ধারাবাহিক উপন্যাস আশ্চর্য নির্বাসন <br /> ১২তম পর্ব থেকে ১৬তম পর্ব ও উপসংহার <br /> বিতস্তা ঘোষাল

ধারাবাহিক উপন্যাস আশ্চর্য নির্বাসন
১২তম পর্ব থেকে ১৬তম পর্ব ও উপসংহার
বিতস্তা ঘোষাল

প্রথম-তৃতীয় পর্ব– প্রথম তিনটি পর্ব
৪-৭ তম পর্ব– সপ্তম পর্ব পর্যন্ত
৭-১১ তম পর্ব– এগারতম পর্ব পর্যন্ত

১২

সৌমিক অনেক ভেবে শেষ অবধি সিদ্ধান্ত নিল মালশ্রী আসার আগে ফ্ল্যাটের সবার সঙ্গে একবার কথা বলবে, তাদের এ বিষয়ে কী মত জানা দরকার।কারন কোয়ারেণ্টাইন শেষ হয়ে গেলে মালশ্রীকে সরকার আর সেখানে রাখবে না। তাছাড়া যে হারে রোজ ভাইরাসটা ছড়াচ্ছে তাতে সরকারের পক্ষে রাতারাতি এত সেন্টার তৈরি করা সম্ভব নয়। বিরোধী দলগুলো এই নিয়ে যতই চেঁচাক সৌমিক নিজের বোধবুদ্ধিতে বেশ বুঝতে পারছে এমন বিপর্যয় এদেশে আগে না হওয়ায় চট করে পরিস্থিতি সামলানো যথেষ্ট কঠিন।ফার্স্ট ওয়াল্ড কান্ট্রি যেখানে পুরো ফেলিওর সেখানে এই দেশ যথেষ্ট চেষ্টা করছে।এখন মাথা ঠান্ডা রেখে মালশ্রীকে বাড়ি ফেরানোটাই প্রথম কাজ।কিন্তু সবার প্রথম বাসুদেবের পরামর্শ প্রয়োজন।জটিল সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধি কম মানুষের।

শ্বশুড় হলেও বাসুদেবের সঙ্গে তার সম্পর্ক গুরু শিষ্য কিংবা বন্ধুর মতো। যখনি বিপদে পড়ে তখন সে বাসুদেবের সঙ্গে কথা বলে ঠিক একটা পথ খুঁজে পায়।

সৌমিকের এই দুঃশ্চিন্তার মধ্যেও হাসি পেল। মালশ্রী মাঝেমাঝে তাকে আক্রমণ করে এই বলে যে নিজের ঘটে তো বুদ্ধি বলে কোনো পদার্থ নেই। যখন ঈশ্বর বলবে, বাছা তুমি পৃথিবী থেকে আসার সময় কি নিয়ে এসেছ, তখন তুমি বলবে, কেন প্রভু, আপনি আমাকে যে ব্রেন দিয়েছিলেন, সেটা যেমন দিয়েছিলেন সেভাবেই ফেরত এনেছি।

ভগবান বলবে, তাহলে তুমি ওখানে কিভাবে এতদিন টিকে ছিলে? তখন তুমি বলবে, কেন প্রভু, আমি আমার নিজের মাথা খাটাইনি ঠিকই কিন্তু আমার শ্বশুড়মশাইয়ের ব্রেন পুরো নিংড়ে নিয়েছি।যা কিছু পরামর্শ বুদ্ধি সব তার থেকেই নিয়ে আমি আমার কার্যোদ্ধার করেছি।

সৌমিক হেসে বলে, তোমাকে তো বুদ্ধি করে বিয়েটা করেছিলাম তবেই না তাকে পেলাম। এই বুদ্ধিটার তো তারিফ করো।

মালশ্রী আর কথা খুঁজে না পেয়ে হাসতে শুরু করে।

সৌমিকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেমন আছে মালশ্রী কে জানে!কতদিন দেখা হয়নি।কোনো ফোনও নেই যে খোঁজ নেওয়া যাবে। অবশ্য প্রথমদিনই জানিয়েছিল সে রকম কিছু হলে খবর দেওয়া হবে। এখনো যখন কোনও ফোন আসেনি ধরে নেওয়া যায় ঠিকই আছে সে।তবু বুকের ভিতরটা হঠাৎ করেই হু হু করে উঠল। মনে মনে বলল, মিস ইউ শ্রী।বাড়িটা খুব ফাঁকা লাগছে তোমাকে ছাড়া।

একটা সিগারেট ধরিয়ে এক টান টেনে ফেলে দিল সৌমিক। তারপর বাসুদেবকে ফোন করল।

দুবার টানা রিং হয়ে কেটে গেল লাইন।এখন ফোন করলেই রিং হবার আগে যান্ত্রিক ভাবে সুরেলা কন্ঠ বলে ওঠে-‘ কোভিড ভাইরাসের সঙ্গে আজ সারা দেশ লড়ছে।কিন্তু মনে রাখতে হবে আমাদের লড়াই রোগের সঙ্গে, রুগীর সঙ্গে নয়…।

স্বাস্থ্য দপ্তর দ্বারা জনস্বার্থে প্রকাশিত এই এই বিজ্ঞপ্তি কি মানুষ আদৌ মানছে!কাগজে রোজই পড়ছে স্বাস্থ্য কর্মীদের অনেককেই নানা নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে। কাউকে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে বাড়িওয়ালা উচ্ছেদ নোটিশ দিচ্ছে তো কোথাও গ্রামে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করা যাবে না বলে পুলিশের উপর ইট পাটকেল ছোঁড়া হচ্ছে। আবার কোথাও বা ডাক্তারদের মারা হচ্ছে, সিস্টারদের গায়ে থু থু ছেটানো হচ্ছে।

এসবই আসলে অশিক্ষার প্রভাব। এসব ভাবতে ভাবতেই বাসুদেবের ফোন এল।

বলো সৌমিক, তোমার কথাই ভাবছিলাম।কি খবর? মালশ্রী কবে ছুটি পাচ্ছে জানলে কিছু?

না, এমনিতে তো পরশু ছুটি পাওয়ার কথা।কিন্তু বাড়িতে আনব কি করে সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।এখানে তো কেউ জানেই না মালশ্রী দেশে ফিরেছে,কোয়ারেন্টাইনে আছে।

তোমার কি মনে হচ্ছে জানলে ঢুকতে দেবে না?বাসুদেব জানতে চাইলেন।

তেমন সম্ভাবনাই বেশি।তাছাড়া বান্ধুলি আবার ফ্ল্যাটের লোকজন যখন জানতে এসেছিলেন মালশ্রীর বিষয়ে, তাদের বলেছে, মা এখনো দেশে ফেরেনি।সৌমিক জানালো।

তাহলে দেখছি সব নিয়েই বিড়ম্বনা।একটু থেমে বাসুদেব বলল।

সৌমিকের মনে হল তিনি কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। সে চুপ করে রিসিভার কানে ধরে রইল।

মিনিট চারেক কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সৌমিক অপেক্ষা করছিল তাঁর পরামর্শ জানার জন্য!তার বুকের মধ্যে কেমন একটা উথালপাতাল করছিল।

সেই মুহূর্তে ও পাশ থেকে বাসুদেব বলল, চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।এখন ফোন রাখি কেমন।আমার আদর নিও তোমরা।বান্ধুলিকে হামি দিলাম। বৌদির খেয়াল রেখো।

আর কিছু না বলেই বাসুদেব ফোন রেখে দিল।

সৌমিক এই সময়গুলোতে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না বাসুদেবকে।এত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি কোনও উপায় না বলেই ফোন রেখে দিল।আশ্চর্য মানুষ! পরমুহূর্তেই মনে হল আসলে তিনি এখন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে এই সমস্যার সমাধান করবে।আর মালশ্রী তো তার মেয়ে।কাজেই তার চিন্তা সবচেয়ে বেশি।

আপাততঃ আবার তার ফোনের জন্য প্রতীক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেল না সৌমিক।

বান্ধুলি ঘরে ঢুকে- বাবা ব্যস্ত? বলে বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। সৌমিক মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল,মায়ের জন্য খুব মন খারাপ করছে তাই না রে?

বান্ধুলি আলতো করে মাথা নাড়ল। সৌমিক বুঝতে পারল মেয়েটা কাঁদতে পারছে না,নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, অথচ বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে অব্যক্ত যন্ত্রণায়। সে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল- চিন্তা করিস না মা।দাদুকে ফোন করেছিলাম। একটা সমাধান ঠিক হয়ে যাবে।

বাবা একটা কথা বলব?

বল।

আমি তো সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম, ভগবান রেগে গিয়ে মায়ের কোনো ক্ষতি করে দেবে না তো! আমার দোষের শাস্তি মা পাবে না বলো। বান্ধুলি ম্রিয়মান গলায় বলছিল।

সৌমিক এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলল, ভগবান মানুষের ক্ষতি করেন না।তবে মিথ্যেটা না বললে মাকে নিয়ে আসার পথটা খোলা থাকত। হয়তো বাধা দিত। কিন্তু কোয়ারেন্টাইনে ছিল এটা তো বোঝানো যেত।

বাবা আমি ঠিক করেছি সবাইকে বলে দেব।তারপর যা হবার হবে।

আমিও সেটাই ভাবছি। সৌমিক মেয়ের কপালে হামি দিল।

বান্ধুলি বাবাকে হামি দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেল।

###

বান্ধুলি চলে যাবার পর সৌমিক খানিকক্ষণ চুপচাপ নিজের চেয়ারে বসে রইল। তারপর জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আকাশটা লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। ছোটো বেলায় পড়েছিল অঝোরে বৃষ্টি নামলে সেই তীব্র ধারায় অনেক রোগ ব্যধি দূর হয়ে যায়। এখনো যদি এমন হয় তবে কী এই ভাইরাস নির্মূল হয়ে যাবে! কে জানে! একটা অস্থিরতা টের পাচ্ছে সে। যে হারে এটা ছড়িয়ে পড়ছে আগামী বেশ কয়েক বছর লাগবে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে। কত মানুষ যে চাকরি হারাবে বিশ্ব জুড়ে তার সীমা পরিসীমা থাকবে না। দারিদ্র বাড়বে, খুন জখম রাহাজানি চুরি ডাকাতি বাড়তে বাধ্য। অভাবের তাড়নায় মানুষ দিশাহীন হয়ে পড়বে।

নিম্নবিত্ত মানুষেরা তাও সাময়িক কাজ হারালেও মানুষ আবার তাদের ঘরের কাজে বহাল করবে।কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা কিভাবে পরিত্রান পাবে! তারা না পারবে চুরি করতে, না পারবে লোকের দরজায় হাত পাততে। তার মনে পড়ল, যখন তারা কলেজে পড়ত তখন প্রায়ই বিভিন্ন মানুষ আসত বাড়িতে জিনিস পত্র বিক্রি করতে।নিজেদের বলত বন্ধ কারখানার শ্রমিক।

একজনের মুখ পরিস্কার মনে পড়ল তার। কোর্ট টাই জুতো পরে আসত। বলত সে জুট মিলের ম্যানেজার ছিল।কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে এখন এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি করছে।বই বিক্রি, ও নিজের দুঃখের গল্প শোনানোর পাশাপাশি আর একটা কথা বলত। এই পাপী পেটের জন্যই লোকের দুয়ারে ঘুরতে হচ্ছে।বুঝলেন, মাসিমা কখনো ভাবিনি সেলস ম্যান হব। ভেবেছিলাম পড়াশোনা যখন এতদূর কষ্ট করে করেছি,বড় চাকরি করব। কপাল দেখুন।যা অপছন্দ তাই শেষ অবধি করতে হচ্ছে।

চন্দ্রাবতী প্রতিবারই একটা দুটো করে এনসাইক্লোপিডিয়া কিনত। আর তাকে বলত, পৃথিবীতে কোনও কাজ ছোটো নয় বাবা।তুমি তো এমনি চাইছ না টাকা,বই বিক্রি করছ।জানো তো বাবা, আমার বাবা বলতেন, যখন মানুষের কাছে বেঁচে থাকার মত কোনো রসদ থাকে না, তখন একমাত্র বই-ই পারে তাকে নতুন জীবন দান করতে। আজ দেখো, তুমি পড়াশোনা শিখেছিলে বলেই না এই বইয়ের গুরূত্ব বোঝাতে পারছ! কাজেই আফসোস কোরো না। কে বলতে পারে একদিন তুমিই হয়তো প্রকাশনার জগতে চলে এলে,কিংবা বইয়ের দোকান খুললে!জানবে যতক্ষণ শ্বাস চলছে ততক্ষণ আশা রাখতেই হবে।

সেই লোকটি চন্দ্রাবতীকে যাবার আগে প্রনাম করে বলত, আপনার কথা যেন সত্যি হয় মাসিমা।দুটো ছেলেমেয়ে, মা, বাবা, এক ভাই, স্ত্রী সবাই আমার মুখের দিকে চেয়ে।

সব হবে বাবা।রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা শুনে নিও, আর রোজ নিজেকে বোলো নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন হবেই হবে…।

সৌমিক দীর্ঘদিন বুঝতে পারেনি মা কেন একই বই বারবার কেনে? তাছাড়া সব বই যে ভালো কোয়ালিটির হত তাও নয়, অনেক সময়ই দেখা যেত ভিতরের বহু পাতা নেই, কিংবা তাতে অনেক পাতার পাশে নানা নোট, আন্ডারলাইন করা। মানে বইগুলো দ্বিতীয় বা তৃ্তীয়বার বিক্রি হচ্ছে হাত বদল হয়ে পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে। তাই যদি নিতে হয় মা বইপাড়া থেকে নিলেই পারে।দাম অনেক কম পরে।

চন্দ্রাবতী ছেলের কথা শুনে বলেছিল, তুই বইয়ের বিষয়টা দেখেছিস? সারা বিশ্বের খবর আছে তাতে। আর এখানে বই মুখ্য নয়, মানুষটা প্রধান। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের পরিবারটাকে বাঁচাতে। আমরা যদি তাকে এভাবে পাশে থেকে হাত বাড়িয়ে না দিই কে দেবে বলতো!মানুষ হিসেবে তো এটাই আরেকজন মানুষের কর্তব্য।

কিন্তু মা, সে তো তোমাকে ঠকাচ্ছে এভাবে।

চন্দ্রাবতী হেসে ওঠে ছেলের কথায়। তোকে কে বলল আমাকে ঠাকাচ্ছে! আমি তো স্বেচ্ছায় ঠকছি।সেতো জোর করেনি। আমি জেনে বুঝেই নিচ্ছি। জীবনটা এত বড় যে সব সময় লাভ ক্ষতি দিয়ে তার বিচার করা যায় কি? তাহলে তো দাড়িপাল্লা নিয়ে চলতে হবে।

সৌমিক তখন এত সব না বুঝলেও অবাক হত মায়ের কথা শুনে।তাছাড়া তার ছাপোষা সরকারি চাকুরে বাবাকেও এই নিয়ে একটি মন্তব্যও করতে শোনেনি কখনো। মানে বাবা নয় জানত না এ বিষয়ে কিংবা সংসারের যাবতীয় দায় দায়িত্ব যেহেতু স্ত্রীর উপর ছেড়ে দিয়েছিল তাই মাথা ঘামাত না। তখন বাবাকে মনে হত ব্যক্তিত্বহীণ এক পুরুষ, যার সংসারে কোনও দাপট নেই, মাসের প্রথমে মাইনের টাকাটা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েই দায় এড়ানো এক পাতি মধ্যবিত্ত মানুষ।

কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পেরেছে বাবা নিজের থেকেও বেশি ভরসা করেছে চন্দ্রাবতীর বুদ্ধি, বোধ ও অন্যান্য ভাবনার ক্ষেত্রে। তাই বিন্দুমাত্র সংশয় ও প্রশ্ন না তুলেই যাবতীয় সিদ্ধান্তের ভার স্ত্রীর উপর ছেড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু এখন সে এসব ভাবছে কেন? সে তো বাবার মতো স্বামী নয়, বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মালশ্রীর উপর অধিকার ফলিয়েছে।তাহলে এখন কেন বাসুদেব কি বলবে সেই সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে!সে নিজে কেন কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছে না!

অথচ মালশ্রীর কি হবে, কিভাবে তাকে বাড়ি আনা যাবে এই ভাবনাটা থেকেই যাচ্ছে। অনেক ভেবে সে ঠিক করল আপাতত অপেক্ষা করবে বাসুদেবের জন্য, সমাধান সূত্র না বেরোলে তখন বাধ্য হয়েই এখনকার স্বরাষ্ট্র সচিবকে ফোন করতে হবে। তার কলেজের সিনিয়র দাদা, সম্পর্কটা এখনো বজায় রেখেছে। সেটাই শেষ ভরসা।

১৩

বাবার সঙ্গে কথা বলে নিজের ঘরে ফিরে এল বান্ধুলি। ইনবক্সে একগাদা মেসেজ এসেছে পাবজি খেলায় যোগ দেবার জন্য। এই সময় তাদের স্কুলের বন্ধুরা খেলে। সারাদিনে মোট পাঁচ বার তার খেলা চলে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে। কোনোটা স্কুলের বন্ধু, কোনোটা কলেজের, কেউ সিনিয়র দাদা দিদি, কেউ ইন্সটাগ্রামের বন্ধু, আর একবার কদিন কলেজ ছুটির সময় একটা কর্পোরেট চাকরিতে যোগ দিয়েছিল, সেখানকার বন্ধুদের সঙ্গে।

সঞ্জনা মেসেজ করেছে, ওয়েটিং।সুমিতের কল এল। কিরে আয়, অপেক্ষা করছি তো।

আসছি বলল বটে।কিন্তু আজ তার খেলায় একেবারেই মন নেই। এমনিতেই সিনিয়র এক দাদা সকালে খেলতে খেলতে বলছিল, তার মাকে পরশু রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আত্মীয় স্বজন কারোর বাড়িতেই যায়নি। পরশু রাতে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল। তারপর থেকে নিখোঁজ।

শোনার পর থেকে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মা হারিয়ে গেলে বুকের ভিতর যে কি চলে তা মা এ’কদিন কোয়ারেণ্টাইনে থাকালীনই সে টের পাচ্ছে।আর এতো মাকে খুঁজেই পাচ্ছে না। তখন থেকেই তার আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। খালি মনে হচ্ছে কখন কিভাবে মা বাড়ি ফিরবে?

