
সুপ্রভাত মেট্যার কবিতা
রাত্রির হাজার পুরস্কার
ধানজমির পাশে যে সব দুঃখ আমি
ফেলে রেখে এসেছি, ভাবছি, তাদের কাছে একদিন যাব ।
গিয়ে বলব, আমার না-পারার কথা।
আমার সব শেষ হয়ে যাওয়া আলো এবং কবিতার কথা।
হায় কান্ন!
অন্নজীবনের সারাটা সময় তুমি
আমার কাছেই থেকে গেলে?
এই পালকশূন্য কবিতা ছাড়া কীইবা তোমাকে দিতে পারি।
একটি মেধাবী পাতার পাশে
গোলাপী প্রেম ফুল হয়ে ফুটুক তবু!
ভাঁজকরা ভাবনা প্রদেশের
একটা তুলতুলে গাল আমার হাতে এসে ঠেকুক;
তা না-হলে, রাত্রির হাজার পুরস্কার
এই শরীর আমি কী করে লিখি তোমাকে?
প্রেম, পাপ, পূণ্য আর ভারসাম্য
বৃষ্টি ছুঁয়ে খসে গেল মেঘ।
না-হয় আমিই ভিজে গেলাম একদিন তোমার সকালে।
তাইবলে এ-কলঙ্ক তোমার নয়।
প্রেমের পাথর শব্দের আঘাত বুকের গভীরে লেখা হয়।
আর তারা প্রত্যাখ্যান হয়ে ভাসে।
যেভাবে ক্ষুধাক্ষেত্রে
ভাতের সৌন্দর্য অবর্ণনীয় সত্য; ঠিক সেইভাবে
আমি সারাজীবন ডুবে থাকতে চাই বইয়ের ভিতরে, গভীরে ।
আর মৃত্যুর পরে ভেসে উঠতে চাই।
না, চাইনা তোমাকে।
হ্যাঁ, এইমাত্র স্বর্গে ঢুকলাম আমি।
না,স্বপ্ন নয় সত্যি।
বইয়ের থাক থেকে আমার সাদা-কালো পিতামহ
অপলক চেয়ে আছেন আমার দিকে, আর বলছেন:
একটা জন্ম মানেই
প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি, তাইনা?
এই যে তুই এখনও বেঁচে আছিস,
মানেই, পাপ আর পূণ্যের ভারসাম্য নিয়েই আছিস।
মূল্যহীন হাত
তোমাকে ভালো লেখার আকাশ
এখনও হাতে পাইনি আমি।
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে এক গ্লাস জলের ঠাণ্ডা সকাল তুমি
এসে দাঁড়াও, শান্ত করো, নিভন্ত করো আমাকে ।
দেখো, সমস্ত পৃথিবী, তার রাত নিয়ে জেগে উঠছে
আমার ভিতরে এখন।
কথা দিয়ে না রাখার সেইসব সময়গুলোর এখন,
কথা উঠছে, রাতে।
বড়পুকুরের ধারে, মাঠে,
তোমার যৌবনকাল ভেসে ওঠে।
আর ঠিক সেইখানে, আলতা রঙের পাতায়
কবিতা তুলছেন ফুটিয়ে, এক নতুন কবি।
হাতে গুনে পাওয়া ভালোমানুষগুলি এখন
থম মেরে আছে ডাঙ্গায়।
আর আমার হাত, দুটোর প্রত্যেকটাই-
একটা, না ধরে কাউকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার হাত;
এর আর কি দাম থাকতে পারে তুমি বলো?
স্তব্ধভূষণ
দুইদিকে গোল পাকিয়ে হাওয়া বইছে।
আর মাঝখান থেকে তুমি, মাঝখানে থেকে
খারাপ হয়ে নিজেকে ডোবাচ্ছ।
হলুদ বিরহের কাছে কে যে এসে উুঁকি মারে রোজ?
তোমার রাগ না অভিমান?
এখনও বুঝিনা আমি।
সমস্ত সহনশীলতা দেখো
কথা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক আমার কবিতায়।
অত্যন্ত নরম লাগছে পাতায়, তাদের।
সন্ধ্যার আরতি দেখতে দেখতে
তোমার রক্তিম মুখ আমি দেখি,
আজ, কেমন যেন হয়ে যায়!
কিছু বলছনা যে?
অনেক বেশি শুনেছ এবং বলেছ আগে, তাই?
ভাবছি এই গ্রাম থেকে আসছে শীতে আমি
তোমাকে নিয়ে একদিন কোলকাতায় যাব।
একটা মাফলার কিনব, উলের, তোমার জন্য।
জড়িয়ে কান এবং মুখ চেপে
কিছু শোনা এবং তোমার বলাকে
আমি স্তব্ধ রাখব হাতের মুঠোয়।
শ্রাবণ সুধা
প্রায় আশ্চর্যজনকভাবে তোমাকে পেলাম!
খড়-কুটোর ভেসে যাওয়া জীবন …..
তোমার কোনও স্পর্শ ছিলনা।
থালাভর্তি ভাতের কোনও সুখ ছিলনা তোমার।
শুধু সম্পর্কের টানে
হৃদয়ের সুতোকে অতি শক্ত করে গেঁথে
যে কবিতা ছিল তোমার; তার স্পর্ধা আমি পাই।
তুমি কত কথার বুলি নিয়ে
কখনও ফেরত হতেনা, জানি।
হাজার আবদারের শ্রাবণ সুধা তোমার মুখ ভেসে উঠত।
কত দুঃখ, পেয়ে যাওয়া অন্ধকারে কত পাথুরে আঘাত
তুমি সয়ে সয়ে, কতযে কবিতা হয়ে উঠত-
বিকেলের আতপ জলে,
আমি তার আজও শুনতে পাই!
-ইতি, ক্ষুধা
বয়সের হিসেব তখন
ইচ্ছেকরে ভুল করে মেয়েরা- সেই বিকেল।
লাবণ্য কি
কখনও কম আলো পেয়ে বসলে ফোটে?
এখন ভালো? কেমন আছ আগের চেয়ে?
কিছু বলছনা যে?
আজ খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে, জানো ?
সত্যি বলছি।
মাথা থেকে সরে গেছে কুটিল অন্ধকার।
তোমার শেষ বাসের ছেড়ে দেওয়া মুহূর্তটিকে ধরে
আজ নিজেকে, অনেকটাই চিনেছি আমি, অনেকটাই,
বিশ্বাস করো?
আজ আর কোনও ভুলই ভুল বলে মনে হচ্ছেনা আমার।
সমস্তই অন্ধকার আলো করে বসে আছে আমার অক্ষর।
শুধু মাঝেমাঝে দেখি,
তোমার ও আমার দূরত্বের ফাঁকে
বাবার মুখ ভেসে উঠলে;
স্মৃতি থেকে টুকরো রুটির শ্বাস ভেসে আসে
ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে
আমাদের বাড়ির দিকে!
কান্নার শ্রীপূর্ণ কথারা
প্রস্তুত থাকাটা জরুরি প্রত্যেকের।
মুহূর্তেই আশিটা বছর চলে যেতে পারে কারোর।
ফুরিয়ে যেতে পারে সময়।
রোজ বাজারে যাই, গিয়ে দেখি,
হাজার দরে শতেক বিক্রি হচ্ছে সেখানে ভূ-কম্পের মতো।
মুড়ি-মুড়কির মতো চলে যাচ্ছে প্রাণ, কবিতা থেকে ।
ছিনিমিনিখেলে ছেলেমেয়েরা
লেখা নিয়ে বাজার বসিয়েছে শহরে।
অবাক আমি, হয়ে, পড়ি আর
অগোছালো একটা রাতের দিকে তাকিয়ে থাকি চুপচাপ।
কান্নার শ্রীপূর্ণ কথারা গ্রামের ভিতরে এসে,
তারা ভাসতে ভাসতে, কবিতা হয়ে উঠবে একদিন-
এই আশায়, কোথায় কলির কেষ্ট
রোজ একবার খোঁজাখুঁজির পর
ক্লান্ত, ফিরে আসি আমি ঘরে!
