
বাস্তব-অধিবাস্তব-পরাবাস্তবের কুহকী ইশারায় সুদীপ বসুর গল্পগ্রন্থ ‘ছায়াবাণীর চারপাশে’
> হিন্দোল ভট্টাচার্য
বাংলাভাষায় গল্প নিয়ে আলোচনা করার বিপদ হচ্ছে কিছু কিছু সংকীর্ণমনা এবং ছাত্রবন্ধুপুষ্ট আলোচকদের হাস্যকর ধারণার সঙ্গে তর্কে উপনীত হতে হয়, যে তর্কের ত্রিসীমানার মধ্যেও সেই সব আলোচকরা আসতে পারেন না। কেন আসতে পারেন না? কারণ তাঁরা বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থ নিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিলেও, যখনই বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গে আসেন, চুপসে গিয়ে ঘ্যানঘ্যানে ন্যারেটিভের সেই গত শতাব্দীর দুই-এর দশকের গদ্যের ডিকশন নিয়েই পড়ে থাকেন। অর্থাৎ, হয় শরৎবাবু নয় শরৎবাবুর আধুনিক সংস্করণ। শরদিন্দুকে ঘাঁটাতে পারেন না। সন্দীপনকে বা কমলকুমারকে বা অমিয়ভূষণকেও না। ইলিয়াসের গল্প নিয়ে চুপ করে থাকেন। ক্লাসিকাল ছোটগল্পের উঠোন থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন না। দুইহাজার কুড়ি সালে এসেও তাই বাংলা গদ্যসাহিত্যের মেনস্ট্রিম ( যদি যাকে মেনস্ট্রিম বলছি, তাকে মেনস্ট্রিম বলতেই হয়) পড়ে আছে উনিশশো কুড়ি সালেই। গল্প কী, সে নিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহলে এখনও তোতাপাখির মতো যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী আওড়াবেন, তাঁদের জন্য সুদীপ বসুর গল্প নয়।
আসলে, নিজের পছন্দ এবং পড়াশুনোর সীমাবদ্ধ পরিসর ও সাহিত্য সম্পর্কে ভাবনার সীমাবদ্ধ পরিসরে থাকতে থাকতে বাংলা গদ্যসাহিত্যের অবস্থা হল বেশ গোলমেলে। একদিকে যেমন বিশ্বমানের কাজ হয়ে চলেছে বাংলা গদ্যসাহিত্যেই মানিক-বিভূতি-সতীনাথ ভাদুড়ী- জীবনানন্দ-কৃষ্ণগোপাল- অভিজিৎ সেন – কমলকুমার- অমিয়ভূষণ- সন্দীপন- দেবেশ- ইলিয়াস- ওয়ালিউল্লাহদের হাত ধরে ( আরও অনেক নামই বাদ পড়ে গেল), অন্যদিকে, চলছে প্রবল মধ্যমেধার সাহিত্যচর্চা। আসলে, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে, যা আলোচিত হয় না, তা হল, বেস্ট সেলার এবং লিটারেচার-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। একজন জয়েস বা বোর্হেসকে কখনওই তুলনা করা হয় না একজন শেলডন বা ফ্রেডরিক ফরসিথের সঙ্গে। কেন তাঁরা তুলনীয় হবেন? এই মৌলিক জায়গাতেই বাংলা সাহিত্য কখনও আসেনি। তাঁরা মনে করেছে খবরকাগজের সাহিত্যই হল পথনির্দেশিকা। মূল ধারার সাহিত্য। কিন্তু আদতে, মূল ধারার সাহিত্য তা-ই যা, প্রতিনিয়ত জায়মান এবং প্রতিনিয়ত নিজেদের ভাঙতে ভাঙতে এক নতুন গদ্যভাষা, গদ্যভাবনার জায়গায় নিয়ে যান। গদ্যসাহিত্যের মানচিত্রটাই বদলে যায়। এ কারণেই একটি সময় ইউলিসিসের মতো উপন্যাস লিখিত হয়েছিল, এই কারণেই, স্তাঁদালের মতো লেখক লিখেছেন অনবদ্য সব লেখা, যেগুলি বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ল্যান্ডমার্ক।