স্পিকারে ইলিনার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বান্ধুলি বান্ধুলি শিগগিরি ওই সবুজ গাছটার পিছনে যা, লুকিয়ে পড়, গাড়ি আসছে…

বান্ধুলি একবার সেদিকে তাকালো, তারপর মোবাইলটা পাশে রেখে চুপ করে শুয়ে রইল।ইলিনা আবার চেঁচাচ্ছে, বান্ধুলি কোথায় গেলি! গুলি ছুঁড়ছে তো! লোকা, লুকিয়ে পড়, দেখ, ওদিকে একটা ব্যাঙ্কার আছে…

বান্ধুলি মোবাইলের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ উলটো দিকে করল।

সে শুয়ে শুয়ে ভাবছে মা না এলে সে কোথায় মুখ লোকাবে! যাবতীয় রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, আবদার, জমানো কথা সব কিছুই তো সে মায়ের সঙ্গেই ভাগ করে নেয়। মা বাইরে থাকলেও কখনো এর ব্যতিক্রম হয় না। আর এখন মা দেশে ফিরে এই শহরে থেকেও বাড়ি আসতে পারছে না। এ ক’দিন দেখা তো দূরের ,একটা কথাও তার সঙ্গে হয়নি। তার কুড়ি বছরের জীবনে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল।

এ কথা ঠিক ঠাম্মা তার সব সময়ের সঙ্গী, এতগুলো বছর সেই বেশিরভাগ সময় দেখভাল করেছে, কিন্তু মা- যত বড় হয়েছে তত বেশি আঁকড়ে ধরেছে মাকে।বয়স সন্ধিকালের যাবতীয় অভিব্যক্তি একমাত্র মা-ই গুরুত্ব দিয়ে বুঝেছে। মা ছাড়া তার নিজের ছোট্ট জীবনটাই অপূর্ণ লাগে এখন। মা বলে, সে হল পৃথিবীর সেরা বাচ্চা। আর সে কি করতে পারছে মায়ের জন্য! উলটে একটা মিথ্যে বলে আরও জটিল করে দিল পুরো বিষয়টাকে।

ঠাম্মা পাশের ঘর থেকে ডাকছে, বান্ধুলি একটু মোবাইলটায় চার্জ দিয়ে দিবি?

সে শুয়ে শুয়েই উত্তর দিল, যাচ্ছি।

তারপর গেম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ঠাম্মার ঘরে গেল।

আজ কি রান্না করলে?চন্দ্রাবতী জিজ্ঞেস করল।

আজ চিলি পনির আর রুটি। চলবে?বান্ধুলি উত্তর দিল।

চলবে কী বলছ! দৌড়াবে। একটু থেমে চন্দ্রাবতী বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি কিছুই করতে পারছি না। একটা কথা বলি, সোমাকে ফোন করে আসতে বলে দাও, তোমার এই পরিশ্রম, একা হাতে সব সামলানো আমি আর চোখে দেখতে পারছি না। তোমার বাবা কি কোনো সাহায্য করতে পারছে?

করছে ঠাম্মা। বাসনগুলো মাজছে, ঘর ঝান্ডা দিয়ে মুছে দিচ্ছে।অন্তত চেষ্টা করছে। এমনিতে তো কুঁড়ের বাদশা।সে যে নড়ে চড়ে এই কাজ করছে তাতেই আমি কৃতজ্ঞ।

বান্ধুলির বলার ধরণ দেখে চন্দ্রাবতী হেসে ফেলল। তারপর বলল, সোমাকে ডেকে নিলে কিন্তু ভালো হত।আমার পিছনেও তো তোমাকে সময় দিতে হচ্ছে।নিজে তো কিছুই পারছি না।আর করোনা হবার হলে তাকে কী রোখা যাবে? এতো এখন দীর্ঘদিন চলবে যা বুঝতে পারছি।

তুমি কবে থেকে সায়েন্টিস্ট বা ডাক্তার হয়ে গেলে ঠাম্মা?

তা না হলেও এমনি এমনি কী চুল পাকল? কত বয়স হল বলতো আমার? চার কুড়ির কাছাকাছি হতে চলল। আর ক’দিন আছি তার ঠিক নেই। কাজেই মৃত্য নিয়ে আর চিন্তা করি না। এখন চিন্তা তোমাদের নিয়েই।

বুঝলাম ঠাম্মা, এখন আপাতত চলুক, পরে ভেবে দেখব। আমি যাই, ফোনটা চার্জে দিই।

বান্ধুলি, চন্দ্রাবতী মৃদু স্বরে ডাকল।

বলো।

মায়ের কোনও খবর পেলে?

খবর আর কি? সেখানেই আছে। তবে এরপর কি হবে কে জানে!

এ আবার কি কথা বলছ! সব ভালো হবে।

বান্ধুলি ঠাম্মার মুখের দিকে তাকালো। তুমি বলছ? তুমি তো মাকে সহ্যই করতে পারো না। বাড়ি ফিরলেই খিটখিট করো।

নাতনির মুখে এ কথা শুনে চন্দ্রাবতী স্তব্ধ হয়ে গেল। সে মালশ্রীর জন্য কতটা ব্যকুল এই মুহূর্তে তা কিভাবে বোঝাবে বান্ধুলিকে! খানিকক্ষণ চুপ থেকে তারপর ম্রিয়মান গলায় বলল, মা হও, তখন বুঝবে মায়েদের কত চিন্তা হয় সন্তান বাইরে থাকলে। বকাটাই কেবল দেখলে আমার সঙ্গে কি তোমার মায়ের সম্পর্ক টিকে থাকত এতগুলো বছর! তোমার সঙ্গে কী মায়ের ঝামেলা হয় না? তুমিও তো কম কথা শোনাও না মাকে। তার মানে কি তুমি তোমার মাকে ভালোবাসো না?

বান্ধুলি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মোবাইল নিয়ে মাঝের ঘরে চার্জে বসালো। তারপর আবার ফিরে এল ঠাম্মার কাছে। বিছানার একপাশ দিয়ে উঠে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরল ঠাম্মাকে। চন্দ্রাবতী নিজের বাঁ হাতটা নাতনির পিঠে বোলাতে লাগল।

বান্ধুলি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। চন্দ্রাবতী বুঝতে পারছে বান্ধুলি আর এই মানসিক দুঃশ্চিন্তা বহন করতে পারছে না। এমনিতে সে নিজেকে শক্ত রাখার যতই চেষ্টা করুক আদতে সে একেবারেই নরম মনের, মাটির তালের মত। তাছাড়া মা ছাড়া কোনো সন্তান এই দুঃসময়ে কী ভালো থাকতে পারে!

কোনো কথা না বলে সে নাতনির গায়ে হাত বোলাতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে বান্ধুলি ঠাম্মার বুকে মুখ গুঁজে বলল, সরি ঠাম্মা। আমার মায়ের জন্য খুব … কথা শেষ না করেই উঠে পড়ল।

ফিরে এল নিজের ঘরে। বহুক্ষণ ধরে এফ বিতে মায়ের দুবাই এয়্যারপোর্টে বসে পোস্ট করা ছবি, তার আগের ছবিগুলো দেখল। দুচোখ বেয়ে জল নেমে এল। দেখতে দেখতে তার চোখ আটকে গেল বিবেকানন্দের ছবি দিয়ে মায়ের একটা পোস্টে। সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনোকিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। সেই মুহূর্তে সে ঠিক করল আবাসনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সত্যি কথাটা লিখবে। তারপর যা হবার হবে।কিন্তু যে সমস্যাটা তার কারনে তৈরি হল তা স্বীকার করে নিলে হয়তো একটা পথ খুলে যেতে পারে। মা বলে, একটা মিথ্যে বললে তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অজস্র মিথ্যের জাল বুনতে হয়, সেখান থেকে বেরোনো তখন অসম্ভব। কিন্তু সত্যির জন্য সব লড়াই করা যায়। কারন তখন পাশে অনেককে পাওয়া যায়।

অনেক ভেবে সে গ্রুপে লিখল, আবাসনের সকল গুরুজনদের জানাচ্ছি আমার মা লকডাউন শুরু হবার আগেই এদেশে ফিরে এসেছে। আপাতত সরকারি কোয়ারেন্টাইনে আছে।এবার বাড়ি আসবে।চোদ্দ দিন হতে চলল। আমি মিথ্যে বলেছিলাম। আমি ভয় পেয়েছিলাম, যদি তোমরা মাকে ঢুকতে বাধা দাও, এই ভেবে।আমার এই অনিচ্ছাকৃত মিথ্যে বলার দায় যেন কোনোভাবেই মায়ের উপর না পড়ে। তোমরা তো জানো আমার ঠাম্মাও অসুস্থ।তিনিও চিন্তায় চিন্তায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আশা করি তোমরা আমাকে ভুল বুঝবে না ও ক্ষমা করে দেবে।

মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে আলো নিভিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকল।

১৪

বাসুদেব সৌমিকের ফোন রাখার পর চা দিতে বলল,তার সর্বক্ষণের দেখভাল করার সঙ্গী বিশুকে।বিশুকে তিনি বেহালার নির্জন রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে। বিশুর তখন বয়স এগারো-বারো।জজ কোর্টের এক বিচারপতির বাড়িতে সে ফাইফরমাশ খাটত।আদি বাড়ি বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। পেটের দায়ে বাপ-মা মরা অনাথ ছেলেটিকে তার কাকা রেখে গেছিল কলকাতায়।ভেবেছিল বিচারের ভার যার উপর তিনি নিশ্চয়ই বাচ্চা ছেলেটিকে ভালোভাবেই রাখবেন।

কিন্তু সেই বিচারক প্রতিদিন রাতে নেশা করে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন হেনস্থাও করত বালকটিকে। বহুদিন সেই যন্ত্রণা সহ্য করার পর একদিন বহুকষ্টে নিজের মধ্যে সবরকম সাহস সঞ্চয় করে প্রতিবাদ করে বিশু। তার ফলে ব্যপক মারধোর করে মাঝ রাতে বাড়ি থেকে বের করে দেয় বিশুকে সেই বিচারপতি। সেদিন প্রকৃতিও দারুন বিক্ষুব্ধ ছিল। সন্ধে থেকেই তুমুল ঝোড়ো হাওয়া আর তার সঙ্গে এক নাগাড়ে বৃষ্টি।

সেদিন অন্য দিনের তুলনায় বেশ রাত হয়ে গেছিল বাসুদেবের ভাইয়ের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরতে। সেইসময় নির্জন রাস্তায় অতটুকু একটা ছেলেকে ওভাবে বসে কাঁদতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে এসে তিনি জানতে চান কি হয়েছে?

বিশু তখন এতটাই ভয়ে কাঁপছিল যে বাসুদেব আর কোনো প্রশ্ন না করে পরম মমতায় গাড়িতে তুলে নেন।তারপর থেকে বিশু তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। পড়াশোনাও শেখান তাকে বাসুদেব। এরপর নিজের অফিসে তার পার্সোনাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করেন।

বিশুও বাসুদেবকে একই সঙ্গে বাবা ও গুরু হিসেবে সম্মান করে। প্রায়ই সে বলে, বাবা না থাকলে আমার কাছে দুটো পথ খোলা ছিল, একটা খুব সহজ পথ, সেটা হল ভিক্ষে বা চুরি ডাকাতি, আর একটা আত্মহত্যা। কিন্তু মরতে আমার দারুন ভয়। তাই বাবা না নিয়ে এলে হয়তো প্রথম পথটাই বেছে নিতাম।

সেই থেকে আজ চল্লিশ বছর হতে চলল বিশু বাসুদেবকে ছেড়ে যায়নি। বাসুদেব তার মেয়ে জামাই এমনকি নাতনিকেও বলে রেখেছে, তার অবর্তমানে বিশুকে যেন তারা দেখভাল করার পুরো দায়িত্ব নেয়। এমনকি বাড়িত একটা অংশও লিখে দিয়েছেন তার নামে।ব্যাঙ্কেও বেশ বড় অঙ্কের টাকা ফিক্সড করে দিয়েছে,যাতে অর্থের জন্য বিশুকে কারোর উপর নির্ভর করতে না হয়।

বিশু বিয়ে করেনি।নিজের গ্রামের বাড়িতেও ফিরে যায়নি। মালশ্রী, বান্ধুলি এদেরকেই সে নিজের মানুষ মনে করে।

এখন বিশু চা করে দিয়ে রান্না ঘরে গেল।বাসুদেব গরম খাবার ছাড়া খেতে পারে না।খায় একটা কী দুটো রুটি।একটা তরকারি দিয়ে আরেকটা কোনও ভাজা দিয়ে।আর একটু দুধ। তাও অধিকাংশ দিনই একটা রুটি, একটু তরকারি, এক চুমুক দুধ খেয়ে উঠে পড়ে বাকিটা বিশুর জন্য রেখে।

এই নিয়ে বিশু রাগারাগি করলে বলে, সেই বিখ্যাত ডায়লগটা মনে নেই? বেশি খেলে বাড়ে মেদ, অনাহারে নাহি খেদ… বলেই হাসতে থেকে।

বিশু আরও খানিকক্ষণ খাওয়ানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে খেতে বসে যায়। বিকল্প খাবার হিসেবে সে তাই চায়ের সঙ্গে ইচ্ছে করে নানা রকম বিস্কুট প্লেটে সাজিয়ে দেয়। একটু বকাবকি করলেও বাসুদেব সেগুলো শেষ অবধি খেয়ে নেয়। এই এখন যেমন বিশু চারটে ক্রিমক্রাকার বিস্কুটের মাঝখানে অনেকটা চিজ, টমাটো, গোলমরিচ আর নুন দিয়ে স্যান্ডুইচের মতো দিয়ে গেল।

সে ক’দিন ধরেই খেয়াল করছে বাবা আজকাল কিছুই খাচ্ছে না।সর্বক্ষণ একটা গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছে। চিন্তাটা মালশ্রীদিকে নিয়ে বুঝতে তার অসুবিধা হয় না।সে জানে বাবা এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি ফোন করলে সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান হয়ে যাবে। এমনকি তার যদি নিজের ফোন করতে অসুবিধা থাকে, সে করলেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই দেখা হবে। এতদিনে সে বাবার সঙ্গে থেকে বুঝেছে পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ হন স্পিরিচুয়্যল ব্যক্তিরা। তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়,আমলাতন্ত্র কোন কিছুর দরকার হয় না।বরং আপাতভাবে যাদের মনে হয় ক্ষমতাবান তারা এই মানুষগুলোর সান্নিধ্য পাবার জন্য ব্যকুল থাকে।বাসুদেবের কাছে সে এমন মানুষ তো কম আসতে দেখল না এত বছরে। সাধারণ মানুষ হলে কোটি কোটি টাকা,নাম, যশ, প্রভাব প্রতিপত্তি কামিয়ে নিত এই দর্শনপ্রার্থীদের থেকে।কিন্তু বাসুদেব এসবের অনেক ঊর্দ্ধে। তিনি চিরকাল মনে করেন মানুষের মঙ্গল কামনা করা ছাড়া তার আর কিছু পাওয়ার বা চাওয়ার নেই। এই অবস্থাতেই তিনি যে নিজের প্রয়োজনে কাউকে ফোন করবে না, সেটা বিশু এত বছরে বুঝে গেছে। অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। যদিও সে নিশ্চিত দিদি নিরাপদে সবরকম প্রতিবন্ধকতা দূর করে যথাসময়েই বাড়ি ফিরবে।বাসুদেবের মধ্যে সেই ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে। সে একাধিকবার সেইসব বিরল ঘটনার সাক্ষী। মাঝে মাঝে ভাবে সেইসব ঘটনা সে লিখে রাখবে।কিন্তু বাসুদেবের সেখানেও আপত্তি।কোনো রকম প্রচারের আলোয় আসতে চান না। অবশ্য সব সময় তা এড়াতেও পারেন না। মালশ্রীদির বিয়েতে কিংবা এবাড়ির কর্ত্রী যখন মারা গেলেন, তখন কি তিনি আটকাতে পেরেছিলেন তাঁর ভক্তদের! বিনা আমন্ত্রণে শুধুমাত্র সংবাদ পেয়েই যে এত মানুষের সমাগম হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

বারো বছরের মেয়েকে রেখে বৌদির আকস্মিক মৃত্যু যেন বাসুদেবকে আরও বেশি করে নির্জন করে দিয়েছিল। এই বাড়িতে তার আসা এরও বছর পাঁচেক আগে। বহুবার তার জানতে ইচ্ছে করেছে, যিনি বাইরের লোককে সব রকম বিপদ থেকে বাঁচান, আগে থেকেই বুঝতে পারেন কী ঘটতে চলেছে, তিনি কেন নিজের স্ত্রীর মৃত্যু আটকাতে পারলেন না! নাকি চাননি আটকাতে!কিন্তু শেষ অবধি সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেনি।

তবে বাসুদেব বোধহয় তার এই জিজ্ঞাসাটা বুঝতে পেরেছিলেন।সরাসরি কিছু না বলে বলেছিলেন, স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁর মৃত্যু আটকাতে পারেননি।বুদ্ধ, চৈতন্য, যীশু, মহম্মদ, রামকৃষ্ণক, বিবেকানন্দও এর থেকে মুক্তি পাননি। যার যখন সময় হবে তখন যেতেই হবে।আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি ভালো রাখার।

মালশ্রীদির বিয়ে হয়ে যাবার পর বাসুদেব সব দিক থেকেই মুক্ত হয়ে গেলেন। বাড়ির বাইরে যাওয়াটাও বন্ধ করে দিলেন।খুব প্রয়োজন না হলে কখনোই বেরোন না। অগত্যা ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে তার যাবতীয় বাইরের কাজ তাকেই সামলাতে হয়।

চা খেতে খেতে বাসুদেব সিগারেট ধরালো।চায়ের সঙ্গে সিগারেট না খেলে তার স্নায়ুগুলো যেন ঠিক নিজের আয়ত্ত্বে আসে না।এটা তার একেবারেই ছোটো বেলার অভ্যাস। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় একটা নিরীহ চা বিক্রেতাকে পুলিশ মারছে দেখে কিছু না ভেবেই নিজের হাতের ছাতাটা দিয়ে পুলিশকে মেরেছিল। সেই অপরাধে তার শাস্তি হয়েছিল তিন মাসের জেল। নামে সংশোধনাগার হলেও সেখানে গিয়ে সে বুঝেছিল আদতে এখান থেকে বেরিয়ে অধিকাংশ নাবালকরাই দাগী গুন্ডা হবার সব রকম ট্রেনিং সেন্টার হল এই জেল।

এই সময় সে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার জন্য নিয়ম করে বিবেকানন্দের কর্মযোগ পড়তে শুরু করেছিল। যদিও তখন সেভাবে কিছুই বোঝেনি।তবু অভ্যাসটা রয়ে গেল। আর সেইসময়ই তার মধ্যে জন্ম নিল অধ্যাত্মবোধ।বাহ্যিক কাজের বাইরে প্রতিদিন নিয়ম করে চার পাঁচ ঘন্টা যোগ সাধনা, ধ্যান এসবের মধ্যেই তিনি নিজেকে, নিজের আনন্দকে নিয়ে মেতে থাকেন সেই থেকেই।

