তুমি দুঃখীর ডন একটি তীব্র বিনির্মাণ <br />  সব্যসাচী মজুমদার

তুমি দুঃখীর ডন একটি তীব্র বিনির্মাণ
সব্যসাচী মজুমদার

তুমি দুঃখীর ডন : বিভাস রায়চৌধুরী : কবিতা আশ্রম : দাম — ২০০ টাকা : প্রচ্ছদ - চিত্রসেন : কবিতা আশ্রম

বিভাস রায়চৌধুরী তাঁর সাম্প্রতিকতম কাব্যটির নাম রেখেছেন ‘তুমি দুঃখীর ডন’ । নামাঙ্কনের ক্ষেত্রে ‘ডন’ শব্দটিকে ব্যবহার করে অবশ্যই তথাকথিত অ-কাব্যিক চিহ্ন হিসেবে পরিচিত একটি পরিস্থিতিকে কবিতার অঙ্গ করে তুলতে চাইলেন। এই বপন কতটা যাথার্থ্য পেয়েছে এ কাব্যে— তা অবশ্যই আলোচনার লক্ষ নয়। লক্ষ হল এই ‘ডন’ শব্দ এই আলোচকের অবস্থানকে কিভাবে স্পর্শ করল।

‘ডন’ শব্দটি বলিউডের কারণে পরিচিতি পেলেও শব্দটির একটি সামাজিক জায়মানতা তো ছিল অবশ্যই। কি সেই জায়মানতা ? না, একজন মানুষ, যে শারীরিক এবং সামাজিক শক্তির অধিকারী। সে ক্ষমতার জোরে প্রভূত অবিশ্বাসকে বাস্তব করে তুলতে পারে। এই পারাটা কখনও কার‌ওর পক্ষে মঙ্গল জনক, কেউ বা অমঙ্গল পায়। কিন্তু তিনি ক্ষমতাশালী একজন মানুষ। যিনি তাঁর পরিস্থিতির ভেতর একটু উজ্জ্বলতা পেয়েছেন।

এই শব্দটিকে নির্ভর করে বিভাস তাঁর এই কাব্যটিকে চারটি ভাগে বিন্যস্ত করেছেন — ‘প্রথম গুলির পর মনে পড়ে ডন ভালবেসেছিল’, ‘দ্বিতীয় গুলির পর কলোনির শাক’, মা – মা গন্ধ’, ‘ডনের অপ্রকাশিত চিরকুট, ডনের মৃত্যু নেই…’ ‘তৃতীয় গুলির সময়/ তার হাতের মুঠোয় এই চারটি কবিতা ছিল।’ চিত্রনাট্যের মতো গ্রন্থটি বিভাজিত হয়েছে। অভিনবত্বের প্রসঙ্গে না প্রবেশ করলেও একথা বলে রাখাই যায় প্রতিটি স্তরে বিভাস বিষয়কে দেখতে চেয়েছেন বিবর্তিত পরিস্থিতি ও মাত্রায়।

প্রথম পর্বে দর্শন বলব না, বলতে চাইব টপিক্যালিটিকে অতিক্রম করে ছোট ছোট কবিতায় মীড়ের কাজ করতে চেয়েছেন যেন। অক্ষরবৃত্তের নিপুণ সাংগীতিক ব্যবহারে বিভাস বস্তুত তাঁর সময় ও জায়মান পরিস্থিতিকে অন্তর্ভেদ করেন, ” জল থেকে ছায়া সরে যায়/ তোমার বিভ্রম যেন হরিণের গতি / মহাশূন্যে ছিপ ফেলে/ বসে থাকা যেন আমার নিয়তি”…( হরিণ, পৃঃ ১৩ ) এই সম্পূর্ণ কবিতায় আমরা যেমন ‘গতি’-র সঙ্গে ‘নিয়তি’র মিলের জন্য অপেক্ষমান ছিলাম, কিন্তু কবির অভিপ্রায় বোধহয় ছিল অন্যত্র। লক্ষ করা যাক, ‘ বিভ্রম ‘ -এর মতো শব্দের অভিঘাতকে বিভাস ন্যস্ত করলেন ‘ছিপ’ শব্দটির ওপরে। কেন বিভ্রম ও ছিপকেই ধরতে চাইছি ? আমরা সম্ভবত দেখতে পেয়েছি যে চূর্ণ কবিতাটি প্রথম ঘোষণা রাখল, বিশ্বাস রাখল, অবস্থান তৈরি করল এই ‘ বিভ্রম’ শব্দটিতেই। দ্বিতীয়টি অর্থাৎ অব্যবহিত পরবর্তী অবস্থানের অবকাশ তৈরি করছে নিঃসন্দেহে ‘ছিপ’-এ। মহাশূন্য নয়, নিয়তি নয় ‘ছিপ’-কেই মুখ্য ক্রিয়া করে তুলছেন। এবং লক্ষ করতে পারছি এটাও ‘বিভ্রম’ শব্দের তৎসম স্পন্দনকে কী অনায়াসে মিলিয়ে দিলেন ‘ছিপ’-এর লোকায়তিকে। এখানেই বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা পরিচিতি নির্মাণ করে বলেই মনে হয়, আদ্যন্ত।

তবে, ছোট কবিতাগুলির প্রথম পার্বিক বিন্যাস কিন্তু শেষ হচ্ছে একটি স্বীকারোক্তিমূলক দীর্ঘ কবিতায়। রচনাটিতে মুক্ত গদ্যে কবি লিখে রাখছেন তাঁর বিক্ষেপ, একজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন , ” আমি জানতাম মেয়েটিকে আমি কোন‌ওদিন পাব না/ আর সেটাই আমার আগ্রহের বিষয়/ নিজেকে ভেঙে জলরঙে মিশিয়ে দিতে দিতে আমিও টের পেলাম/ ভালবাসার জাদু…/ না – পাওয়ার ঐশ্বর্য…/ ভাষায় ডুব – ডুব পানকৌড়ি…”( কমলা রঙের বমি)।

দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশের আগে একটি কথা বলে রাখা ভাল, ‘বমি’ শব্দটি বিভাসের কবিতা বিশ্বের প্রথমাবধি একটি চিহ্ন হিসেবে আবর্তিত হয়েছে, ‘ নষ্ট প্রজন্মের ভাসান ‘ থেকেই হয়েছে, এ কাব্যেও। চিহ্নটি সম্পর্কে অবকাশে আলোচনা করা যাবে।

দ্বিতীয় পর্বে বিভাস একটি অদ্ভুত নির্মাণ করলেন। বাঙালদের জন্যে একসময় এ দেশের মানুষের পত্তন থেকে কচু – ঘেঁচু, শাক উধাও হয়ে যেত। উদ্বাস্তু, দেশছিন্ন, অর্থনীতির কাছে নতুন মাথাব্যথার এই মানুষগুলোর পুষ্টির একমাত্র নির্ভর ছিল এই অকিঞ্চিৎকর শাক- পাতা। সেই সারাবছর অকাতরে ভেজা, জলা জায়গাগুলোতে ফুটে ওঠা সেই শাকগুলোর নামকে ব্যবহার করলেন কবিতাগুলির শীর্ষে — শুষনি শাক, নিমপাতা, কলমি শাক, ব্রাহ্মী শাক, কচু শাক, থানকুনি – গ্যাঁদাল, গিমি শাক, আমরুল শাক, বেথো শাক ইত্যাদি। এবং প্রতিটি শাকের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন শ্রমজীবী পরিবারের, প্রান্তেবাসী পরিবারের একজন বালকের কিছু স্মৃতি। নিপুণ করুণ রস তৈরি হল তো বটেই এমনকি একটি সময়ের অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের একটি নথিচিত্র‌ও নির্মিত হয়, ” মা বলত, এ কোন হারামি / দেশ ভাঙল আমাদের? / এপারে কী পেলাম রে? কচু ? / হা রে কপাল আমার! / যা সে কচুশাক‌ই তুলে আন…/ মাছ নেই…ভাত নেই…সব খেয়ে নিয়েছে বর্ডার!”( কচু শাক, পৃঃ ২৯)। আরেকটু লক্ষ করতে অনুরোধ করব, ‘ আমার ‘ -এর সঙ্গে ‘ বর্ডার ‘-এর মিল দেওয়ার জন্য বিভাস কতটা দম ধরে রাখলেন, নিবৃত্ত করলেন, সংবরণ করলেন, নিরস্ত্র করে রাখলেন শব্দ সংযোজনাকে ! অক্ষরবৃত্ত শিক্ষার্থীদের কাছে একটি অবশ্য লক্ষনীয় কারু বলেই মনে হয়।

তবে, দেশভাগ বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতায় বারবার ফিরেছে— এ কথা যেমন মনে পড়ছে, তেমন‌ই এ কথাও সাব্যস্ত হচ্ছে যে, এই টপিক্যালিটিকে বারংবার কবিতায় পরিণত করার সামর্থ্য‌ও অর্জন করেছেন বিভাস।

তৃতীয় পর্বে বিষণ্নতা, শ্লেষ আর দার্শনিক বৈভব একত্র সম্মিলিত হয়। যাপনের সোচ্চার ও প্রান্তিক চিন্তাগুলো দার্শনিকতার বেশে পরিবেশিত হতে থাকে। ক্ষমতা, ক্ষমতা – পর্যবেক্ষণ এবং ক্ষমতার অভিঘাত তৈরি করে একটি স্পন্দিত জীবন-দর্শন, ” অনুত্থান জনিত অসুখ/ ক্ষমতার প্রায়শই হয় / ওকে মারলাম কিভাবে?/ সে অনেক গোপন অধ্যায়”(৭, পৃঃ ৪৫) কিংবা ” সবাই অবাক হয়ে দেখেছে অদূরে/ একটি লণ্ঠন আর মায়ের অসহ্য বমি / মা’র বমিমাখা মুখে/ লেগে আছে মরা প্রজাপতি “( ১৮, পৃঃ ৫৬)।

অপাচ্য দ্রব্য শরীরে অধিক হয়ে গেলে, তার বমনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে চায়। আবার খাদ্যের অভাব শরীরের পাচক রসগুলিকে বমির মাধ্যমে বের করে দিতে চায়। কেবল খাদ্যা – খাদ্যের কারণেই বমি ঘটে তাই নয়। মানসিক আঘাত, বিবমিষা, আপত্তিও বমির উদ্রেক করতে পারে। অনুমান করা যায়, বিভাসের কবিতা আবহমান একটি বিবমিষা বয়ে চলেছে ? রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি বিবমিষা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি বিবমিষা, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রতি বিবমিষা বমির অস্ত্রকে নির্মাণ করে। আত্মরক্ষা আর আক্রমণের যূথাচারে গড়ে ওঠে এই বমির মেটাফোর বলেই মনে হয়।

এই সূত্রেই তৃতীয় পর্বের উনিশ নম্বর কবিতাটিকে উল্লেখ না করলে এই আলোচনা অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যাবে বলে মনে হয়। বিভাসের কবিতার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল মানুষের জীবনের সঙ্গে অন্যান্য জীবনের সম্পর্ক গড়ে তোলা। একে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ বলে সরলীকরণ করা যাবে না। প্রকৃতি একটি বিরাট বিস্তার। এমনকি নেবুলা কিংবা ইউরেনাস‌ও মানুষের যাপিত প্রকৃতির অন্তর্গত, যার অনেকটাই মানুষের ধারণার বাইরে। তাই একে এক ধরণের মৃত্যুশীল প্রাণের সঙ্গে আরেক রকমের মৃত্যুশীল প্রাণের সম্পর্ক নির্মাণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। কিংবা মানুষের অস্তিত্বের বাইরে দাঁড়িয়ে মানুষের অস্তিত্বকে ধারণা করা, “আমগাছে দোয়েল ডাকছে/ মানুষ শুনল মিষ্টি ডাক / ভাবল জীবন তার ভরে গেছে একেবারে/ পাখিটা হয়তো/ চিৎকার করে বলেছিল/ ডিম ভেঙে গেছে তার/ আবার পাখিও দেখে / হাসিমুখে একটা মানুষ/ তার দিকে চেয়ে আছে খুব…/ পাখি ভাবে লোকটার ডানা দুটো ভাঙা…/ইস আর উঠতে পারে না !”(১৯)

চতুর্থ পর্ব আদ্যন্ত এবং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক হয়ে উঠতে চায়। স্পষ্টত বিরুদ্ধে রাখতে চায় যাপিত ইতিবৃত্তকে। মানুষের অভ্যাসকে মনে করিয়ে দিতে চায় যে, আর‌ও একটি সমান্তরাল যাপনের কথা ভাবা সম্ভব, ” নিজের কথা কমাতে হবে/ নিজের কথা / ততদূর কমাতে হবে যাতে/ চোখ এক নির্জন আয়োজনে যেতে পারে”( বড় কথা, পৃঃ ৬৫)

তবে সংশয় তৈরি হয় দু’টি পঙক্তির ক্ষেত্রে, ” প্রকৃতির ইচ্ছেকে নয় ,/ মানুষ তার নিজের ইচ্ছেকে জেতাতে চায় ! জেতায়…”( প্রতিশোধ, পৃঃ ৬৪)। আদৌ কি মানুষের নিজের ইচ্ছে বলে কিছু হয়? মানুষ তো একধরণের বায়োকেমিক্যাল ফলাফল। সে যে গাছ কেটে ফেলতে চাইছে আবার সে যে গাছ লাগাতে চাইছে— দুটো উভমুখি মনস্তত্ত্ব‌ই জায়মান। এবং দুটো চিন্তাই তাকে দিয়েছে তথাকথিত প্রকৃতি বা বায়োকেমিক্যাল প্রতিক্রিয়া। মানুষ তো বিবর্তিত প্রকৃতির মধ্যে একটি অস্তিত্ব মাত্র। সে কেবল তার নিজের প্রয়োজনীয় আবহাওয়ার বিবর্তনকে কিংবা বলা নিরাপদ — আবহাওয়ার আবর্তনকে তরান্বিত করে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। এবং সেই ভূমিকা পালনের প্ররোচনা তো তথাকথিত প্রকৃতিই মানুষকে দিয়েছে।

এবার চতুর্থ পর্বের আলোচনার শুরুতে ব্যবহৃত ‘রাজনৈতিক’ শব্দটির প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে আসা যাক। মানুষ ঠিক সেই চলনটিকেই বেছে নেয়, যার ফলে সে আর তার অভ্যস্ত প্রতিবেশ ভাল থাকতে পারে। সে পারাটা অপরের কাছে মঙ্গলের নাও হতে পারে। অন্য অনেকের কাছে। কিন্তু, তবুও এই বেঁচে থাকার সামাজিক চলন হিসেবে এক একজন মানুষ তার সমানুভবির সঙ্গে মিশে আলাদা আলাদা দল বা ভাল থাকার সার্থ গড়ে তুলবে। মনে হয় এটাই তার রাজনীতি। কবিও ঠিক এই সহজ অবস্থাকেই নির্ণয় করে নিতে চেয়েছেন। স্পষ্ট এবং ঋজুভাবে পক্ষ নিয়েছেন, পক্ষ নিয়েছেন প্রান্তিক মানুষের ভাল থাকার শর্তে। প্রান্তের কেন্দ্রকেও অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছেন সীমান্তের দিকে, সীমান্ত অতিক্রম করে ছুঁতে চেয়েছেন আরেকটি প্রান্তবর্গকে, ” তুমি ভাল আছ ? জিজ্ঞেস করতে চাই না তোমাকে,/ শুধু চাই লুট করে পাওয়া ভাল – থাকা ফেলে / ছুটে এস দ্রুত…/ পাগল ঘুমিয়ে আছে গাছতলায়, সেখানে ঝাঁপাও…/ আর দেখো ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ছে জলাধার…/ জল জল জল জল…/ যার জল তার কাছে ফিরে যাচ্ছে আবার আবার…”( প্রতিশোধ, পৃঃ ৬৩)

এই কাব্য আমাদের সমসময়ের একটি ঘনিষ্ঠ মনোলগ। অন্তত আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ মানুষ যেভাবে বাঁচতে পছন্দ করছেন, তার সমান্তরাল আরেকটি বেঁচে থাকার সন্ধান দিতে চায়। এমন একটি বিকল্প জায়মানতা, যে হয়তো আর‌ও কিছুকাল মানুষের পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে প্রলম্বিত করবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অনুপ্রাস ধীরে এ কাব্যে উন্নিত হয় লোক দার্শনিকতায়। যার ভেতরে রয়ে গেছে কিছু মায়া আর অনেকটা অভিভাবকত্ব।

এ কাব্য গ্রন্থ একটি জরুরি পাঠ হয়ে উঠেছে বিভাস রায়চৌধুরীর তীব্র সহৃদয়তায়।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes