
জলছবির কথারা
মৌসুমী রায় চৌধুরী
জিনিয়াদের বিল্ডিংটা দশতলা। ও থাকে তিনতলায়। আমি ঘাড় উঁচু করে একবার দেখার চেষ্টা করলাম পুরোটা। তবে ভালোভাবে দেখতে গেলে আমাকে ওই ফুটে যেতে হবে। দারোয়ানটার নাম যেন কি বলেছিলো ও!শম্ভু হ্যাঁ ওটাই।
আমি এগিয়ে গিয়ে ওনাকে ডাকলাম।
অপরিচিত কারো মুখে নিজের নাম শুনে ওনার ভ্রু কুঁচকে গেলো।উনি তাকিয়েছেন দেখে আমিও একগাল হেসে দিলাম।আমি চমকে দিতে খুব ভালো বাসি।
জিনিয়া তখনি ওপর থেকে মুখ বাড়ালো। শম্ভুকাকাকে বললো,
-ও আমার বন্ধু শম্ভুকাকা ওকে আসতে দাও।
এবার শম্ভুকাকা হাসলেন। হাসলে ওনার মাড়ি সুদ্দু দেখা যায়।যে কেউ একবার তাকালে আর দেখতে চাইবেনা।
শম্ভুকাকা আবার একবার আমার দিকে দেখলেন। এবার তবে ভ্রু টা একটু বেশিই কুঁচকালো।
স্বাভাবিক!’ পেহেলে দর্শনদারি ফির গুন বিচারী’…… পিঠের ব্যাগটা ভাগ্গিস আনিনি আজ। ওটা র আয়ু তো কম নয়। ক্ষত ঢাকতে মায়ের হাতের নিপুন সব কারুকার্য একসাথে লেগে পড়েছে কাজে। মলি মাসি সোনাঝুরির হাট থেকে এই ব্যাগটা মা কে এনে দিয়েছিলো। ওটাই নিয়ে এসেছি।
শম্ভুকাকা সব দেখে শুনে কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন।
এসব জায়গার দারোয়ানদেরও স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে হয়।
এগিয়ে গেলাম ভেতরে। বহুতল আবাসন। পার্কিং লট তো থাকবেই। সেটা ক্রস করে মেইন গেটের সামনে গেলাম। ওখান দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে লিফটের দরজা।
লিফট চড়তে খুব ভালো লাগে আমার।
আমি উঠে আগে দশ টিপলাম। লিফটটা উর্দ্ধমুখী হয়ে চলতে চলতে থামলো দশতলায়। লিফটের ডানদিকে একটা ফ্ল্যাট বাঁদিকে করিডোর ধরে এগোলে মুখোমুখি দুটো দুটো করে মোট চারটে। এবার একটু সিঁড়ি টপকালেই ছাদ। আমি সিঁড়িতে উঠলাম না। এসময় ওখানে লোকজন থাকার সম্ভাবনা কম।
আমি ভিড় এড়িয়ে চলি অনেকদিন হলো।তবুও নির্জনতা আমার একান্ত আপন এখনো হতে পারেনি।
আমি আবার লিফটে উঠলাম। জিনিয়াদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার ইচ্ছে হলোনা। মনে হলো আরেকটু ওঠানামা করলে ভালো হোতো। কিন্তু থাক। আরেকটু পরেই পৌলমীর আইবুড়োভাত। আসলে বন্ধুরা মিলে ওকে আইবুড়োভাত খাওয়াচ্ছে। সবাই বলেছিলো বড় রেস্টুরেন্ট এর কথা। জিনিয়া বারণ করেছে। ও বলেছিলো নিজেরা রান্না করবে। ও যে আমার কথা ভেবেই রেস্টুরেন্ট এর ব্যাপারটায় নাকচ করেছে আমি জানি। ও আমার সবকিছু আগ কীভাবে যেন বাড়িয়ে বুঝে ফেলে!
আমি এদের মধ্যে খুব একটা কথা বলিনা। সব জায়গায় সবার কথা বলতে নেই। ওরা আমার সমবয়সী হলেও চিন্তাধারায় অনেক উচ্চ।
আসলে জিনিয়া আমার বেস্টফ্রেন্ড। এই ফ্রেন্ড সার্কেল ওর। আমাকে ও জোর করে ঢুকিয়েছে। আমি ওর কথা ফেলতে পারিনা। এদের মধ্যেও আমার দুটো ভালো বন্ধু আছে তৃষা আর সুপ্রতিম।
ওরা খুব ভালো। জিনিয়ার মতো। কথায় কথায় পয়সার গরম দেখায়না।
লিফট তিনতলায় থামলো। জিনিয়া ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রেখেছে। আমার জন্য!ভেতরে ভেতরে গুমোট ভাবটা কাটবে কাটবে করছে।মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাট।দুটোই ওদের।জিনিয়ার বাবা বাড়িতে আছেন। তাই অন্যটার দরজা বন্ধ।
একটু অস্বস্তি হলো। জিনিয়া শাড়ি পড়েছে দেখলাম। খুব সুন্দর একটা সিল্ক। আমি এই সাদা কুর্তি টা পাক্কা আড়াইশো টাকায় কিনেছিলাম ধর্মতলা থেকে।তাই কি দরদাম করে!মা বলে আমাকে এটা পড়লে ভালো লাগে।
দরজার সামনে সাজি দাঁড়িয়ে। দেখেই কেমন নাক কোঁচকালো। আমি হাসলাম। ও দরজা ছেড়ে ভেতরে গেলো।জুতো খুলে ঢুকে দেখি জিনিয়া রান্নাঘরে চেঁচামিচি করছে। নিজেরা রান্না করবে বলে ওদের বাড়ির রান্নার লোকটাকে পাকড়াও করেছে।
আমার তেমন কিছুই দায় নেই। খালি নিমন্ত্রণ খেতে আসা।
ও বেরিয়ে এলো। ওকে কি যে সুন্দর লাগছে!চশমা নেই চোখে।লেন্স পড়েছে। একদম লাইট মেকআপ করেছে। আমি ছেলে হলে প্রেমে পড়ে যেতাম কি?
আমাকে দেখে ও একগাল হাসলো। তারপর কাছে এসে বললো,
– শাড়ি পড়লিনা কেনো?
-টিউশন পড়িয়ে এলাম।
-আজ রবিবার।
-তাইতো দুপুরে টিউশন।
জিনিয়া ঠোঁট চেপে খানিক হতাশ হলো।
তারপর আমাকে টেনে নিয়ে গেলো একটা রুমে যেখানে ওরা সবাই শুয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।
তৃষা এসে জড়িয়ে ধরলো নিঃসংকোচে। আমিও তাই করলাম। সুপ্রতিম একগাল হেসে বললো,
-কীরে ডুমুরের ফুল!
আমি হাসলাম। ছেলেটা এদের মধ্যে সবথেকে ভালো। আরেকজনও এই খাতায় নাম লেখাতে পারতো কিন্তু আমার কাছে তার অকারণে নম্বর কাটা গেছে।
সুপ্রতিম তখনো আমার দিকে চেয়ে।
-লাস্ট কবে দেখা হয়েছে তোর সাথে বলতো?
কবে হয়েছিল? সত্যি বলতে আমারো মনে পড়লো না। আমি এরকম অভিযোগে অভ্যস্ত। হঠাৎ হঠাৎ উবে যাওয়া আমার স্বভাব।
-কেমন আছিস?
এতক্ষনে মুখ খুলে নিজেকে একটু হালকা করতে চাইলাম। এমন সাদামাটাভাবে এসে সবার মধ্যমণি হওয়ার ইচ্ছে আমার ছিলোনা।
সুপ্রতিম এবার উঠে বসে বললো,
-চলছে বিন্দাস!
তৃষা হাত ধরে টেনে বসালো সোফায়।আমি বসে চারিদিক দেখতে লাগলাম। অনেক পরিপাটি গোছানো। জিনিয়া একবার বলেছিলো ওর এন্টিক প্রীতির কথা। এখানে এসে মনে হলো একদম সত্যিই বলেছে।
আসলে, জিনিয়ার সাথে আমার আলাপটা একটু ড্রামাটিক বলা চলে!এখনো ওকে দেখলেই আমার
সেই সন্ধ্যেটার কথা মনে পড়ে……
এখন সেই গল্প শুরুর আগে একটু ভনিতা না করলেই নয়।
তখন আমি কলেজে। সেকেন্ড ইয়ার চলছে। হিস্ট্রি আমার পছন্দের সাবজেক্ট। বাবাকে বলতেই বাবাও সায় দিয়ে ওই সাবজেক্টেই অনার্স স্ট্রিমে ভর্তি করালো। স্টুডেন্ট হিসেবে আমি ছিলাম মিডিওকার।
কিন্তু ইতিহাসে ছিলাম বরাবরই প্রথম। কলেজে গেলে মানুষের নাকি ডানা গজায়!কিন্তু প্রথম বছর কাটার পরেও যখন পিঠের দুদিক ফাঁকা থেকে গেলো, আমি নিজে থেকেই ব্যাপারটায় মনোযোগী এবং উদ্যোগী হলাম। সিরিয়াস মার্কা মারা স্টুডেন্টরাও যখন আমার সামনে দিয়ে ক্লাস বাঙ্ক করে টোনা টুনির সাথে সিনেমা হলের চক্কর কাটতে শুরু করলো, ব্যাপারটা আমার একদম ইগোয় লেগে গেলো। তারপর আর কী!যা হয়। নতুন প্রেম। ঝাক্কাস ফোনালাপ।ছেলেটা ছিল আমার ডিপার্টমেন্টাল সিনিয়র।নামটা অর্নিশ, অর্নিশ কাটারি। এইরকম মারকাটারি টাইটেলের জন্য আমি তাকেই সুযোগ দিলাম। ‘তাকেই’ বলছি কারণ লাইনে আরো একজন ছিল। ওর নাম মনে নেই। মুখ টাও না। তবে ওকে সবাই ‘হ্যান্ডু ’ নাম দিয়েছিলো। ওর হ্যান্ডুগিরির ফান্ডা খতম করেছিল যে মেয়েটা সে হলো আমাদের সাজি।
তো একদিন হলো কী……
ভালোবাসার মরশুমের মতো তখন কলেজ জুড়ে ব্রেক আপের মরশুম চলছে। কারণ কিছু ছিলোনা, বা থেকে থাকলেও অলৌকিক অথবা নিছকই কাকতালীয়। অর্নিশ ছিল ভীতু প্রকৃতির প্রাণী। ওকে সুযোগ দেওয়ার এটা অন্যতম কারণ। আমাকে ভয় পাওয়া উচিৎ ছিল ওর। সবসময় নয় কিন্তু কিছু সিরিয়াস বিষয়ে।
একদিন বৃষ্টি ভেজার খুব শখ হলো। এমন শখ খুব যে হয় সেটা নয়, তবে অর্নিশ ছিল বলেই কি জানিনা সেদিন আমার ভেজার জন্য অকারণেই একটা কারণ জন্মালো।
কলেজ মোড়ের রাস্তাটা পেরিয়েই একটা নির্জন গলি পড়ে। আজীবন নির্জন নয়, গলিটা এমনিতে ক্রিকেট পিচ হিসেবে ব্যবহার করে পাড়ার ছেলেপুলেরা। মাঝে মাঝে ওদের দয়া হলে লোকজন যেতে আসতে দেয় আর কি!
গলিটা সরু লম্বা। দুদিকে পুরোনো আমলের বাড়িগুলো জীর্ণ শরীর নিয়েও বীর দর্পে দাঁড়িয়ে।প্যালেস্তারা খসে গিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে রয়েছে যেন!
আমরা দুজনেই আয়োজন করে ভিজছিলাম না। শুধু ছাতাটা হাতে নিইনি। আর একটা জিনিস ছিল লক্ষণীয় সেদিন আমরা দুজনেই ছিলাম নীরব। আমি চুপচাপ ছিলাম কারণ আমার ভালো লাগছিলো ওভাবেই। কিন্তু স্পর্শ না করেও আমি অর্নিশের টালমাটাল অনুভূতির ঢেউ গুনতে পারছিলাম সহজেই। ওর নীরবতা যে কি বিশাল এক আর্তনাদ হয়ে আমার খামখেয়ালিপনার দোরগোড়ায় আঘাত হেনে যাচ্ছিলো, সেটা আমার বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।
গলির এমাথা থেকে ওমাথা দেখা যায় না। আরেকটু এগিয়ে একটা বাঁক আছে। ওখানে মাঝেমধ্যেই এক্সিডেন্ট হয়।এই রাস্তার অবস্থা ভালো না বলে বাইকও আসেনা খুব একটা।সেদিন তো আরোই ছিলোনা। অর্নিশ সন্তর্পনে আমার হাতটা দখল করে নিলো। নতুন কিছু ছিলোনা। প্রেমের দুদিন বাদে আমি নিজেই ওর হাত ধরেছিলাম, যদিও ওই হ্যান্ডু কে দেখিয়ে।
আমি কিছু বললামনা। কিছুক্ষন পর হাতের ওপর চাপ বাড়লো এবং তা আরো গাঢ় হলো। ওর গাঢ়ত্ব মাপার আগেই এক হ্যাঁচকা টানে ও আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। ওর চশমাহীন চোখের দিকে চেয়ে আমি ঢোক গিললাম।অতঃপর প্রথম অনুভূতি!কিন্তু আমার রেসপন্স না পেয়ে অর্নিশ জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো। বৃষ্টি কমে এসেছে। গলির মধ্যে বিকেলের সময়ও হঠাৎই যেন সন্ধ্যে নেমে এলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায় আমি ঠিকঠিক ঠাওর করতে পারলাম না ওর চোখের ভাষা। ও আবারো এগোলে আমার কী হয়ে গেলো জানিনা ঠাঁটিয়ে চড় মারলাম। একটা নয়, পরপর দু গালে দুটো।
রাগে মানুষের বোধবুদ্ধি ঘোলাটে হয়ে যায়। অর্নিশ সেই মুহূর্তে আমার কোমর চেপে জোর করে…..
ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষনে মামাতো বোনের অসাধারণ সেলফ ডিফেন্স টেকনিক মনে করে মেইন পয়েন্ট বরাবর দিলাম ঝেড়ে এক লাথি!সে লাথির পরিসর এতই বড় ছিল যে পাক্কা এক সপ্তাহ ওকে কলেজ চত্বরে আর দেখা গেলোনা।
কেটে গেলো আরো এক মাস। বান্ধবীদের সামনে মেকি দুঃখ দেখালাম। জানালাম, ব্রেকাপ মরশুমে আমিও সর্দিজ্বর বাঁধিয়ে বসে আছি। ওরা হা হুতাশ করলো তবে সামনে, পেছনে সেকি খিল্লি!
এসব ছেড়ে টিউশনি ধরলাম। মোদ্দা কথা, কলেজে পড়াটাকে ঠিকঠাক ইউটিলাইজ করা চাই।
একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরছি।সেই একি গলি। রাত ৮টা হবে।হঠাৎ একটা শাকচুন্নি মতন কেউ ঘাড় চেপে ধরলো। আমি ছোটো থেকে হাউমাও করে লোককেই ভয় দেখিয়ে এসেছি। সেদিন যে কী হলো!আমি ভয়ে পড়ে ‘বলো হরি, হরি বোল ‘বলে চিৎকার করতে শুরু করলাম।
আমি জানতাম শাকচুন্নি লোকের বাড়ি থেকে শাক চুরি করে খায়, জাতে ভূত তালে চোর গোছের!কিন্তু ওর হাতে ফল কাটার ছুরি দেখে আমার ভয় উবে গেলো। আমি তখন একেবারে গুম মেরে গেলাম। আসলে ভাবছিলাম, কোন ডিফেন্স টেকনিক কাজে লাগাবো। মামাতো বোন তো ছেলেদের বিরুদ্ধে লড়তে শিখিয়েছে। এতো মনে হচ্ছে অতীব পরী জাতীয় শিক্ষিতা রমণী। গায়ের পারফিউম তাই বলে।দামী বিদেশী পারফিউম। এসব গন্ধ শুঁকলে ফুসফুসের দাম বেড়ে যায়!
কানের কাছে অনবরত হিস্ হিস্ শব্দ হচ্ছে।আমি ছুরির দিকে একবার তাকিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,
-এই তুমি কি স্বেচ্ছাধারী নাগিন?তাহলে জিভের বদলে ছুরি কেন?
অন্ধকারে মুখটা বোঝা গেলোনা। কিন্তু ছুরিটা নেমে গেলো গলা থেকে। মন খারাপ করলো!
এরই মধ্যে একটা বাইক উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসছিলো। আমি সুযোগ কাজে লাগাতে যাবো, ঠিক তখনি ওর মুখে হেডলাইটের আলো পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। ওরে সাব্বাস!এই মেয়ে এখানে কী করে?
আমি হে হে করে হেসে বললাম,
-রং নাম্বার!রং নাম্বার!আপনি যার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছেন সে আমি নই। এজন্য আমি ভীষণভাবে….
-এই চোপ!অসহ্য মেয়ে তো তুমি! কোথায় ভয় পাবে, আমার পায়ে পড়বে আশ্চর্য!রিডিকিউলাস!
-যা ছাতা!আরে তুমি যে পায়ে জুতো না পড়ে মানুষ পড়তে ভালোবাসো আগে বলবা না!
আমি একবার দেখেছি একে আমাদের ক্যাম্পাসে। মেয়েটা দারুন সুন্দরী! মনে হচ্ছে রেগে গিয়ে আবারো নাক মুখ লাল করে ফেলেছে…. আগেরবার তো আমাকে দূর থেকেই ভস্ম করে দিচ্ছিলো।
মেয়েটা আচমকা শান্ত হয়ে গেলো। অতি পরিচিত দৃশ্য!সামনে যখন আমি এমনটা হওয়াই উচিৎ।কিছুক্ষন চুপ থেকে ও ই বললো,
-ওদিকে চলো।কথা আছে…এখানে বড্ডো অন্ধকার!
আমি আবারো খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলাম।
-এহহ!অন্ধকারে দু মিনিট দাঁড়াতে পারেনা, আইছে আমার কিডন্যাপার!
মেয়েটা এবারও কিছু বললো না। ওকে অনুসরণ করে বড় রাস্তার ওপর একটা ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে ঢুকলাম।
যেদিকে গেলাম ওদিকটা একটু ফাঁকা শুধু একটা টেবিলে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে।আমরাও গিয়ে ওদের পাশে বসলাম।
আমি অধৈর্য হচ্ছিলাম। বাড়ি ফিরতে হবে। এদের মধ্যে জিনিয়াকে ছাড়া আমি কাউকেই আগে দেখিনি।
জিনিয়াই প্রথম মুখ খুললো,
-অর্নিশকে তুমি ছেড়ে দাও।
আমি হতবাক! বললাম,
-সেই কবেই দিয়েছি। তাছাড়া আমি ছেড়ে না দিলে তুমি ওর হাত বগলদাবা করে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে কী করে? হ্যাঁ? বলো বলো….
জিনিয়া হতাশা মিশ্রিত স্বরে বললো,
-ভালোভাবে দেখলেই বুঝতে ওর হাতটা আরেকটু হলেই ছিঁড়ে চলে আসতো।
-তো অমন করে ধরারই বা দরকার কী? আজীব!
-ও তোমাকে দেখানোর জন্য আমাকে ইউজ করেছে। জাস্ট টু ফীল ইউ জেলাস!
-জেলাস!আমিইইই? এরে এই ছাগলকে নিয়ে কে জেলাস হবে? আমি আমি…এই তুমি জানো সেদিন জোর করে ও আমাকে….
এতক্ষনে আমার খেয়াল হলো বাকিরা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমি সংযত হলাম। বললাম,
-সে…সে যাই হোক….. আমি ওকে কোনোদিনই ধরিনি।
-ধরোনি? প্রেম করোনি?
-ধের!ওটাকে প্রেম বলে? তোমরাই বলো, নাকের ওপর চোদ্দবার চশমাই তুলে গেলো দু মাস ধরে আর তাছাড়া…তাছাড়া, ওকে দেখে আমার প্রেম পায়নি কখনোই!
যে একটা ছেলে বসেছিল ওই টেবিলে সে আচমকা হোহো করে হেসে উঠলো। আমি বিব্রত হলাম। জিনিয়া আবারো হতাশ হলো!
-ও ফিরতে চায়…তুমি কি ফেরাবে?
-আমি বলি হ্যাঁ, আর গলায় আড়াই প্যাঁচ খেয়ে পচা ডোবায় পড়ে থাকি বলো? বলো বলো…থামলে কেন?
বলছিনা ওকে আমি ধত্যবেই ফেলিনা।
-ওকে ওকে কুল ডাউন! কুল ডাউন!
এতক্ষনে পুরুষ কণ্ঠের সাড়া পেলাম।আমার কেন জানি ভেতরে ঝড় উঠলো। আমি চেয়েও থামাতে পারছিলাম না। এতো নতুন!আমার ভয় হলো। এই ঝড়ের আঁচ ঘুনাক্ষরেও যেন বাইরে না আসে!
আমি তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়লাম। বললাম,
-ক্ষ্যামা দে মা!আমি বাড়ি যাই? মা এতক্ষনে ঝাঁটা নিয়ে মোড়ের মাথায় এসে গেছে। এখানে এসে গেলে তোমরাও আমার সাথে ফ্রী সার্ভিস পাবে। যাই হ্যাঁ?
জিনিয়া সেদিন আমায় আর আটকায়নি। অর্নিশের ইয়ার ফাইনাল হয়ে গেলে আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। বাপরে!কোথাও বাদ রাখেনি। লাইব্রেরি, কলেজ গেট, ফুচকার দোকান সবেতে ওর পিছু করা চাইই চাই। ও চলে গেলো। একদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল। বলেছিলো,
-আমি কলকাতাতেই থাকছি। মরে তো যাচ্ছিনা। দেখবো তুমি কতদূর যাও!
আমি একগাল হেসে বলেছিলাম,
-গো এহেড মিঃ মারকাটারি!এই শর্মা আপনার জন্য নয়। ইউ ডিজার্ভ বেটার অর্নিশ। জিনিয়া তোমায় ভালোবাসে।
-আর তুমি?
-আমি কাউকে ভালোবাসলে তাকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নই অর্নিশ। যেটা আমার সেটা আমারই!
তারপর থেকে ইতিউতি আমি জিনিয়ার সাথে ঘুরতে যেতাম। কখনো প্রিন্সেপ ঘাট তো কখনো ময়দানের ঘোড়ার গাড়ি। এভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে লাগলো। বেশিরভাগ এফোর্ট টাই ওর।কখনো সখনো সাথে তৃষা, সুপ্রতিমরাও থাকতো। আরো একজন থাকতো…
-এই যে, এনাও ধরো জিনিয়া পাঠালো।কেন যে আমাকেই পায়…
সাজির হাতে ফিশ ফ্রাইয়ের প্লেট। ও দায়সারাভাবে ধরে আছে। আমি হাতে নিলাম। খেলাম না। টি টেবিলে রেখে ওকে বললাম,
-কেমন আছো? সব ঠিকঠাক…
সাজি দাঁতে দাঁত পিষলো। মেয়েটা আমাকে একদমই নিতে পারেনা।
-ভালোই থাকার কথা ছিল। তুমি এলে এবার দিন বেকার যাবে। জাস্ট ইরিটেটিং!
-আমি একটু অমনি…. সাজি? অনেক দিন তো হলো!এখন তো ওই ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসো।
সাজিকে যতদিন দেখেছি,বুঝেছি মেয়েটা ভীষণ সেনসিটিভ। একটুতেই মুষড়ে পড়ে। তবে এসবের মধ্যে বাজে ব্যাপারটা হলো ওর প্রতিক্রিয়া দেখানোর ধরন ভিন্ন। ওর কাছে যে অপরাধী তার ছায়াও ও মাড়ায় না উল্টে আশপাশের মানুষ জনের ওপর ঝাল ঝাড়ে!
সাজি কখন পাশের ঘরে গেছে জানিনা।
পৌলোমী এলো আরেকটু পর। বিয়ের কনেদের মধ্যে বিয়ের মাস কয়েক আগে থেকেই একটা নববধূর জৌলুস দেখা যায়।
ও একটা সুন্দর লাল জামদানি পড়েছে।
গলায় ছোটো গোলাপ ফুলের মালা।
জিনিয়া আর তৃষা মিলে সবটা গুছিয়ে ফেললো নিমেষেই। আমি হেল্প করতে চাইলেও জিনিয়া বারণ করলো।ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
-সাজি আবার উইয়ার্ড বিহেভ করেছে?
