ফয়েজ় পরিক্রমা-৪
নীলাঞ্জন হাজরা
একটা সার কথা বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, একটা সমীকরণই বলা যায় — অপরিচয় আনে দূরত্ব, দূরত্ব আনে অবিশ্বাস, অবিশ্বাস আনে সন্দেহ, সন্দেহ আনে ঘৃণা। কী ভাবে আনে, ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও তস্য পরিবারের আরও নানা সংঘের উত্থানের ইতিহাস তার প্রমাণ। আমার কোনও মুসলমান সহপাঠী সে সময় ছিল না। একজনও না। কিন্তু বৈচিত্রকে মেনে নেওয়ার এই অভ্যাস রক্তের মধ্যে এমনই ঢুকে গিয়েছিল যে, ‘গুজরাটি’ বা ‘মণিপুরি’-কে যেমন ‘অন্য’ কাজেই ‘দূর’ মনে হয়নি কখনও, মুসলমান বা মুসলমান বলে মহাবদমাইশিতে দেগে দেওয়া কোনও কিছুকেই তা মনে হওয়ার সুযোগ হয়নি আমার কোনও দিন। ফয়েজ় পরিক্রমার চতুর্থ পর্ব । নীলাঞ্জন হাজরার কলমে।
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন- তৃতীয় পর্ব
নেই, কোনওখানে নেই আর রক্তের দাগ
ইন সার্চ অফ ভ্যানিশ্ড ব্লাড। শিল্পী নলিনী মালিনী
রাকেশের সেই কান্না কোনও দিন ভুলব না। অঝোরে কান্না। সারা দিন, সারা রাত। আমরা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ঢুলে ঢুলে পড়ছি, আবার ধড়মড় করে জেগে উঠেই দেখছি সে কেঁদে চলেছে। দিশাহারা। এটা ক্লাস ফোর, মানে সেই ১৯৭৬ সালের কথাই হবে। কারণ ছবির মতো দেখতে পাচ্ছি ঘটনাটা ঘটেছিল প্রেমানন্দ ধামে, যে হস্টেলটা ছিল শুধু ক্লাস ফোরের ছাত্রদের জন্যই। যেমনটা আগে বলেছি কোথাও, দু’ পাশে দুটো চৌকো বাগান রেখে, খিলান করা পোর্টিকো দিয়ে উঠে একটা লম্বা বারান্দা। তার ওপরেই একটা হলঘর। ডান পাশে আর বাঁ পাশে দুটো করে ছোটো ঘর। এই কাণ্ড ঘটেছিল ডান দিকের প্রথম ছোটো ঘরটায়। এক মঙ্গলবার।
সেশন শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ বোর্ডিং স্কুলে হাজির হয়েছিলাম যখন, আমাদের হস্টেলের ভাষায়, আমার ‘বেড পড়েছিল’ হল ঘরে। আজ আর ঠিক মনে নেই, কিন্তু গরম বা পুজো কোনও একটা ছুটির পরে বাড়ি থেকে ফিরেই দেখি সব একেবারে ওলট-পালট। নোটিশ বোর্ডে যে তালিকা দেওয়া আছে সেই অনুযায়ী আমার বেড পড়েছে ওই ছোটো ঘরে। কী যে রাগ হয়েছিল! কিন্তু ওই যে আগেও বলেছি, রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে আমার ঋণের কোনও সীমা নেই। এইটা করা হতো রুটিনলি, প্রায় প্রত্যেক ছুটির পরে। অনেক পরে বুঝেছি কী এক সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল আমাদের দিল-ও-দিমাগে এর ফলে — গোষ্ঠীবদ্ধতার প্রবণতাটা কখনও গজাতেই পারেনি রক্তে। শৈশবে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ তৈরির একটা ব্যাপার থাকে। সে যে কী বন্ডিং — এই বন্ডিং শব্দটার জুৎসই বাংলা খুঁজে পাচ্ছি না, প্রাণের