পাশাপাশি আরেকটি খারাপ নেশাও শুরু হয় এখান থেকেই।অন্যান্য আসামীদের সঙ্গে বিড়ি সিগারেটে টান দেওয়ার অভ্যাস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে সব অভ্যাস পালটে গেলেও এই পুরোনো নেশাটা কোনও ভাবেই ছাড়তে পারেনি।

সিগারেটে টান দিয়ে একটা সুখের হাসি হাসল বাসুদেব। তার মুখে এখন প্রশান্তির ছাপ।যেন দিশা পেয়ে গেছে কিভাবে মালশ্রী বাড়ি ফিরবে তার।

সিগারেটের শেষ অংশটা আশট্রেতে ফেলে বাসুদেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের ঘরের দরজাটা ফাঁক করে, বিশু আমি স্নানে গেলাম, বলে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকল।

বিশু জানে এরপর বাসুদেব বাথরুম থেকে বেরিয়ে টানা দেড় থেকে দু’ঘন্টা পুজো করবে, তারপর একটা সিগারেট শেষ করে রাতের খাবার খেতে বসবে।

এই অবসরে সে নাম সংকীর্তন করতে বসে। টানা এক ঘণ্টা ঠাকুরের গান করে রুটি বানাবে।তার মন বলছে, বাবা দু- একদিনের মধ্যেই যোগ সাধনায় বসবে। তার ঘর থেকে একটা অন্য রকম গন্ধ নাকে এসেছে বিশুর।

সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল পরের কটা রাত জাগার জন্য।

১৫

সকাল থেকে একটা কিছু ঘটছে টের পাচ্ছে মালশ্রী।ব্যস্ত পায়ের শব্দ, ফিসফাস, অস্পষ্ট ভাবে হলেও শুনতে পাচ্ছে সে। বিছানা ছেড়ে সে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আওয়াজগুলো শোনার চেষ্টা করল। এখনো তার ঘরে চা বা জলখাবার কিছুই আসেনি। ঘড়িতে কটা বাজে নির্দিষ্টভাবে বুঝতে না পারলেও প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে অনুমান করতে পারছে। খিদে পাচ্ছে। প্যাভলকের সেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মত একটা নির্দিষ্ট ধরা বাধা সময়ে পেট চিনচিন করে বুঝিয়ে দেয় খিদে পেয়েছে।

বান্ধুলি কখনো খিদে পেয়েছে এটা বুঝতে পারে না। কিন্তু নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর তার ঝোঁক উঠত ছোটোবেলায়। হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে বসত। কেন কাঁদছে, খিদে পেয়েছে কিনা এসব জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলত না। অথচ একনাগাড়ে কেঁদে যেত।

মালশ্রী আবিষ্কার করেছিল ওই সময় তাকে কিছু খাইয়ে দিলে সে চুপ করে যায়। অর্থাৎ তার খিদে পেত।কিন্তু খেলার খেয়ালে সেটা বুঝতে পারত না।

এখন তার নিজের সে রকম একটা বিরক্তি কাজ করছে। অল্প অল্প গা গোলাচ্ছে।এরপর যখন খাবার আসবে তখন হয়তো খিদে মরে যাবে।

কিন্তু হলটা কি? কেন কেউ এখনো এল না?

সে দরজার সামনে থেকে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েকজন সেখানে দাড়িয়ে।একটু দূরে দূরে নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে।প্রত্যেকের মুখেই মাস্ক।

একটা অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে আসছে। এখানেই আসছে বোধহয়। হঠাৎ তার মনে হল কারোর কি কোভিড ধরা পড়ল? তখনি ভাবল, তাহলে কি আমারই রিপোর্টে পজেটিভ এসেছে? তাই কি সকাল থেকে আমাকে খেতে দেওয়া হল না? আমাকে এখন অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে নিশ্চয়ই। তারই প্রস্তুতি চলছে।

একটা অচেনা শিরশিরানি শরীর জুড়ে বয়ে গেল সেই মুহূর্তে।

তার মানে আমার আয়ু শেষ হয়ে এল। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে আর আমার দেখা হল না। মেয়েটার জন্য প্রাণ আকুলিবিকুলি করে উঠল।

বান্ধুলি, আর কখনো তোর সঙ্গে দেখা হবে না মা। এবার থেকে তুই একা হয়ে গেলি। আমার মৃতদেহ কি দেখতে পাবি? নিজের মনে নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।

লন্ডনে এই রোগে কেউ মারা গেলে হাসপাতাল তার মৃত দেহ বাড়ির লোকেদের দিচ্ছিল না। সহর থেকে বহু দূরে নির্জন জায়গায় সরকারি ব্যবস্থায় দেহ সৎকার করা হচ্ছিল নির্দিষ্ট ভাবে মুড়িয়ে। মৃতদেহ থেকেও ভাইরাস সুস্থ শরীরে সংক্রামিত হয়।

এখানে কি করবে?সৌমিক, মা এরা কেমন থাকবে সে না থাকলে! সৌমিক কি আরেকটা বিয়ে করবে? কিই বা বয়স তার! ছেলে হিসেবে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সটা এমন কি! কিন্তু সে তো সব সময় বলে হাজার ঝগড়া হোক তোমার সঙ্গে, তবু এক জন্মে একটাই বিয়ে হয়, একবারই সাত পাকে ঘোরা। দুবার আর তা হয় না।

কিন্তু চন্দ্রাবতী! তিনি কি চাইবেন ছেলে জীবন এভাবেই কেটে যাক! তিনি তো এমনিতেই বলেন, এমন সব চাকরি যে স্বামী স্ত্রী এক সঙ্গে থাকা যায় না। আলাদাই যদি থাকবি তো বিয়েটা করার দরকার কি ছিল?

আর বান্ধুলি! সে কিভাবে থাকবে মা ছাড়া? যদিও আমাকে ছাড়া থাকা তার অভ্যাস হয়ে গেছে।তবু এটা তো জানে যেখানেই হোক মা আছে। রোজ শুতে যাবার আগে, ঘুম থেকে উঠে মার সঙ্গে কথা না হলে তার শান্তি নেই। বাড়িতে থাকলে ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখেই মা মা বলে বিছানা থেকেই চেঁচাবে। যতক্ষণ না বিছানায় গিয়ে সে তাকে চটকাবে, ততক্ষণ সে এভাবেই শুয়ে থাকবে।

চন্দ্রাবতী বলে, ধেরে মেয়ের আদিখ্যেতা দেখো! মাকে না দেখে তিনি বিছানা ছাড়বেন না। মা কি রোজ থাকে তোর? তখন তো দিব্বি উঠে পড়িস।

পরমুহূর্তেই মালশ্রীর উদ্দেশ্যে বলে, যা না, মেয়েটা মা মা করে হেঁদিয়ে গেল, আর তুই এখন রাজ্যের কাজ নিয়ে বসলি! রাখ ওসব। আগে মেয়ের কাছে যা।

এখন কি হবে?আমি তো আর তোমাদের কাছে ফিরতে পারব না। তুমি সব সামলে নিও মা। নিজের মনেই বিড়বিড় করল।

না, না বাড়ির কাউকে আসতে হবে না, তার থেকে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে গেলে তারাও… আর ভাবতে পারল না সে। মাথাটা ঘুরে গেল।কোনো রকমে টাল সামলে বিছানায় ফিরে এল। বিছানার পাশে রাখা বোতল থেকে জল খেল।

নিজেকে নিজেই বিদায় জানাবার জন্য প্রস্তুত হল। তখনি তার ভাবনায় এল, কিন্তু আমার তো গলা ব্যথা, জ্বর, শ্বাস কষ্ট এসব কিছু হচ্ছে না। এগুলোই এ রোগের লক্ষন। রোজ সিস্টার এই প্রশ্নগুলোই করে। তাহলে? আর সেই ডাক্তার যার আসার কথা সাবিনা বলেছিলেন, সেও এল না এখনো পর্যন্ত।

এইসব প্রশ্নের মধ্যে হঠাৎ করেই যেন সে একটা আশার আলো দেখতে পেল। চোখ মুছে সে আবার জানলার কাছে ফিরে গেল। অ্যাম্বুলেন্স নেই। তার মানে সে নয়। অন্য কেউ। কিংবা হয়তো অ্যাম্বুলেন্সটা আদৌ এখানে আসেইনি। সে সাইরেনের শব্দ শুনে অনুমান করে নিয়েছিল এসব। তাই যেন হয়। নিজেকেই বোঝালো সে।

তখনি শব্দ করে দরজা খুলে একজন তার চা আর খাবার নিয়ে ঢুকল।

সে তাকে দেখে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, আজ এত দেরি হল কেন? কিছু কি ঘটেছে?

আজকের ছেলেটি নতুন। একে আগে দেখেনি। কিংবা হয়তো অন্য কোথাও ডিউটি দেয়, তার ঘরে আসে না।

ছেলেটি একটু ভেবে নিয়ে বলল, একজনের পজিটিভ এসেছে।তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।সেইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য খাবার বানাতে দেরি হয়ে গেছে। আসলে সত্যি বলব ম্যাডাম, আমরা সবাই একটু ঘাবড়ে গেছি। এখানে ফার্স্ট টাইম ধরা পড়ল তো! যারা তাকে দেখছিল, খাবার দিচ্ছিল তারাও আজ থেকে কোয়ারেন্টাইনে।

মালশ্রী বলল, তাই বুঝি তুমি এসেছ?

