ধারাবাহিক উপন্যাস <br />কেদার <br /> শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

ধারাবাহিক উপন্যাস
কেদার
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

তেরো

“বেণুং ক্কণন্তমরবিন্দদলায়তাক্ষং/ বরহাবতংসমসিতাম্বুদসুন্দরাঙ্গম।।/কন্দর্পকোটিকমনীয় বিষেষশোভং/গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।”(কাকে ভজনা করি আমি? সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে যার কণ্ঠে মুরলীগান, শিরোভূষণে ময়ূরপুচ্ছ, সুন্দর নীলমেঘের মতো, দুই চোখ কমল নয়নের মতো।;ব্রহ্মসংহিতা,শ্লোক ৩০)

উঠোনে লোক জমেছে সামান্য। কৃষ্ণেন্দু কোনও মতে ব্যবস্থা করে ঘরে আনতে পারল তার ঠাকুমার শরীরকে। সবকিছু একলা করেছে সে।না।পুরোটা একলা নয় যদিও। মাকে জানায়নি। সহেলীকেও না। ডাক্তার সই করতে বলেছিল দুই জায়গায়। সই করে বসে ছিল নীচের রাস্তায়। চার ঘন্টা আগে মৃতদেহ ছাড়ার নিয়ম নেই। শিকদারজ্যেঠুর ছেলে প্রফুল্লদার নম্বর খুঁজে পায়নি তখন। শেষে সাহায্য করে দিল হাসপাতালেই অপেক্ষা করতে থাকা এক অচেনা মহিলা।
-তোমার মা অলোকানন্দা না?গোকুলঘরিয়া বাড়ি?
-আপনি আমার মাকে চেনেন?
কৃষ্ণেন্দু চিনতে পারল না তাঁকে। অনেক চেষ্টা করেও না।কিন্তু মহিলাটির মুখে স্মিত হাসি যেন তাকে বারবার বোঝাচ্ছিল, ইনি তাকে চেনেন।
-কী হয়েছে?
-ঠাকুমা। নেই।
রহস্যময়ী মহিলাটি চুপ করে গিয়েছিল খানিক।তারপর কোনও অজ্ঞাত কারণে চোখ দিয়ে নেমে আসা জল মুছে বলল,”কখন ছাড়বে বলেছে?”
-সার্টিফিকেট পেতে চার ঘন্টা।
মহিলাটি পার্স থেকে তিনটি পাঁচশো টাকার নোট বের করে বলেছিল,”একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।দেখ পাও কিনা। বলবে ভগবন্তপুরের এমএলএ সনাতন বারুইয়ের লোক।মনে থাকবে?”
-কোনও কিন্তু নয়।যা বলছি করো।পরে বলব সব।তোমার মা আমাকে চিনত। তোমার নাম কী যেন?
-কৃষ্ণেন্দু।
-বেশ। এখন যাও।আমি এখানেই আছি।অসুবিধে হলে বলবে। সনাতন বারুই, ভগবন্তপুর।
কৃষ্ণেন্দু ঘাড় নেড়ে চলে গিয়েছিল।গাড়ি করে ঠাকুমাকে গোকুলঘরিয়ায় ফিরিয়ে আনার সময় মহিলাটিকে আর দেখতে পায়নি সে।ঘরে আসতেই কৃষ্ণেন্দু দেখল তার ওপর ওপর মা খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটা মেনে নিল। এর কারণ খানিকটা বুঝতে পারে সে। এতোগুলো বছর একজন অর্ধমৃত মানুষের সঙ্গে কাটিয়ে এসেছে তার মা। অনেকটা বেশ দূর দিয়ে বয়ে চলা গোকুলিয়া নদীটার মতো। ঠাকুমাকে সাজাতে সাজাতে দু একবার চোখ মুছল সে। তার বাবা অরিন্দমের জীবনচিহ্ন বহন করছিল ঠাকুমা। আজ সেও চলে গেলে তার বাবার চিহ্ন একমাত্র রয়ে যাবে তার রক্তে। মৃতদেহ সাজাতে সাজাতে বিকেল হলো। প্রফুল্লদা খবর পেয়ে কয়েকটা ছেলে নিয়ে এসেছে। গোকুলঘরিয়ার শ্মশানে এখন বৈদ্যুতিক চুল্লি বসেছে। বাবার মৃত্যুর সময় ওটা ছিল না।কৃষ্ণেন্দুর চোখে সে স্মৃতি বড়োই ঝাপসা। এই ঠাকুমাকেও সে তেমন কাছ থেকে পায়নি। স্ট্রোকের পর পড়েই থাকত ঘরে। তবু কাপড় ছাড়িয়ে ঘি মাখাতে মাখাতে তার মন ভার হয়ে আসছিল। সুরঙ্গমা চৌহান ঠিক বলেছেন। নগ্নতার শতসহস্র রূপ। ঠাকুমার নগ্ন শরীর স্পর্শ করতে করতে কৃষ্ণেন্দু তার শিল্পীর দুই চোখ দিয়ে প্রাণভরে দেখল মৃত্যুর রঙ। সমস্ত শরীর থেকে যেন কেউ তার শেষ রক্তবিন্দুটুকু ক্যানভাসে শুষে নিয়েছে। মধ্যিখানে সহেলী ফোন করল দুইবার। কেষ্ণেন্দু ধরল না। ধবধবে সাদা শাড়ি, কপালে চন্দনের তিলক, নাগে তুলো দিয়ে ঠাকুমাকে দাহ করতে চলল কৃষ্ণেন্দু।
কৃষ্ণেন্দুরা চলে যেতে অলোকানন্দার হঠাৎ কেমন যেন নিজেকে শূন্য কলসের মতো লাগছিল। অরিন্দম যেদিন চলে গেল, সেদিন তার আজকের মতো পরিণত প্রাজ্ঞতা ছিল না। মানুষের জীবন ঠিক গাছের পাতার মতো। ঝরে পড়বার আগে তার জীবনের বলিরেখাগুলো তার সামনে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।অরিন্দমের মৃত্যুর পর সে যেমন করে কেঁদেছিল, আজ কি আর কারো জন্য তেমন করে কাঁদতে পারবে সে!
-চিন্তা করিসনে। মানুষটা খুব কষ্ট না পেয়েই চলে গেল। এটাই তো ভালো।
অলোকানন্দা চমকে তাকিয়ে দেখল তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সুকুমারী। তার চোখের চাহনিতে কণামাত্র উন্মত্ততা নেই, কথনে লেশমাত্র জড়তা নেই। সুকুমারী ভালো হয়ে গেছে। সুকুমারী হেসে বললে।
-তোর সেলাই করা অহল্যার শালটা গায়ে দিলুম এড্ডু। কিছু মনে করিসনে বোনটি আমার।
অলোকানন্দার দুই চোখে এবার যেন বান ডেকে আসে। গোকুলিয়া নদীতে একসময় যেমন হতো। তার শাখা নদী কাঁকি আর চালুন্দি ফুলে ফেঁপে উঠত জলে। নদীপারের কলমীলতা, পুটুসফুল আর আকন্দঝোপগুলো কেঁপে উঠত, আর গ্রামের মানুষ বলে উঠত, ‘ওরে বান ডেকেছে রে। সামাল দে।’ দুকূল ছাপিয়ে যাওয়া জল অলোকানন্দার চোখে। অদ্বৈত গোঁসাই ঠিক বলে। নিতাই একহাতে কেড়ে নিলে অন্যহাতে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেয়।
-তুই ভালো হয়ে গেছিস সুকুমারী?
সুকুমারী হেসে বলল,”হয়েছিই তো ভালো। জন্মের ভালো। আর আমাকে পাহাড়া দিবি নে।”
অলোকানন্দা সুকুমারীকে ছাড়তেই চাইছে না যেন।আঁকড়ে ধরে রাখে দুইহাতে।
-কোথায় চলে গিয়েছিলি বল দিকি?
-যাক সে কথা। এখন এই শাল আমি নিলাম। তোকে মজুরি দেব। দিবি?
অলোকানন্দা হেসে বললে,”ও শাল তোমার হল। মজুরি লাগবেনি।”

কৃষ্ণেন্দুর ফিরতে ফিরতে রাত হল। অলোকানন্দা আর সুকুমারী দুজনেই জেগে অপেক্ষা করছিল তার জন্য। শাশুড়ির অস্থি হাতে নিয়ে ঠাকুরগরে রেখে কৃষ্ণেন্দু ঘরে আসতেই টিউবকল থেকে এক বালতি জল তুলে গামছা দিয়ে উঠোনেই চান করতে বলল অলোকানন্দা। তারপর এক গোছা খড়ের নাড়ায় আগুন ধরিয়ে আঁচ নিয়ে তবে ঘরে ঢুকতে দিল। কৃষ্ণেন্দু অসম্ভব শান্ত চোখে মায়ের আদেশ পালন করে ভিতরে ঢুকে এল। সুকুমারী তার মাথায় বিলি কেটে বলল,”কীরে। ঠাকমার জন্য মন খারাপ?”কৃষ্ণেন্দু মাথা নেড়ে বলল।
-মানুষ দিন দিন চামাড় বনে যাচ্ছে সুকুমারীমাসি।
-কেন রে?
-শ্মশানেও ব্যবসা। চুল্লিতে পুরো পোড়ানো আর হাফ পোড়াবার রেট, অস্থি নেবার ছোট মেজ বড় মালসার রেট, পুরুত বলল মানসি করতে। তার মূল্য ধরে দিল। সবেতেই টাকার থলি ধরিয়ে দিল গো মাসি।
সুকুমারী হেসে বলল, “আমার অচ্যুতও ঠিক অমন করে বলে। কী করবি, এযে কলিযুগ। গোঁসাই বলে, জগৎ জিতাম কেন?মনো হি এনো।” মনকে জিতে নে দেখি। আমার অচ্যুতকে ফিরিয়ে আনি। তোর একটা বন্ধু দরকার।
-অচ্যুতদা ফিরে এসেছে? কোথায় ছিল এতোদিন।
-সামলে নে। বলব সব।
রাতে ঘুম এল না কৃষ্ণেন্দুর। এক রাত নয়। এভাবে পরপর তিন রাত। এগারোদিনের দিনের মাথায় ঠাকুমার শ্রাদ্ধ।সামান্য জোগাড় হল।পুরুতঠাকুর আর পাঁচজন ব্রাহ্মণ। সুকুমারী আর অলোকানন্দা রান্না করল। গ্রামের কিছু মানুষ এলো খেতে। কাজ সুসম্পন্ন হচ্ছিল প্রায়। শুধু শেষ বিকেলে একটা লোক হঠাৎ এসে একটু চেঁচামেচি করে গেল। লোকটাকে আগে দু একবার দেখেছে কৃষ্ণেন্দু।রণজয় সেন না কী যেন নাম।ওই মুরগিখাঁচায় সিংহানিয়ার মুরগির হিসেবনিকেশ করে।লোকটা একটা সবুজরঙের আইনি কাগজ সঙ্গে এনেছিল।মার সঙ্গে ওর কথা বলার ধরনটা কৃষ্ণেন্দুর ভালো লাগল না। পুজো সারবার পর মাকে জিজ্ঞেস করতে মা বলল,”ও কিছু না।পরে বলব। লোকটা কয়েকটা টাকা পায়। তাই।”
এই কদিনে সহেলীর সঙ্গে কথা হয়েছে একবার। কলেজে রেজাল্ট বের হয়েছে। সে আর সহেলী দুজনেই পাশ করে গেছে নজরকাড়া নম্বর নিয়ে। বাড়তি খবর, ফ্রান্সের একটি ফ্যাশনহাউজ আসছে কলকাতায় তাদের কলেজে। ‘নিউমিউজ’।প্রধানত ‘ন্যুড’ মডেলের উপরেই তারা কাজ করে। মানুষের শরীরের নগ্নতা যে বিশ্ববাজারে একটা বিরাট বড়ো বিপণনের বিষয়, কৃষ্ণেন্দু সেটা এতোদিনে বুঝে গেছে। সহেলী বলছিল, স্যার নাকি বলেছেন। কৃষ্ণেন্দুর কাজ ওদের ভালো লেগেছে। কলকাতা ফিরতে হবে তাকে। কাজটা পেলে বেশ কিছু টাকা আসবে। সে জানে তার মায়ের এখন টাকা দরকার। টাকার অঙ্কটা কতো, তা অবশ্য মা বলছে না কিছুতেই। পঞ্চজবা গাছে ধ্বসা নামলে যেমন চোখের সামনে গাছ শুকিয়ে মরে, ঠিক তেমনই গোকুলঘরিয়ায় বহু ভিটে সামান্য অর্থাভাবে শুকিয়ে যেতে রেখেছে কৃষ্ণেন্দু। সুকুমারীমাসি ভালো হয়ে যাওয়াতে সে আপাতত নিশ্চিন্ত। মা একা থাকবে না। কাল সকালের ট্রেন। রাতে ঘুম এল না কৃষ্ণেন্দুর। সহেলী বলছিল। নতুনগ্রামের কোন রেলে চাকরি পাওয়া ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ দেখছে ওর পরিবার। সহেলী একবার বলে ফেলেছে তাকে। হাতে সময় নেই।একদিকে বসতভিটে, অন্যদিকে সহেলী। ফরাসীগুলোর মন তাকে কাড়তেই হবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কৃষ্ণেন্দু সচকিত হয়ে উঠল।পাখিতে গাবফল ঠোকরানোর মতো কোনও আওয়াজ ভেসে আসছে পাশের ঠাকুমার ঘর থেকে। তবে কি এতো রাতে চোর ঢুকল ঘরে! ওঘরে এতোদিন ঠাকুমা শুতো। এখন তার একটি ছোট সাদাকালো ছবি আছে শুধু। আত্মা অশরীরীতে বিশ্বাস নেই তার। তবে?হাতের কাছে লগা পাকড়ে পা টিপে টিপে কৃষ্ণেন্দু এগিয়ে গেল ঠাকুমার ঘরের দিকে। ঘরে মৃদু সবুজ নাইটল্যাম্পটা জ্বলছে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। শব্দটা আসছে এখনও। খুব দ্রুত নয়, স্তিমিত আকারে। দরজার কাঠের পাটাতনগুলো বাতাসের আদ্রভাবে আর মাটির নোনা লেগে আলগা হয়ে এসেছে সামান্য। সেই আলগা হয়ে যাওয়া ছিদ্রে চোখ রাখল কৃষ্ণেন্দু। ঘরের ভিতরে নাইটবাল্বের মৃদু সবুজাভ আভায় দুটি নারীশরীর। একে অপরের উপর বসে আছে। আধো আলোছায়ায় সে নারী অবয়ব চিনতে ভুল হলো না কৃষ্ণেন্দুর। একটি তার মা, অন্যটি সুকুমারীমাসি। ঘরের সবুজাভ রেখা তাদের দুজনের নগ্নতাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। একে অপরকে বারবার আঘাত করছে যেন, আবার আলিঙ্গন। দুই নারীর ভালোবাসাবাসি আর শীৎকার রূপ নিচ্ছে গাবখাওয়া কপতের শব্দে। সুকুমারীমাসির স্তন তার মায়ের স্তনে স্পর্শ করছে। যেভাবে গাছের দুটি অপ্রস্ফুটিত কুঁড়ি একে অপরকে ছুঁয়ে দেয়। কৃষ্ণেন্দু তার উপস্থিতি ওদের বুঝতে দিল না। বরং নিশিথের চাতকের মতো হার সমুদ্রের জলোচ্ছাসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো দুই উন্মত্ত শরীর দেখতে লাগল মুগ্ধ নয়নে। তারপর ফিরে এল নিজস্ব ঘরে। খাটের নিচ থেকে আঁকার শিট বের করে স্কেচ আঁকতে শুরু করে দিল আপনমনে। সমুদ্রসৈকতের মতোই একটার পর একটা ফিগার স্কেচ বেরিয়ে আসছে তার পেনসিল থেকে। কৃষ্ণেন্দু জানে কীভাবে সে ওই ফরাসীদের মন কাড়বে। অবশেষে সে জানে!

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes