
সুদেষ্ণা ঘোষ-এর কবিতা
অরণি বা অন্ধকারের সার্কাস
১
মৃদু অপমানের কথায় অনেক দূরের শহরে
তোমার কথা মনে পড়ত
মনে পড়ত যখন
সেই বাড়ির কারনিশে একটা নীল স্কার্ফ অনেকদিন একা পড়ে ছিল
যে বাড়ি যা সেপিয়া রঙের বিকেল থেকে আলাদা করা যায়নি।
মনে পড়ত এসব আসলে সম্পর্ক নয়।
সম্পর্ক বলতে তো কাচের এলোপাথাড়ি রাগ…
দেওয়ালে মোমের ছায়া ক্রমাগত বড় হয়ে যাওয়া…
বড়জোর বৃষ্টির দেওয়ালের ওপাশ থেকে ভেসে আসা একটা দুটো আটপৌরে কথা।
আকাশ ফেটে নামা জ্যোৎস্নার নীচে কিছু বলার বাকি থাকে না।
বলার থাকে না বাতিল রাজকন্যার মতো হেসে ওঠা বিকেলের কাছেও।
আমার বাঁহাতে নড়বড়ে ক্রেডল
আর ডান হাতে দুঃখ ঝলমল।
আমার ছোট্ট টবে তিনটে টকটকে ক্রিসেনথেমাম।
মাঝেমাঝে মনে পড়ত
সম্পর্ক বলতে
দূরের গানের ভিতর শিউরে ওঠা সেপ্টেম্বর মাসের আকাশ।
রাতের কারনিশে কাঁপতে থাকা নীল প্রজাপতি…
আস্তে-আস্তে বুঝতে পারছিলাম।
রেললাইনের স্লিপার বেয়ে এভাবেই হাসতে-হাসতে হেঁটে যাবে ও।
জ্যোৎস্নার ভিতর চুঁইয়ে নামা শীত?
নাকি অভিমান
যা জ্যোৎস্না হয়ে গেছে।
২
ট্রাফিকের আলো দপ করে লাল হয়ে যেত।
আমার কোনও শোক ছিল না।
অরণির চোখের দিকে তাকানো যেত না।
সুইসাইড-পয়েন্টের পাশ দিয়ে ছুটে যেত জোরে গানবাজানো গাড়ি।
শুধু একটা আর্তনাদের মতো পাখির ডাক।
শুধু একটা নির্জন রাস্তার উপর উপুড় হয়ে পড়া রক্তহীন বিকেল।
একটা-দুটো অকথ্য শব্দে হেলান দিয়ে থাকতে-থাকতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠত প্রতিশ্রুতি।
দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করতাম।
অন্ধকার করিডর আর একটা নীলচে শান্ত আলোর সম্পর্ককে আমি অরণি ভেবে চুপ করে থাকতাম।
৩
আয়নার মধ্যে ঢুকে একদিন রুটম্যাপ হারিয়ে ফেলেছিলাম অরণি
তারপর থেকে লাল-নীল আলো জ্বলছে-নিভছে…
দেওয়ালে একটা ফাঁকা চোখের মুখোশ
আর বহুদূর থেকে ভেসে আসা ছোট্ট মেয়ের গান।
কীরকম পাগল-পাগল লাগত অরণি।
কেউ ফিসফিসিয়ে বলছিল, ‘তারপর কী প্রচণ্ড উল্লাস…’
কেউ চেঁচিয়ে বলত, প্লুটো গ্রহের ঠান্ডার কষ্ট!
ওদের কারও চোখের দিকেই তাকানো যেত না অরণি!
চোখ বলতেই আমার চিরকাল মনে পড়ে…
সমুদ্র আর সূর্যাস্তের মধ্যে থমকে থাকা সেই করুণ বিকেল।
আমি দেখি লাল-নীল হাহাকারে জড়িয়ে যাওয়া বেলুনের সুতো
আমি বুঝি অভিমানের হাত শক্ত করে চেপে রেখেছে মাঝরাত।
আর রেডিয়োর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে চুপ করে যাচ্ছে গোলাপি উল, দশ নম্বর কাঁটা।
আমি কবেই আয়নার ভিতর ঢুকে পড়তে পারতাম অরণি
কিন্তু
মাঠের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের মতো গড়িয়ে গেল হাওয়া।
দূরে টাওয়ারের আলো আশকারা পেয়ে অন্ধকারের মাথায় চড়ে বসল।
একটা ছটফটে গলি কোথাও জায়গা না পেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আমার আর অরণির মাঝখানে।
এসব হয়তো কিছুই তেমন নয়।
সন্ধের মুখে ল্যাম্পপোস্টে ঠান্ডা নরম ভেপারের আলো জ্বলে উঠল।
অরণি বলে কেউ ডেকে উঠতে গিয়ে হারিয়ে গেল চিরতরে।