অভ্যাসবশত
তুমি কি চোখের জল ফেলতে ফেলতে
আজও আমাকে খুঁজছ?
আমার কোনও ঘর নেই কবিতা।
একা থাকার অভ্যাস আমাকে আশ্বস্ত করেছে।
বাউল করেছে হৃদয়।
হওয়া ভাতের উল্টানো হাঁড়ি থেকে
যে ফ্যান গড়িয়ে পড়ে
আমি তার মতো নদী, স্রোত, বয়ে যাই….
তোমার কথার আলো গড়িয়ে, বিকেল নামে ।
একটা হলুদ রঙের পাখি উড়ে যায়।
সন্ধ্যা হয় আমার।
এমনই দেবতুল্য হৃদয় তোমার
আমাদের গ্রাম আর কবিতা; যার
প্রনাম সাপেক্ষে এই লেখার বয়স,
অতিশয় ধুলো, পথ ছোট হয়ে এলে
তোমার ঘরও একদিন মন্দির হয়ে ওঠে।
শ্বেতা
আমাদের কোনও ভালোদিন নেই।
এত বেশি ঝড়ের সামনে
আজ কীকরে পাঠাব তোমাকে!
প্রায় কুড়ি-বাইশ বছরের তেতুল কাজল মেঘ,
আমাদের বৃষ্টিবাসর সুখ এখনও শান্ত,
সিক্ত হয়ে পড়ে আছে লেখায়।
দেখা যাচ্ছে, আলো না-ফুটলে, কিংবা
ফুটলেও তুমি আর আসছইনা আমার কাছে!
কথা পাঠাচ্ছনা কোনও, চিঠিতে আমাকে।
ফালি এক চাঁদের জ্যোৎস্নায় বসে,
তোমাকে দেখছি, কুয়াশা ছাপিয়ে,
হিম ঠাণ্ডা মুখ তোমার, সাদা ঘোমটায়,
রহস্যের পাশ দিয়ে, আমাকে কাটিয়ে কেমন যেন
চলে যাচ্ছ গভীর অন্ধকারের দিকে, সকরুণ!
মৃত্যু যে স্তব্ধতা নিয়ে আসে,
আর্তনাদ তারই ফসল, কান্না ….
যা চেপে রাখতে গিয়েও কখনও চাপা যায়না!
যেতে হবে তাই, প্রস্তুতি নিয়েছি,
দুঃখের নোনাজল ধুয়ে দিতে দিতে,
আমাকেও একদিন- শ্বেতা!
অন্যঅভিপ্রায়
সকাল-পাঁউরুটি সেরে
দৌড় আমার কলেজের ভাত তখন ছিল মায়ের শিয়রে।
মাঠে মাঠে রৌদ্র, এবং ধুলোর সঙ্গে
তখন চলত অতিশয় ভাব।
আমি এক পৃথিবী নিজেকে নিয়ে গিয়ে, আবার
এক পৃথিবী ফিরে এসে শূন্যতেই থাকতাম রোজ।
সত্যি আমার কোনও গন্তব্য ছিলনা তখন।
আর এখন শুধু দৌড় আর দৌড়।
মাথায় বৌয়ের চাপ হাঁটছি কস্মেটিকের রাস্তা ধরে
নতুন শহর। যদিও মাসে চারটা দিন মাত্র
খরচ হয় আমার সপ্তাহান্তের রাতে।
তাতেই, শরীর ও সংসারে এটা নেই, ওটা নেই,
গায়ে সেরকম কোনও অলঙ্কার নেই, কার নেই, বাইকও নেই, ফ্ল্যাটবাড়ির মতো একটা নীরবতাও নেই; কেননা
অফিসে খুশি থাকা মহাশয়দের দলে
আমার তেমন কোনও হাত ছিলনা যে!
তাছাড়া, সেরকম পুতুল হয়ে ভালো থাকবার
আমার কোনও অভিপ্রায়ও ছিলনা।