আভেরনো
লুইস গ্লিক
(বাংলা তর্জমা: অংকুর সাহা)
আভেরনো
লুইস গ্লিক (১৯৪৩- )
[আভেরনো লেক। প্রাচীন আগ্নেয়গিরির ক্রেটারে জল জমে তৈরি হ্রদ। লাতিন ভাষায় নাম “আভেরনাস”। ইতালির নেপলস শহর থেকে দশ মাইল পশ্চিমে অতলান্তিক মহাসাগরে নিকটে তার অবস্থান। লেকের পরিধি দু মাইল এবং গভীরতা দুশো ফুট। পৌরাণিক যুগের রোমানরা ভাবতেন এই হ্রদ হল পাতালের প্রবেশপথ।
“আভেরনো” লুইস গ্লিকের দশম কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা। যে মেয়েটির কথা বারবার ফিরে ফিরে আসে এই কবিতায়, তিনি গ্রিক পুরাণের দেবী পার্সিফোনি, পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী ডিমিটারের কন্যা। তাঁকে প্রেমের ছলনায় ভুলিয়ে ভালিয়ে পাতালে নিয়ে যান মরণের দেবতা হেডিস। স্বর্গের সূর্যালোকিত তৃণভূমি ছেড়ে তিনি তলিয়ে যান পাতালের অন্ধকারে, প্রেমের আহ্বানে।
লুইস গ্লিক এর পরবর্তী কবিতার বই এর নাম: “যৌথ খামার থেকে শীতকালীন পাকপ্রণালী”, ২০২১ সালে প্রকাশিত হবে।]
।।১।।
আত্মার মৃত্যু ঘটলে তোমারও মৃত্যু হয়।
তা না হলে, বেঁচে থাকো তুমি।
ভালো ভাবে বেঁচে থাকা নয়, কাজ চালানোর মতো —
এ বিষয়ে তোমার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে চিন্তিত নয় কেউ।
এই সব কথা আমি আমার সন্তানদের বললে
তারা কোন আমল দেয় না।
তারা ভাবে, এই সব বুড়ো লোকেরা —
তারা সর্বদাই আজেবাজে বকে যায়:
তাদের মস্তিষ্কের কোষগুলি মরে যাচ্ছে রোজ
সেটা লুকিয়ে রাখতে তারা এমন সব বস্তুর কথা বলে
যাদের অন্য কেউ চোখে দেখতে পায় না।
তারা চোখের ইশারায় কথা বলে একে অন্যকে;
শোনো বুড়োদের কথা, পরমাত্মার কথা বলবে তারা
কারণ চেয়ারের অন্য কোনো প্রতিশব্দ তাদের জানা নেই।
একলা থাকা মানুষের কাছে অভিশাপ।
একা থাকার কোনো ইচ্ছেও নেই আমার —
যখন তুমি একলা, কেউ শুনতে পাবে না তোমার কণ্ঠস্বর।
চেয়ারের প্রতিশব্দ মনে আছে আমার।
কিন্তু বলতে চাই — আমার আগ্রহ নেই একেবারে।
এই ভেবে আমার ঘুম ভাঙে
প্রস্তুত থাকতে হবে তোমায়।
পরমাত্মা তোমায় ছেড়ে যাবেন শিগগির —
পৃথিবীর কোনো চেয়ারই এগিয়ে আসবে না তোমার রক্ষায়।
আমি ঘর ছেড়ে গেলে লোকেরা কী বলে, সব আমি জানি।
আমি কি নতুন সঙ্গী খুঁজবো, কিংবা নতুন কোনো
ওষুধ খেতে আরম্ভ করবো ডিপ্রেশনের জন্যে।
তাদের ফিসফিস আলোচনা শুনি কীভাবে তারা
ভাগ করে নেবে খরচাপাতি।
আমার ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলি
স্বপ্নের জগতে বাস করছো তোমরা সবাই।
খুব খারাপ, তারা ভাবে, আমায় ভেঙে পড়তে দেখে।
খুব খারাপ, তাদের কানে আমার এই নিয়মিত বক্তৃতা ছাড়া,
যেন এই নতুন শিখে নেওয়া তথ্যে নেই আমার অধিকার।
ঠিক, একই অধিকার রয়েছে তাদের সকলের।
স্বপ্নের জগতে বাস করছে তারা। আর আমি প্রস্তুত হই
প্রেতের ভূমিকা নিতে। চিৎকার করতে চাই
কুয়াশা সরে গেছে —
একটা নতুন জীবন পাওয়ার মতো ব্যাপার:
পরিণামের অংশীদার তুমি নও;
আর পরিণাম কী তুমি আগে থেকেই জানো।
ভেবে দ্যাখো একবার: ষাট বছর চেয়ারে বসে তুমি। আর এখন
খুঁজছো জীবনের সারাৎসার খোলাখুলি ও নির্ভয়ে —
সরিয়ে ফেল মুখাবরণ।
দেখে নাও কার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছো তুমি।
।।২।।
আমি সেখানে ফিরে যাই নি অনেককাল।
আবার যখন দেখি সেই মাঠ, শরৎকাল শেষ হতে চলেছে।
এখন প্রায় শুরু হবার আগেই তা শেষ হয়ে যায় —
বৃদ্ধদের গ্রীষ্মের পোশাক লাগে না বললেই চলে।
নিখুঁত তুষারে ঢাকা ছিল মাঠ।
এখানে কী ঘটে গেছে তার কোনো চিহ্ন আর নেই।
তুমি জানো না এই জমির চাষি
আর নতুন ফসল বুনেছে কি না।
হয়তো সে সব ছেড়েছুড়ে দেশান্তরী হয়েছে।
