বাবাকে যেভাবে দেখছি
সৌমনা দাশগুপ্ত
বিমলেন্দু মজুমদার আমার বাবা, একথা ভাবতে গর্ব হয়, এক ভালোলাগায় ভরে ওঠে বুক। কারণ, বিমলেন্দু মজুমদার এক আপসহীন সংগ্রামের নাম, এক আজীবন সাধনার নাম। যেহেতু আমার বাবা, তাই খুব কাছের থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর কাজকর্মগুলি। কিন্তু নিজের বাবাকে নিয়ে লিখতে বসে ভয়ও করে বৈকি, পাছে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারি। বাবার কাজের এতো ব্যাপ্তি, এতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। একসময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী, পরবর্তীতে অতিবামেদের সঙ্গে কাজ করে জেল খাটা, চাকরি নিয়ে সমস্যা, আপস না করতে পারার জন্য বারবার উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা না নেয়া, এসব তো ঘটেছেই বাবার জীবনে, তা ছাড়াও সাংবাদিকতার কাজ, আমার মনে হয়, আজ বাবা যে অবস্থানে, তা বোধহয় হতই না। আসলে, সাংবাদিকতার কাজে না ঢুকলে এতোখানি জনসংযোগ বাবার কখনই তৈরি হত না। জনসংযোগ শব্দটি আমি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম। বাবার প্রথম ও প্রধান পরিচয়, লোক-সংস্কৃতির গবেষক, তাতে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন মানুষের লৌকিক জীবনের ভেতর ঢুকে পড়া, সেটা জনসংযোগের ক্ষমতা না থাকলে একেবারেই অসম্ভব। একটু গোড়ার দিক থেকে না বললে বাবার কাজকে বোঝা যাবে না।
অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখলি জেলার রামানন্দপুর গ্রামে ১৯৩৯ সালে বাবার জন্ম হয়। জন্মের সাড়ে তিনমাসের মধ্যেই মাকে হারান। তখন এই মাতৃহারা শিশুটি ঠাকুমা ও কাকিমার কোলে বেড়ে উঠতে থাকেন, এবং পড়াশুনোর জন্য ভিটে-মাটি ছেড়ে ছেচল্লিশ সালের কোনও এক শীতের দিনে তাঁর কাকুর সঙ্গে চলে আসেন জলপাইগুড়ি জেলার তেলিপাড়া চা-বাগানে। নদী-নালা-খাল-বিলের দেশ থেকে তরাই-ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গল পরিবৃত এই চা-বাগানের পরিবেশ ও সংস্কৃতি তাঁর শিশু-মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষত, সে-সময়ের এই অঞ্চলের শীত, দূরে আকাশের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের সারি আর কোনও কোনও বছর তো এমন ঠাণ্ডা পড়ত যে, রাত্তির হলে বালতিতে রাখা জল জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যেত, এ-সবই ছিল তাঁর কাছে এক বিস্ময়। আর তখন থেকেই শুরু হয় জীবনের সংগ্রাম। তখন থেকেই বা কী করে বলি, যে শিশুটি জন্মের পরেই তার মাকে হারিয়েছে, তার জীবনের সংকটের দিন তো সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু পরিবারের বড়ছেলে আমার বাবা যখন চা-বাগানে চলে আসেন, সেসময় তাঁর কাকুর একার উপার্জনে চলত একটি বিশাল পরিবার। ফলে টানাটানি, অর্থাভাব লেগেই থাকত। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে শাক-পাতা, কচু, মেটে-আলু সংগ্রহ করে আনা বা বাগানের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটির থেকে মাছ, কাঁকড়া ধরে আনা, এসব ছিল বাবার প্রায়দিনের কাজ, বিশেষত বর্ষাকালে। কিন্তু এভাবেই ধীরে ধীরে তরাই-ডুয়ার্সের প্রকৃতি, সেখানকার গাছপালা, লতা-গুল্ম সব চিনে ফেলেন হাতের তালুর মতো করে। আমি দেখেছি, উত্তরবঙ্গের, বিশেষত জলপাইগুড়ি জেলার জৈব-বৈচিত্র্য ও লোক-ইতিহাস বাবার সম্পূর্ণ নখদর্পণে। তেলিপাড়া চা-বাগানে থাকাকালীন সেখানকার চা-শ্রমিকদের সঙ্গে এক নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে বাবার। চা-শ্রমিকেরা ছিলেন ছোটনাগপুরী আদিবাসী। এভাবে জীবনের শুরু থেকেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাবার এক আত্মিক যোগ তৈরি হতে থাকে। আজও বাবা মাতৃভাষার মতো বলতে পারেন সাদরি ভাষা। আর ছিল বই পড়ার অদম্য নেশা। চা-বাগান সংলগ্ন জঙ্গলের মধ্যে একটি গাছে মাচা তৈরি করেছিলেন বাবা। সেটাই ছিল সেই বালকের স্টাডি বা নিরিবিলিতে বসে বই পড়ার জায়গা। ততোদিনে ওই প্রত্যন্ত এলাকায় বসেও মুলক রাজ আনন্দের “দুটি পাতা একটি কুঁড়ি” পড়া হয়ে গেছে, পড়া হয়ে গেছে “গুড আর্থ”-এর মতো বই। মনের ভেতর জাগতে শুরু করেছে, সমাজচেতনা। “ভোম্বল সর্দার” পড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাবা। অর্থাৎ তখন থেকেই বই তাঁর শিশুমনে সাড়া জাগাতে শুরু করেছে। এরপর জলপাইগুড়ি শহরের আনন্দ চন্দ্র কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময় থেকে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। তখন কিন্তু বাবা কবিতা লিখতেন। সেসময়ে ওই কলেজে পড়াচ্ছেন অমিতাভ দাশগুপ্ত, দেবেশ রায়ের মতো কবি-সাহিত্যিকেরা। এঁদের সঙ্গে বাবার গোটা জীবনের এক আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ঘনিষ্ঠতা হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এ-কথাগুলি এই লেখায় সেভাবে প্রাসঙ্গিক নয় বলে বিস্তারে যাচ্ছি না।
রাজনৈতিক কারণে বাবার চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচুর বাধা এসেছে। সেসময়ে দিনের পর দিন অনাহারে, অর্ধাহারে কাটাতে হয়েছে। যাই হোক, সেসব পর্ব মিটিয়ে শেষ অব্দি থিতু হয়েছেন জলপাইগুড়ি হাই স্কুলের শিক্ষকতার চাকরিতে। কিন্তু ছকে বাঁধা জীবন সবার জন্য নয়। তাই পড়া ও জানার এক অদম্য খিদে বাবাকে সারাজীবন তাড়িয়ে ফিরেছে।
আমার ছোট বয়েস থেকেই দেখতাম বাবা কখনও একটি কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন না। নিজে হাতে ধানের জমিতে কাজ করতেন, বাড়িতে প্রায় সব ধরনের সবজি ফলাতেন, গরু ও মুরগি পুষতেন। আবার কাঠের কাজে, বিশেষত, খোদাইয়ের কাজে ছিল তাঁর বিশেষ পারদর্শিতা। আমি বাবাকে কখনও শুয়ে বসে কাটাতে দেখিনি। তখনও লোক-সংস্কৃতির কাজ শুরু করেননি, কিন্তু কবিতা ও গল্প লেখা চলছে সমানতালে, ছাপা হচ্ছে পরিচয়, উত্তরসূরী, ত্রিবৃত্ত, মধুপর্ণীর মতো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। সেইসঙ্গে হাতের কাজ, যাকে বলে কাটুম-কুটুম, সেগুলো তৈরি করতে কেটে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা। এতো বৈচিত্র্য ও নৈপুণ্য বাবার কাজে যে, বহুবার বহু শিল্পী ওঁকে বলেছেন কলকাতায় প্রদর্শনী করার জন্য। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। বাবার এইধরনের কাজগুলির বেশিরভাগই তিনি কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে সংরক্ষণের জন্য দিয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়াও মৌমাছি পালন করতেন। সেটাও কিন্তু শুধুমাত্র শখে নয়। রীতিমতো পড়াশুনো করে, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে তবেই করতেন। এর মধ্যে আবার শুরু হল বনসাই তৈরির কাজ। এখনও আমাদের জলপাইগুড়ির বাড়িতে অনেকগুলি বনসাই করা গাছ রয়ে গেছে। এসব কাজ কিন্তু বাবার পড়াশুনোর ক্ষেত্রকে কোনোভাবেই ব্যাহত করেনি। আসলে বাবার জীবন দেখে আমি একটাই শব্দ শিখেছি, তা হল, ডিসিপ্লিন। অসম্ভব নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে কাটিয়েছেন, এখনও কাটাচ্ছেন। নইলে ভাবা যায়, এই কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও অশীতিপর এবং প্রচণ্ড অসুস্থ একজন মানুষ আজও প্রতিদিন পুজো করার মতো নিষ্ঠা নিয়ে লিখে চলেছেন। মাসখানেক আগেই ওঁর একটি বই প্রকাশিত হল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং আরও কয়েকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি আছে। আরও বিবিধ কাজ করেছেন আমার বাবা। তার মধ্যে একটি হল ১৯৭৯ সালে “জলপাইগুড়ি সায়েন্স অ্যান্ড নেচার ক্লাব” তৈরি করা। এটি ছিল উত্তরবঙ্গের প্রথম এই ধরনের সংগঠন। বিজ্ঞান আন্দোলনের জন্য, কুসংস্কারমুক্ত এক সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার জন্য বাবা আজীবন লড়াই করে যাচ্ছেন। এই প্রতিষ্ঠানটির আরও একটি লক্ষ্য হল, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শুধু বিজ্ঞান-চেতনা নয়, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার এক বোধ জাগিয়ে তোলা। সে কারণে, তরাই-ডুয়ার্সের বিভিন্ন অঞ্চলে নেচার স্টাডি ক্যাম্প করে প্রকৃতির কোলে বসে প্রকৃতিকে চেনার সুযোগ করে দিয়েছেন। আজও বাবার সুযোগ্য উত্তরাধিকারীরা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
শুধু এটুকুই নয়, যুক্ত ছিলেন “পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ” সমিতির সঙ্গেও। ছিলেন সেই সমিতির রাজ্য কমিটির সদস্য এবং জেলার সম্পাদক। বাহাত্তর তেয়াত্তর সাল নাগাদ জলপাইগুড়ি জেলায় শুরু হয় এই সমিতির কাজ। বাবা জলপাইগুড়ি জেলার সমস্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে বয়স্ক শিক্ষার প্রকল্প শুরু করেন। যান-বাহন বলতে একটিমাত্র সাইকেল আর কিছু হাটবাস। ১৯৭৫ সালে জলপাইগুড়ি জেলার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন পিটিআই-তে। শুরু হয় সাংবাদিকের জীবন। এরপর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতেও যোগ দেন। নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজ ও সাংবাদিকতার কাজ করতে গিয়ে বাবার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠে কৌম সমাজের লৌকিক জীবনের। এখান থেকেই তৈরি হয় লোকসংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা।
এখনকার প্রজন্ম জানেন না, সত্তরের দশকের শেষ বা আশির দশকের শুরুর দিকে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিস থেকে “ভূমিলক্ষ্মী” বলে একটি কাগজ বেরোতো। এখানে ছাপা হতে থাকে বাবার একের পর এক ফিচার-ধর্মী লেখা। জলপাইগুড়ি জেলার বালাপাড়া গ্রামের তাঁতিদের নিয়ে লেখেন “বালাপাড়ার তিনশ ঘর তাঁতি এখন মুড়ি ভাজে”। বাবার মতে এটাই তাঁর লৌকিক জীবনের সংকট নিয়ে প্রথম লেখা। এখান থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায় তাঁর চলার পথ। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গেছে দুটি বই – “আদিবাসী প্রতিবেশী”(১৯৭৯) ও “পড়াইকো জিরেওয়া”। প্রকাশক “পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি”। উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে বইদুটি। “আদিবাসী প্রতিবেশী” বইটির পুনর্মুদ্রণ হয়েছে। এর মধ্যে “পড়াইকো জিরেওয়া” বইটি হল, টোটো উপজাতির মানুষদের বয়স্ক শিক্ষার জন্য লেখা। টোটো উপজাতিদের জন্য এধরনের কাজ বাবাই প্রথম করেন।
হিমালয়-সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ, তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলের ভূমিরূপ ও জৈববৈচিত্র্য যেমন অনন্য, তেমনই এই অঞ্চলের জনসংস্থান বৈচিত্র্যও তুলনারহিত। একশো একান্নটি ভাষা-উপভাষা ব্যবহারকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাস এই এলাকায়। এখানে যেমন একদিকে বসবাস করছেন মেচ(বোড়ো), রাভা, গারো, টোটো, লেপচা, ভুটিয়া(ড্রুকপা), ইয়োল্মো, কাগাতে প্রভৃতি স্থানীয় জনজাতি, তেমন অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের চা-বাগান পত্তনের সূত্রে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে এসে স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হয়েছেন, ওঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতাল, মাহালি প্রভৃতি দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক গোষ্ঠীর জনজাতি। এঁদের মধ্যে টোটো উপজাতিদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন বাবা। বাবার কাজের সবচাইতে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল, তিনি ক্ষেত্র-সমীক্ষার জন্য স্রেফ দু’চারদিন কোনো গ্রামে, কোনো উপজাতিদের মধ্যে কাটিয়ে তারপরই কিছু লিখে ফেলা, এটা কখনও করেননি। বাবা একটা আশ্চর্য কথা বলেন, সেটি হল, যখন কোনো গ্রামের কুকুর তোমাকে আর তাড়া করবে না, তখন তুমি বুঝবে তুমি সেই গ্রামের মানুষদের একজন হয়ে গেছ। এভাবেই সমস্ত জীবন ধরে আদিবাসী সমাজের একজন হয়ে উঠতে চেয়েছেন আমার বাবা। বাইরের থেকে গিয়ে নিজের কাজটুকু সেরে চলে আসা নয়, তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে তাঁদের কথা বৃহত্তর সমাজের কাছে তুলে ধরা, এটাই বাবার কাজের মূলমন্ত্র। তাই আজও টোটো বা রাভা উপজাতির মানুষেরা আমাদের বাড়িতে আসেন, এমনকি বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গেও বাবার এখনও নিবিড় যোগাযোগ রয়ে গেছে। আজও তাঁরা নিয়মিত বাবার খোঁজখবর নেন, নিজেদের বিবিধ বিষয়ে পরামর্শ চান।
কাজ করেছেন টোটো, রাভা, মেচ, ওঁরাও, মুন্ডা, ডয়া, বিরহড় প্রভৃতি উপজাতিদের নিয়ে। তখন আমি ছোট, কিন্তু তবুও মনে আছে, সেটা ১৯৭৯ সাল, বাবা ভুটানে ডয়া উপজাতিদের গ্রাম তাপাখাঁ থেকে ঘুরে এলেন। সে কী রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! ডয়ারা নাকি কাউকে ওঁদের গ্রামে ঢুকতে দেন না। ভিনদেশি দেখলেই দূর থেকে বিষাক্ত তির চালিয়ে মেরে ফেলেন। তখন দেশে রাজার আইন হয়েছে তাই ঢুকতে দিচ্ছেন। আর সে কী দুর্গম পথের বর্ণনা! খান কয়েক নদী পেরিয়ে, ধসে ভাঙা পথ উজিয়ে, পাহাড় ডিঙিয়ে তবে পৌঁছনো যায় ওঁদের গ্রামে। আরও কতো কতো গল্প! ডয়াদের ওপর ভারত থেকে বাবাই প্রথম কাজ করেন। বাবা ক্ষেত্র-সমীক্ষা না করে কিছু লেখেননি। ২০১১ সালের পর, যখন ওঁর হার্ট বাইপাস সার্জারি হয়ে গেছে, ধরা পড়েছে ক্যান্সার, সিওপিডি-র মতো মারণ রোগ, তখনও বাবা নিজে যেতে না পারলেও প্রতিনিধি পাঠিয়ে ক্ষেত্র-সমীক্ষা করে তবেই লিখেছেন। আসলে বাবা তো লোকসংস্কৃতির গবেষণা করেননি, লোকসংস্কৃতির সাধনা করেছেন সমস্ত জীবন ধরে।
বাবার জীবনের স্ট্রাগলের বিষয়ে একটি কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ওঁর গবেষণা শুরুর গল্প। ততোদিনে কিন্তু “দি এশিয়াটিক সোসাইটি” থেকে বাবার A SOCIOLOGICAL STUDY OF THE TOTO FOLK TALES”(১৯৯১) বইটি প্রকাশিত হয়ে গেছে। যে বইটির পুনর্মুদ্রণও হয় ২০১০সালে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর করা আমার বাবাকে সমাজ-বিজ্ঞানের ওপর গবেষণার অনুমতি দিচ্ছে না। ইন্টারডিসিপ্লিনারি কাজ করা সেসময়ে একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। এদিকে বাবারও জেদ, বাংলা নিয়ে কাজ করবেন না। এই নিয়ে বাবাকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখেছি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অবশেষে অধ্যাপক বাণীপ্রসন্ন মিশ্রের তত্ত্বাবধানে শুরু হল বাবার তথাকথিত অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের কাজ। শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি নয়, আত্মস্থ প্রজ্ঞাই ছিল এই মানুষটির কাছে মূল কথা। বাণীপ্রসন্ন মিশ্র বুঝেছিলেন বাবার মেধা ও প্রতিভাকে, মর্যাদা দিয়েছিলেন তাঁর নিষ্ঠাকে। ফলে টোটো উপজাতির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান নিয়ে বাবার গবেষণাপত্রটি মনোনয়ন পায়।
ইতিমধ্যে আরও বিস্তৃত হয়েছে বাবার কাজের পরিসর। শুধু টোটো উপজাতিই নয়, আরও বিভিন্ন উপজাতিদের সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। শুধু তরাই-ডুয়ার্সই নয়, ক্ষেত্র সমীক্ষার জন্য ভুটান, মেঘালয়, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে গিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন। ততোদিনে যুক্ত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের “লোক-সংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রে”-র সঙ্গে, রাজ্য কমিটির সদস্য ও জলপাইগুড়ি জেলার প্রতিনিধি হিসেবে। সেখান থেকেই প্রকাশিত হয় বাবার “রাভা জনজীবন ও লোককাহিনি”(২০০৮) বইটি।
প্রথাগত চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর বাবার কাজ করা ও লেখার সময় আরও বেড়ে যায়। ফলে প্রকাশিত হতে থাকে পরের পর বই। ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের “সেন্টার ফর স্টাডিস ইন লোকাল ল্যাংগুয়েজেস আন্ড কালচারস”-র কর্মসমিতির সদস্য হিসেবে যোগ দেন এবং উত্তরবঙ্গের লোকনাট্যের ওপর সমীক্ষার কাজে প্রকল্প-পরিচালক হয়ে কাজ শুরু করেন। সে-সময়ে এই সেন্টারে একটি পাঁচদিন ব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করেন, যেখানে উপস্থিত ছিলেন নাট্য অকাদেমির সচিব সুকান্ত রায় থেকে শুরু করে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী প্রমুখ উজ্জ্বল নাট্যব্যক্তিত্বেরা। নাটকের নাগরিক ধারার সঙ্গে লোকজ ধারার আদান-প্রদান নিয়েই এই কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই সদ্য প্রকাশিত হয়েছে বাবার “দেশ ও কালের প্রেক্ষাপটে উত্তরবঙ্গের লোকনাটক” বইটি।
এর আগেও অবশ্য আরও কিছু বই প্রকাশিত হয়ে গেছে – “উত্তরবঙ্গের আদিবাসী শিল্পকলা”(২০০৭) সূচনাপত্র প্রকাশন, “বিরহড়: একটি বনচারী জনজাতি”(২০১৭), প্রকাশক – দি এশিয়াটিক সোসাইটি, “প্রান্তীয় উত্তরবঙ্গের ভাষা ও ভাষিক পরিস্থিতি”(২০১৮) , উত্তরের ভাষা(২০১৮) অশোকগাথা প্রকাশন, “জলদাপাড়ার জলদাজাতি ও তাঁদের কথ্যভাষা”(২০১৮) মাতৃভাষা প্রকাশন, “উত্তরবঙ্গের আদিবাসী”(২০২০) গাঙচিল প্রকাশন, “THE TOTOS: A SMALL PRIMITIVE TRIBE OF SUB-HIMALAYAN BENGAL”(2020), West Bengal State Akademi Of Dance Drama Music & Visual Arts, RABINDRA BHARATI UNIVERSITY. এর মধ্যে পেয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির থেকে ‘তাপসী বসু স্মারক পুরস্কার’(২০০৯) এবং লোক-সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের “পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নৃত্য, নাটক, সংগীত, ও দৃশ্যকলা অকাদেমি”-র থেকে ‘আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন স্মারক আকাদেমি পুরস্কার’(২০০৯-১০) ও আরও বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। এর মধ্যেই প্রকাশিত হতে চলেছে বাবার আরও দুটি বই – “নৃগোষ্টীসূচক স্থাননাম অনুসরণে লুপ্তপ্রায় জনগোষ্টীর ভাষা ও জনগোষ্টীর সন্ধান” ও “প্রবন্ধ সংকলন”। যে কথা বলতে ভুলে গেছি, আদিবাসীদের জীবনকে উপজীব্য করে বাবার একটি গল্প সংকলনও হয়েছে ২০১৯ সালে – “রিনছেন”। বইটি পুনর্মুদ্রনের ভাবনা-চিন্তা চলছে।
আসলে, বাবাকে যেভাবে দেখেছি বা দেখে যাচ্ছি তা বলতে বসলে কথা আর ফুরোবেই না। একজন আদ্যোপান্ত শিকড় ছুঁয়ে বেঁচে থাকা মানুষ, একজন কর্মযোগী মানুষ, যিনি কোনও ফলের প্রত্যাশা না করে আজীবন কৌম সমাজের এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অস্তিত্ব, সামাজিক, আর্থিক সংকটের কথা বলে যাচ্ছেন, বলে যাচ্ছেন তাঁদের বিপন্নতার কথা। সারাজীবন ধরে চেষ্টা করে গেছেন দেশের মূল সংস্কৃতির ধারাটির সঙ্গে জনজাতিদের সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রেখেও একটা সংযোগ তৈরি করার। আসলে ওঁর লেখা না পড়লে শুধুমাত্র আমার কথা শুনে মানুষটিকে সবিশেষ বোঝা যাবে না। প্রতিটি লেখায় বাবা চেষ্টা করেছেন এইসব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার প্রতিবাদ করতে। তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আগ্রহ ও সম্মানবোধ জাগিয়ে তুলতে, যাতে করে তাঁরাও মানুষের মতো করে বাঁচতে পারেন, পেতে পারন মূলধারার সকল সুযোগ-সুবিধা। আসলে বাবার যতোগুলি কাজের কথা বললাম, তার মধ্যে সবগুলোই তাঁর নেশা, কেবল লোক-সংস্কৃতির গবেষণা হয়ে উঠেছে তাঁর জীবন-চর্যার অংশ।