হ্যাঁ। আগের দশ জন বসে গেল, আমরা দশজন এলাম।

ওঃ। সিস্টার, ডাক্তার সবাই কোয়ারেন্টাইনে?

হ্যাঁ। সে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, সবাই অবশ্য এখানেই রয়েছে।বাড়ি তো যেতে পারবে না।যাক, চিন্তা করবেন না, আমরা আছি।

ছেলেটিকে বেশ মিশুকে মনে হল মালশ্রীর।এখানে এসে থেকে সবাইকে কেমন গম্ভীর দেখছিল সে, এই প্রথম ব্যতিক্রম দেখল।

সে জানতে চাইল, তোমার নাম কি ভাই?

শিবেন।

আচ্ছা শিবেন তাঁকে কোন হাসপাতালে নিয়ে গেল?

সরকারি কোনো হাসপাতালেই নিয়ে যাবে। এখন তো সব কটা সরকারি হাসপাতালই করোনা স্পেসালিটি হসপিটাল হয়ে গেছে।তাছাড়া আপনাদেরও এখন ছাড়া যাবে না। মনে হচ্ছে আরও চোদ্দ দিন রাখবে এখানেই।

কেন? মালশ্রী জানতে চাইল অধীর আগ্রহ নিয়ে।

আরে একজনের তো নয়, পুরো দশ জন কোয়ারেন্টাইনে। কাজেই আপনাদের মধ্যে যে কেউ এক্টিভ কেরিয়্যার নয় তা নিশ্চিত করে বলা যায় কি?

কথাটা শুনে আঁতকে উঠল মালশ্রী। আবার চোদ্দ দিন! এখানেই! সে বলল, বাড়িতে গিয়েও তো কোয়ারেন্টাইনে থাকা যায়।

যায় হয়তো।কিন্তু আপনি যেখানে থাকেন সেখানকার লোকেরাই ঢুকতে দেবে না। চারদিকে যা হচ্ছে! ডাক্তার সিস্টার স্বাস্থ্য কর্মীদেরই পাড়া ছাড়া করছে, তাতে আপনারা তো সকলেই সাক্সপেক্টেড।

তাহলে অন্য কোনো রোগী মানে কারোর অন্য কোনো সমস্যা হলে তারা কোথায় যাবে? এই চিন্তায় আমার তো এখন হার্ট এ্যাট্যাকও করতে পারে। তখন কী হবে? মালশ্রী একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করল।

শিবেন যেন এই প্রশ্নটা আসা করেনি। সে মালশ্রীর দিকে না তাকিয়ে বলল,আচ্ছা দিদি, এখন চলি। সবাইকে জলখাবার দিতে হবে।অনেক দেরি হয়ে গেছে। বলে আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল।

মালশ্রীর মনে হল শিবেন প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্যই তাড়াতাড়ি চলে গেল। কিন্তু এখন তার আর অতটা ভয় করছে না। যেন আজকের মত যমের দূতকে সে ফেরত পাঠাতে পেরেছে, এমনভাবে মুড়ি আর দুধ মেশাতে মেশাতে মালশ্রী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তেই মনে হল এই স্বস্তিটা সাময়িক। একবার যখন এখানে এসে গেছে, কাল যে তার রিপোর্টও পজেটিভ আসবে না তার কোনো মানে নেই।

কিছু ঘটার আগে বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুব জরুরী।কিন্তু কিভাবে? যদি এদের কারোর থেকে ভিডিও কল অন্তত করা যায়! সেই চেষ্টা করতেই হবে।

খাওয়া শেষ করে স্নানে ঢোকার আগে মালশ্রী বিড়বিড় করল, এই ঝড় থেমে যাবে একদিন।কিন্তু কবে?

১৬

সারারাত একনাগাড়ে ধ্যান করার পর রাত শেষ আর ভোর হবার ব্রাহ্ম মুহূর্তে বাসুদেব চোখ খুলল।এই সময় কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছে সে। এই মুহূর্তাটাই সেই চরম ক্ষণ পরমপুরুষ বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড তৈরি করেছিলেন। আর কোনো ভয় নেই তার মেয়েকে নিয়ে।যে সব সংশয় দানা বেঁধেছিল তা দূর হয়ে গেছে।

ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার এখন। এক জায়গায় নিজের শরীরকে রেখে অন্য জায়গায় আত্মার বিচরণ,আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরে না এলে শরীরের সব কটা দরজা বন্ধ হয়ে যায় এই সাধনায়। এতটুকু মনোসংযোগ নষ্ট হলে দুজনেরই ক্ষতি। নিজের বয়স হয়েছে, এখন নিজে চলে গেলেও এই পৃথিবীর খুব বেশি ক্ষতি হবে না, কিন্তু সকলের জন্য তাকে প্রার্থনা চালু রাখতেই হবে। একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারন করে সে নিশ্চিন্ত মনে স্নানে গেল।স্নান সেরে তার কড়া চা আর সিগারেট চাই।তবেই শরীরটা আবার বল পাবে।কিন্তু বিশুকে কী এখন ডাকা ঠিক হবে? ভাবতে ভাবতেই দরজায় মৃদু ধাক্কার আওয়াজ পেল।সে হাসিমুখে দরজা খুলল।বিশু দাঁড়িয়ে চা নিয়ে।

কিরে এত ভোরে উঠে পড়েছিস?

জানি আপনার এইসময় চা দরকার হবে।কিন্তু বাবা, এটা তো একটা ফোন করলেই সমাধান হয়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে। তবে কেন…

বাসুদেব তার সন্তানসম বিশুর দিকে তাকিয়ে হাসল। সব কিছুর প্রয়োজন আছে জীবনে। শুধু আলোটাই দেখব, ভোগ করব আর আত্মাকে কিছু ফিরিয়ে দেব না তা কি হয়! এই আইসোলেশনটার খুব দরকার ছিল মালশ্রীর, বলে বাসুদেব বিশুর মাথায় হাত রাখল।

সেই মুহূর্তে তার শরীরে অদ্ভুত এক আলোড়ন হল।যেন বিদ্যুতের একটা প্রবাহ তার শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। সে দেখল স্বয়ং শ্রী বাসুদেব তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার এক হাতে সুদর্শন চক্র অন্য হাতে শাঁখ। পিছনে আলোর বন্যা বইছে। এ কী দেখছে সে!

কোন রকমে চায়ের কাপটা সামনে রাখা কাঠের ছোট্ট টেবিলে রেখে তাঁর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল বিশু। এই মুহূর্তটার জন্যেই সে এত বছর ধরে প্রতীক্ষা করেছে।এতদিনে তার ইহজীবন স্বার্থক হল।

বাসুদেব বিশুর দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিল।এবার তাকে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে হবে।

বহুদিন বাদে মালশ্রীর ঘুম ভাঙল বেশ দেরি করে। এখানে আসার অনেক আগে থেকেই তার সাউন্ড স্লিপ বা গভীর ঘুম বলতে যা বোঝায় তা উধাও হয়ে গেছিল।এমনিতেই তার ঘুম খুব গাঢ় নয়, তারপর এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে সেখানকার সময়ের সঙ্গে এডজাস্ট করতে বেশ সময় লাগে। যখন পুরোপুরি অভ্যাস হয়ে যায় তখনি ফেরার সময় এসে পড়ে। এবার আরও খারাপ অবস্থা ছিল। প্রথম মাসের পরেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে গিয়ে দুই দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে অসুবিধা হচ্ছিল।তাছাড়া মনের মধ্যে কোভিড নিয়ে একটা আতংকও ক্রমশ দানা বাঁধছিল। দেশে ফেরার তাড়া, ফিরেও বাড়ির সবাই ঠিক থাকবে কিনা এসব ভাবনায় তার ঘুম প্রায় উড়ে গেছিল। তারপর যাও বা ফেরা হল, এসে থেকে কোয়ারেন্টাইনে।

চল্লিশ বছরের জীবনে এই প্রথম একদম একা।মোবাইল,ল্যাপটপ, গ্যাজেট যেগুলো তাদের জীবনের সবসময়ের সঙ্গী সেগুলোও নেই।

এমনকি একটা কাগজ বা বইও দেয়নি যা দিয়ে সময় কাটতে পারে। এ যেন একপ্রকার নির্বাসন। ব্রিটিশ শাসনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হত যাতে তারা কারোর মুখ না দেখে একা একাই পাগল হয়ে যায়, নয় আত্মহত্যা করে।

প্রথমদিকে তার নিজেরও সেরকম পাগলের মত লাগছিল। অঙ্কের হিসেবে চোদ্দ দিন খুব বেশি দিন নয়। কিন্তু চোদ্দকে যদি চব্বিশ ঘন্টা দিয়ে গুণ করা হয় তবে তার সময়টা কম নয়।

ধীরে ধীরে শান্ত হয়েছে তার মন। উপলব্ধি করেছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই একেবারে নতুন এবং অজানা। এক মুহূর্তের সঙ্গে আরেক মুহূর্তের কোনো মিল নেই।এখন সুস্থ আছি বলে কাল বা একটু বাদেও থাকব এটাও অনিশ্চিত। শুধু এই মুহূর্তটুকুই সত্য।বাকি কোনো কিছুর উপরেই তার নিয়ন্ত্রণ নেই।

কাল মাথার মধ্য এক আতংক নিয়ে শুতে গেছিল।এই কোয়ারেন্টাইন সেন্টারেও পজেটিভ এসেছে মানে সেও যে কোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে,এই ভাবনা তাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল।সেই নিয়েই চোখ বোজার চেষ্টা করছিল।

তখনি এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল, যা তার যুক্তি বুদ্ধি তর্ক দিয়ে বিশ্লেষণের বাইরে।সারা ঘর জুড়ে সে স্তোস্ত্র ও মহামৃত্যঞ্জয় মন্ত্র উচ্চারণ শুনতে পাচ্ছিল।তার সঙ্গে যজ্ঞে দেওয়া ঘি বেলপাতা আর চন্দন কাঠের গন্ধ সে স্পষ্টভাবে অনুভব করছিল। পুজারীর গলা তার খুব ভালোভাবে চেনা। ছোট্ট থেকে শুনে আসছে তার পাঠ।সে অবাক হচ্ছিল বাসুদেব এখানে এলো কিভাবে?এখানে কারোর আসা নিষিদ্ধ। তবে কী বাসুদেব নিজের মেয়েকে দেখার জন্য বিশেষ অনুমতি যোগাড় করেছে! তাই যদি হয় তবে বাবা তাকে একবারও ডাকছে না কেন?

সে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল চোখ খুলতে। বাবা বলে চিৎকার করে ডাকতে।কিন্তু ততবারই আরও বেশি করে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছিল।সে কিছুতেই তাকাতে পারছিল না। ক্রমশ তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।সেই ঘুম ভাঙল এতক্ষণে।

চারদিকে তাকালো মালশ্রী।পাশের টেবিলটায় সকালের চা,বিস্কুট, মুড়ি, এমনকি দুপুরের ভাতের প্যাকেটটাও পরে আছে। ক’টা বাজে এখন? একটা-দুটো-তিনটে… কেউ ডাকেনি তাকে। সেতো বেঁচে আছে। তবে? নাকি ডেকেছিল দূর থেকে! সে ডাক তার মাথায় গিয়ে পৌঁছায়নি!

কিন্তু এগুলো নিয়ে আর তার মন বিষন্ন নয়।বরৎ এক অনাবিল শান্তি তাকে স্পর্শ করছে।সমস্ত তামসিক শক্তি থেকে বেরিয়ে এসে সে যেন এতদিনে নিজেকে খুঁজে পেল। বাসুদেব তাকে এই প্রশান্তির কথাই বলত,যা মনকে এক অন্য আলোর সন্ধান দেয়।

বহুদিন বাদে নিশ্চিন্ত মনে মালশ্রী বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকলো। যেন তার নতুন জন্ম হল।ভালো করে স্নান করে এই নব জন্মের দিনটাকে সে পালন করবে।

###

সেদিন সৌমিক, বান্ধুলি এমনকি চন্দ্রাবতীও ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়।দরজার বেল ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে। কোনো রকমে সৌমিক চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলল। সামনে দাঁড়িয়ে আবাসনের সেক্রেটারি পার্থদা ও প্রেসেডেন্ট অরুণদা। সৌমিক তাদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল আসার কারন।

সরি, তুমি বোধহয় ঘুমচ্ছিলে, এসে বিরক্ত করলাম।পার্থদা বলল।

ভিতরে এসো। বলে দরজার সামনে থেকে সরে এল সৌমিক। বোসো, বলে সোফার দিকে হাত দেখিয়ে সে বলল, এক মিনিট, আসছি একটু ভিতর থেকে।

কলিংবেলের শব্দ শুনে বিছানার সামনের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো।সাড়ে এগারোটা বাজে। এত বেজে গেল!এক লাফে বান্ধুলি উঠে মুখ ধুয়ে নিল চট করে। তারপর রান্নাঘরে চা বসাবার আগে পার্থ জ্যেঠুর গলা শুনে বাইরের ঘরের পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, চা খাবে তোমরা?

নারে, অনেক বেলা হয়ে গেছে।একটু থেমে অরুণ জ্যেঠু বলল, তোর মেসেজ পেয়েছি।ওই নিয়েই… কথা শেষ হবার আগেই বান্ধুলি ব্যকুল স্বরে বলল, আমার মায়ের কিছু হয়নি। লন্ডন থেকে ফেরার পর চোদ্দ দিন হয়ে গেল মা কোয়ারেন্টাইনে।আমাদের পর্যন্ত দেখতে দেয়নি মাকে।তবে মায়ের কিছু হয়নি।হলে জানাতো।

সৌমিক ফ্রেস হয়ে ততক্ষণে ড্রইংরুমে চলে এসেছে।

পার্থদা বলল, তুই বাবার জন্য চা করে আন। এত চিন্তা করিস না। মা আসবে ঠিক সময়েই।

সৌমিক বুঝতে পারছিল না এরা কি বলতে চাইছে! বান্ধুলিও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।

ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে।প্রতিটা সেকেন্ড তাদের কাছে মনে হচ্ছিল অনন্ত সময়। যেন সব কিছু থমকে গেছে,শুধু ঘড়ির শব্দ আর মাথার উপর পাখাটা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

তাদের সেই অবাক করা মুখের দিকে লক্ষ করেই পার্থদা বলল, তোমার শ্বশুড়মশাই ফোন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আমার কথা হয়েছে। আমি অরুণকেও সব জানিয়েছি। সন্ধে ছটার সময় কমিউনিটি হলে কিংবা কি একটা ওয়েব অ্যাপ আছে, সেটার মাধ্যমে আমরা এই নিয়ে আলোচনা সভা ডেকেছি।যেভাবেই হোক না কেন তোমাকে পাঁচটার মধ্যে জানিয়ে দেব।মেশোমশাই বললেন, চোদ্দ দিন নয়, আরও দুই সপ্তাহ ওখানে থাকতে হতে পারে মালশ্রীকে। আমরা যদি আপত্তি না জানাই তবে নিয়ে চলে আসাটাই সবার জন্য ভালো হবে।

সৌমিক আশ্চর্য হল পার্থদার কথায়।কাল চোদ্দ দিন পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।সে অর্থে পরশু বাড়ি আসার কথা ছিল মালশ্রীর।সেখানে আরও চোদ্দ দিনের কথা বাসুদেবই বা কিভাবে জানলেন? পার্থদার ফোন নাম্বার কোথা থেকে পেলেন তিনি? তার সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

বান্ধুলিও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটতে চলেছে তাদের সঙ্গে। সে কোনো রকমে বলল, জ্যেঠু প্লিস মাকে আসতে দাও।মা কোথাও বেরবে না, একটা ঘরেই দরকার হলে আরও এক মাস থাকবে।কিন্তু আমরা আর পারছি না এভাবে।

পার্থদারা উঠে দাঁড়ালো। একটা উপায় ঠিক বের হবে।চিন্তা করিস না। তোর দাদু আছেন, আমরাও তো আছি। সকলে মিলেই গোটা একটা পরিবার।এখন চলি। পাঁচটা নাগাদ রেডি থেকো।

কমিউনিটি হলে নয়, শেষ পর্যন্ত ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আবাসনের সকলে যে যার ঘরে বসেই আলোচনায় অংশ নিল। প্রবীণরা প্রথমে একটু আপত্তি জানালো। তাদের বক্তব্য ছিল, এখনি না ঢোকানোই ভালো। আরও কিছুদিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর একদম নেগেটিভ সিওর হয়ে তবে আসাই ভালো।

কিন্তু তাদের যুক্তি তুলনায় নবীনদের যুক্তির কাছে ভেসে গেল। তারা বোঝালো, যে কোন পরিবারের যার খুশি এটা যখন তখন হতে পারে। এই যে আমরা দোকান যাচ্ছি,বাজার যাচ্ছি সেখান থেকেও আসতে পারে।আমরা কেউ সম্পূর্ণরূপে নিরাপদে থাকব এমন প্রতিশ্রুতি কেউ দিতে পারব না। কাকিমার এর মধ্যে পজেটিভ আসেনি। নিশ্চয়ই ওখান থেকে ছাড়ার আগে আরেকবার রিপোর্ট করিয়েই ছাড়বে।যদি সেটাও নেগেটিভ থাকে তবে আসার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা নেই। একটা মানুষকে যদি নিজের বাসস্থানে ঢুকতে না দেওয়া হয় তবে তার থেকে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।

বান্ধুলি ভিডিও চলাকালীণ একবারও বাবার পাশ থেকে ওঠেনি। সে চুপ করে সকলের কথা শুনছিল।নিশ্চিন্ত হতে চাইছিল মা শেষ অবধি আবাসনে ঢুকতে পারছে কিনা!