আমি একটু হেসে ততোধিক ফিসফিসিয়ে জবাব দিলাম,
-ছাড় তো!ওর জায়গায় থাকলে আমিও অমনি করতাম হয়তো তার থেকেও বেশি।
-হ্যান্ডু দা যা করলো ওর সাথে…
-ওর সাথে নয় বল ওদের সাথে…. ভরা কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতর মেয়ে নিয়ে ব্যবসা করাটা যে সে ব্যাপার নয়। পুরো ইউনিয়ন ওর পেছনে ছিল।
-তুই ভাগ্গিস ওকে বাঁচালি সেদিন…নাহলে ও যে কীভাবে সব সামলাতো? আদৌ বেঁচে থাকতো কীভাবে? আমার এখনো ভাবলেই ভয় করে!
-তোদের মতো বন্ধু পাওয়াও তো ভাগ্যের…. স্পেশালি ও না থাকলে একা আমি….
জিনিয়ার হাত থামলো। আমিও থেমে গেলাম। মন না চাইলেও লাগাম টানতে হয় কখনো সখনো।
আমি পিছু ফিরে সোফার দিকে এগোলাম। পিঠে কেমন যেন গরম হাওয়া অনুভব করছিলাম। জিনিয়ার দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণতা আমার পিঠ নয় মুহূর্তেই যেন বুকটা পুড়িয়ে ফেললো।
পৌলোমী আমার দিকে অনেক ক্ষণ ধরে চেয়ে থেকে সোফায় আমার পাশে এসে বসলো।
-তোমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি…ভুলে গেছিলাম একদম।
আমি বললাম,
-ঠিক আছে, ও কোনো ব্যাপার না।
-তবুও…বলছি তুমি চলে এসো হ্যাঁ। সাত তারিখে ভেন্যু তো জানোই…. আর শোনো আসার সময় জিনিয়ার সাথে এসো।
-কেনো? আমি তো ভেন্যু চিনি।
-না আসলে…বুঝতেই পারছো বেশ হাইফাই জায়গা তো…. যাকে তাকে….
জিনিয়া আবারো বুঝে ফেললো। ও চট করেই পৌলোমী কে ডেকে উঠলো। কথা শেষ না করেই সে উঠে গেলো।
আমি ঠিক করলাম আমি যাবোনা। আমি এখানেও আজ খাবোনা।
এইসব ভেবে ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট গিফট বের করলাম। পৌলোমী এখন আসনে বসে পড়েছে। ওর খাবারের থালার চারপাশে ফুলের ছড়াছড়ি।
জিনিয়া এসে আমাকে থামিয়ে দিলো। হাত টেনে অন্য ঘরে নিয়ে গেলো। এখানকার হৈচৈ কখন থেমে গিয়েছে খেয়াল করিনি।সবাই এখন পৌলমীর কাছে ওই ঘরে।
এখনো একজন সোফায় বসে আছে এই ঘরে।ও হইহোল্লা ভালোবাসেনা। কিন্তু নির্জনতা ওর জন্য নয়।নির্জনতা কখনো সুখ বয়ে আনেনা। ওর জীবনের কোথাও বিষাদ থাকা উচিত না।
ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমার এই ছেঁড়া কাঁথা আর লাখ টাকার ভাবনার ব্যাপারটা ছিল একপাক্ষিক। ওর ব্যক্তিসত্ত্বার একদম উল্টো পিঠটাই ছিল প্রেমিক সত্ত্বা। যা আমার কাছে আকাশের চাঁদ নয় সূর্যের মতোই দুর্লভ এবং অনাকাঙ্খিত কিছু।
অর্ঘ্য এবার একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পড়ছিলো। বৃথা চেষ্টা!এসব ওকে মানায়না। এখানে একটা চেস বোর্ড পেলে ও বসে যেত। আমিও খেলতে পারি। বাবা শিখিয়েছিল ছোটো একটা বোর্ড ছিল বাবার। না ঠিক বাবার নয় দাদুর।
জিনিয়া আগেও এমন করেছে। ফাঁকফোকর খুঁজে আমাদের আলাদা করে সুযোগ করে দিয়েছে। অর্ঘ্য তখন আমার অনেকটা কাছে এসে দাঁড়াতো। ওর আফটার শেভিং লোশনের গন্ধটা আমার প্রিয়।
ও বারবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতো,
-তোমার চোখে কী আছে বলোতো? আমি…আমি এরকম হয়ে যাই কেনো?
আমি হাসতাম। ওর বুকের কাছে আঙ্গুল ঠেকিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াতাম।ওর ধৈর্য্য তখন তাসের ঘরের মতোই ভঙ্গুর, দুর্বল।
বছর দুয়েক আগে শ্যামবাজারের পুরাতন জীর্ণ বাড়িটা থেকে যখন বাবা কে স্ট্রেচারে করে বের করা হচ্ছিলো। কোথা থেকে যেন ও এসে আমাকে জাপ্টে ধরেছিলো।
আমি তালজ্ঞান হারিয়ে ওর বুকে হামলে পড়ে কেঁদেছি।
ছোটোপিসি তো মাকে বলেই বসলো,
-এ ছেলেকে পেলে কোথায় বৌদি??
আমার মা বলতে পারলোনা যে ‘আমার মেয়ে পেয়েছে ওকে’।
হঠাৎ দেখলাম আমার হাত ধরে টানতে টানতে মামী ঘরে নিয়ে চলে গেলো।
জিনিয়া এলো তার দুদিন পরে। আমি তখন টিউশনে বেরোবো। ছোটো বোনটার টিউশন ফী দিতে হবে। প্রেসারের ওষুধ না খেলে মায়ের মাথা ঘোরে।
ও বললো,
-অর্ঘ্যর ফোনটা ধরিসনি কেনো?
আমি যত না ব্যস্ত তার থেকে অধিক ব্যস্ততা দেখিয়ে বললাম,
-সময় নেই রে। কিছু দরকার ছিল?
জিনিয়া অবিশ্বাস্য নজরে একবার দেখেই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
অর্ঘ্যর সাথে দেখা হলো আরো মাসখানেক পরে। ওর অমন উদভ্রান্তের মতো রূপ দেখে সেই প্রথম ও শেষবার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর সন্দেহ হলো আমার।
গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে এসেই ও আমার দু বাহু খামচে ধরলো।
আমার কাছে ওর এই স্পর্শ নতুন।
-কেনো এমন করছো তুলি ? কীসের জন্য? প্রয়োজন ফুরিয়েছে?
-তোমাকে কোন প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছি মনে করতে পারছিনা আমি, সরি।
আমার ব্যাথা লাগছিল হাতে। তবু ওকে ছাড়াতে ইচ্ছে হয়নি সেদিন। মনে হলো এই ক্ষত গুলো নিয়ে যদি আজীবন বাঁচতে পারতাম!
তারপর আজ এই প্রথম দেখা। এতক্ষন ধরে এতকিছু ভাবতে গিয়ে খেয়াল হলো আজকের অর্ঘ্য বড্ডো পরিপাটি। ও আগের মতো উদভ্রান্ত অগোছালো হয়ে আমার কাছে এলোনা। বরং এ ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে ঢুকলো।
পড়ন্ত বিকেল। আস্তে আস্তে নিভন্ত কিরণ শেষবারের মতো আকাশ রাঙিয়ে ডুবে গেলো দিগন্তে।
আমি রাস্তায় বেরিয়ে এসেছি অনেক আগেই।
কিন্তু এখন ফুটপাথে বসেও কীভাবে ওদের হুল্লোরের শব্দ কানে বাজছে ঠাওর করতে পারলাম না।
আমার মনে হলো আজকের আগে কোনোদিন অর্ঘ্য কে এত সুন্দর লাগেনি।টুকটুকে লাল পাঞ্জাবী পড়ে ও যখন পৌলমীর পাশের আসনে বসলো, আমি হাসলাম। ছড়ানো হাসি।
যাক জীবন আমাকে হতাশ করেনি। এইসময় একটুকরো মেঘ প্যারেড করতে করতে ছেয়ে ফেললো সন্ধ্যের আকাশ।
অনেকদিন পর আজ দেদারসে ভিজলাম।আকালের সন্ধানে সিনেমায় মৃণাল সেন বলে গিয়েছিলেন, “আকাল আমাদের সর্বাঙ্গে। শুধু শরীরে নয়, চেতনায়, মননে এবং শরীরে তো অবশ্যই।” জলের ঝাপটায় বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠলো দুটো মুখ খুব পাশাপাশি। একজন যে ছেড়ে চলে গেছে আমায়,বহুদূরে।আরেকজন যার অস্তিত্ব আমার দীর্ঘশ্বাস জুড়ে…..।