গল্প কী? তা তো নিশ্চয় মেজমাইমার পিরিয়ড নয়, বা মেসোমশাইয়ের বাজার নয়। এগুলিও হতে পারে গল্প। কিন্তু সেক্ষেত্রে একধরনের ‘ক্রিটিকাল ক্রাইসিস অফ ফিলোজফি’ থাকা উচিত বলে মনে হয়, নাহলে সে গল্প কেবলই কাহিনির কথকতা হয়ে দাঁড়ায়। শুধু কাহিনি আওড়ে যাওয়া গল্পের বিষয় নয়। প্রকৃত শিল্প, গল্প বা উপন্যাস পড়ে, যদি বিশ্লেষণ নয় একধরনের অনুভূতিমালার জন্ম হয়, যদি সেই অনুভূতিমালার মধ্যে তৈরি হয় একধরনের অস্তিত্বের শিকড় টলিয়ে দেওয়া বিপন্নতা, তাহলে আমার মনে হয়, আমি সেই লেখার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যার কাছে হাঁটুমুড়ে বসা যায়। এই অনুভূতিমালার ইতিহাসযানের কাছে এসে চুপ করে গিয়েছিলাম এক সময় কাফকা পড়ে। জয়েসের ডাবলিনার্স, ইলিয়াসের ‘খোঁয়ারি’, বোর্খেসের গল্প, পিটারবিক্সেলের গল্প, কালভিনোর গল্প, লু সুন, মার্কেজ, অনেকটা এইভাবেই আক্রান্ত করে। নাম করতে হল বলে দুঃখিত। কারণ নাম করলে সকলের নামই করা উচিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই লেখাটিকে মনে হবে রেজিস্টার খাতা। সে কাজ না করাই ভাল।
হ্যাঁ, সুদীপ বসু তাঁর ‘ছায়াবাণীর চারপাশে’ গল্পগ্রন্থে যা লিখেছেন, তা গল্পই। তবে, বাংলায় গল্প বলতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পাঠক এবং সমালোচকরা অভ্যস্ত, এই গল্পগুলি সেরকম গল্প নয়। এই গল্পগুলি বাংলা গল্প বা গদ্যসাহিত্যের আগামী যুগের গল্প বলেই আমার পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে। এতে, বাংলার মহান কালজয়ী সাহিত্য-জ্যোতিষীদের কিছুই এসে যায় না। কিন্তু এই কথা বলতে পেরে আমার ভাল লাগছে। কেন এমনটা মনে হচ্ছে? কারণ, পাঠক হিসেবে সেই এক আঙ্গিক এবং অন্তর্গত কোনও সংকটহীন, প্রশ্নহীন, বর্ণনামূলক, বোবা, বুদ্ধিহীন গল্প পড়তে পড়তে যখন গল্প পড়ার প্রতিই মন বিস্বাদ হয়ে গেছে, তখন সুদীপ বসুর এই গল্পগুলি আমাকে ভাবাল। আমি গল্প পড়ে এই অনুভূতিই চাই। যেন ভাবতে পারি। যেন তা আমাকেও বিপন্ন করে। যেন তা আমার অস্তিত্বের শিকড় ধরে নাড়া দেয়। সুদীপ বসু যে একদমই ধ্রুপদী আঙ্গিক ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন তা নয়। কিন্তু গল্পের ধ্রুপদী আঙ্গিকের পারস্পেকটিভটাকে বদলে দিয়েছেন। এই বদলে দেওয়াটি এত সূক্ষ্মভাবে হয়েছে, যে এই মাত্রাগত পরিবর্তনের জায়গাটি বাইরে থেকে ধরা যাচ্ছে না। এমনটি মনে হয় কালভিনোর গল্প পড়তে পড়তে। এক আবহগত পরিবর্তন হয়ে যায় তাঁর গল্পে। যেন এক ইন্টিরিয়র মনোলগ চলতে থাকে প্রতিটি গল্পেই। আমরা বুঝতে পারি, নানা চরিত্রের সমাবেশ নিয়ে সুদীপ বসুর এই গল্পগ্রন্থের বিভিন্ন গল্প থাকলেও, আসলে, আসলে, জয়েসের স্টিফেন ডেডেলাসের মতো একটি চরিত্র এই গল্পগুলির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃত্যু, যৌনতা, শৈশব, সম্পর্ক-এর প্রচলিত অর্থ এবং মাত্রাগুলিকে তিনি প্রশ্ন করতে করতেই চলছেন গল্পগুলিতে। যেমন- ‘ছত্রিশ বছর পর হঠাৎ’ , ‘গয়নার গল্প’, ‘হ্যামলিন হ্যামলিন’ ‘মনসিজবাবুর ডুবসাঁতার’,’আকাশলীনা’, ‘শবনম’ ইত্যাদি