দ্বন্দ্ব অহর্নিশ <br /> বিশ্বজিৎ রায়

দ্বন্দ্ব অহর্নিশ
বিশ্বজিৎ রায়

গান্ধীবাদী নন যাঁরা সেই সহিংসপন্থীদের আত্মত্যাগের প্রতি রবীন্দ্রনাথ সশ্রদ্ধ। সহিংসপন্থা যেখানে নিরপরাধ সাহেব-মেমদের প্রাণহরণ করে, যেখানে কেবল বন্দেমাতরম্‌ ধ্বনি সহিংস-বোধকে নির্বিচারে উদ্দীপিত করে সেখানে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা মুখর। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সরব আবার স্বদেশের নামে হিংসা যেখানে নিরপরাধের প্রাণ নেয় সেখানেও তিনি প্রতিবাদী। রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই একা হয়ে যান।

রবীন্দ্রনাথই সমস্যাটির কেন্দ্রে উপনীত হতে পেরেছিলেন। ব্যক্তি ও সমূহ এ দুয়ের টানাপোড়েনের স্বরূপ না বুঝলে স্বাধীনতার অর্থ ভেদ করা যাবে না। বাহাত্তর বছর হয়ে গেছে ভাঙা স্বাধীনতার – তবু ব্যক্তি ও সমূহের ভারসাম্য বজায় থাকে না।

মুঘলরা পূর্ববর্তী অনেকের মতো যে অর্থে এ-দেশের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, আকবর যে ভাবে ভারতীয় শাসক হয়ে উঠেছিলেন ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের যে রকমে সমীভবন ঘটেছিল সেই অর্থে ইংরেজরা এদেশের হয়ে ওঠেননি। তাঁরা বহিরাগত ও এদেশ তাঁদের উপনিবেশ। ভারত কাঁচামাল সরবরাহ করবে, ম্যাঞ্চেস্টারের কলের উৎপাদিত দ্রব্য কিনবে – বণিক আর শাসকদের দু-ফেরতা লাভ হবে। এই লাভের কলকব্জা ঢেকে রাখার জন্য তাঁরা নানা আপাত হিতবাদী কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা বলবেন আমাদের জন্য রেললাইন, কিন্তু আমাদের জন্য তো রেললাইন নয়। কাঁচামাল বন্দরে পাঠাতে হবে, প্রশাসনিক-সামরিক শাসন বজায় রাখতে হবে, উৎপাদিত দ্রব্য বন্দর থেকে বাজারে পাঠাতে হবে তারই জন্য রেললাইন। ভূমিঢাল রেললাইন পাততে গিয়ে নষ্ট হলে চাষের বারো বাজলে কিছু যায় আসে না। কেরানি তৈরির জন্যই শিক্ষা – ধুতি পরে কলে ঢোকো, অফিসের বস্ত্রের উপযুক্ত হয়ে বাইরে এসো। এই ঔপনিবেশিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল – সমূহ ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দিতে হবে। এই স্বাধীনতার দাবি অনিবার্য ও ন্যায়-সংগত।

তবে আরেকটি প্রশ্ন না-তুললে তো স্বাধীনতা তাৎপর্যহীন হয়ে যায়। শাসকের মুখ বদল হল কিন্তু শাসন পদ্ধতির! অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার মৌতাত কি গেল ? নাকি সাহেবদের ফেলে যাওয়া জুতোতেই ভাঙা স্বাধীন দেশের শাসক পা গলালেন? প্রশ্নটা স্বাধীনতার অনেক আগেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উত্থাপন করেছিলেন। তাঁর এ প্রশ্ন করা সাজে। প্রশ্নটা বাইরে থেকে করেননি। ভেতর থেকে করেছিলেন। দু-দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা যিনি তিনি স্বাদেশিক, নেশনবাদী নন। স্বাদেশিকতার সীমা কোথায় শেষ হয় আর নেশনের প্রহার কোথায় শুরু হয় সেই ভেদরেখাটিকে নির্দেশ করাই তাঁর জীবনের শেষ দুই-দশকের মুখ্য কাজ।

রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শাসকের কল-কব্জাগুলোকে পছন্দ করতেন না, ব্যক্তিজীবনে সে-সব যতটা সম্ভব পরিহার করেছিলেন। জাতীয়তাবাদীরা সমূহকে স্বাধীন করতে গিয়ে যেখানেই ঘুরপথে পুঁজির দিকে, নেশনের যুক্তির পক্ষে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত। আর বিরক্ত সেখানে, যেখানে ব্যক্তি চোখ বন্ধ করে দেশীয় নেতার অনুসারী। চরকা কাটেন যে গান্ধী তাঁর সে কৃত্য ব্যক্তিগত উপলব্ধির ফল। গান্ধীবাবাকে অনুসরণ করে যে সমূহ চরকা কাটে তাঁদের দেশপ্রেমের যান্ত্রিক পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায়নি। গান্ধীবাদী নন যাঁরা সেই সহিংসপন্থীদের আত্মত্যাগের প্রতি রবীন্দ্রনাথ সশ্রদ্ধ। সহিংসপন্থা যেখানে নিরপরাধ সাহেব-মেমদের প্রাণহরণ করে, যেখানে কেবল বন্দেমাতরম্‌ ধ্বনি সহিংস-বোধকে নির্বিচারে উদ্দীপিত করে সেখানে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা মুখর। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সরব আবার স্বদেশের নামে হিংসা যেখানে নিরপরাধের প্রাণ নেয় সেখানেও তিনি প্রতিবাদী। রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই একা হয়ে যান।

তাঁর এই একাকিত্বে যাঁরা সঙ্গে ছিলেন তাঁরা এদেশের মানুষ, অন্যদেশেরও। বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথ এমন এক মুক্ত পরিসর হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন যেখানে স্বাধীনতা ব্যক্তি-উপলব্ধি সঞ্জাত বলেই সামূহিকতার নির্বিচার ছাঁচ চেপে শরীর মনে চেপে বসবে না। অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন তিনি সাফল্য তাঁর আসেনি। সাফল্য আসেনি বলে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাটাই ভুল এ-বলার মানে হয় না। রাশিয়ায় গিয়ে তীর্থদর্শনের অভিজ্ঞতা হল তাঁর, আবার এও বুঝলেন রাশিয়া যদি ব্যক্তিমানুষকে ভুলে সমাজতন্ত্রের ছাঁচটিকে বড়ো করে তোলে তাহলে এদেশ ভাঙবে। দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ – সমাজতন্ত্রের জুলুমের ফল তিনি দেখে যাননি, যথার্থ অনুমান করতে পেরেছিলেন। বিশ্বভারতীর আদর্শ নিয়ে জুলুমবাজি করেননি বলেই চকিত সংক্ষিপ্ত সামূহিক সাফল্যের মুখ সে প্রতিষ্ঠান দেখেনি। তবে এই প্রতিষ্ঠান অনেক মানুষ তৈরি করেছিল যাঁরা রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন ও আদর্শকে সম্প্রসারিত করেছেন।

সমূহকে একদিকে চালনা করলে নানা লাভ হয়। কে আর তা অস্বীকার করবে? স্বাধীনতার নামে, রাষ্ট্রগত স্বাধীনতার নামে সেই একদিকেই চালনা করা হয় সমূহকে। চালনা করা সহজ হয় ভয় দেখিয়ে, ভুলিয়ে রেখে। পুরনো চিহ্নগুলোকে নতুন প্রেক্ষিতে বসিয়ে দেওয়া হয়। ইউ টিউবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে রচিত স্বদেশগীতি শুনতে গেলে ইদানীং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির পুতুল হয়ে ওঠেন অনেক সময়। রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্য মাঝে মাঝেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা লাগিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে। সেই খেলায় নাগরিকসমূহকে উত্তেজিত ভাবে সামিল করার জন্য পুরনো স্বদেশগীতি নতুন বোতলে ঢুকিয়ে দেওয়ার দস্তুর চোখে পড়ে। সমূহকে একদিকে চালাতে পারলেই তো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হস্তান্তর, স্বাধীনতা প্রাপ্তি। তারপর? তারপর নানাভাবে ক্ষমতার নখ-দাঁত বাইরে আসে, ‘সাম আর মোর ইক্যুয়াল’ এই সমীকরণ আবার তৈরি হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে ব্যক্তি সরব হন।

নিজের বোধ জাগ্রত না হলে, নিজের লোভ শমিত না হলে, শাসন ও ক্ষমতাতন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠেন মানুষ। ক্ষমতা সুবিধে ও সুযোগ দেয়। তাকে আমরা স্বাধীনতা বলে ভাবি – তা স্বাধীনতা নয়। ক্রমে সেটা বোঝা যায়। ক্ষমতা ক্ষমতাভোগীর দিকে বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে ধেয়ে আসে।

রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব প্রকল্পটি তাই ব্যক্তির আত্মবোধ কেন্দ্রিক। আত্মবোধ যাঁর আছে তিনি সমূহের অংশ হবেন। স্বদেশ তাঁকে অর্জন করতে হবে, জন্মসূত্রে মুফতে স্বদেশ মিলবে না। যা মিলবে তা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ভাবনা ও কতগুলি বিধি। সেই ভাবনা ও বিধি মাননীয় নেশন হতে পারে, স্বদেশ নয়। নিজের বোধে নিজের কাজে ব্যক্তি মানুষ স্থানিকতার সূত্রে, বৈশ্বিকতার প্রেক্ষিতে যখন সচেতন ভাবে সমূহের অংশ হন তখনই স্বাধীনতার ধ্যান শুরু হয়। এ ধ্যান ক্রিয়ামূলক, শেষ হয় না। চলে, চলতেই থাকে আজীবন। তাই রোজ স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য কাজ করতে হয়। দেশের স্বাধীনতা দিবস পালন এক আর স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য নিত্যদিন সচেতন থাকা আর এক। এই সচেতনতা না থাকলেই নির্বিচারে রাষ্ট্রিক ছাঁচ মাথায় চেপে বসবে। রাষ্ট্রিক ছাঁচকে চাপে রাখা চাই, প্রশ্ন করা চাই, ভালো কাজ করলে বাহবাও দেওয়া চাই। সম্পর্কটা দ্বন্দ্বমূলক – দ্বন্দ্ব মানে মিলন ও কলহ। সেই মিলন কলহের টানাপোড়েনে নেশনকে স্বদেশ করে তোলাই ব্যক্তি নাগরিকের নিত্য দিনের কাজ।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    দেবরাজ চক্রবর্তী 3 years

    ভালো লেখা।সমৃদ্ধ হলাম

  • comment-avatar
    Anup Sengupta 3 years

    বিষয়ের গভীরে নেমেছেন আলোচক। তাঁর এই সন্দর্ভ মনে রাখার মতো।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    410 Gone

    410 Gone


    openresty