ঘন্টা দেড়েক আলোচনার পর সকলেই মালশ্রীর ফেরার পক্ষে সিলমোহর দিল।

পার্থদা সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই লকডাউন পর্যায়ে কিভাবে পুরো আবাসনকে নিরাপদে রাখা যেতে পারে তার একটা পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা আবারও দিলেন। যারা লকডাউন শুরু হওয়া থেকে এখানে ছিলেন, অর্থাৎ দুজন সিকিউরিটি গার্ড, একজন প্লাম্বার, একজন ইলেক্ট্রশিয়ান, একজন সুইপার আর ম্যানেজার লকডাউনের পুরো পর্যায়টায় এখানেই থাকবেন।তাদের যাবতীয় খরচা আবাসন কর্তৃপক্ষ বহন করবে। তাদের পরিবারের জন্য টাকা পয়সা যা দেওয়ার তা দুদিনের মধ্যে ব্যাঙ্ক একাউন্ট বা জি পের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা হবে। স্থানীয় নার্সিংহোমকে বলা হয়েছে যেকোনো এমার্জেন্সিতে তাদের সাহায্য করতে। আপাতত সরকার থেকে যে অস্থায়ী বাজার বসানো হচ্ছে তার একটি তাদের গেটে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একা থাকেন তাদের প্রতিদিন নিয়ম করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও দেখভালের দায়িত্ব এখানকার বাসিন্দাদের নিতে হবে।

তবে আবার মনে করিয়ে দেওয়া হল এই কদিন বাইরের ড্রাইভার, কাজের পরিচারিকা ঢুকতে পারবে না এই আবাসনে। এইটুকু অসুবিধা বাদ দিলে বাকিটা সবাই মেনে নিলেন মতান্তর ছাড়াই।

মিটিং শেষ।বান্ধুলি বাবাকে জড়িয়ে ধরল। মা ফিরতে পারবে পরশু এই আনন্দে তার চোখে জল।সৌমিকের পুরো বিষয়টাই রহস্যময় লাগছে। সে কাল রাতেই খবর পেয়েছে মালশ্রীকে আরও দুই সপ্তাহ সেখানে থাকতে হবে।একজনের পজেটিভ এসেছে।তাই বাকিদের ছাড়া যাচ্ছে না।কিন্তু সেটা সে কাউকেই জানায়নি, এমনকি বাসুদেবকেও। অথচ তিনি সব জেনে গেলেন কিভাবে আর কি করেই বা সবাই এত তাড়াতাড়ি মেনে নিল মালশ্রীর ফেরার বিষয়টা! পার্থদার ভূমিকাও তার কাছে আশ্চর্য লাগল।

আপাতত একটা বোঝা পিঠ থেকে নামল মনে হচ্ছে। বাসুদেবকে জানাতে হবে ভেবে সে ফোন করল। ওপাশ থেকে বাসুদেব বললেন, পরশু সকাল আটটা বাজার আগেই মালশ্রীকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যেও।মেয়েটার মনের উপর এ‘ক’দিন মারাত্মক ধকল গেছে।তাকে একদম বিশ্রাম নিতে বোলো কিছুদিন।রাখছি তবে।

সৌমিক জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, বাবা সেই যখন ব্যবস্থা করলে, তখন আগে কেন করলে না? কী দরকার ছিল ওখানে রাখার! কিন্তু কোনো প্রশ্ন করার বা জানার সুযোগই পেল না।তার আগেই ফোন রেখে দিয়েছে বাসুদেব।

উপসংহার

অবশেষে টানা পাঁচমাস বাদে নিজের আবাসনে ফিরল মালশ্রী। কাল রাতে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার থেকে ফোন করে সৌমিককে জানানো হয়েছিল, মালশ্রী নেগেটিভ। তাই ওকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।তবে বাড়ি ফিরেও যেন আরও চোদ্দ দিন একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি বললেন, মশাই ওপরমহলে যখন আপনার এত চেনাজানা এখানে রাখার কি দরকার ছিল? এয়্যারপোর্ট থেকে সোজা বাড়ি নিয়ে গিয়ে আইসোলেশনে রাখলেই পারতেন।এসব জায়গা কি আপনাদের মত লোকেদের উপযুক্ত? শুধু শুধু ম্যাডাম কদিন কষ্ট পেলেন। আমরাও জানতে পারিনি, তিনিও বলেননি একবারও নিজের পরিচয়।

সৌমিক কথা না বাড়িয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিল।এসব যে বাসুদেবের কল্যানে তা বুঝতে আর তার অসুবিধা হচ্ছে না।

নিজের আবাসন, ব্লক এমনকি ফ্ল্যাটের সামনেটাও একদম প্রথম দেখার মত ভালো লাগছে মালশ্রীর।কোনো প্রশ্ন না করেই সিকিউরিটি তাদের গাড়িটা ঢুকিয়ে দিল।একদম নিজেদের বিল্ডিং-এর সামনে এসে নামল তারা। লিফট বন্ধ। তাই হেঁটেই ছয়তলায় উঠল। দরজা খোলাই ছিল।

মালশ্রীকে ঘরে ঢুকতে দেখে চন্দ্রাবতী হাউমাও করে কেঁদে উঠল। আর যেতে হবে না তোকে ওইসব চাকরিতে। এবার এখানেই যা করার করবি।

শাশুড়িকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে সে সৌমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে মায়ের।

সৌমিক বলল, আগে ফ্রেস হয়ে নাও। তারপর বলছি।

চন্দ্রাবতী বলছিলেন, কাছে আয়, কতদিন মুখটা দেখিনি।

কিন্তু সব না পালটে স্নান না সেরে তাঁর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে সে বলল, চেঞ্জ করে আসছি।

সেই ঘর থেকে নিজের ঘরে ঢুকে মালশ্রী অবাক হয়ে গেল।সারা ঘর জুড়ে বান্ধুলি তার নানা ছবি ঝুলিয়ে রঙ বেরঙের কাগজে লিখেছে ‘ওয়েলকাম হোম মা’। মালশ্রী মেয়েটা কোথায়, তাকে জড়িয়ে ধরবে কিনা ভাবতে ভাবতেই বান্ধুলি পিছন থেকে এসে জাপটে জড়িয়ে ধরল মাকে। এইমুহূর্তে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এই কথাটা তাদের কারোর মাথাতেই নেই।

সৌমিক এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। এবার সেও সব ভুলে মালশ্রী আর বান্ধুলিকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরল। তাদের প্রত্যেকের চোখ বেয়েই নেমে আসছে জল।

##

মা কি ভাবছ?

ভাবছি দেখতে দেখতে প্রায় দু বছর কেটে গেল।সেই দুঃসহ দিনগুলো আজও মন থেকে পুরো মুছে ফেলতে পারিনি।কত পরিচিত মানুষ এই সময়টুকুতে হ্যাঁ থেকে হঠাৎ না হয়ে গেল।দেখতেও পেলাম না তাদের মুখগুলো চলে যাবার পর।ধাপার মাঠ নাকি কোথায় তারা শেষ অবধি স্থান পেল সেটাও জানা গেল না।

মা এখন কিন্তু বাড়ির লোককে শশ্মানে যেতে দিচ্ছে সরকার।

দিচ্ছে।কিন্তু প্ল্যাস্টিকে মোড়া নিজের প্রিয়জনকে দেখতে কার ভাল লাগে? একটা শ্বাস ফেলে বলল মালশ্রী।ভেবে দেখ এই সময়টুকুর মধ্যে তোর দাদান, পিসিমনি দুজনেই চলে গেল।দাদানের মুখটাও দেখতে পেলাম না।

মা তখন তুমিও তো হাসপাতালে লড়ছিলে করোনা আক্রান্ত হয়ে।আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম তুমি আর ফিরবে না।

আমিও তাই ভেবেছিলাম।তার পর বাড়ি ফিরে যখন শুনলাম বাবা চলে গেলেন তখন বুঝলাম নিজের জীবন দিয়ে বাবা আমাকে রক্ষা করে গেলেন।বাবার তো কোভিড হবার কথা নয়।বাইরেই তো যেত না।তবু হল।আর আমি এক অযোগ্য সন্তান বাবার মুখটাও শেষ মুহূর্তে দেখতে পেলাম না।

মা, তুমি তো বলো পৃথিবীতে যা ঘটার তাই ঘটবে,আমরা নিজেরাও কিছুই ঠিক করতে পারি না।দাদানের তো বয়স হয়েছিল সত্তর।কিন্তু একবার ভেবে দেখো পিসিমনির কথা!তোমার থেকেও ছোটো। ভাই আর বোন দুজনেই অনাথ হয়ে গেল।পিসেমশাই কিভাবে সব সামলাচ্ছে বলো।সবই নিয়তি।

হুম।একটাই আশার কথা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গেছে।বহু মানুষের টিকা নেওয়া শেষ।মালশ্রী বলল।

বান্ধুলি বলল, না মা এতটা নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো সময় আসেনি।থার্ড ওয়েব আসছে।দুটো টিকা নিয়েও মানুষ মারা যাচ্ছে।তবে এসব ভেবে লাভ নেই।একটা সভ্যতা যখন ধ্বংস হয় তখন তার আগে নানা ঘটনা ঘটে।এটাও তেমন কিছু।কাজেই মন খারাপ কোরো না।দাদান বলত, মানুষ খালি প্রার্থনা করতে পারে অপরের মঙ্গল সাধনায়।এর বাইরে আর কিই বা করতে পারি আমরা?আজ বরং আমরা ছাতে যাই চলো।অজস্র তারার মালায় আকাশ সেজেছে।অথচ দেখো আজ কৌশিকী অমাবস্যা।দাদান এই দিনটায় সারা রাত পুজো করত।চা ছাড়া কিছুই খেত না।রাত ভোর হলে ছাত থেকে নেমে আসত।জানলা দিয়ে দেখো মা আকাশটা কেমন লাল হয়ে আছে।মনে হচ্ছে আলো ঠিকরে পড়ছে পৃথিবীর বুকে।অথচ ঘোর অন্ধকার থাকার কথা। আমরা আজ প্রার্থনা করি জীবিত মৃত সবার জন্য।চলো দুজনে মিলে বলি – ওম অসতো মা সদ্গময়।তমসো মা জ্যোতির্গময়।মৃত্যোর্মামৃতং গময়।আবিরাবীর্ম এধি।রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং,তেন মাং পাহি নিত্যম্।দাদান তো রোজ এটাই বলত মা।

মালশ্রী মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করল, বাসুদেব কখন যেন বান্ধুলির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।সে মেয়ের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে বলল-ছাতের চাবিটা নে।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes