অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br /> ষষ্ঠত্রিংশতি পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
ষষ্ঠত্রিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ৩৬তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।

৩৬

তাজমুল দৌড়ে চলেছে। ধানক্ষেত, মাঠ, মন্দির মসজিদ, কত কী পড়ল তার রাস্তায়। সে তবু দৌড়ে চলেছে। তার পেছনে তাড়া করে আসছে সেই মেয়েটা, যাকে সে কয়েকমাস আগে এরকম একটা ধানক্ষেতেই খুবলে খেয়ে ফেলে এসেছিল। সে তো একা নয়, আরও তিনজন ছিল তার সঙ্গে। তিনজন না চারজন? ঠিক মনে পড়ে না তাজমুলের। মোট কথা, সে একা নয়, সবাই ভাগ পেয়েছিল, ভাগ করলে কি পাপ কমে যায়? পাপ ভাগ করা যায়? পাপ কেন? ছেলেরা তো একটু আধটু দুষ্টুমি করেই, করেই ফেলে। ওরকম তো কতই হয়, বানতলা থেকে গুজরাট পর্যন্ত। কিন্তু সেই মেয়েটাকে তো ছিঁড়ে খুঁড়েই শেষ হয়নি গল্প, তার পেছনে দুটো দানা খরচা করা হয়েছিল। যাতে সে বুকে হেঁটে গিয়ে পুলিশে ডায়রি না লেখায়, হেব্বি কড়ক জান ছিল সেই চিকনি চামেলির। তাজমুলের কাঁধে কামড়ে এক সের মাংসই তুলে নিয়েছিল প্রায়। সেই থেকে কী অদ্ভুত ব্যাপার হয় যে। যতবার কোন মেয়ের সঙ্গে শোয়, কাঁধের জায়গাটা কেমন দপদপ করে, কীরকম ভয় ভয় লাগে, ও বারবার বলতে থাকে ‘দেখি তোমার দাঁত দেখি, দাঁতের ধার কেমন দেখি’
শুনে হেসে গড়িয়ে যায় মেয়েগুলো। ‘দাঁত দেখবে কেন গো, দাঁত?’ বলে একটু রসিক যারা তারা আবার তাজমুলের বুকে কামড় দেয়। হালকা কামড়, এ এক মোক্ষম তরিকা, ছেলেদের চাগানোর। কিন্তু তাজমুলের তো এতে উল্টো কাজ হয়, সে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়, নেতিয়ে যায়। কোন মস্তিই মারতে পারে না। বেগার এক মুঠো টাকা যায় মাগিগুলোর পেছনে। তাজমুলের আজকাল আর যেতে ইচ্ছে করে না ওদের কাছে। সবসময় একটা ভয় কাজ করে। মনে হয় ওরা কামড়ে তার সারা শরীরের মাংস তুলে নেবে। এই মেয়েগুলো খুব খতরনাক। শুধু এগুলো কেন, দুনিয়ার সব মেয়েগুলোই খতরনাক।এই যে মেয়েটা, যাকে তারা ছিঁড়ে খুঁড়ে তারপর গুলিতে ঝাঁঝরা করে চলে এসেছিল, সে কী করে জ্যান্ত হয়ে তার পেছনে ছুটে আসতে পারে? একটু দম নিতে দাঁড়িয়েছিল তাজমুল, তার মধ্যে মেয়েটা তার গায়ের কাছে চলে এসেছে। তাজমুল দেখল ওর নাক থেকে আগুনের শিখা বেরিয়ে ধেয়ে আসছে তার দিকে। এই আগুন তাকে ধরে ফেলবেই, আর জীয়ন্ত পুড়িয়ে মারবে তাকে। উহ মা, কী ভয়ানক!

ভয়ে কাঠ হয়ে গেল তাজমুল, আগুনের হলকা লাগছে গায়ে, অমনি ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘুম ভেঙে সে দেখল সত্যিই আগুন লেগেছে ঘরে, এর হলকাই লাগছিল তার গায়ে। শালা কেতো সিগারেট টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়েছে না নিভিয়েই, সেই আগুন ছোবড়ার গদিতে লেগে গেছে, সে চিৎকার করে উঠল ‘কেতো, বাচ্চু ওঠ শালা গাণ্ডু, আগুন লেগেছে আগুন’। ওরা সেই আগুনের মধ্যেই অকাতরে ঘুমোচ্ছিল, ওর চিৎকারে সবাই থাড়িমাড়ি করে উঠল। আগুন খুব বেশি ছড়ায়নি, তোশকের এক কোণ ধরেছে সবে। কিন্তু ঘরে জল বলতে তো খাবার জল এক জগ শুধু। তাজমুলের মাথায় ভেসে উঠল উঠোনের কল আর একটা মেয়েছেলের স্নানের দৃশ্য। সে তড়াক করে লাফিয়ে দরজা খুলে উঠোনের দিকে গেল।কেতো চেঁচিয়ে উঠল ‘কী করছিস কী? আমাদের ওদিকে যাওয়া বারণ তো’
‘তাহলে কি ঘরে বসে পুড়ে মরব’? ওরা আর কথা না বাড়িয়ে ওর পেছনে পেছনে এল। জানলা দিয়েই দেখেছিল তাজমুল কলের কাছে অনেক বালতি ভরাই আছে। সে একটা তুলে ঘরে গিয়ে তোষকে ঢেলে দিল। এইরকম তিন বালতি ঢালার পর আগুন নিভল। কিন্তু সেই ঘরে বাকি রাতটা ওরা থাকবে কী করে? তোশক পোড়া ছাই, জল,কাদায় থইথই সে ঘরে পা রাখার জায়গা নেই।কেতোটা এত গান্ডু, উঠোনে থপ করে বসে পড়ে বলল ‘ডাকলি কেন শালা, কী সুন্দর ঘুমোচ্ছিলাম’।
তাজমুল রেগে বলতে যাচ্ছিল, ‘ডাকা আমার গুখুরি হয়েছে শালা, তোর পুড়ে মরাই উচিত ছিল। দুনিয়া থেকে একটা পাপ ঘুচত তাহলে’।
কিন্তু সেই মুহূর্তেই কীসের যেন শব্দে ওর কথাটা আর শেষ করা হল না, ওরা তিনজনেই সচকিত হয়ে উঠল, আপসেই ওদের হাত চলে গেল কোমরে গোঁজা অস্তরের দিকে। আকাশে ঘসা ঘসা চাঁদের আলো, রাতটা বেশ, একটা শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে। অর্জুন গাছের মধ্যে দিয়ে এসে সে হাওয়াটা আরও মিঠে হয়ে উঠেছে, ইচ্ছে করলে বাকি রাত ওরা উঠোনেই কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হেব্বি রিস্ক তাতে। কে কোথায় দেখে ফেলবে, অমনি আর সকালের মুখ দেখতে হবে না। তাজমুল ভাবছিল, ও মরে গেলে জগতে কার কী ক্ষতি হবে? মা কাঁদবে, এটা সে নিশ্চিত।যদিও তার আরেকটা ভাই আছে, দিদিও আছে, দিদি বিয়ে হয়ে পাশের গাঁয়েই থাকে। তবু মার যেন তার ওপর কী এক টান। মা দাঁড়িয়ে আছে টিফিন কৌটো হাতে তার জন্যে সোনারপুর স্টেশনে-এইটা যেন চোখের সামনে দেখতে পেল তাজমুল। যদিও যে জীবন সে বেছেছে, তা একটা রাস্তার পোকার থেকেও খারাপ, যে কোন মুহূর্তেই যে কেউ পিষে দিয়ে চলে যাবে, তবু, তবু মার জন্যেই এত সহজে মরে যেতে পারে না সে।
সামনের ঘরের দরজাটা খুলে গিয়েছিল। সেখান দিয়ে যে বেরিয়ে এল, তার বুকে সায়া বাঁধা, চুল উঁচু করে বাঁধা, হাতে শাঁখা পলা, যদিও কপালে বা সিঁথিতে সিঁদুর চোখে পড়ল না। বউটা এসেই কলপাড় থেকে একটা ন্যাতা আর মগ, বালতি নিয়ে সোজা তাদের ঘরে ঢুকে ঘর সাফ করতে লেগে গেল। যেন সে জানতই আগুন লেগেছে আর সে আগুন নেভাতে গিয়ে ঘর জলে থইথই অবস্থা। মিনিট দশেকের মধ্যে ঘর পরিষ্কার করে সে বলল ‘আপনারা ঘরে যান, এখুনি শুকিয়ে যাবে, পাখা ছেড়ে দিয়েছি, এখন কলপাড় ছাড়ুন, আমি চান করব’
তাজমুল আশ্চর্য হয়ে গেল। এই বউটাকেই সে সম্পূর্ণ নিরাবরণ স্নান করতে দেখেছে সেদিন। সেটা কথা না, কথা হচ্ছে, সেদিন তো ভোর রাত ছিল। এখন বড়জোর দুটো বাজে। এখন স্নান করবে এ? এ কি সারারাতই স্নান করে নাকি? কেতো ঢুলতে ঢুলতে ঘরে ঢুকে গেল তখুনি, বাচ্চুও। কিন্তু তাজমুল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ঘসা চাঁদের নিচে।
ওদের ঘর পরিষ্কার করে এসে খালি বালতিগুলোয় জল ভরতে শুরু করল বউটা। দুত, কি বৌ বৌ করছে, তার বৌ নাকি? এ তো একটা মেয়েই, বড়জোর তেইশ চব্বিশ বয়স হবে। সেদিন তো একেই ও একদম উদোম হয়ে স্নান করতে দেখেছিল। আবছা জোছনার নিচে দেখা, তবু সে শরীর যেন তার কতকালের চেনা খুব।আর সেদিনও খেয়াল করেছিল, আজও দেখল এই মেয়েটার এত কাছে এসেও তার শরীরে হিলিবিলি হচ্ছে না কিছু। বরং ভেতরটা আশ্চর্য শান্ত হয়ে আছে। তাদের গ্রামে একটা বড় দিঘি আছে, কত, কত বছরের পুরনো। লোকবসতির থেকে দূরে। আসলে ওটা ছিল একসময়ের জমিদার চৌধুরীদের। তাদের বাড়ির ভাঙ্গা দেউলের পাশে সে দীঘিতে বড় একটা কেউ যায় না। নিচে কত গুল্ম, দেখা যায় নামলে। জমিদাররা কেউ থাকে না, স্নান করে না বড় একটা কেউ, কিন্তু ঘাট আর জল খুব পরিষ্কার থাকে। হয়তো কাউকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, সে-ই পরিষ্কার রাখে সব। জানে না তাজমুল। মূল গ্রামের একটেরে তারা থাকে, কয়েক ঘর মুসলমান। সবাই গরিব।তাদের নিজেদের একটা মসজিদ অব্দি নেই। পাশের গ্রামে যেতে হয় বিশেষ বিশেষ দিনে। একজন পাণ্ডা গোছের লোক, রমজান মোল্লা, মাঝে মাঝে এসে তাদের চেতাতে চেষ্টা করে, পরকালের জন্যে দানধ্যান, মসজিদ বানাবার ইঁটের টাকা- কেউ শোনে না তার কথা। বলে ‘সারাদিন আমরা পেটের ধান্দায় ঘুরি। পেট আগে না পরকাল আগে?’ রমজান মোল্লা বিরক্ত হয়ে চলে যায়, কিন্তু আবার আসে। এইসব লোকেরা সহজে হাল ছাড়ে না, দেখেছে তাজমুল। খুব ছোট থেকেই ও মার সঙ্গে কাজে যায়। বাড়ির সামনে মার শাক সব্জির খেত, সেই বিক্রি করে মা ক্যানিং বাজারে। তারা ছোট বলে কলকাতার দিকে যায়নি। তাজমুল মার সঙ্গে সঙ্গে বসত। তাই গ্রামের খবর তেমন রাখে না। কখনো ফুরসত পেলে চৌধুরী দীঘিতে চান করতে যেত। ঘেমে নেয়ে গেছে, হয়তো কারো সঙ্গে ঝগড়া মারপিট, টকঝক হয়েছে। কিন্তু দীঘির জলে নামলেই শরীর মন জুড়িয়ে যেত। কোথাও চান করে এমনটা হয়নি তার। এই মেয়েটাও তেমন । একে দেখলে সব শান্ত হয়ে আসে। কেন এমন হয় বুঝতে পারে না তাজমুল।সেই চৌধুরীদীঘির শীতলতা আরেকবার অনুভব করবে বলে ওখানে দাঁড়িয়েই রইল তাজমুল। মেয়েটা যেন ওকে লক্ষ্যই করেনি এমনিভাবে খালি বালতিগুলোয় জল ভরছিল। তাজমুলের একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত লাগছিল। মেয়েটা জল ভরছে কল পাম্প করে করে, কিন্তু পাম্পের কোন ক্যাচ কোঁচ আওয়াজ হচ্ছে না। তাছাড়া বালতিতে জল ভরার তো একটা আওয়াজ হয়, সেসব কিছুই হচ্ছে না। তারপর সে যখন ঝাঁটা দিয়ে কলপাড় ঝাঁট দিল, তারও কোন আওয়াজ হল না। তাজমুলের মনে হল ও কোন সাইলেন্ট ছবি দেখছে, আগে আগে ছবি যেমন ছিল, নির্বাক। জল ভরা হয়ে গেল, ঝাঁট দেওয়া হয়ে গেল। এবার কী করবে মেয়েটা তাজমুল যেন জানে, কিন্তু তাতেও তার শরীরে কোন ছটফটানি হল না। বরং কেতো আর বাচ্চু এদের পাশে শুলে তার শরীরে একটা উত্তেজনা হয়।না, না সে ওইসব নয়, ওই ছেলেতে ছেলেতে যারা করে। সে হচ্ছে কেতো। তবে কেতোর নীতি আছে। কখনো তাদের গায়ে হাত দিতে আসেনি। বাপিদার সঙ্গে নাকি ওর একটা মাখো মাখো ব্যাপার আছে। কেতোর ছোটখাটো নরম শরীরটা বাপিদার খুব পছন্দ। তাই অনেক উতপটাং কেসে জড়িয়ে পড়লেও ওর সব মাপ করে দ্যায়। এই তো কিছুদিন আগেই একটা বাইরের মার্ডারে ওর নাম জড়িয়ে গেল। স্রেফ টাকার জন্যে একজন নামী লোককে আর তার ড্রাইভারকে খুনের ছক কষেছিল এক মা বেটা। মা টি হেব্বি জিনিস। কেতো পুরনো চেনা, ওকে ফোন করে বলেছে, ‘কিছু কাজ নয় রে কেতো, খুন সানিই করবে, তুই শুধু একটু জাপটে ধরে থাকবি,’ কেতো ভাবল মজা মন্দ নয়, কাজ কিছুই নেই, শুধু জাপটে ধরা, তার জন্যে পঞ্চাশ হাজার রোকড়া পাওয়া যাবে অমনি।তবু ও দোনামোনা করছিল। ও তো বাপিদার কম্পানিতে কাজ করে, বাপিদা জানতে পারলে সেঁকে ছেড়ে দেবে। ও চুপ করে আছে দেখে সেই মহিলা, অতসী হালদার ধরা ধরা গলায় বলল ‘তোরা আমাদের পাশের ঘরে থাকতিস রে কেতো, তোর মা কাজে বেরিয়ে গেলে তোর কত মুতের কাঁতা পাল্টেছি, আমি তোর মাই তো। মার জন্যে, ভায়ের জন্যে এটুকু করবি না? এখনকার দিনে বিশ্বাসী লোক পাওয়া যায় না। তাই তোকে এত খোসামোদ করছি।’ ব্যস হয়ে গেল। কেতো মাল ক্যাচ কট কট।মায়ের কথা বললে কেতোর ভেতরটা উথাল দ্যায়, ভাতের ফেনের মতো। মাকে তো তার মনেই নেই। জন্মের বছর খানেকের মধ্যেই ভেগেছিল।রঙের মিস্তিরি নিতাইয়ের সঙ্গে। না ভেগে করবে কি? বাপ তো নিত্য কেলাত। মা ভাগার পর দিদিমা তাকে নিয়ে গেল। সেই বুড়িও বাঁচল না বেশিদিন। তারপর থেকে এর, তার দোরে ঘুরছে সে। দুয়ারে সরকারের মতো। তাই অতসি মাসীর ডাক ফেলতে পারেনি সে। কিন্তু মা ছেলে যে এমন ছড়িয়ে ফেলবে কে জানত। সে পুলিশের জালে ফেঁসে গেছিল আর কি। অগত্যা বাপিদার কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ল। বাপিদা তাকে কোলে বসিয়ে বলল ‘ঘাবড়াস না, তুই আমার জিগর কা টুকরা। তবে পরে আবার এমন করলে আমি নিজেই তোকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। আমি তোকে কী দিইনি যে তুই লেজ তুলে পঞ্চাশ হাজারের পেছনে দৌড়লি?’