পুলিশ খোঁজ পায়নি মেয়েটির।
লোকে বলে, ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে সে চলে যায় বিদেশে,
যে দেশে খোলা মাঠ নেই।
এমন একটা আকস্মিক দুর্যোগ
কিছু চিহ্ন রেখে যায় না পৃথিবীতে।
লোকে আবার সেটাই পছন্দ করে — তারা ভেবে নেয় এতে
নতুনভাবে জীবন শুরু করার সুবিধে।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম দীর্ঘকাল, একদৃষ্টে শূন্যতার দিকে তাকিয়ে।
অল্প সময় পরে খেয়াল হয়, কী অন্ধকার আর কী শীতল।
সত্যিই দীর্ঘকাল — কোনো ধারণা নেই কতটা দীর্ঘ।
পৃথিবী যখন সিদ্ধান্ত নেয় কোন স্মৃতি অবশিষ্ট রাখবে না
প্রহরকে মনে হয় অর্থহীন।
কিন্তু আমার সন্তানদের কাছে নয়। তারা নাছোড়বান্দা
আমাকে উইল বানাতে হবে; তাদের ভয় সব ধনসম্পত্তি
বাজেয়াপ্ত করবে সরকার।
তাদের উচিত একদিন আমার সঙ্গে আসা
আর তুষারে আবৃত মাঠ নিজের চোখে দেখা।
পুরো কাহিনী সেখানে লেখা রয়েছে তুষারে।
কিছু না: আমার কিছুই দেবার নেই তাদের।
সেটা হল আমার প্রথম অংশ।
দ্বিতীয় অংশ: আমার দেহ যেন দাহ না হয়।
।।৩।।
সীমান্তের এপারে: আত্মা ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
সীমান্তের ওপারে: জীবিতেরা বাঁচে ভয়ে ভয়ে।
মাঝখানে: অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরিখা।
তরুণীরা জিজ্ঞেস করে আমায়
আভেরনো লেকের আশেপাশের জায়গাটা নিরাপদ কি না —
এখানে শীত খুব, তারা উষ্ণতার খোঁজে যেতে যায় দক্ষিণে কিছুদিনের জন্যে।
তাদের একজন, রসিকতা করে বলে, কিন্তু খুব বেশি দক্ষিণে নয়–
আমি বলি, অন্য যে কোনো জায়গার মতোই নিরাপদ,
তারা খুশি হয়ে রওনা দেয়।
তার অর্থ হলো কোনো জায়গাই নিরাপদ নয় আর।
তুমি ট্রেনে ওঠো, আর হারিয়ে যায় তার পরে।
তারা তোমার নাম লেখে জানালায়, আর হারিয়ে যাও তুমি।
এমন জায়গা রয়েছে পৃথিবীর সব অঞ্চলে,
এমন জায়গা যেখানে তুমি যাও এক তরুণী,
আর ফিরে আসবে না কোনোদিন।
সেই আগুনে পুড়ে যাওয়া মাঠের মতন।
তারপর হারিয়ে গেলো মেয়েটা।
হয়তো তার অস্তিত্বও ছিল না,
এখন আর তার সত্যি-মিথ্যে প্রমাণ করার উপায় নেই।
আমরা কেবল একটি কথাই জানি:
পুড়ে গেছে পুরো মাঠটা।
আমরা নিজের চোখে দেখেছি।
তাই মেয়েটির কথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই আমাদের,
সে যা করেছিল। তা না হলে
পৃথিবী শাসন করেছে যে সব শক্তি
তারা রয়ে যাবে আমাদের উপলব্ধির বাইরে।
মেয়েরা তাদের ভ্রমণের কথা ভেবে খুশি।
আর যাই করো ট্রেনে চড়বে না, আমি বলি তাদের।
ট্রেনের জানালায় জমা শিশিরে তারা নাম লেখে তাদের।
আমি তাদের বলি, তোমরা খুব ভালো মেয়ে,
চেষ্টা করো তোমাদের নামগুলো রেখে যেতে পেছনে।
।।৪।।
উপদ্বীপের যে অংশটি দ্বীপবহুল সমুদ্রে
গিয়ে মেশে, সেখানে
খুদে খুদে দ্বীপগুলোর গা ঘেঁষে
পাল তুলে এগোই আমরা
যতক্ষণ না সেগুলো ভাঙতে ভাঙতে
টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে ভেসে
ছড়িয়ে যায় উত্তর মহাসাগরের জলে।
দ্বীপগুলিকে দেখে মনে হয় নিরাপদ,
কেন না কেউ বাস করে না সেখানে।
তারপর ঘরে ফিরে এসে হেঁসেলে বসে
আমার দেখি গোধূলির সূচনা আর তুষারপাত।
একটার পর আরেকটা।
নীরব থাকি আমরা, তুষারে সম্মোহিত
যেন এক উদ্দামতা লুকানো ছিল
প্রকৃতিতে এর আগে, এখন
তা চোখের সামনে এসেছে,
নিশীথে একটা কিছু যেন
উন্মোচিত এখন —
নীরবতায় আমরা প্রশ্ন করি,
যে প্রশ্ন কেবল বিশ্বস্ত বান্ধবদের করা চলে,
যেগুলো অনন্ত ক্লান্তির প্রশ্ন,
প্রত্যেকের আশা, অন্য যেন তার চেয়ে বেশি জানে
এবং যদি তা না হয়,
এই যৌথ সংবেদন থেকে গড়ে উঠবে অন্তর্দৃষ্টি।
আমরা মরণশীল, এই উপলব্ধি থেকে
আমাদের কোনো কল্যাণ হবে কি?
জীবনের প্রধান সুযোগকে হারানো কি সম্ভব?
এই ধরণের প্রশ্ন।
প্রচণ্ড তুষারপাত। অন্ধকার নিশীথ এখন
ব্যস্ত ও শুভ্র বাতাসে পরিণত।
কিছু সত্য আমরা উন্মোচিত হতে দেখিনি।
কেবল তাদের প্রকৃত অর্থ উন্মোচিত হয় নি।
।।৫।।
প্রথম শীতটা পেরিয়ে আবার ঘাস গজালো সেই ভূমিতে;।
কিন্তু লাঙ্গলের সুসংবদ্ধ রেখা সেখানে অনুপস্থিত।
রয়ে গেলো সদ্য গজানো গমের সুবাস, এক রকমের
এলোমেলো ঘ্রাণ, নানান আগাছার সঙ্গে মিশে, মানবসমাজ
এখনো যার কোন উপযুক্ত ব্যবহার খুঁজে পায় নি।
বেশ একটা মাথা-ঘোরানো ব্যাপার — কেউ জানে না
সেই ক্ষেতের চাষ কোথায় কেটে পড়েছে।
প্রতিবেশীরা ভাবে সে পটল তুলেছে।
কেউ কেউ বলে তার এক মেয়ে থাকে নিউ জিনাল্ডে,
সেখানে গিয়েছে সে গমের বদলে
তার নাতিনাতনিদের দেখাশোনা করবে বলে।
দেখে যা মনে হয়, প্রকৃতি ঠিক আমাদের মতন না;
তার স্মৃতিতে ভরা কোন গুদামঘর নেই।
মাঠ-ক্ষেত ভয় পায় না দেশলাই কাঠিকে,
অথবা কমবয়েসী মেয়েদের। সে মনে রাখে না
লাঙ্গলের দাগগুলিকে। তাকে খুন করতে পারো,
পোড়াতে পারো, কিন্তু বছরখানেক পরে সে আবার
জ্যান্ত সবুজ হয়ে উঠবে, যেন তার আগে
অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নি।
সেই চাষি বাইরে তাকায় জানালা দিয়ে।
হয়ত নিউ জিল্যান্ডে অথবা অন্য কোন অজানা দেশে।
সে ভাবে: এই আমার জীবনের সমাপ্তি।
জীবনকে সে প্রকাশ করতো ক্ষেতের ফসলে;
এখন তার আর অন্য কিছু ফলানোর অভীপ্সা নেই
ধরিত্রীর থেকে। সে চিন্তা করে, পৃথিবী
তাকে হারিয়ে দিয়েছে।
মনে পড়ে যায়, যেদিন আগুন লেগেছিল তার ক্ষেতে,
সে নিশ্চিত যে আগুনটা দুর্ঘটনা ছিল না।
তার মনের গহনে কেউ বলে, আমি এটা মেনে নিতে পারি,
আর একটু বিরাম নিয়ে, আবার লড়বো তার সঙ্গে।
তার সারাজীবনের কর্ম যখন মুছে দিল আগুন,
তার পরের বসন্তকাল, চাষির জীবনের শোচনীয় মুহূর্ত
সে উপলব্ধি করে পৃথিবী জানে না কীভাবে
শোকপালন করতে হয়, বরং সে পাল্টে নেবে নিজেকে।
আর তারপর পৃথিবী যেমন চলছিল চলবে সেই চাষিকে ছাড়াই।
অনুবাদ: অংকুর সাহা।