গল্পে সুদীপ বসু আশ্চর্য দক্ষতায় প্রায় রূপদক্ষ শিল্পীর সূক্ষ্ম ভাস্কর্যের মতো নির্মেদ কথনের দিকে চলে যান। কবি বলেই সম্ভবত সুদীপ বসুর এই সব ছোটগল্পে রয়েছে আশ্চর্য সব ছোট ছোট চিত্রকল্পের ব্যবহার। সেই সব চিত্রকল্প আসলে তাঁর ছোটগল্পের পরিসরকেই আরও ব্যাপ্ত করে দিচ্ছে। অনেকটা জীবনানন্দের গল্পের মতো, যেখানে এক একটি চিত্রকল্প যেন মনঃসমীক্ষকের মতো পাঠকের অন্তরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। সুদীপ সত্যের এবং অ-সত্যের সঙ্গে বারবার এক টানাপোড়েনের খেলায় ডুবে থাকেন তাঁর ছোটগল্পে। আর এই যাতায়াতে তাঁর সঙ্গী হয় একধরনের অধিবাস্তবতা। যে অধিবাস্তবতা বোর্খেসের গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, সেই অধিবাস্তবতার মধ্যেই সুদীপ বসু এক একটি এমন পরিমণ্ডল তৈরি করেন গল্পে, যেখানে বোঝাই যায়্ তথাকথিত বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর একপ্রকার যুদ্ধই চলছে। ‘সাড়ে তিনটের বাস’ বা ‘কালো ম্যাজিকের এক রাত’ এই ধরনের অধিবাস্তবিক গল্পের এক উদাহরণ।
গল্প নিয়ে আলোচনার সমস্যা এই, যে গল্পের অংশ তুলে আলোচনা করে তার সম্পর্কে আসলে কিছুই বলা যায় না। সেই ছাত্রবন্ধুসুলভ আলোচনার মধ্যে না গিয়ে পাঠকের প্রতি একটা কথাই বলা যায়, সুদীপ বসুর গল্প বাংলা গল্পের মানচিত্রে এক ভিন্ন যাপনের ব্যাটন ধরে আছে, যে যাপনের অংশ ছিলেন এক সময়ে জীবনানন্দ দাশ, অরূপরতন বসু, রবিশংকর বল, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং অমিয়ভূষণ মজুমদার। এই গল্প সকলের দ্বারা সমানভাবে গৃহীত হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি এ প্রশ্নের মুখোমুখিও তাঁকে হতে হবে, এই লেখাগুলি আদৌ গল্প কিনা, বা তিনি আদৌ গল্প লিখতে পারেন কিনা। এখনও জীবনানন্দ দাশের গল্প পড়েও অনেকে এই মন্তব্য করে থাকেন। হয়তো, বোর্খেস বা পিটারবিকসেল বা কালভিনো এই বাংলা ভাষায় গল্প লিখলে তাঁদের গল্প নিয়েও এই সব কথা তাঁরা বলতেন। কিন্তু, লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপের ছাপ্পা থাকায় তাঁরা বেঁচে গেলেন। আসলে্, নামোচ্চারণ হল তাঁদের, কিন্তু পঠিত হলেন না তেমন ভাবে।
তবে, সেই সব, তিক্ততা থাক। আসল কথা, বাংলা সাহিত্যে আড়ালে থাকা এক গল্পগ্রন্থ ‘ছায়াবাণীর চারপাশে’ পড়ুন। আর আপনার রবিবাসরীয় আমেজ যে ছোটগল্পের মূল লক্ষ নয়, সে সম্পর্কে সচেতন হোন। সুদীপ বসুর গল্প যদি আপনাকে ‘ইরিটেট’ করে, যদি ‘আক্রান্ত’ করে, যদি ‘অস্বস্তি’-তে ফেলে, তাহলে, তার মুখোমুখি হোন।
গল্প পড়ার প্রেক্ষিতটাও তো বদলাতে হবে পাঠককে। যেমন, সিনেমা মানেই আর উত্তম-সুচিত্রার হারানো সুর নয়, তেমন, গল্প মানেই নয় দৈনন্দিনতার মুদির দোকানের লিস্ট এবং দুপুরের ফ্যামিলি প্ল্যানিং। বাংলার প্রসিদ্ধ সংবাদপত্রগুলিও এই বিষয়ে একটু ভাবতে পারেন। অনেকদিন একইরকম চর্চার প্রকাশে, তাঁরাও কিন্তু সাহিত্যকে শ্যাওলাবন্দি করে ফেলছেন। একটু অন্যরকম কিছু হলে ভাল হয় না কি?
সুদীপ বসুর গল্প
গ্রন্থ- ছায়াবাণীর চারপাশে
ধানসিড়ি
প্রচ্ছদ- শান্তনু মিত্র
দাম- ১৭৫টাকা
খুব, খুব ভালো লাগলো হিন্দোল… তোমার গদ্যের চালে সবসময়ই একটা আবিষ্কার থাকে… এতো লুসিড ও ইন্টেন্স….
শুধু একটা কথা, শুরুর ওই কথাগুলো বলে আর লাভ নেই.. এই মধ্যমেধার সঙ্গেই লড়ে যেতে হবে… তাই ঘুরেফিরে অরণ্যে রোদন হয়ে যাচ্ছে…
নমস্কার সুপ্রভাত…
আলোচনার শুরুতেই একটি কথা খুব ভালো লাগলো যে গদ্য সাহিত্যের মেনস্ট্রিম বলে কোনো কিছুকেই গ্রহণ করে নিলে অভিনবত্বকে বা নোভেলটিকে অস্বীকার করা হয়।অতএব কোনো প্রচলিত ধারাকে ঐ অভিধাতে ভূষিত করা যায় না …।
এরপর যখন বললেন বাংলা গদ্য সাহিত্যে এখন বিশ্বমানের কাজ হচ্ছে … এবং চলছে মধ্য মেধার সাহিত্যচর্চা ।…বেস্ট সেলার ও লিটারেচারের মধ্যে পার্থক্য আছে । এবং এ প্রসঙ্গে ইউলিসিস ও বিশ্ব সাহিত্যের রেফারেন্স … অনবদ্য ও এবিষয়ে একদম সহমত পোষণ করছি । তবে যে মৌলিক ধারার কথা বলেছেন … তা অবশ্যই নোভেলটির হাত ধরে আসবে একদিন …।
তারপর গল্প কী ?…এই সম্পর্কিত বিশ্লেষণ ও ক্রিটিক্যাল ক্রাইসিস অব ফিলোজোফির উল্লেখ …বেশ আকর্ষণীয় ও সুন্দর । সুদীপ বসুর গল্পগ্রন্থ ‘ছায়াবাণীর চারপাশে’ র গল্পগুলি নিয়ে যে আলোচনা করেছেন …তাতে আমার মতো পাঠকের আগ্রহও বৃদ্ধি পায় । বইটি সংগ্রহ করে পাঠ করবো । সর্বপরি আপনার আলোচনাটি সুন্দর , সাবলীল ও সামগ্রিক ।
ভালো থাকবেন
দুর্গা শংকর দাস (মেদিনীপুর )
এক অপূর্ব চলনে লেখা আপনার এই পাঠ প্রতিক্রিয়াটি পড়লাম , বইটির বিষয়ে আগ্রহ বাড়িয়ে দিলেন 🙏
ঠিক যে ধরনের গল্প খুঁজি। খুবই আগ্রহী হলাম। আপনার লেখা সম্বন্ধে নতুন আর কী বলি। লাজবাব।
বইটি পড়ার আগ্রহ রইলো| আপনার আলোচনাটি অসাধারণ,শিক্ষণীয়|
চমৎকার লিখেছেন। বইটি পড়বার আগ্রহ জন্মালো।
stromectol over the counter usa stromectol over the counter uk