
পারফিউম
রূপশ্রী ঘোষ
একটা ডেডবডি রোজ ঘুরে বেরায়। ভোর থেকে। ঘরের মধ্যেই। বারান্দায় যায় চায়ের গ্লাস হাতে, পায়রা আদর দেখে নীরবে। কিন্তু সে কিছুতেই চিতায় উঠতে চায় না। তার পায়ের আওয়াজ, তার কাজের আওয়াজ বাড়ির লোক সবাই পায়। এবং অতিষ্ঠও হয় কারণ আওয়াজে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে যে। তাকে বহুবার তার বন্ধুরা, অনেক বিজ্ঞ দাদা-দিদিরা সবাই বলেছে,
– আরে তুমি চিতায় ওঠো এবার, চিতায় উঠছো না কেন?
– (কোনো উত্তর দেয় না)
– কী ব্যাপার এত কথা আমরা বলে যাচ্ছি অথচ তুমি আমাদের কথার কোনো উত্তর দিচ্ছ না কেন? তুমি ডেডবডি। তুমি চিতায় যাও। তুমি পৃথিবীর নিয়ম ভাঙছ কেন? জানো না, ডেডবডিকে হয় চিতায় না হয় কবরে যেতে হয়?
– হুম!
তাকে খুব বোঝালে সে কেবল ‘হুম’টুকু বলে। এর বেশি কোনো কথা বলে না। সে নিজেও জানে সে ডেডবডি। তবুও চিতায় যায় না। কিন্তু ঘুরেফিরে সমস্ত কাজকর্ম সে করে। তাতে সবার সুবিধাই হয় তবুও তাকে চিতায় যেতে বলে সবাই। কিন্তু কেন বলে সে নিজেও জানে না। আর নিজেও যায় না কেন, তাও সে জানে না। ডাক্তাররা যেমন ব্রেইন ডেথ না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু ঘোষণা করে না, সেরকম আর কী। এ ডেডবডি কিন্তু পুরো মৃত না। তাকে সবাই মৃত বলে বলে বোঝানোর চেষ্টা করে, সে মৃত। কিন্তু তাও সে শোনে না। তার একটি বাচ্চা মেয়ে আছে, সেও বলে,
– মা, তুমি চিতায় যাচ্ছ না কেন? তুমি মৃত। তোমাকে আমার ঘরের মধ্যে এমন মৃত দেখতে ভালো লাগে না। প্লিজ তুমি চিতায় যাও মা। বাড়ির সবাই আমাকে বলেছে, অনেকদিন আগেই তোমার মৃত্যু হয়েছে। আমরা সবাই তোমাকে মৃত বলেই জানি। আমাকেও তাই বোঝানো হয়েছে তুমি মৃত। নাহলে তো আমি এতদিন কিছুই জানতাম না।
অ্যাজ্ ইউজুয়াল ডেডবডি চুপ থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। তার ভাবনাও সে কোনোদিন কারো কাছে প্রকাশ করে না। সে মাঝে মাঝেই বেরোয় এদিক সেদিক, কোথায় যায় কেউ জানে না। সে যেন একটা রোবটও বলা যায়। সব দেখে, সব বোঝে, সব শোনে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। বাঁচার জন্য মানে, যতটুকু বেঁচে আছে তার জন্যে যতটা পরিমাণ খাওয়া দরকার খায়, জামাকাপড়, ডাক্তার, ওষুধপাতি কোনোকিছু নিয়েই খুব বেশি কোনো খরচ তার নেই। বাড়ির কেউ জানতেও চায় না, কারণ সবাই জানে সে মৃত। আর যেটুকু বেঁচে আছে তা বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা পায় তাই যথেষ্ট। তাই তাকে নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। মাঝে মধ্যেই তার কাছে ফোন, মেসেজ আসে এটা জানতে চেয়ে যে, ‘কী গো তুমি কবে চিতায় যাচ্ছ?’ সে ফ্যালফ্যাল করে মরা মাছের চোখ নিয়ে মেসেজগুলো পড়ে, ফোনের উল্টোদিকের কথাগুলো শোনে। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। কারণ সে তো ঠিক করেনি কবে চিতায় যাবে। তাই সে কিছু বলতে পারে না। তাকে সবাইমিলে ব্যতিব্যস্ত করে, ‘এই ঢের হয়েছে, এবার যাও তো তুমি চিতায়। তুমি বড্ড অনিয়ম করছ। আমাদের জগৎ সংসারের কোনো নিয়মই তুমি মানছ না। যাও এবার চিতায় যাও’।
সেই একই গল্প ডেডবডি সব শোনে আর চুপ থাকে। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। ডেডবডি কিন্তু জানে দীর্ঘদিন ধরে তার উপর কী কী অত্যাচার চালানো হয়েছে এবং সে অত্যাচারের ঘনত্বটাই বা কত। তবুও। তবুও সে চিতায় যায় না। তার মেয়ে কিন্তু জানে না পুরো সত্যিটা। ডেডবডি মেয়েকে বলার চেষ্টাও করে না। কারণ ডেডবডির যন্ত্রণা বুঝতে বা তার সমব্যথী হতে এখনো অনেক সময় লাগবে, তাই সে তার মেয়ের মাথায় এমন জাঙ্ক জিনিস ঢোকায় না। কিন্তু এটা ডেডবডি ভাবে যে, চিতায় ওঠার আগে মেয়েকে এই শিক্ষা দিয়ে যাবে, সে যেন কোনো মানুষকে ডেডবডি না বানায়। তাকে যতটা যা শেখানোর বা শিক্ষা দেওয়ার সে হয়তো দেবে। দেবে কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু সে এমনটাও ভেবেছে আগে। মেয়েটা মাঝেমধ্যে তার মায়ের মৃত দেহের কাছে আসে, গায়ে মাথায় হাত বোলায় আবার চলে যায়। খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। কারণ সে জানে মা মৃত। তাই মায়ের কাছে থাকা যায় না, থাকা নিষেধ। থাকেও না। আগে সে মায়ের গন্ধ ছাড়া ঘুমোতেই পারত না, কিন্তু এখন সে মৃতদেহের গন্ধ ছাড়া আর কিছুই পায় না, তাই খুব বেশিক্ষণ না থেকেই চলে যায়। ডেডবডিও চায় না তার গন্ধ বা তার গা থেকে বেরোনো কোনো জার্ম বাচ্চার ক্ষতি করুক। তাই সে জোরও করে না বাচ্চাকে বেশিক্ষণ কাছে আটকে রেখে মাতৃসুখের তৃপ্তি অনুভব করতে। সে ডেডবডি এটা মেনেই নিয়েছে। কিন্তু কবে চিতায় যাবে এটা ঠিক করেনি। সে এও জানে যে, সে না গেলে অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছে বা হবে। তবুও সে যায় না। যাবেও না হয়তো খুব সম্প্রতি। বাড়িতে অতিথিরা আসে যায়। আসা-যাওয়াটুকুই জানে ডেডবডি। তার আগে পিছের কোনো খবর সে জানে না। তবুও নিয়ম করে যত্নের করে না কোনো ত্রুটি। এ আই যুগের মেশিন যেন বা। মাথায় যতটুকু ভালো ডেটা গুঁজে দেওয়া হয়েছে ততটুকুই সে প্রয়োগ করে তার বেশি নয়। খারাপ তথ্য কি তার মাথায় এখনো গুঁজে দেয়নি কেউ? দিয়েছে, দিয়েছে। কেবল প্রয়োগ করেনি, প্রয়োগ করে না সে। সুযোগ বুঝে করবেও হয়তো কখনো। সে নীরব তো তাই কখন কী করবে আগে থেকে প্রেডিক্ট করা সম্ভব নয় কারোর পক্ষে।
ডেডবডি মাঝে মধ্যে কোথায় যায় কেউ জানে না। কেউ না। তবে সে একটা এনজিও চালায় এটা সকলে জানে। সেখানে কী সেখানো হয় তাও কেউ জানে না। ডেডবডি লাখো লাখো তার মতো মহিলা ডেডবডি নিয়ে একটা সমিতি গড়ে তুলেছে। সেখানে সবাই আসে নিয়ম করে। এই সমিতির প্রধান সে নিজেই। তবুও সে রোজ যায় না, মাঝেমধ্যে যায়। যখন যায় একবারে অনেকটা কাজ শিখিয়ে দিয়ে চলে আসে সে। তার বন্ধু ঋতুর কৌতূহল খুব তার সম্পর্কে। তার কাছে খুব নিয়মিত জানতে চায়,
– আচ্ছা তুমি সত্যি করে বলবে তোমার মতলবটা কী? কেন তুমি চিতায় যাও না? কেন কোনো কথার জবাব দাও না। প্লিজ বলো। এতটা নীরব থাকলে সবারই খুব অসুবিধা হয়। আমারও হচ্ছে।
তবুও ডেডবডি চুপ থাকে। দেখা হলে ঋতু তাকে ঝাঁকুনি দিয়েও জানার চেষ্টা করেছে বহুবার। তবুও তার ঠোঁট খোলাতে পারেনি কোনোদিন। যেন কেউ চিরতরে সেলাই করে দিয়েছে তার ঠোঁট। তাকে কথা বলানো যায় না কিছুতে। আর বলবেই বা কেন? সে তো ডেডবডি। সবাই তার মাথায় এটাই ঢুকিয়ে দিয়েছে, তুমি কিন্তু ডেডবডি। ঋতুর কৌতূহল দিনেদিনে বেড়ে চলে, ও কেন এমন করছে। একদিন ঋতু ডেডবডির বেরোনোর খবর জেনে গিয়েছিল। তারপর থেকে সে তক্কে তক্কে থেকে তার পিছু নেয়। গোপনে সেও বেরিয়ে পড়ে দেখতে কোথায় যায় ও। তাকে ধাওয়া করে সেই গোপন জায়গার হদিশ নিয়ে আসে। ধাওয়া না করলে সত্যিই খুঁজে পাওয়া সম্ভব হত না ঋতুর পক্ষে। নির্জন জায়গা, ঝুপড়ির মধ্যে পোড়ো বাড়ি টাইপের একটা বাড়ি। বাড়িটার গায়ে জমা শ্যাওলা, আর তাকিয়ে থাকা হাড় পাঁজর তার বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছে। ঋতু দেখেই অবাক হয়, ডেডবডি কীভাবে এ জায়গার হদিশ পেল ভেবে। গুগল ম্যাপে কী নামে সার্চ দেবে তাও ঋতু বুঝতে পারল না। কিন্তু সে এটুকু বুঝতে পারছে যে, বন্ধুর নীরবতা মানে নীরব নয়। যেন বা নীরব মুখরতা। ডেডবডি ওই ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর ঋতু আবার চুপিচুপি ফিরে আসে। এবং খুব ভালোভাবে মাথার মধ্যে একটা ম্যাপ তৈরি করতে করতেই ফেরে সে।
পরে একদিন একা একা আবার যায় ঋতু। সে এমনই এক জায়গা আগে ওকে ধাওয়া করতেই হত, না করলে সত্যিই ঋতুর চোদ্দো গুষ্টির পক্ষেও সে জায়গা আবিষ্কার করা সম্ভব হত না। গিয়ে ঋতুর চক্ষু ছানাবড়া। গিয়ে দেখে অসংখ্য মহিলা ডেডবডি সেখানে কাজ করছে। ডাক্তার, মাস্টার, ইঞ্জিনিয়ার সমস্ত পেশার মহিলা। ওর মতোই তারা, যারা চিতায় যায়নি অথচ মৃত। গিয়ে দেখে তারা সব মশাল তৈরি করছে। মশাল বানানোর বুদ্ধি ঋতুর বন্ধুই দিয়েছে। সে-ই প্রধান ওখানকার। তার সিদ্ধান্ত এটাই যে, চিতায় ওঠার আগে সমস্ত সংসারে আগুন ধরিয়ে তবে সে চিতায় উঠবে। নিজেদের চিতা নিজেরাই সাজিয়ে রাখবে আগে থেকে, কিন্তু যে মশাল তারা তৈরি করছে তাতে সফল হলেই এক এক করে সমস্ত সংসার যারা তাদের এতদিন গনগনে আগুনে পুড়িয়েছে, জ্বলন্ত আঁচে সেঁকেছে দিনরাত, ভিতরের প্রতিটা হাড় পাঁজরাকে পরিণয় করেছে কাঠ কয়লায়, তাদেরকে ওদের তৈরি মশালের আগুনে আগে জ্যান্ত পোড়াবে, তার আগে সাজিয়ে রাখবে নিজেদের চিতা। চন্দনকাঠ পাওয়া সম্ভব নয়, নিম কাঠও না, যা পাবে তা দিয়েই সাজাবে কিন্তু তাতে মেশাবে আতর। অসংখ্য আতরের শিশি খালি করে তারা সুগন্ধে ভরিয়ে দেবে চারপাশ। যারা নিষ্পাপ নির্দোষ তাদের নাকে যাতে পোড়া মাংসের গন্ধ না যায়, তাদের কথা ভেবেই এত আড়ম্বরে, সযত্নে তারা নিজেরেরাই সাজাবে নিজেদের চিতা। তারপর নিজেদের ডেডবডি চিতায় তুলবে। সবার প্রথমে তারা এও নাকি করবে ঋতু শুনে এসেছে, আধুনিক কায়দায় গুগুল ফর্ম বানিয়ে তাদের মনে জমে ওঠা ক্ষত, দীর্ঘদিনের জবাব না চাওয়া প্রতিটি প্রশ্ন লিখবে। প্রত্যেক ডেডবডি তাদের যে যার বাড়ির লোকজন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজের সামনে যাকে প্রশ্নগুলো করা দরকার সে কাজ করবে। সঙ্গে থাকবে পার্টির করার ভঙ্গিমায় বিশাল বিলাসবহুল এক আয়োজন। সমস্ত ইচ্ছাপূরণের পর তবেই তারা সংসারে জ্বালবে আগুন।
এসব জানার পর ঋতুর মুখে আর কোনো ভাষা নেই। সে দেখতে পাচ্ছে মশালের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলা সমস্ত সংসার। পুড়ে পুড়ে গলে পড়া দলা দলা মাংস। সংসারের পোড়া মাংসের গন্ধ তার নাকে আসছে। যারা ডেডবডি তৈরি করে তাদের পোড়া মাংসের গন্ধও। তবুও সে হাঁপিয়ে যাচ্ছে না। কোনো বিস্ময় প্রকাশ করছে না। কারণ ঋতু তার বন্ধুকে যতই চিতায় ওঠার জন্য জোরাজুরি করুক না কেন, সে নিজেও জানে সেও একটা ডেডবডি। কেবল তার মুখের উপর স্পষ্ট করে কয়েকবার বলা হলেও তার গায়ে কেউ টিকিট সেঁটে দেয়নি এটা বলে যে, এবার চিতায় ওঠো। সে নিজে তাই এখনো চিতায় ওঠার কথা ভাবতে পারছে না। এবার তার খুব আনন্দ হচ্ছে। সেও অবলীলায় চিতায় চলে যাবে কেউ তাকে ‘তুমি মৃত’ বলে গায়ে টিকিট লাগিয়ে দিলে। তবে তার আগে তার বন্ধুর তৈরি মশাল কারখানায় সেও যোগ দেবে। চুপিচুপি মজুত করবে মশাল। বারুদ। যেভাবে চুপিচুপি সেও ডেডবডিতে পরিণত হচ্ছে সেভাবেই। কোথাও হয়তো এই বদল ঋতুও চাইছিল, কিন্তু পারছিল না। এরপর থেকে সে তার বন্ধুকে আর চিতায় ওঠা নিয়ে প্রশ্ন করে না। ও জানে সময় হলেই ও জ্বলে যাবে। সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়ে চলে যাবে। যেভাবে সে এতদিন নীরবে জ্বলেছে তার থেকেও বেশি আগুন সে জ্বালাবে। এটুকু বিশ্বাস আজ ঋতুর মনে তৈরি হয়েছে। ঋতু যেন তার পায়ের তলার জমি খুঁজে পেয়েছে। সামাজিকভাবে বাঁচার সুফল যেন ঋতু আজ উপলব্ধি করতে পারছে।
মশাল তৈরি চলছে। ডেডবডি মাঝে মধ্যেই গিয়ে গাইড করে আসছে। তার চিতায় ওঠা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করলেও ঋতু আর তাকে কোনো প্রশ্ন করে না। ঋতুর এখন আর কোনো আক্ষেপ নেই। নীরবেই তৈরি হোক মশাল। তা দিয়ে সমস্ত ডেডবডি আগুন জ্বালাবে। চিতায় ওঠার আগে। শেষ কামড় সবাই দিতে চায়, দেওয়াই উচিত, দেবেও। এ নিয়ে কারো মনে আর কোনো দ্বিধা নেই। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও পুড়বে না কেবল মশাল তৈরির সেই নির্জন পোড়ো বাড়িটা। কারণ সে বাড়িতে এখন আর কেউ আগুন দেবে না। কেউ জানে না তার ঠিকানা। ঋতু তো দেবেই না। কক্ষনো না। মশাল তৈরি হবে।