বাপিদার অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। তুলোর বাক্সে রাখা আঙুরের মতো রাখে কেতোকে। তার এমন কীর্তি। তারা কেউ এমন করলে ওখানেই গুলি করে মারত। কেতো বলেই পার পেয়ে গেল। ওর বদলে আর একটা একই চেহারার ছেলেকে ফাঁসানো হল। সে এখন জেল খাটছে। বেরিয়ে এলে এই দলেই ঢুকবে।
সেই কেতো, বাচ্চুদের পাশে শুয়ে অনেক সময় ঘুম যে আসে না তার, তার কারণ, এরা হচ্ছে পাকা খুনী, রক্তের নেশা আছে এদের, কখন হয়তো শখ চেগে উঠল, তাজমুলকে মেরেই দিল। কে বলতে পারে নেহাতই হাতের তাগবাগ ঠিক রাখার জন্যে কেতো কি বাচ্চু তাজমুলকে মেরে বসবে না? না, বাচ্চু এমনটা করবে বলে মনে হয় না তার। কারণ বাচ্চু হচ্ছে একশো শতাংশ পেশাদার। সুপারি না পেলে সে পিঁপড়েও মারবে না আর সুপারি পেলে চুপচাপ নিজের মাকেও খুন করে দেবে। এই লাইনে যখন ট্রেনিং হয়, তখন একটা দাদা বলেছিল, ‘মনে রাখবি এইসব কাজ করা শক্ত খুব। কারো ওপর রাগ পুষে তুই এইসব করছিস না। লোকে যেমন অফিসে চাকরি করে, সেইরকম ডিউটি এটা তোর। পয়সা পাচ্ছিস, তাই গুলি চালাচ্ছিস। ব্যস মিটে গেল। কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবি না। জড়ালেই তুই শেষ। ইউ আর ফিনিশড’।
বাকিরা কেউ কথা বলেনি, আদৌ ওদের খোপরিতে ঢুকেছে কিনা কে জানে। কিন্তু কুরিয়ারে কাজ করার জন্যে অনেক ভালো ভালো লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে তার, ভালো কথা শুনেছে, সে তাকিয়ে দেখেছিল মালটার দিকে। কি শান্ত মুখ, চোখ দুটো যেন ফকিরের মতো। সবাই ওকে বলছিল জগাদা। সে ফট করে বলে বসেচ্ছিল ‘রাগ থাকলে তো নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে পারতাম জগাদা। একটা কারণ থাকত খুন করার। এমনি এমনি খুন!’
‘এমনি এমনি কেন, এটা তোর চাকরি। চাকরিতে অনেক রকম কাজ থাকে, এটাও কাজ। তাছাড়া যাদের মারতে হচ্ছে, তারা বহু আগেই মরে ভূত হয়ে গেছে।’
কেমন কেঁপে উঠেছিল তাজমুল। তবু ও বলতে ছাড়েনি ‘ আমার কাছে কিন্তু হিসেবটা অন্যরকম দাদা। রাগ থাকলে ভালো হত। আমি নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে পারতাম। হ্যাঁ আমার লোকটার ওপর খার ছিল। আমি ওকে টপকে দিয়েছি।
কিন্তু এখানে যাকে মারব, তাকে তো চিনিই না। হয়তো লোকটার সঙ্গে আমার খুব পটত, হতে পারে আমি ওর খুব বন্ধু হতে পারতাম। হয়তো ও পাশে থাকলে আমার এতটা একা লাগত না। কিন্ত সেসব সুযোগ তৈরিই হল না, তার আগেই আমি মানুষটাকে খাল্লাস করে দিলাম। কেন দিলাম? না, অমুক লোকের পথের কাঁটা ছিল লোকটা, সে চেয়েছে তাই আমি ওকে সরিয়ে দিচ্ছি। সত্যি বলছি দাদা, এ আমার কাছে ঠিক কিলিয়ার হচ্ছে না। পয়সা পাচ্ছি বলে মারব? এতে কী হবে বলুন তো, লোকটাকে হয়তো মারব, কিন্তু চোখদুটোর কী হবে? চোখ কখনো মরে না। সেই মেয়েটা, যাকে ভেবেছিলাম মেরে ধানক্ষেতে ফেলে এসেছি, তার চোখ দুটো এখনো তাড়া করে বেড়ায়। মেয়েটাকে মারতে পারলেও চোখ দুটো মারতে পারিনি। সেরকম, যাদের মারব, তাদের চোখ তো মরবে না, আমাকে তো তারা বলবে, আমরা তোমার কিছু করিনি, তবু মারলে কেন?আমাদের ওপর তোমার তো কোন রাগ থাকার কথাই নয়’
ওর বকবকানি লোকটা শান্ত হয়ে শুনছিল। অন্য কেউ হলে এক দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দিত। বলত ‘আনসান কথা বলিস নি। না পোষায়…’
না, এ লাইনে না পোষানোর মানে মরণ- এ কথা জানে পটা। একবার চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ঢুকেছ মানে আর বেরোতে পারবে না, বেরোতে গেলে রাস্তায় গাড়ি পিষে মারবে, বলা হবে অ্যাক্সিডেন্ট। আর ভেতরে এদের লোক হয়ে থাকলেও মরতে হবে একদিন না একদিন। কোন সুপারি কিলার কোনদিন লাইফে সেটল করে সেলিব্রিটি হয়েছে? কেউ কোনদিন শুনেছে নরম সোফায় গা এলিয়ে বসে টিভিতে ইন্টারভিউ দিচ্ছে? আজ নয় কাল তাকে মরতে হবেই। তাজমুল টের পেল সে একটা মোবাইল গেমের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তার চারপাশে ওত পেতে আছে মৃত্যু।
লোকটা বলল ‘রাগ থাকলে কি অ্যাকশন করতে সুবিধে হত?’
সে ভয়শূন্য হয়ে জবাব দিল ‘সে তো বটেই, যেমন সেই লোকটা আমাকে অপমান করেছিল। ওকে ছাড়ব না আমি’
‘কী নাম মনে আছে’?
‘থাকবে না? সব চিঠির খামে তো জ্বলজ্বল করত নামটা। ওই নাম কি ভোলা যায়?’
একটু কি চমকাল লোকটা?
‘কোথায় বাড়ি বল তো? কীভাবে আলাপ তোমার সঙ্গে?’
‘ঝিলপাড়ে বাড়ি। বিশাল তিনতলা। দোতলায় অর্ধেক ছাদ, সেখানে বসে বসে লোকটা বই পড়ে অন্ধকার নেমে আসা অব্দি। আমি চিঠি দিতে যেতাম। তখন স্যার নেমে আসত নিচে। পর্দার ফাঁক দিয়ে যে ঘরটা দেখা যেত, শুধু বই আর বই। এত বই কারো বাড়ি দেখিনি আমি। চিঠি দেবার জন্যে এত বাড়ি যাই, অনেক বাড়ির ভেতরেও যাই সই করাতে, বেশির ভাগ বুড়ো মানুষ। সাজানো গোছানো ঘর। দু চারটে বই কাচের শো কেসে সাজানো। সাজাতে হয় তাই। শো ওসব। আমরা বুঝি ওসব দাদা, কে অরজিনাল আর কে সত্যি। এই লোকটার বাড়ির মেঝেতেও বই পড়ে থাকত, সোফার এক কিনারেও গাদা করা। ওনার বৌ গজগজ করত ‘কত আর গুছোব? সোফাটা তো অন্তত রেহাই দাও। লোক এসে বসবে কোথায়?’ ভারি ভক্তি হত দেখে। তাই স্যার বলতাম ওঁকে। পাড়াটাও খুব ভালো লাগত। বড় বড় দীঘি, অনেকটা আমাদের গাঁয়ের চৌধুরী দীঘির মতো, চওড়া চওড়া রাস্তার দুপাশে কি সুন্দর সব বাড়ি, একটা বাচ্চাদের পার্ক অব্দি আছে। আমি চেষ্টা করতাম, ওই জোনটায় লাস্টে ঢুকতে। সারা শহরে চিঠি বিলি হয়ে গেলে ওখানে ঢুকতাম। তারপর ঝিলের ধারে কিংবা চিল্ড্রেন্স পার্কে অর্জুন গাছের নিচে বসে টিফিন খেতাম। শহরে আর কোথাও বসে খাবার জায়গা ছিল না। পার্কটায় বাচ্চারা খেলত। মাঝে মাঝে আমার গায়ে বল এসে লাগত, আমার ভালো লাগত। ওরা ভাবত আমি রেগে যাব বুঝি, বল আর ফেরত পাবে না ওরা। কিন্তু আমি দিয়ে দিতাম বল। বলতাম তোমরা লুকোচুরি খেল না আর? দাড়িয়াবান্ধা? পিট্টু, কুমীরডাঙ্গা?
‘বৌ বাসন্তী? চু কিতকিত? চোর চোর?’
‘আপনি জানেন স্যার এত খেলা?’ তাজমুল অজান্তেই এই লোকটাকে স্যার বলে ফেলল। একে দেখেও তার বেশ ভক্তি হচ্ছে। কারণ ঘরে ঢুকেই সে দেখেছে এই লোকটা বই পড়ছে বসে বসে। ভারি মোটা বই, ইংরেজি। তার এই লাইনের অভিজ্ঞতায় এমনটা দেখেনি কখনো। বাপিদার কাছে দু একবার দেখা করতে গিয়ে সে দেখেছে দু চারটে চকচকে পত্রিকা, তার ওপর ন্যাংটো মেয়েমানুষের কিংবা পুরুষমানুষের ছবি। সেটা দেখে চমকায়নি তাজমুল। কোথায় কী মানায় তার একটা পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেছে তার। এ লাইনে তো কম দিন হল না। কিন্তু এ লোকটা পড়ছে একটা গোদা বই, ইংরেজি, যাতে ন্যাংটো মেয়ে, পুরুষ তো দূরের কথা কোন ছবি নেই।
‘এইসব খেলতেই খেলতেই তো বড় হলাম। এখন শুধু চোর চোর’
বলে হাসল অল্প, তারপর বলল ‘বলো তুমি’
‘কত ফুল সেই পার্কটায়।’
‘আচ্ছা মোরগঝুঁটি ফুল ছিল ওখানে? রক্তের মতো রঙ?’
তাজমুল মাথা নাড়ল। এরকম কোন ফুলের নামী শোনেনি সে। দেখা তো দূরের কথা।
লোকটা বলেই চলল ‘বাচ্চারা খেলতে আসত, তুমি ওদের বাগানে ঢোকা বন্ধ করলে। ওরা আর খেলতে পায় না। বাগানের চারদিকে কেঁদে কেঁদে ঘোরে। একদিন একটা বাচ্চা এল। তার দুহাতে দুপায়ে পেরেক মারার ক্ষত।
তুমি জিগ্যেস করলে এগুলো কী? সে বলল এ হচ্ছে ভালবাসার ক্ষতচিহ্ন। তারপর একদিন দেখা গেল দৈত্যটা গাছের নিচে মরে পড়ে আছে। তার শরীরের ওপর শুধু ফুল আর ফুল’
তাজমুল চাপা গলায় বলল ‘ওই দৈত্যটা কি আমি? আমি তো বেঁচে আছি’
‘আমরা সবাই মরে গেছি। একদিন ওরা বাগানটা দখল করে নেবে’
তাজমুল কেমন কেঁপে উঠেছিল শুনে। ওর খেই হারিয়ে গিয়েছিল কথার। কী যেন বলছিল ও। মনেই পড়ছিল প্রথমে। সেই বোসের সঙ্গে আলাপের কথা?
জগাদা আবার বলল ‘বেশ। একদিন ওকেই মারবে তুমি। ধরে নাও এটাই তোমার বাকি কাজ করার পুরস্কার’

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes