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাকে কি পুরস্কার পাওয়ার জন্য এখন থেকে সংসারে কুন্ঠিত হয়ে থাকতে হবে নাকি!
সত্যি বলতে কুনাল আমাকে কোনোদিনই আর ওর ছবিতে অভিনয় করার জন্যে বলেনি। আমিও আগ বাড়িয়ে কিছু বলিনি। হয়ত রাগে। হয়ত অভিমানে। হয়ত আমার শিল্পীসত্ত্বা আমার নারীসত্ত্বা বুঝেছিল এই চাপের সামনে মাথা নোয়ানো যাবে না। তবু তো মাথা আমি নুইয়েইছিলাম। ওর প্রিয়াঙ্কা বলে মেয়েটির সাথে সম্পর্কের কথা জেনেও আমি ওকে কিছু বলিনি। কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। উলটে আমার মা একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি মিথ্যা বলেছিলাম যে, না মা ওসব রটনা! ওর ছবির নায়িকা তো! আর জানোই তো এখন ছবিতে আলাদা করে জোর না থাকলে, এসব কেচ্ছা বেচেই উতরায়!
পরপর চারটি ছবিতে ও বিভিন্ন চরিত্রে প্রিয়াঙ্কাকে কাস্ট করল। ওর সাথে মেয়েটির অবৈধ সম্পর্ক ইন্ডাস্ট্রিতে যেন ওপেন সিক্রেট। আমার অনেক ছবির প্রচারেও আমাকে জিজ্ঞাসা করা হত, আপনি কুনালবাবুর ছবিতে কবে কাজ করছেন! আমি সচেতনভাবে এ প্রশ্ন হেসে এড়িয়ে যেতাম। কখনও বলতাম, যবে আমায় উনি নেবেন। কখনও বলতাম, যেদিন ও মনে করবে আমার জন্যেই স্পেশালি ও কোনো চরিত্র ভেবেছে, আমার ধারণা ও নিশ্চই আমাকে নেবে। কখনও বলতাম, আমরা বাড়িতে কাজের কথা ঢুকাইনা। মাঝে মাঝে মজা করে এও বলেছি, আপনারা ওনাকে বলুন না যাতে ওনার পরের ছবিতে উনি আমাকে কাস্ট করেন।
না, এই সব মন্তব্য যে সবই খুব সেকুলার মন্তব্য তা না। আমাকে ও ফলস্ পজিশনে ফেলবে আর আমি মুখ বুঝে সহ্য করব এমন মেয়ে আমি নই। আমি ওকে নিজে থেকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম। আমি ওকে নিজে থেকে বলেছিলাম ওর সাথে প্রেম করব। আমি… আমি প্রথমা চৌধুরী… আমি দু’বারের জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী, আমি যেমন ওকে ভালোওবাসি, তেমন আমি ওকে এটাও দেখিয়ে দিতে পারি, আমার সাথে এইসব চালাকী করে ও বেশিদূর এগোতে পারবে না।
মাঝে বাধ সাঁধলো ওর জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যাওয়াটা। ও যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুধু করে দিল। শুধু তাই নয়, ও যেন একটা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু করল আমার সাথে। ওর এই জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরে, এক বড় বাংলা দৈনিক ওর একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিল। সেখানে অবশ্যম্ভাবীভাবে ওকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনাদের বাড়িতেই তিনটে জাতীয় পুরস্কার। কোথায় রাখেন! ও তখন বলেছিল, বৌয়েরটা দেখতে দেখতে চোখ হেজে গেছিল, এবার তাকাতে ভালো লাগবে। ওকে যে প্রশ্ন সাংবাদিক করেছিলেন, তার উত্তর কিন্তু এটি ছিলনা। তবু ও এরকম একটি উত্তর দিয়ে হয়ত আমাকেই বলতে চেয়েছিল যে আগে শুধু তুমি ছিলে, এখন আমিও আছি।
কুনালের রাগ বাড়ল যখন ওর পরের বছরই আমার তৃতীয় জাতীয় পুরস্কারটা আমি পেয়ে গেলাম। আসলে আগেরগুলো প্রেডিক্টবেল ছিল না একদমই। কিন্তু এই ছবিটায় সাইন করেইছিলাম এটা ভেবে যে এতেই আমার তৃতীয় জাতীয় পুরস্কারটি রয়েছে। তার কারণ এই ছবির পরিচালক সৌরনীল ঘোষ। ওনার উনিশটা ছবির ষোলোজন নায়িকা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। আর আমি ইতোমধ্যেই দু’বার পেয়ে গেছিলাম। সবাই খুব উত্তেজিত ছিল আমার আর সৌরনীল দা’র কোলাবোরেশন নিয়ে। শ্যুটিং-য়েও অনেকবার এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হত। কখনও আমি ভুল করলে, বা নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা করলে, সৌরনীল দা আমাকে স্পষ্ট বলে দিত সবার সামনে, এটাতে জাতীয় পুরস্কার পেতে হলে আমি যা বলবো সেরকম করে কর। নিজে পাকামো করিস না। আমি তর্ক করতে গেলে বলত, তুই জানিস তো যে তোকে আমিই তোর তৃতীয় জাতীয় পুরস্কারটা পাওয়াতে পারি? তোর বর কিন্তু পারবে না…
সৌরনীল দা ইন্ডাস্ট্রিতে ঠোঁটাকাটা হিসাবে বিশেষ পরিচিত। সেবারের জাতীয় পুরস্কারে আমাদের নাম ঘোষণা হতেই চারিদিক থেকে ইন্টারভিউয়ের বহর নেমে এল। এক টিভি শো-তে সৌরনীল দা এই কথাটা বলে দিল যে ও আমাকে কিভাবে বলত ও’ই একমাত্র আমাকে আমার তৃতীয় জাতীয় পুরস্কারটি পাওয়াতে পারে, কুনালের দ্বারা সেটা হবেনা। সাংবাদিক উলটে প্রশ্ন করলেন, কেন কুনালবাবুও তো আগের বছর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। সৌরনীল দা বললেন, সে তো গান লিখে। ছবি বানিয়ে পেয়ে দেখাক! বা ছবি বানিয়ে কোনো অভিনেতাকে পাইয়ে দেখাক… তাহলে বুঝব! ওর স্ত্রী এত ভালো অভিনেত্রী… তাকে যে ব্যবহার করতে পারেনা, সে ভালো ছবি করিয়ে বলে আমি মনেই করি না!
এই ইন্টারভিউ টেলিকাস্ট হতে বাড়িতে প্রচন্ড অশান্তি করেছিল কুনাল। মদ খেয়ে এসে জিনিসপত্র ভাঙচুর, খাবার নষ্ট করা – আর সেদিন ও প্রথমবার বিনা প্ররোচনায় আমার গায়ে হাত তুলেছিল। হাত দিয়ে মেরে সুখ মেটাতে পারছে না দেখে বেল্ট দিয়ে। ওর সেদিন ভাব ছিল যেন, এবার তোমাকে আমি শায়েস্তা করে দেবো। এই অশান্তিতে আমাদের মধ্যেকার ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হল। সরাসরি যুদ্ধ শুরু হল। আর এই যুদ্ধ শুরু হতে আমি বুঝলাম, আমি কতটা দুর্বল। মানুষ হিসাবে, শিল্পী হিসাবে, নারী হিসাবে। আমি আমার স্বামীর এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারিনি। আমি পারিনি ভালোবাসার আগে আত্মসম্মানকে দাম দিতে। আমি পারিনি এক পুরুষের অবান্তর পৌরুষকে করুণা দেখিয়ে বেরিয়ে আসতে ও বাড়ি থেকে। আমার মা মারা গেছেন সবে। আমার বাবা তখন সেই একাকী নিভৃতের জীবনে সবে সবে মানিয়ে নিচ্ছেন। সেখানে আমি তাকে আরেক ক্ষতে বিদ্ধ করতে চাইনি, পারিনি। আমার বিয়ে ভাঙার যত না ক্ষত, এই কথা জানতে পারা যে কুনাল আমার সাথে এই ব্যবহার করেছে, সেই ক্ষতেই বাবা শেষ হয়ে যেতেন। বাবা কুনালকে খুব স্নেহ করতেন। অনেককে গর্ব করে বলতেন, ও আমার ছাত্র। সাধারণত বাবা কাউকে ‘ছাত্র’ বলতেন না। কুনালকে বলতেন। মিথ্যা বলব না, কুনালেরও বাবার প্রতি এক তীব্র শ্রদ্ধা ছিল, হয়ত এখনও আছে। তবু সেই শ্রদ্ধা তাকে বিনা কারণে তার মেয়ের প্রতি খারাপ আচরণ করা থেকে আটকাতে পারেনি।
মানুষের অনুভূতি বড় জটিল বিষয়। জটিলতর তার প্রকাশ। জটিলতম পারিপার্শ্বিকতার সাথে তার সম্পর্ক। সবসময় তাকে একের-পিঠে-এক হিসাবে দেখা যায় না। বোঝাও যায় না। এই আমাকেই ধরুন না। আমাকে যখন কুনাল নানান ভাবে হেনস্থা করছে, মারছে, মারের চোটে আমার কান্না পেত ঠিকই, কাঁদতামও, কিন্তু আমার কেন জানি না কোনোদিন রাগ ওঠেনি। মনে হয়নি আমাকে মারার কোনো অধিকার ওর আদৌ নেই। আর শুধু মারা কেন, আমার ওপর চ্যাঁচানো, হম্বিতম্বি করা, কিছুরই অধিকার ওর নেই। ও এইভাবে ওর ব্যর্থতার দায় আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। এইভাবে পৌরুষের অহংকার দেখিয়ে, মৌহুর্তিক উন্মত্ততাকে নিজের ব্যর্থতায় প্রলেপ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে না। তবু কোন এক অযৌক্তিক অবান্তর ভালোবাসার প্রকাশ আমাকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এই চিন্তায় যে যে হাতে ও আমাকে ভালোবাসায় ছুঁয়েছে একদিন, কাছে টেনে নিয়ে আদর করেছে, কি করে ও সেই হাতে, আমার শরীরের ওপর প্রহার বর্ষণ করতে পারলো, পারছে দিনের পর দিন!
আমার এই অনুভূতি বিপর্যয় শুধু কুনালের ক্ষেত্রে না, বাবার ক্ষেত্রেও হয়েছে। আমার বাবা রোগশয্যায় শায়িত। প্যারালাইসড্। নিজে থেকে কিছুই করতে পারেননা। আমার কিন্তু ওনাকে দেখে খুব যে কষ্ট হত তা কিন্তু না। মানে, একজন মানুষকে ঐ অবস্থায় দেখে যতটুকু কষ্ট হওয়া দরকার, ততটুকুই ছিল। উনি যে আমার বাবা সে বোধ ছিল, আমার আশ্রয়ের দরকার পড়লে আমি সেই অসুস্থ বাবার কাছেও এসেছি। আশ্রয় পেয়েছি। তবু আমার বাবা এত কষ্ট পাচ্ছে বলে তো আমার বুক ফেটে যাওয়ার কথা, তা কিন্তু আমার হয়নি।
একদিন একটি কান্নার দৃশ্যের শ্যুটিং। আমি সাধারণত গ্লিসারিন ব্যবহার করিনা। আমাকে পাঁচ দশ মিনিট দিলেই আমি ন্যাচারালি চোখে জল আনতে পারি। সেদিন কি হল কে জানে, আকুল হয়ে কাঁদলাম। সে কান্না আর থামে না। এতই কাঁদছিলাম যে শ্যুটিং প্যাকাপ হয়ে গেলো। মহুয়া দি বলল, কি হয়েছে তোর? কি হয়েছে বুঝতে গিয়ে দেখলাম, আমার বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। যে বাবাকে আমি মঞ্চের ওপর দাপাতে দেখেছি, ওনার পড়ার টেবিলে দেখেছি কি এক দারুণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে উনি লিখতেন, কি এক ভাবগম্ভীর মুখ করে সিগারেট খেতেন, সেই বাবাকে এই বিকৃত মুখে একটা জঞ্জালের মত শুয়ে থাকতে দেখে আমার যেন বুক ভেঙে যাচ্ছিল।
আরেকদিনও, আরেকটি ছবির শ্যুটিং। আমি এক রেপ ভিকটিমের মায়ের চরিত্রে। ধর্ষকদের দেখে আমার তীব্র রাগ, জিঘাংসা বেরিয়ে আসবে, এই ছিল দৃশ্য। আমাকে ডিরেক্টর বললেন প্রথমা দি এটা খুব ইন্টেন্স একটা দৃশ্য হবে। আপনি এমনভাবে চ্যাঁচাবেন যেন মনে হয় আপনার হাতের কাছে কিছু থাকলে আপনি ছেলেগুলিকে কুচিকাটা করে ফেলবেন। কিন্তু একই সাথে নিজের মেয়ের সাথে ঘটা ঘটনায় আপনি মরমে মরে যাচ্ছেন। আবার তাদের মধ্যে একটি ছেলের প্রতি মা হিসাবে আপনার এ’ও জিজ্ঞাস্য যে আপনার মেয়ে ছেলেটিকে ভালোবেসে কি এমন ভুল করেছিল যে ছেলেটি তার সাথে এইভাবে প্রতারণা করল! বুঝেছেন তো? আমি বললাম, হ্যাঁ বুঝেছি। আমাকে দু’মিনিট দাও। সেদিন আউটডোর শ্যুটিং। আদালতের বাইরে হবে দৃশ্যটি। সেদিন এমন চ্যাঁচালাম যে যে নতুন ছেলেটি প্রেমিক-ও-ধর্ষকের চরিত্রে অভিনয় করছিল, সে কেঁদে ফেললো। ডিরেক্টর কাট্ বলার পরও আমি চ্যাঁচিয়ে গেলাম। মহুয়া দি এসে মাথায়, ঘাড়ে, মুখে ঠান্ডা জল দিল। সেদিন প্যাকাপের পরে মহুয়া দি বলল, প্রথমা, একটা কথা বলব, কিছু মনে করবি না তো?
কিরে?
তুই শিওর তুই এই কান্নাকাটি বা আজকের সেই চ্যাঁচানোর সীনটা করলি… অভিনয়ের জন্যেই করলি? মানে তুই ঠিক আছিস তো?
হ্যাঁ, মহুয়া দি, চিন্তা করিস না, আমি ঠিক আছি!
আমাকে কিন্তু বলতে পারিস!
হ্যাঁ, জানি। অবশ্যই কথা বলার হলে তোকে বলবো…
সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি ভাবলাম, আমি কি সত্যিই ঠিক নেই? মহুয়া দি’র কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সেদিন প্রথম টের পেলাম আমার মধ্যে এক অনুভূতির সংকট দেখা দিচ্ছে। আমি এক জায়গার অনুভূতির প্রকাশ অন্য জায়গায় করে ফেলছি। তাই কি? সেদিন গাড়িতে আসতে আসতে নিজেকে প্রশ্ন করতে করতেই বুঝতে পারলাম। মনে পড়ল, সেদিন সকালে ছেলেটিকে দেখে চ্যাঁচানোর সময় আমি সত্যিই মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম কুনালের সেই পাশবিক মুখটাকে, উদ্ধত হাতটাকে, আমার গায়ে আঁছড়ে পড়া প্রতিকটা বেল্টের বাড়ি… আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার লাগছিল। শরীরে, মনে, মাথায়… আমার যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমার কাছে দুটো মাত্রই রাস্তা খোলা, মৃত্যু, আর নয় প্রতিরোধ। আমার বাবা বেঁচে ছিলেন তখন, মরার মতই, তবু বেঁচে ছিলেন। মৃত্যু আমি বেছে নিতে পারতাম না। আর শুধু বাবা বেঁচে রয়েছেন বলে নয়, বাবা যেন বেঁচে থেকে বলছেন, লড়াই না করে হেরে যেও না। মরতে তো একদিন হবেই। কম্প্রোমাইজ যেন সেই মৃত্যুর বাহ্যিক উপলক্ষ্য না হয়!
তবুও তখনই আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আরো কিছুদিন মার খেলাম। মারের হাত থেকে বাঁচতে, বাবার অসুস্থতার অজুহাতে আমি এ বাড়িতে এসে রইলাম কিছুদিন। তারপর বাবা আমার শেষ বাঁধন ছিঁড়ে দিয়ে বিদায় নিলেন কিছুদিন পরে। সেদিনও আমি লক্ষ্য করলাম, শত চেয়েও আমি আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল বার করতে পারলাম না। মনে এমনকি এ’ও এল, এত মিডিয়া আসছে, ইন্ডাস্ট্রির লোকজন, নাট্যকর্মী, কলাকুশলীরা আসছে, এদের সামনে এক ফোঁটা জল না ফেললে খারাপ দেখায়, কি ভাববে তারা? শেষে গ্লিসারিন লাগিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করলাম ক্যামেরার সামনে। মহুয়া দি এসে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক আছিস? আমি মহুয়া দি’কে একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে গিয়ে বললাম, মহুয়া দি, আমার অনুভূতি কাজ করছে না ঠিক মত!
এরকম সময় এরকম হয়! কিছু ভাবিস না… ঠিক হয়ে যাবে!
না, মহুয়া দি! আমি শুধু আজকের কথা বলছি না!
কে জানে মহুয়া দি আমার কথা কতটা বুঝল। খালি নিজের মত বলে গেলো কুনালের নামে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেস দিয়েদে। নন-বেলেবেল্। দু’তিন বছর জেলে খেটে আসলে বুঝবে! বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, কুনাল এসেছে। সাথে নিয়ে এসেছে প্রিয়াঙ্কাকে। আমার সাথে কোনো কথা না, কিছু না। বাবাকে মালা দিল, প্রণাম করল। প্রিয়াঙ্কা আমার কাছে এসে সুর করে বলল, দিদি খবরটা শুনে এত খারাপ লাগছে। তখন যেন সত্যি সত্যি একবার মনে হল, দি ফাঁসিয়ে। আর ফাঁসানোরও তো কিছু নেই। ও তো সত্যিই আমার ওপর অত্যাচার করেছে। তারপর আবারও মনে হল এখন ওর নামে কমপ্লেন করলে আবার খবরে কাদা ছোড়াছুঁড়ি হবে। আমাদের মিডিয়া তো এসব খবর একেবারে লুফে নেওয়ার জন্যে বসেই আছে। আবার ভাবলাম, সবে আমার বাবা মারা গেছেন। লোকে কি ভাববে, এই সবে বাবা মারা গেলো আর মেয়ের ব্যক্তিগত জীবনও পাব্লিক হয়ে গেলো! তারপর ভাবলাম, এ নতুন করে বেরোনোর কি আছে! প্রিয়াঙ্কার সাথে কুনালের সম্পর্কের কথা কি কারোর অজানা? আমার সাথে বৈবাহিক ঝামেলার কথা বাইরে না আসুক, ওর সাথে মেয়েটির সম্পর্কের গুঞ্জন তো অনেক অনলাইন খবরের পোর্টালে আছেই অনেকদিন।
আমার চতুর্থ জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা হল। বাবা চলে যাবার পর থেকে আমি এ বাড়িতেই ছিলাম। সব নিউজ চ্যানেল থেকে ফোন আসছে। ইন্টারভিউ দেওয়ার আবদার আসছে। সারাদিনের এসব হাঙ্গামার পর আমি আর মহুয়া দি বসে আছি বারান্দায়, আমার হঠাত কি মনে হতে, মহুয়া দিকে বললাম, মহুয়া দি, একটা কথা বলব? তুই আমায় খারাপ ভাববি না তো?
মহুয়া দি আমার থেকে একটু বড় হলে কি হবে, হাবভাব, কথাবার্তা মায়ের মত। বলল, কি কথা বল না!
চ, কুনালকে ফাঁসিয়ে দি?
ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে?
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু ওটায় বেশিদিন জেল হয়না। তিন বছর মত।
তুই কি যাবজ্জীবন চাইছিস?
যাবজ্জীবন না হলেও, অন্তত বছর দশেক! আমার আজও সেদিনের আমার গলার স্বরের কথা মনে আছে। নিরুত্তাপ, স্থির, নিরুদ্বেগ। যেন কোনো চরিত্রে অভিনয় করছি। আর আমি, আসল আমি, প্রথমা চৌধুরী, যেন সেই অভিনয় করছি, সাথে নিজেও নিজেকে দেখছি। ভালোও লাগছে। এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, ঠিকই আছে। আসল আমি ভীতু, আমি তো কোনোদিন কুনালের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতাম না। অতএব অভিনয়েই সই।
বছর দশেক?… কিভাবে?
সে জানি না। কিন্তু, শুধু ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেস চাপালে ও বেরিয়েও যেতে পারে। আর ভুলে যাস না ও ইউনিয়নের কাছের লোক, সরকারের কাছের লোক। আমার বাবা মা দুজনেই বামপন্থী ছিলেন। প্লাস, সেবারের পর থেকে আমায় যতবার প্রচারে যাওয়ার জন্য ডেকেছে, আমি যাইনি, দিদি নিজে ফোন করেছিলেন, তাও না বলেছি। ফলে ওদের ওর পক্ষ নিতে কারণের অভাব হবে না। ফলে, এমন কিছু করতে হবে…
কিন্তু কি সেটা?
ভাবতে হবে একটু!
তারপর থেকে আমি ভেবেছি। সেই প্রথমা হয়ে ভেবেছি যে প্রথমা হয়ে ওঠা আমার অনেক আগেই উচিত ছিল, যা আমি হতে পারিনি। সেই অভিনয়ের অভিনয় না করলে, জানি হতে পারতামও না কোনোদিন। এই অভিনয়ে আসল প্রথমা বিরক্ত হয়েছে মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, দরকার নেই। কি এক মানিয়ে নেওয়ার বাসনা বারংবার আমাকে আমার অভীষ্ট থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি প্রথমা চৌধুরী। আমি ভীতু, আমি দুর্বল কিন্তু আমি চারবারের জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী। আমি কখনও আমার অভিনয় বা তার প্রস্তুতিতে ফাঁক রাখিনা। ভেতর থেকে কেউ যেন জানান দিচ্ছিল, এবারেও রাখবো না।
মন তো বলছিল, পারবো। কিন্তু উপায় জানা ছিল না। তারপর হঠাত একদিন সকালে দিলীপ দা ফোন করলেন বম্বে থেকে। আমাকে জাতীয় পুরস্কারের জন্য কনগ্র্যাচুলেট করলেন। বললেন, আরে, আর কটা জাতীয় পুরস্কার পেলে তুমি বম্বেতে কাজ করবে বলো তো? আমি হেসে বললাম, ভালো স্ক্রিপ্ট পেলেই করব! কেন, গুলশানের সাথে, হরিপদ পুনিয়ার সাথে তো করেছিলাম। দিলীপ দা’ও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ঠিক মনে রেখেছে ও দুটো আমার কেরিয়ারের প্রায় প্রথম দিককার ছবি। হেসে বলল, ও তো আপকি পিছলি জনম্ কি পিকচারস্ হ্যায় না! আমি বেশি কথা না বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পরিচালক কে? একদম টিপিকাল বিসনেসম্যানদের মত বলল, একটা ছেলে আছে… নতুন… ফিল্ম ইন্সটিটিউট সে পাসাউট! মেরে পাস এক স্ক্রিপ্ট লায়া হ্যায়… বোল রাহা হ্যায় কি আপকে বিনা ইয়ে পিকচার নেহি হো সাকতা!
আমি বললাম, আপনি ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ছেলেদের দিয়ে ছবি বানাচ্ছেন? আপনার টাকা উঠবে?
দিলীপবাবু বোধ হয় আমার শ্লেষটা বুঝলেন। বললেন, আরে আপ লোগ ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড কে বাদ ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড লে যা রহে হে… হামকো ভি চাহিহে এক! আপকো মিলে… ডিরেক্টর কো মিলে… ডিওপি কো মিলে… মুঝে কোহি ফারাক নেহি। এক চাহিহে …বাস্!
বুঝলাম এর সাথে ভেজিয়ে লাভ নেই। বললাম, ঠিকাছে, ডিরেক্টরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিন। আমার ফোন নাম্বার দিয়ে বলুন আমার সাথে যোগাযোগ করে নিতে। স্ক্রিপ্টটা শুনি!
চলিয়ে ঠিক হ্যায়! লেকিন… প্লিজ ম্যাডাম, এক পিকচার হামারে সাথ ভি কিজিয়ে! দেখিয়ে, সিরফ্ আপকো লেনে কে লিয়ে হাম আব ইন্সটিটিউট সে ডিরেক্টর মাংওয়া হ্যায়! বুঝলাম, যে ইন্সটিটিউটের থেকে ওর কাছে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসেনি। উনিই কাউকে একটা তুলে এনেছেন এই ছবিটা করবেন বলে।
ছেলেটির নাম শুভ। শুভ্ সামথান্। দিলীপ বাবুর সাথে কথা বলার ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফোন করল সে। জানালো, কলকাতাতেই আছি ম্যাম্। জিজ্ঞেস করল, আজ কি দেখা করা যায়! আমার কাল ফিরে যাওয়া!
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বাড়ি থেকে সেরকম বেরোনো হয়না ভেবে আমি ছেলেটিকে একটা ক্যাফেতে দেখা করতে বললাম। জিজ্ঞাসা করল, কোন ক্যাফে। আমি বললাম, ইউ চুজ। আমাকে লোকেশনটা শেয়ার করো, আমি পৌঁছে যাবো। গেলাম। ছেলেটিকে সুন্দর দেখতে। উজ্জ্বল চোখ, একমুখ দাড়ি। ঘন ভ্রু। টিকালো নাক। বয়েস ত্রিশের শুরুতে। একটা ঘিয়ে রঙের কটন্ প্যান্ট আর স্যাজ্ রঙের গেঞ্জি। চাপা গেঞ্জিতে শরীরের একটা হালকা আভা ফুটে ওঠে, বিশেষত বুকের। জামার হাতা বাহুর সাথে যেন চেপে বসতে গিয়েও বসেনি। ছেলেটিকে দেখে আমার হঠাত মনে হল কতদিন হয়ে গেলো কোনো পুরুষ শরীর ছুঁইনি আমি। তাই জন্যেই হয়ত ছেলেটিকে আমার একটু বেশি ভালো লাগল। বেশি ভালো লাগল ওর স্ক্রিপ্ট। ওর স্ক্রিপ্ট শোনানোর ধরণ। একবার মনে হল, বাড়িতে ইনভাইট করি। তারপর ভাবলাম, ভবিষ্যতে কাজ করলে দেখাসাক্ষাৎ তো হবেই।
ছেলেটি ভালো লেখে। আমি মনে মনে রাজি হয়ে থাকলেও, ওকে ফাইনাল কিছু জানালাম না। বললাম, পরে দিলীপবাবুকে জানাবো। একটু সময় দাও। কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এতকিছুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল ওর স্ক্রিপ্ট থেকে একটা রেফারেন্স পেলাম হঠাত। সুইসাইডের রেফারেন্স। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো, আরে, ভারতীয় আইনে কাউকে সুইসাইড করতে প্ররোচিত করাও তো দন্ডনীয় অপরাধ। ব্যস্। বাড়ি এসে রিসার্চ-ওয়ার্ক করতে বসে গেলাম। অনেকদিন পর যেন মনে হল, আমার কাজের একঘেয়েমী কাটছে। তখনও জানি না, এটা আদৌ কাজে দেবে কি দেবে না। শুধু আন্দাজের বসেই খুঁজে পেতে দেখতে শুরু করেছিলাম।
দু’দিন পর মহুয়া দি’কে ডেকে পাঠালাম। এলে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কোনো চেনাজানা ডাক্তার আছে?
চেনা জানা বলতে… হ্যাঁ, মানে বাবাকে যিনি দেখেন?
কোথায় প্র্যাক্টিস করে?
একটা বেসরকারি হাসপাতালে।
আচ্ছা, ওকে একদিন একটু বাড়িতে ডাকা যায়? আমার বাড়িতে… মানে এখানে!
মহুয়া দি আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ যাবে, কিন্তু কেন? ডাক্তার কেন দরকার পড়ল তোর হঠাত?
মহুয়া দি, একটা প্ল্যান ভেবেছি! একটু নেট ফেট ঘেঁটে দেখলাম, এবেট্মেন্ট অফ সুইসাইড… তিনশো ছয় ধারা… ননবেলেবেল্… শুধু প্লটটা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে আমিও না মরি, কিন্তু সুইসাইডের প্ররোচনায় ও’ও জেলে যায়। তারপর কেস উঠলে তোরা তো আছিসই। সাক্ষী দিবি তো?
সে দেবো! মহুয়া দি’র গলার স্বর শুনে মনে হল বোধয় এবার একটু ভয় পেয়েছে। ওকে বললাম, কি অচেনা লাগছে না আমায়? আমারও লেগেছিল বিশ্বাস কর… কুনালকে! প্লিস মহুয়া দি আমায় একটু হেল্প কর…
ভেবেছিলাম পরবর্তী কিছুদিনে প্ল্যানটাকে আরেকটু রিফাইন করে নেবো। সেটা করতে গিয়েই মাথায় এল, সুইসাইড নয় করতে যাবো। চিঠিও লিখে রেখে যাবো যে আমি কুনালের দৈন্যন্দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি। কিন্তু ভাবছি বিশ্বাসযোগ্য হবে তো ব্যাপারটা! অনেক ভেবে ঠিক করলাম একটা উকিলের সাথে কথা বললে ভালো হয়। কারণ নেট দেখে আর কতটুকুই বা জানা যায় আইন সম্বন্ধে? কিন্তু উকিলের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এই চিন্তায় আরেকপ্রস্থ বিরক্তি এল। আবার একবার যেন মনে হল, আমি কি অপরাধের বিচার চাইতে চাইতে অপরাধী মানসিকতার হয়ে যাচ্ছি? কিন্তু এইবারে যেন এক রোখ চেপে ধরেছিল আমার—এর শেষে না দেখে থামবো না। ভাবলাম, না আমি তো আসল প্রথমা চৌধুরী না, আমি তো সেই প্রথমা চৌধুরীর চরিত্রে অভিনয় করছি যে সাহসী, প্রতিবাদী, যে নিজের ওপর হওয়া সমস্ত ধরণের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। তাহলে সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তাকে যদি অপরাধীর মতই ভাবতে হয়, তাতে দোষের কি? নিজেকে এভাবে আবারও দাঁড় করালাম, কিন্তু মাথায় চলছিল যত কম লোকজনকে জড়াতে চাইছি এতে, ততই যেন বেড়ে চলেছে। আমার কেন জানিনা এরকম একটা অনুভূতি হয় যে বেশি লোকদের জড়ালেই ফেলিওরের চান্স বাড়ে। তবু অনেক ভেবে দেখলাম, একজন উকিলের সাথে পরামর্শ না করলেই নয়। আমি যেসব উকিলকে চিনি, তারা সবাই বেঙ্গল বেসড্। ভালো উকিল। কিন্তু, সবাই কোনো না কোনো প্রোডাকশন হাউসের সাথে যুক্ত। কুনালও এই প্রফেশনের। তাই তাদের আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অভিনয়ের জগতের বাইরের কোনো উকিলকে পাওয়া যাবে না এমন নয়। তবু কে ভালো হবে, কার থেকেই বা খোঁজ নেবো? পলিটিক্সের কারোর থেকে খোঁজ নেবো? তখনই হঠাত আমার সায়কের নাম মাথায় এল। সায়ক রায়, ইদানীংকালে খুব নামকরা উকিল। নামকরা বলতে, যত না তার ওকালতি প্রফেশনের কারণে, তার থেকে অনেক বেশি তার স্যোসাল মিডিয়ায় সচেতন উপস্থিতির জন্য। সে মায়েদের দলের সমর্থক ও একপ্রকার নেতা। রাজ্য সরকারের সমস্ত দুর্নীতির আইনগত চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই তার নাম ও পরিচয়। ও যদিও এসব ব্যাপারে কনসাল্টটেন্স দেয় কিনা জানিনা, তবু একবার কথা বলে দেখা যেতেই পারে। এই ভেবে আমি দেবব্রতকে একটা মেসেজ করলাম। দেবব্রত আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বামপন্থী ইউনিয়নের নেতা। দেবব্রতর সাথে আমার বন্ধুত্ব আমার মায়ের জন্যেই। মা অনেকদিন পর্যন্ত দেবব্রতর বাবা, সুধাময় জেঠুদের দলে নাটক করেছে। পরে, সুধাময় জেঠুর থেকে দেবব্রত যখন দলের দায়িত্ব পেলো, মা তারপর ওর ডিরেকশনেও দু-তিনটে প্রোডাকশনে কাজ করেছে।
দেবব্রতকে মেসেজ করতে, ও ঘন্টাখানেক পরে, সায়কের নাম্বারটা পাঠিয়ে দিল। সাথে জিজ্ঞাসা করল, পম্মা, সব ঠিক আছে? ও আসলে কুনাল আর প্রিয়াঙ্কার ব্যাপারটা জানে, তাই হয়ত জানতে চাইল, আমি ডিভোর্স বা ঐ জাতীয় কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইছি কিনা। আমি বললাম, হ্যাঁ, ঠিকাছে। আমার একটা কাজের বিষয়ে একটা পরামর্শ লাগবে। ও বেশি কথা বাড়াল না, বলল, ঠিকাছে।
আমি সায়ককে ফোন করলাম। প্রথমবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ব্যস্ত আছে ভেবে তখন আর করলাম না। ও রাত বারোটা নাগাদ রিং-ব্যাক করল। ধরলাম। ওদিক থেকে গলা ভেসে এল, কে বলছেন? ফোন এসেছিল এই নাম্বার থেকে একটা। গলাটা ভিডিওতে যতটা কর্কশ শোনায়, ফোনে একটু পেলব।
হ্যাঁ, তোমার নাম্বারটা আমি দেবব্রত ঘোষের কাছ থেকে পেয়েছি। আমি প্রথমা চৌধুরী কথা বলছি।
প্রথমা চৌধুরী মানে… আরেহ! ম্যাম… আপনি ফোন করেছেন! বলুন বলুন, আমার মা আপনার খুব বড় ফ্যান!
আমি হাসলাম। বললাম, ঠিকাছ একদিন তোমার মায়ের সাথে কথা বলিও। কিন্তু আমি তোমাকে অন্য একটা কারণে ফোন করছি। আমার একটা ব্যাপারে একটু আইনী পরামর্শ নেওয়ার আছে। তাই আমার তোমার একটু সাহায্য লাগবে।
হ্যাঁ ম্যাম… একদম একদম।
তুমি কি আমার বাড়ি আসতে পারবে?
এখন?
না না, এখন না। মানে কাল পরশুর মধ্যে যদি পারো!
হ্যাঁ ম্যাম, অবশ্যই! কাল হবে আমার। আপনার বাড়ির লোকেশনটা পাঠিয়ে দিন… হোয়াটস্যাপে। আমি চলে যাবো!
কখন আসবে? দুপুরে এসো। এখানে এসে খেয়ো।
না না ঠিকাছে, আমার জন্য অত ব্যস্ত হতে হবে না।
না না, এতে ব্যস্ত হওয়ার কি আছে? আমিও তো খাবো!
হাসলো। বললাম, বেশ, রাখি? কাল দেখা হচ্ছে!
পরেরদিন যথাসময়ে সায়ক এলো। দেখি হাতে করে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছে। আমি বকা দিলাম, এসব আবার কি? একটা প্রফেশানাল কাজে ডেকেছি তোমায়!
স্মার্টলি বলল, দুপুরের খাওয়াটা তো প্রফেশানালিজমের মধ্যে পড়ে না, তাই ভাবলাম ফুল নিয়ে যাই! আসলে আমি আপনার এক ইন্টারভিউয়ে পড়েছিলাম, আপনার ফুল খুব পছন্দের।
আমি মনে মনে ভাবলাম আমায় এত ভালোবেসে ফুল এনে দিল। একটু পরেই যখন কথা বলতে বসব, তখন যে আমাকে কি ভাববে, কে জানে!
খাওয়ার আগে অনেক কথা হল। ওর প্রফেশন নিয়ে। আমার সিনেমা নিয়ে। আমার মা, বাবাকে নিয়ে। বলল যে মা’কে ও চেনে। একবার কোনো এক জমায়েতে কথা হয়েছিল। তখন ও ল’ কলেজের ছাত্র। আমি বললাম, চলো, খেয়ে নেবে। বলল, আগে কাজের কথা বলে নিলে হয়না!
আমি সিরিয়াস হওয়ার ভান করে বললাম, না হয়না। ও দেখলাম, মাথা নীচু করে বলল, ঠিকাছে ম্যাম!
খেতে খেতে বলল, এসব আপনি রান্না করেছেন?
আর কে করবে?
সব কিছু?
আর কে করবে?
দারুণ হয়েছে। আপনি এত ভালো রান্না করেন বলেননি তো কোনো ইন্টারভিউতে।
শুধু ইন্টারভিউ পড়ে যদি একটা মানুষকে চেনা যেত, কত ভালো হত না?
সায়ক বোধয় একটু লজ্জা পেল আমার এই কথায়। মিনমিন করে বলল, আমি জাস্ট একটু স্টাডি করছিলাম আর কি!
না, হোম ওয়ার্ক করে আসা ভাল!
খেয়ে উঠে ও এসে সোফায় বসল। আমিও ডিসগুলো বেসিনে নামিয়ে, টেবিলটা মুছে এসে বসলাম। বললাম, শুরু করি?
হ্যাঁ ম্যাম, বলে একটা ডায়েরি পেন বার করল। আমি দেখে বললাম, ওগুলো রেখে দাও, ওগুলোর দরকার পড়বে না। আমার কথা শুনে ও ডায়েরিটা বন্ধ করে সামনের টি-টেবিলে নামিয়ে রাখল। আমি ওকে কথা শুরুর আগে বললাম, দেখো, যে কথাগুলো আমি তোমায় বলব, তাতে তোমার আমার সম্বন্ধে ধারনা সম্পূর্ণ পালটে যেতে পারে। ভালোর দিকে না বাজের দিকে, সেটা তুমি ডিসাইড করবে। কিন্তু, তোমাকে আমাকে একটা কথা দিতে হবে।
ও সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল!
আমি তোমাকে যে কথাগুলো বলব, সেগুলো কাউকে বলবে না। দেবব্রতও জিজ্ঞাসা করতে পারে। তাকেও বলবে না। শুধু তুমি আর আমি জানবো… আর কেউ না! রাজি?
হ্যাঁ ম্যাম একদম বলুন।
আমি ওকে খুলে সব বললাম। ও যতই মুখ নরম্যাল রাখার চেষ্টা করুক, আমি ওর চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, ও ভেতরে ভেতরে অবাকই হচ্ছে! আমি কথা শেষ করে বললাম, এবার তুমি বলো!
ম্যাম… একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ও কথা বলা আরম্ভ করল, আমি জানি এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু আপনার আরো আগে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।
জানি সায়ক জানি। আমি পারিনি। কিন্তু, নাও আই ওয়ান্ট টু রেক্টিফাই মাই মিস্টেক!
হুম।
বলো… হুম বলে থেমে গেলে হবে?
মানে কি বলুন তো, আমি যতদূর জানি, অ্যাবেট্মেন্টের চার্জ আনা যায়… তবে আপনি সেক্ষেত্রে যদি না মরেন, তাহলে কিন্তু অ্যাবেটর্ এর শাস্তি অত হবে না। বুঝেছেন?
আচ্ছা। আমি একটু হতাশই হলাম ওর কথায়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, ভাগ্যিস ওর সাথে কথা বললাম, নয়ত, গুগুল দেখে কাজ করতে নেমে গেলে মুশকিল হত। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে উপায়?
উনি কি আপনার কাছে টাকা পয়সা চেয়েছেন কখনও?
নাহ!
আর ওনার বাড়ির লোকেরা কেমন?
ওর বাড়ির লোক বলতে ওর বাবা। তিনি এখানে থাকেন না। বর্ধমানে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। আর উনি অমায়িক লোক।
আচ্ছা, তাহলে শ্বশুর বাড়ির অত্যাচারের কেসও দেওয়া যাবে না।
না, একদম না।
দেখুন, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের চার্জ আসবে। আপনি এখনও অব্দি যা ভেবেছেন, সেটা করলে তিনশো সাতও লাগবে। কিন্তু, সেটা পুরোপুরি কার্যকর করে না যদি না আপনি মরেন।
ওকে একটু চিন্তিত দেখালো। একটু অন্যমনস্কভাবে বলল, যদি অ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার কেস কোনোভাবে লাগানো যায়!
আমি ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললাম, কিন্তু ও তো আমায় মারতে চায় না। অবশ্য জানি না, মনে তো হয় না একদম মেরে ফেলতে চায় বলে।
ডাজন্ট ম্যাটার! আপনাকে যখন উনি মারেন… মারতেন… যদি কোনোভাবে উনি কোনো সেন্সিটিভ জায়গায় আপনাকে মারেন, ধরুন, মাথায়… বা বুক… যা থেকে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে… সেইক্ষেত্রে আপনি চাইলে পার্পেট্রেটরের বিরুদ্ধে অ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার কেস আনতে পারেন।
আচ্ছা।
সেদিন আর বেশি কথা হল না। ওরও কোন মিটিঙয়ে যাওয়ার ছিল। ওকে বললাম, ঠিকাছে, আমি একটু ভেবে নি। তোমাকে জানাবো। তোমাকে হয়ত আরো কয়েকবার আসতে হতে পারে…
একদম ম্যাম! নো প্রবলেম। আপনি আপনার সুবিধা মত ফোন করবেন।
সায়ক এসে মাথাটা আমার ঘেঁটে দিয়ে গেলো। প্রথমটা একটু বিরক্ত লাগছিল। তারপর ভাবলাম, না না ঠিকই আছে, আমি একটু বেশিই সহজ ভাবছিলাম ব্যাপারটা। সেদিন রাত্রে মহুয়া দি’কে বললাম, কাজ থেকে ফেরার পথে আমার বাড়ি হয়ে যেতে। ও আসলে ওকে সব কথা বললাম, সায়ক যা যা বলল। ও’ও চিন্তিত মুখে বলল, তাহলে এখন উপায়?
উপায় তো কিছু একটা বার করতে হবেই। যাই হোক, তুই কি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছিস?
না বলার সময় পায়নি রে।
তাড়াতাড়ি বল।
হ্যাঁ বলবো।
শুধু বলবি না, একেবারে ইনভাইট করে আসবি। এখন তো আমার সেরকম কাজ নেই, আমি বাড়িতেই থাকবো। এর মধ্যেই বল। দিলীপবাবুকে বেশিদিন ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। কাজ শুরু হয়ে গেলে আর এসব হবেনা।
হ্যাঁ বুঝেছি, ঠিকাছে দেখছি।
মহুয়া দি’র যেমন কথা, তেমন কাজ। দুদিনের মধ্যে ডাক্তার মেয়েটিকে নিয়ে হাজির। মেয়েটির নাম পায়েল। তাকে সব বুঝিয়ে বলা গেলো। সে সবটা শুনে বলল, দিদি আপনাকে একটা সাজেশন দেবো?
আমি মনে মনে ভাবলাম, এই তো, ডাক্তারও তবে নিজেকে এখন এই প্ল্যানের পার্ট ভাবতে শুরু করেছে। আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ বলো না!
পায়েল বলল, আপনি শেষ একদিন যেচে মার খেতে পারবেন না? মানে, আপনিই গিয়ে আপনার হাজব্যান্ডকে উস্কান। কি বলুন তো, গায়ে টাটকা এভিডেন্স থাকলে, তার ইমপ্লিকেশনটা বেশি হবে। আমি ভেবে দেখলাম কথাটা ও ঠিকই বলছে। সায়কও সেরকমই বলছিল। আমি সায়ককে ওখানে বসেই ফোন করলাম, কথা বলা যায় একটু!
হ্যাঁ ম্যাম বলুন। পায়েলের কথা ওকে বললাম। ও শুনে বলল, ম্যাম, উনি কতক্ষণ আছেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? ও বলল, আমি আপনার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নেই। আপনার বাড়ি গিয়ে কথা বলি? আমি বললাম, তাহলে তো খুব ভালো হয়। এসো।
সায়ক এসে বলল, সরি, নিজে থেকে চলে এলাম।
আমি বললাম, আরে না না। তুমি যে নিজে থেকে আসতে চেয়েছ, আর আমার এই ইস্যুটায় এত ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছ, এতেই আমি কৃতজ্ঞ।
আমি ‘কৃতজ্ঞ’ বলেছি বলে লজ্জার হাসি হেসে বলল, আরে ম্যাম, আপনি কি যে বলেন!
সায়ক পায়েলের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, ম্যাম, জানি শারীরিক কষ্টটা আপনাকেই ভোগ করতে হবে, কিন্তু একবার যদি আপনি ওনাকে আপনার মাথায় বা বুকে বা পেটে মারতে বাধ্য করতে পারেন না… তাহলে খুব ভালো হয়!
আমি ইয়ার্কি মেরে বললাম, যদি সত্যিই মরে যাই! ওরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। ওদেরকে আর বেশি অপ্রস্তুত না করে, আমি হেসে ফেললাম। ওরাও বুঝল যে আমি ইয়ার্কি মারছিলাম। কিন্তু আমার মনে মনে একটু ভয় করছিল বৈকি! নিজে থেকে কি এমন করব যাতে ও আমাকে এমনভাবে মারতে উদ্যত হয় যে আমার মাথায় লাগে বা বুকে? তাতে যদি সত্যিই সিরিয়াস ইঞ্জুরি হয়ে যায়!
সায়ক বলল, ম্যাম দেখুন, আপনি যা বলছেন, বেল্ট ফেল্ট দিয়ে মারলে আপনি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের চার্জ আনতে পারবেন, কিন্তু অ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার আনতে পারবেন না।
আমি বললাম, কিন্তু এত ইঞ্জিউরি হলে, আবার বাড়ি এসে সুইসাইড করাটা একটু বাড়াবাড়ি লাগবে না!
সায়ক একটু ভেবে বলল, ম্যাম, আপনি একটা কাজ করুন। সুইসাইডের প্ল্যানটা ছেড়ে দিন। আপনি ওই বাড়িতে কি করে ওনাকে আপনাকে মারতে উদ্যত করতে পারেন সেটা ভাবুন। উনি নিজে হাতে যা মারবেন মারবন। সায়কের কথা শুনে আমার হাসি পেলো। ও সেটা বুঝতে পেরে, লজ্জা পেয়ে বলল, সরি ম্যাম। আমি ওকে প্রবোধ দিয়ে বললাম, না না বলো!
মানে আমি বলতে চাইছি, ধরুন উনি সিভিয়ার কিছু করলেন না, কিন্তু আপনি এমনভাবে বেকায়দায় হোক বা কিছু যদি আহত হন তাতেও কিন্তু কাজ হতে পারে। আপনারদের ও বাড়িতে ঘরে সিসিটিভি নেই তো?
না!
কিন্তু চেষ্টা করতে হবে যা’তে উনিই প্রহারটা করেন। তার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। তাহলে কি হবে বলুন তো, আপনি ইঞ্জিওরড্ হয়ে মহুয়া দি’কে ফোন করবেন। মহুয়া দি আপনাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখবে, সেটা পরে এভিডেন্স হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এটা ননবেলেবেল্ তো! মহুয়া দি জিজ্ঞাসা করল।
দেখুন ননবেলেবেল মানে বাই রাইট সে বেল পাবে না। সেখানে উকিলকে… আপনার উকিলকে দেখাতে হবে যে তিনি বাইরে থাকলে প্রমাণ লোপাট করতে পারেন, সাক্ষীদের ম্যানুপুলেট করতে পারেন… উনি সেলিব্রেটি… যেটা এইক্ষেত্রে অ্যাপ্লিকেবল্ ও হবে। মানে, ননবেলেবেল্ মানে হচ্ছে বেল্ পাবে কিনা সেটা কোর্ট ডিসাইড করবে। তবে কি বলুন তো, আপনিও সেলিব্রিটি। ফলে আপনার ফেমকে কাজে লাগিয়ে ওদের দিকের উকিল বলতে পারে যে আপনি কোনোভাবে প্ল্যান করে ওকে ফাঁসাচ্ছেন। কিন্তু এখানে আমাদের কাছে দুটো হাতিয়ার আছে। এক হচ্ছে আপনার সাথে ওনার ঝামেলার একটা কালেক্টিভ প্রমাণ, পাশের বাড়িতে শুনেছে বা কিছু। আর দুই, আপনার ফিজিকাল ইঞ্জিউরিগুলোও। আরেকটা হচ্ছে, সরি টু সে ম্যাম, বলে একটু আমতা আমতা করছিল সায়ক, আমি প্রবোধ দিয়ে বললাম, আরে বলো…
মানে… আরেকটা ব্যাপার হল, কুনালবাবুর সাথে প্রিয়াঙ্কার সম্পর্ক! যদিও সেটা অফিসিয়াল কিছু না, তাও সেই যে রুমর্ সেটাকে কোনোভাবে কাজে লাগানো যায় কিনা দেখতে হবে। আইনত কাজে লাগানো না গেলেও পাবলিক পারসেপসনে সেটা তো আসবেই।
বুঝলাম। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম।
আমাদের ফাইনাল প্ল্যান সেদিনই রেডি হয়ে গেলো মোটামুটি। আমি আমার জিনিসপত্র আনার নাম করে কুনালের বাড়িতে যাবো। রাতের দিকে। যাতে ও বাড়িতে থাকে। অবশ্য তার আগে আমি ওর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে গাড়ি থেকেই দেখে নেবো ও বাড়িতে আছে কি নেই। যদি থাকে তাহলে বাড়িতে ঢুকবো। ঝামেলা অশান্তি করব। অবশ্য মনে হয়না তার দরকার হবে! আশা করছি আগের প্রতিবারের মত এবারেও সে বিনা প্ররোচনাতেই আমাকে মারতে উদ্যত হবে। তাও আমাদের যা প্ল্যান তাতে ওকে একটু বেশি তাতাতে হবে। একটু উস্কে দেবো না হয়—সদ্য চার নম্বর জাতীয় পুরস্কারটা পেলাম! গায়ে দাগ, মাথায় বা শরীরের কোথাও একটা মোটামুটি সিরিয়াস ইঞ্জুরি নিয়ে ফিরতে হবে। তারপর ও বাড়ি থেকে মহুয়া দি’কে ফোন করব। মহুয়া দি অ্যাম্বুলেন্সের নাম্বার নিয়ে রেখেছে। মহুয়া দি’কে বুঝিয়ে রেখেছি, রিহার্সালও করিয়ে নিয়েছি কয়েকবার। আমাকে ঐ অবস্থায় ও বাড়ি থেকে বার করার সময় ছোটোখাটো একটা ড্রামা করতে হবে। মানে একটু চিৎকার চ্যাঁচামেচি করবে, হাউমাউ করে কাঁদবে, এই আর কি। আমি জানি না কে, তবে, আমাদের ঐ বাড়ির আশেপাশেই এক মিডিয়ার ইনফরমার থাকে, সে নিশ্চিত মিডিয়াকে জানিয়ে দেবে। আর ও না জানালে মহুয়া দি তো আছেই। জাস্ট অসহায়তার ভান করে ইন্ডাস্ট্রিতে কয়েকজনকে ফোন করবে। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে মহুয়া দি আমাকে ও বাড়ির সামনে রাস্তায় ফেলে রাখবে। তাতে একটা কালেক্টিভ এভিডেন্স থাকবে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সিসিটিভিগুলোতেও থেকে যাবে। সেখান থেকে হাসপাতাল। পায়েল রেডিই থাকবে। আমি গেলেই সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে। ওখান থেকেই পুলিশকে জানানো হবে ইত্যাদি।
যেদিন রাতে কুনালের বাড়িতে যাবো ঠিক হল, সেদিন বাথরুমে স্নানের পর গা মুছতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে থমকে গেলাম। থমকে গেলাম বলতে নিজেকে দেখে না, মনে হল, অন্য কেউ একজন। সত্যি বলছি। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করালাম, এটাই আমি, এটাই আমি এটাই আমি। সেখানে দাঁড়িয়ে আমার মা’র কথা হঠাত খুব মনে পড়ল। মনে হল মা আজকে থাকলে মনে অনেকটা জোর পেতাম। মনে মনে ঠিক করলাম, কেন ঠিক করলাম জানি না, শুভর ছবিটা করা হয়ে গেলে আর ছবি করব না। পুরোপুরি ছেড়ে না দি, অন্তত কিছুদিন রেস্ট নেবো। পিছনে ফিরে দেখলে আমার মনে পড়ে না কবে সেভাবে আমি একটু ছুটি কাটাতে গেছি। এসব মিটে গেলে এবার কোথাও একটু যাবো। নির্জন কোথাও। সেদিন যেন বাথরুম থেকে আর বেরোতে ইচ্ছা করছে না। কি যেন টেনে টেনে ধরছে বারংবার। ভাবছি, মন কি জানান দিচ্ছে যে আমি আজকের এই যুদ্ধে হয়ত হেরে যেতে পারি? এই হারে আমার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যদি তাই হয় তবে কি আমার আর ছুটি কাটাতে যাওয়া হবে না? স্বাদ নেওয়া হবে না আমার চিন্তা মুক্ত মনের সঙ্গ? – এসব ভাবতে ভাবতেই সারা দুপুর কাটিয়ে দিলাম বাথরুমে। বেরিয়ে এসে আর ভাত খেতে ইচ্ছা করল না। একটু কফি খেলাম, সাথে দুটো টোস্ট বিস্কুট।
এই শেষ মুহূর্তে মৃত্যুচিন্তা যেন আমাকে কেমন জাপটে ধরতে চাইছে। মনে চলছে, যদি মরে যাই, বেকায়দায় নিজেকে বেশি আহত করতে গিয়ে যদি প্রাণটাই চলে যায়, তাহলে? এসব চিন্তা করতে করতেই সন্ধ্যা সাতটার সময় ভাত নিয়ে বসলাম, আর ভাত কপালে জুটবে কিনা ভেবে। ডাল ছিল, বেগুন ভাজা ছিল, শুকনো করে ডিমের ঝাল। শেষ গ্রাসটা মুখে তুলে হাত চাটছি, মনের মধ্যে কে যেন বলছে, এই শান্তি করে বসে খাওয়ার থেকে আরাম কি আর কিছুতে আছে? এসবের কি সত্যিই খুব দরকার আছে? ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও।
আমি সে স্বর অগ্রাহ্য করে নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, এত মার খেলাম, এত অপমানিত হলাম, এর কোনো দাম নেই?
ঘরে এসে শাড়ি বের করলাম। শায়া ব্লাউজ পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজছি। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বারবার নিজের চোখের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। তাতে কি যে একটা অনুভূতি হচ্ছিল, তা বলা খুব মুশকিল। তা সুখের না, দুঃখেরও না। হীনমন্যতার না, খুব উত্তেজনারও না। কি যেন বিষাদ। প্রিয় জিনিস হারিয়ে ফেলার কষ্ট! কি হারিয়ে ফেললাম আমি? কি খুঁজছি আমি? নিজের সাথে আর যুদ্ধ না করতে পেরে আমি বসে পড়লাম। নিজে থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে এল। ভাবলাম, না আমাকে এখন নিজেকে শক্ত করতে হবে। আমি কিছুতেই এত মার খাওয়ার পর চুপ করে বসে থাকতে পারব না। আবার ভেতর থেকে আওয়াজ পেলাম, তুমি মার খাওয়ার পরও ওর কাছে, ওর বাড়িতে পড়ে ছিলে কেন? কিসের লোভে? তুমি তো সমাজের আর সকল গৃহবধূদের মত নও যে স্বামীর ওপর সকল দিক থেকে, বিশেষত অর্থনৈতিক দিক থেকে, নির্ভরশীল। তুমি স্বাধীন। আর শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, সকল দিক থেকে স্বাধীন। তবু কিসের প্রত্যাশী হয়ে তুমি পড়েছিলে কুনালের কাছে?
আমি বললাম, আমি যে ভালোবাসতাম কুনালকে।
সেই আওয়াজটা, যে আমার ভেতরের এক অলৌকিক খাদ থেকে উঠে আসছিল, হেসে উঠলো। যেন মা। বলল, এসব বাজে কথা। ভালোবাসলেই যে সমস্ত অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করতে নেই, করতে হয়না, এ কি তুমি জানতে না?
আমি নিশ্চুপ রইলাম।
সেই স্বরটি বলে চলল, তোমার আসল সমস্যা কুনাল নয়। তোমার আসল সমস্যা তুমি যে ভীতু, এটা তুমি মেনে নিতে পারছ না।
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, না, এ সত্য নয়। আমি মেনে নিতে পারছি তো। পারছি। পারছি বলেই তো, আজ আমি সাহস সঞ্চয় করে এতদূর এসেছি। এবার যে বদলা নেবো!
প্রত্যুত্তর ভেসে এল, আর তা করার জন্য তোমাকে নিজের চরিত্রেই অভিনয় করতে হচ্ছে! তুমি কি বুঝতে পারছ না এর অর্থ?
কি অর্থ এর?
এর অর্থ তুমি মানুষটা এমন নও। নিজেকে বদলিয়ো না। কুনালকে শাস্তি দিতে গিয়ে তুমি কুনালের মত হয়ে যেও না। তুমি, তুমি প্রথমা চৌধুরী, তুমি চারবারের জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী, তোমাকে শান্তি কিনতে এত কসরত করতে হবে কেন? আর এত কসরত তুমি কিসের জন্যেই বা করছ? এতদিন ধরে এত মার খেয়েছ, সেটা প্রমাণ করবে বলে আবার আজ মার খেতে যাবে? আর এতেই কি তুমি রেহাই পাবে ভেবেছ? হাসপাতালের রেস্ট শেষ হলে, কোর্ট কাছারির ঝামেলা শুরু! যে শান্তি তুমি পেতে চাও, সেই শান্তি যে তোমার থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে! শান্তি তো বাইরে নেই, কর্মহীনতাতেও নেই, শান্তি তো মনের এক অবস্থামাত্র…
তাহলে কি অন্যায় মুখ বুঝে মেনে নেবো?
তুমি তো ইতোমধ্যেই নিয়েছ।
আগে বলিনি বলে কি এখনও বলব না!
বলো। কিন্তু তুমি তো শুধু ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে আটকে থাকতে চাইছ না … তুমি তো কুনালকে অ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার কেসে ফাঁসাতে চাইছ! তাই না? অন্যায়ের বিচার চাওয়া আর প্রতিহিংসায় মত্ত হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে – এ’কথা তো তোমার অজানা নয়।
হ্যাঁ, তো? ও আমাকে বিনা কারণে…
ওর ইন্সিকিউরিটি ছিল, তোমার কিসের ইন্সিকিউরিটি?
আমি নিরুত্তর হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে। নিজের শরীরের অস্তিত্ব যখন আবারও অনুভব করতে শুরু করেছি, দেখলাম, আমার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। আমি শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, তবে আমি কি করব এখন?
যদি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেস দিয়ে শান্তি পাও তো দাও, আর নয়ত ছেড়ে দাও… ডিভোর্স কেস ফাইল করে বেরিয়ে এসো সম্পর্ক থেকে। তারপর নিজের মত বাঁচো নিজের জীবন… আর কি! তারপর ছুটিতে যাও। রেস্ট নাও। এঞ্জয় করো…
কিন্তু এখন সায়ক… মহুয়া দি… এরা? এরা যে আমাকে দুর্বল ভাববে!
সে এক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, তুমি প্রথমা চৌধুরী! চারবারের জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী…
আমি মহুয়া দি’কে ফোন করলাম। ফোন করে বললাম আমরা যা প্ল্যান করেছিলাম তার আর প্রয়োজন নেই। আমি আর হাঙ্গামা চাই না। আমি ডিভোর্স কেস ফাইল করব। আশা করছি ডিভোর্স দিতে কুনাল কোনো সমস্যা করবে না। মহুয়া দি কি একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, প্লিজ মহুয়া দি, এই ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না। তুমি একটু পায়েলকে জানিয়ে দাও। আমি সায়ককে জানিয়ে দিচ্ছি।
সায়ককে ফোন করলাম। তুলেই খুব উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, রেডি? ও আগের থেকে আমার সাথে অনেক সড়গড় হয়েছে। আমি হেসে বললাম, একটা কথা বলব? তুমি কি আমায় জাজ করবে? সায়ক ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বলল, কি যে বলেন ম্যাম!
আমি প্ল্যানটা এক্সিকিউট করছি না!
ও… ও একটু অবাক হয়েছে বুঝলাম। ও কোনো কথা বলার আগেই বললাম, বাড়িতে তুমি?
হ্যাঁ ম্যাম!
মা আছেন?
হ্যাঁ!
দাও ফোনটা! একদিন কথা বলব বলেছিলাম!
শুভ’র ছবির শ্যুটিং শেষ হয়েছে এই দু’দিন হল। আমি কাল কলকাতায় ফিরে যাবো। শুভ খুব ভালো ডিরেক্টর। ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে ওকে তুলে আনতে দিলীপবাবু যে ভালোই হোমওয়ার্ক করেছেন, বুঝলাম। ও ভালোই কাজ শিখে এসেছে। ছবিতে কি করতে চায়, কি দেখাতে চায়, একদম স্বচ্ছ ধারনা আছে ওর। মাথায় যেন পুরোটা ছকা। এই ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার পাবে কিনা, সে তো বলতে পারবো না, তবে উজ্জ্বল ভবিষ্যত। অন্তত এতদিন এই প্রফেশনে থেকে আমার তো তাই ধারনা।
ও আরেকটা কথা! জাস্ট আগে একবার মেনশন করেছিলাম বলে বলছি, শুভ ডিরেক্টর হিসাবে যেমন ভালো, বিছানাতেও তেমনই।