টানের বাড়া। সম্ভবত হস্টেলে এটা আরও প্রগাঢ় হয়। তৈরি হয়ে যায় ছোটো ছোটো দল। একসঙ্গে তাদের সব কিছু। খাওয়া-দাওয়া-স্নান-ড্রিল-খেলা-হাসি-কান্না- প্রার্থনা-ছোটো ছোটো যৌন আবিষ্কার ও অন্যান্য নানা ‘অপরাধ’…। সব। মনের মধ্যে একটা দলীয়, clanish, বোধ তৈরি হয়। এটা আমার দল, এর মধ্যে আমি স্বচ্ছন্দ, নিশ্চিন্ত। ক্রমাগত বেড বদল করে, ঘর বদল করে, ধাম বদল করে— সঙ্গী বদল করে এটা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হতো।
ছুটি থেকে ফিরে দেখলাম আমি চলে গেছি সেই চার জনের রুমে। দু’জনের কথা স্পষ্ট মনে আছে— রাকেশ আর ইন্দ্রনীল-ওয়ান। তৃতীয় জন বোধ হয় ছিল সৌরভ, নাও হতে পারে। রাকেশ জেটলি। খাস গুজরাটি। আহমেদাবাদ থেকে এসেছে। ইন্দ্রনীল মুখার্জি-ওয়ান (আমরা বরাবর মুখার্জি-ই শুনেছি, মুখোপাধ্যায় নয়), ওয়ান কারণ ওই একই নামে ছিল আর একজন। কলকাতার ছেলে। আর যদি সৌরভ হয়ে থাকে, সৌরভ ঘোষ, বিহারের বাঙালি। এই রাকেশ ছিল একেবারে ‘শুদ্ধ্ শাকাহারী’ — নো পেঁয়াজ, নো রসুন। ডিম-মাছ-মাংস কল্পনাতীত। আর এই রাকেশের একবার প্রবল ইচ্ছে হলো মাংস খাওয়ার! এবং তাকে মোক্ষম তাতাল এই অধম! দিনটা ছিল মঙ্গলবার, কারণ সপ্তাহের ওই দিনটা ছিল মাটন-ডে! সাত দিন ভাগ করা থাকত মাছ-ডিম-নিরামিষ মিলিয়ে মিশিয়ে। এটা লাঞ্চ। রাতে রোজ নিরামিষ। তেমনই এক মঙ্গলবার আমি আর রাকেশ এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে ঠিক করলাম রাকেশ খাবে মাংস।
ডাইনিং হলে পিঁড়ি পেতে বসা। সারি সারি। ভাতটা সার্ভ করত ছাত্ররাই। বিপুল হাঁড়ি। একটা ঠেলার ওপর চাপান। কুষ্ঠ রোগী-ভিখিরিদের যে ঠেলায় চাপিয়ে টেনে নিয়ে যেতে একসময় আকছার দেখা যেত কলকাতার ফুটপাথে, কতকটা সেই রকম একটা পাটাতনের নীচে চারটে ছোটো চাকা বল-বিয়ারিং দিয়ে লাগান। তবে পাটাতনের মাঝখানে একটা প্রমাণ মাপের গর্ত যাতে হাঁড়ির নীচেটা খাপে খাপে বসে যায়। ভর্তি করা ভাত। দুপাশে দুই ছাত্র — একজন ঠেলছে, একজন টানছে। দেড় হাতি লম্বা লোহার হাতা দুটো। একজন ডান দিকের সারিকে দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, অন্যজন বাঁ দিকের সারিকে। ঠকাং, ঠকাং, ঠকাং, ঠকাং — হাতা ঠুকতে হতো, কারণ ঝরঝরে ভাত হস্টেলে কখনও খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। এরপর কিন্তু ডাল-তরকারি-মাছ-ডিম-মাংস, যেদিন যা, বিরাট বিরাট গামলাতে ঘষটে টানতে টানতে ঝড়ের গতিতে দিতে দিতে যেত ডাইংনিং হলের রাঁধুনি-কাম-ওয়েটার সীতারাম-দা, লছমন-দা-রা! লম্বা ডাইনিং হলের এক মাথায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ঈগলের চোখে সমস্ত কিছুর ওপর নজর রাখত সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, ডাগর ড্যাবডেবে চোখের কালাচাঁদ-দা। যে ‘ভেজ’, মাছ-ডিম-মাংস আসার সময় তাকে হাত দিয়ে থালা আগলে প্রবল ভাবে নেড়ে বুঝিয়ে দিতে হতো সে ভেজ। অনেক সময় যন্ত্রবৎ পরিবেশনের দ্রুততায় খানিকটা গরম ঝোল হাতা থেকে চলকে পড়ে যেত থালা-আগলান-হাতের ওপর।
খাওয়া শুরুর ঠিক আগে ছিল গলায় গলা মিলিয়ে কলের পুতুলের মতো প্রার্থনা —
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতম্।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মর্কসমাধিনা।।
(অর্পণ করাটাই ব্রহ্ম, হবিঃ, অর্থাৎ যা অগ্নিতে অর্পিত, তা ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, আহুতির এই ক্রিয়া ব্রহ্ম
সেই গন্তব্যও ব্রহ্মই যা ব্রহ্মর্কর্মে অবিচল জন প্রাপ্ত হন।।)
রবীন্দ্রনাথের ‘মেলালিং মেলালিং মেলালিং’-এর মতোই সম্ভবত ক্লাস সিক্স থেকে গীতা-পাঠ শুরুর আগে বছরের পর বছর যে দ্বিতীয় শব্দটিকে ‘ব্রহ্মা-হাবিব’ বলে এসেছি তা আর অস্বীকার করি কী করে!
কিন্তু এ উচ্চারণের পর একটিও কথা বলা কঠোর নিষেধ ছিল খাওয়ার সময়। পিন-ড্রপ-সাইলেন্স। কাজেই ‘ভেজ’ ছেলেটির অমন আকুল হাত নাড়া। তার জন্য আলাদা তরকারি। এক্সট্রা দই।
মুশকিল হলো, রাকেশ তো ভেজ। সীতারামদাদেরও দিয়ে দিয়ে মোটামুটি মুখস্তই হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া কালাচাঁদদার প্রখর দৃষ্টি। উপায়? আমার বাটিতে মাংস পড়ল, চার পিস্। ভাতের মধ্যে ঢেলে নিলাম। মাংস পাতে পড়ার পর সকলেরই খাওয়ার একাগ্রতাটা কেমন বেড়ে যেত— সেই মোক্ষম ‘হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ…’। কর্তব্য-সাঙ্গ-করা কালাচাঁদদা একটু নিশ্চিন্ত, শিথিল। স্যাট করে মাংসের দুটো পিস্ থালা বদল করে ফেলল। রাকেশ কাঁপা হাতে বিদ্যুৎগতিতে তা চালান করে দিল ভাতের স্তরের নীচে। কখন যে খেল লক্ষ করিনি। কোনও কারণে সেই মঙ্গলবার ছিল ছুটি। স্কুল নেই। থালা-বাটি-গ্লাস ধোয়ার সময় লক্ষ করলাম রাকেশের মুখ থমথমে। রুমে ফিরেই মেঘ ফেটে পড়ল। Like summer tempest came his tears!! হাপুস নয়নে কান্না। বাকি দু’জনের তো শুনে আক্কেল গুড়ুম। ‘দিমাগ পাগলা গ্যায়াথা তেরা! নীলু, তোর কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই’। এবার কাজ তাকে ঠাণ্ডা করা, আর তার থেকেও বড়ো কাজ অপরাধটাকে ধামাচাপা দেওয়া। নইলে আমার চামড়া গুটিয়ে নেবে বলাই-দা, শ্রীনিবাস-দা। একতলা-দু’তলার দুই ওয়ার্ডেন মাস্টার মশাই। সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ল এই বিপদ এড়াতে। দরজা বন্ধ করা মানা। কাজেই একদিকে পালা করে পাহারা, কেউ আসছে কি না, আর একদিকে রাকেশকে ঠাণ্ডা করা। টিফিনে গেল না। রাতের ডিনারেও না। মাঝে মাঝে লাঞ্চ-ডিনার স্কিপ করলে কেউ খুব একটা পাত্তা দিত না। আর একটিবার সাধিলেই খাইব-র কোনও গপ্প ছিল না। আমরা বাকি তিনজন কোনও ক্রমে নাকে-মুখে গুঁজে ফিরে এসে রাকেশকে সঙ্গ দিচ্ছি। আর ঘুমে ঢুলে পড়ছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
প্রার্থনার লাইনে ধরা পড়ে গেল, রাকেশ নেই। কী ব্যাপার? বলাইদার শত জেরাতেও রাকেশ মুখ খোলে না। কেবল চোখ দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে। শেষে আমায় পুরো ঘটনা কবুল করতে হলো। পাথরের মতো মুখ নিয়ে বলাইদা শ্রীনিবাসদাকে ডাকলেন। জাত চলে গেছে, তা ফেরান যায় কী উপায়ে? কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমি অক্ষত থেকে গেলাম। উপায় বার করলেন শ্রীনিবাসদা। চল্ তোরা দুজন, মন্দিরে। সব ধর্মের সামনে পাপ কবুল করলে সে পাপ আর থাকে না। সব ধর্ম? শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-সারদাদেবীর ছবি তো মন্দিরে আছেই। আমাদের একমাত্র সহপাঠী রোমি, যদ্দূর মনে আছে ছিল খ্রিশ্চান, নাগা। তাক লাগানো ফুটবল খেলত। তার কাছ থেকে একটা ক্রুশ পাওয়া গেল। কিন্তু কোনও মুসলমান তো নেই। দুই মণিপুরি সহপাঠী ইয়ান্দ্রমবম্ সমরেন্দ্র সিং আর কেইশাম নীলকান্ত্ সিং দুর্দান্ত ছবি আঁকত। তাদেরই একজন লাইব্রেরি থেকে আনা একটা ম্যাগাজিনের ছবি দেখে দেখে একটা পিচবোর্ডের ওপর হুবহু এঁকে ফেলল আল্লাহু-আকবর — থুল্থ্ অক্ষরের (তখন থোড়াই তা জানতাম!) ক্যালিগ্র্যাফির অপরূপ অনুকরণ! সত্যিই মনে করতে পারছি না আর কিছু ছিল কিনা। স্মৃতি খুব গোলমেলে ছলনাময় — মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে গৌতম বুদ্ধ এবং গুরু নানকের ছবিও ছিল। পরম শ্রদ্ধায় সেই সব সামনে রেখে মন্দিরের পবিত্র গন্ধে আমরা শপথ নিলাম এ পাপ আর কখনও করব না! রাজেশের কান্না থামল।
ফয়েজ় পরিক্রমায় কেন এ গপ্পো? এই কারণেই যে, আজ আমি বুঝি ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর দুনিয়ায় উচ্চবর্ণ, হিন্দু, মফস্সুলে, মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তান আমার প্রবেশ যে অনায়াসে ঘটতে পেরেছিল তার একটা নিশ্চিত কারণ — এই সব ছোটো ছোটো ঘটনা আমার মধ্যে ‘অন্যের’ ‘The other’-এর সঙ্গে দূরত্বটাই তৈরি করতে দেয়নি। রাকেশ যে ভীষণ ‘অন্য’ তা মর্মে মর্মে নিশ্চয়ই বুঝেছিলাম সেদিন।
যেমন বুঝতাম, ধরা যাক, সমরেন্দ্র, নীলকান্ত্, প্রকাশ, ব্রজকিশোর ও আরও কয়েকজন মনিপুর থেকে আসা সহপাঠী একেবারেই অন্য রকম। তাদের চিঠি আসলে দেখতাম, অক্ষর বাংলা হলেও (তখনও তাই ছিল) ভাষা একদম আলাদা। ইবা — বাবা। আর ইমা — মা, এ ছাড়া আর কিচ্ছু বোধগম্য হতো না। চেহারায় সকলেই আমাদের গড় বাঙালি-বিহারির থেকে বড়োসড়ো ছিল। বেপরোয়া। থোড়াই কেয়ার। কিন্তু প্রত্যেকে এক একজন শিল্পী। শিল্পবোধটাই যেন তাদের অস্তিত্বের অঙ্গ। কী আশ্চর্য আঁকার হাত। ধুতি, চাদর এই সব দিয়ে সরস্বতী পুজোর ছোটো ছোটো প্যান্ডেল বা ঝুলন সাজানোর দিনে তাদের নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত।
আর তাদের কাছ থেকেই শিখে থালা বাজিয়ে গলা ছেড়ে গাওয়া হতো — সনা লইবাক মণিপুর। আমার সোনার দেশ মণিপুর। বাকি আর একটা লাইনেরও মানে না বুঝেই। আমার মনে পড়ে না, আমরা অন্য কোনও বাধ্য-হয়ে-শেখা দেশাত্মবোধক গান — ‘উঠ গো ভারত লক্ষী’, ‘হও ধরমেতে ধীর’, ‘দেখ্ তিরঙ্গা লেহেরায়া’ ইত্যাদি — এমন হইচই করে নিজের মনের আনন্দে কখনও গেয়েছি। আজ এত বছর পরে এই লেখা লিখতে বসে জানতে পারলাম, এই গান রচনা করেছিলেন মণিপুরী কবি ওজা বাচস্পতিমায়ুম জয়ন্তকুমার শর্মা (১৯৩৫-২০১৫)। এতে সুরারোপ করেছিলেন মণিপুরি চলচ্চিত্রকার ও সঙ্গীতকার অরিবম শ্যাম শর্মা, খুব সম্ভবত ১৯৬১ সালে। অনেক অনেক বছর পরে পরমাশ্চর্য এই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় করার সৌভাগ্য ঘটেছিল, তাঁর নির্দেশিত ‘Loktak: The Dying Lake of Manipur’ তথ্যচিত্র এবং ‘Sangai: The Dancing Deer of Manipur’, নামের রুদ্ধশ্বাস একটি নৃত্যনাট্য-নির্ভর ছবি অ্যামেরিকান সেন্টারে দেখানোর ব্যবস্থা করার সময়। সামান্য কয়েক মিনিট দেখা যেতে পারে এখানে —
Sangai: The Dancing Deer of Manipur— https://indianculture.gov.in/video/sangai-dancing-deer-manipur
কিন্তু কেমন ছিল সেই গান? সনা লইবাক মণিপুর? খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেলাম অপূর্ব এই ভিডিওটাও।
সনা লইবাক মনিপুর — https://www.youtube.com/watch?v=gAxbVHN9dhA
যদিও আমরা গানটা গাইতাম আরও দ্রুত লয়ে! সুরের থেকে সেখানে আনন্দ বেশি।
আমি বলতে চাইছি, make no mistake, এরা সব যে আমার থেকে ‘অন্য’ তা বিলক্ষণ বুঝতাম, কিন্তু সেই ‘অন্য’-র সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেঁচে থাকাটাই ভাগাভাগি করে নিতে নিতে কখনও তাকে ‘The other’ বলে দূরে ঠেলে দেওয়ার কোনও সুযোগই ঘটেনি, সন্দেহ কিংবা ঘৃণা তো কল্পনাতীত! ২০১৭ সালে আমার লেখা ভ্রমণকাহিনির বই ‘ইরানে’ উদ্বোধন করার সময় একটা সার কথা বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, একটা সমীকরণই বলা যায় — অপরিচয় আনে দূরত্ব, দূরত্ব আনে অবিশ্বাস, অবিশ্বাস আনে সন্দেহ, সন্দেহ আনে ঘৃণা। কী ভাবে আনে, ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও তস্য পরিবারের আরও নানা সংঘের উত্থানের ইতিহাস তার প্রমাণ। আমার কোনও মুসলমান সহপাঠী সে সময় ছিল না। একজনও না। কিন্তু বৈচিত্রকে মেনে নেওয়ার এই অভ্যাস রক্তের মধ্যে এমনই ঢুকে গিয়েছিল যে, ‘গুজরাটি’ বা ‘মণিপুরি’-কে যেমন ‘অন্য’ কাজেই ‘দূর’ মনে হয়নি কখনও, মুসলমান বা মুসলমান বলে মহাবদমাইশিতে দেগে দেওয়া কোনও কিছুকেই তা মনে হওয়ার সুযোগ হয়নি আমার কোনও দিন।
আমি যখন সেই ১৯৭০-এর দশকের শেষ ভাগে, কৈশোর থেকে শুরু করে ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি যৌবনের দোরগোড়া পর্যন্ত, ‘গুলোঁ মে রঙ্গ্ ভরে’-র মাধ্যমে উর্দুর খোঁজ শুরু করেছি, তখনও সে ভাষাকে ‘মুসলমানদের ভাষা’ বলে দেগে দেওয়ার সাংঘাতিক মিথ্যে বদমাইশিটা শুরু হয়েছিল কি না তা আমার জানা নেই। সত্যি বলতে কী, জানতেও চাই না। কিন্তু এ সত্য অনস্বীকার্য যে তার প্রথম যে সব দিকপালের সঙ্গে আমার পরিচয় হচ্ছিল তারা সকলেই মুসলমান। কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রতন নাথ দর সরশার (১৮৪৬ – ১৯০৩) রচিত তিন হাজার পাতার চার খণ্ডের ম্যাগনাম ওপাস ফসানা-ই-আজ়াদ (আজাদের কাহিনি) যে সাবেকি উর্দু কাহিনি-গদ্যকে প্রথম আধুনিক উর্দুর দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছিল ১৮৭৮ সালে, কিংবা সে বিপুল কেতাব যিনি হিন্দিতে তরজমা করেছিলেন ‘আজ়াদ কথা’ নামে, সেই যুগান্তকারী আধুনিক সাহিত্যিক ধনপত রাই শ্রীবাস্তব ওরফে প্রেমচন্দ (১৮৮০ – ১৯৩৬) যে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আসরার-এ-ম’বিদ’ (দেবস্থানের রহস্য) সহ পাঁচ-পাঁচটি উপন্যাস ও কম সে কম ষাটটি ছোটো গল্প রচনা করেছিলেন উর্দুতে , কিংবা আরও আধুনিক কালে কৃষেণ চন্দর (১৯১৪-১৯৭৭), রাজিন্দর সিং বেদীর (১৯১৫-১৯৮৪) মতো ডাকসাইটে সব ‘অ-মুসলমান’ সাহিত্যিকরা যে অজস্র মণিমুক্তো রেখে গিয়েছেন উর্দুতে — এ সব তথ্য জেনেছি, বস্তুত এ ভাবে ভাবতেই শিখেছিলাম, অনেক পরে। যখন এ ভাবে ভাবানো হলো, এবং এই হারামজাদামোটার সক্রিয় বিরোধিতার প্রয়োজন হলো।
তার বহু আগে আমার তাকে এসে পৌঁছল মহম্মদ সাদিক রচিত অনবদ্য কেতাব A History of Urdu Literature. Second Edition (Revised and Enlarged). OUP. 1984। (বন্ধনীতে বলে রাখি, এই ১৯৮৪ সালটা আমার এই পরিক্রমার কাহিনিতে এক মহাজরুরি তারিখ)। বহু বছর আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াত সারাক্ষণ। সে বইটা যে কে ঝেড়ে দিল তা ঠাওর করতে পারিনি। বছর দশেক পরে তার ১৯৯৫-এর সংস্করণ কিনে নিয়েছিলাম। যাই হোক, সে কেতাবের গোড়াতেই যে দুরন্ত চরিত্রটির সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনি, মহাপণ্ডিত অধ্যাপক সাদিকের মতে, এক্কেবারে রাকেশ জেটলি-র দেশের মানুষ। জন্ম খাস আহমেদাবাদে। ওয়ালি গুজরাটি বা ওয়ালি দক্কনি। কে তিনি?
ওয়ালি দক্কনি ব্যতিরেকে ভারতীয় গজ়লের কোনও চর্চা শুরু হতে পারে না। তিনি ভারতীয় উর্দু সরোবরে গজ়লের প্রথম আলোড়ন। আমির খুসরো বিরাট ব্যাপার — পলিম্যাথ। কিন্তু আমরা যদি অবলোকনের পরিসরটাকে একটু ছোটো করে গজ়লের ছন্দে সীমিত করে ফেলি তা হলে শুরু করতেই হবে ওয়ালি-কে দিয়ে। ফয়েজ়ের কবিতায় পৌঁছতে গেলে আমাদের যে সরোবর পার করতেই হবে মধ্যযুগীয় উর্দু কবিতার, তা আমি ভাবছি পার করব খানিকটা শৈশবের সেই দুরন্ত খেলায় যাকে আমরা বলতাম ব্যাঙ-বাজি। তিনটে মূল লাফ, যা একটার সঙ্গে একটা অদৃশ্য টানে বাঁধা। ওয়ালি (১৬৬৭-১৭০৭)-মীর (১৭২৩-১৮১০)- মির্জা (১৭৯৭-১৮৬৯)। এই ব্যাঙবাজিটা রিওয়াইন্ড করে দেখে নিই একঝলকে টানটা কী রকম। স্রেফ দুটো শের।
মির্জা গালিবের একমাত্র প্রামাণ্য ছবি। ১৮৬০-এর পরে তোলা
রেখতে-কে তুম-হি উস্তাদ নেহি গালিব
ক্যাহতে হ্যায়ঁ আগলে জ়মানে মে কোই মীর ভি থা।।
(উর্দুর এক তুমিই ওস্তাদ নও গালিব
লোকে বলে সেকালে ছিল মীর বলে কে-একজন)।।
এ লেখায় প্রণম্য আবু সয়ীদ আইয়ুবের তরজমায় ‘গালিবের গজ়ল থেকে’ বইটির কথা আগে বলেছি। তার অসামান্য ভূমিকায় আর পাঁচটা জিনিসের মধ্যে আছে গালিবের কাব্যদম্ভের কথা। সমসাময়িক অধিকাংশ কবিকে মানুষ পদবাচ্যই মনে করতেন না। তাঁর ঠোঁট থেকে এ হেন উচ্চারণই যথেষ্ট গালিব-পূর্ববর্তী উর্দু সাহিত্য-দুনিয়ায় মীর তাকি মীর কে ছিলেন তা মর্মে ডলে দেওয়ার জন্য। লক্ষ্য করুন এই আপাত-নিরীহ শে’রটার দুর্ধর্ষ মজা — প্রথম পঙ্ক্তিতেই নিজেই নিজেকে ঘোষণা করে দিচ্ছেন উর্দুর ওস্তাদ বলে, তবে কিনা, ‘কহতে হ্যায়ঁ’…। আমি বলছি না মশাই, লোকে বলে। ‘কোই মীর ভি থা’। ‘কোই’, তাচ্ছিল্যটা ভাবুন — ‘কে-একটা যেন’ গোছের!। কিন্তু কী করা যাবে, কবিতায়, কবিতা প্রসঙ্গে যে অনৃত ভাষণ চলে না। আর গালিব যে জানেন, নখদর্পণে উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস, তাই মর্মে মর্মে জানেন, মীরের আশ্চর্য সব কবিতার কথা। কবিতার কাছেই যে মির্জার এক এবং একমাত্র দায়বদ্ধতা। কাজেই আঁতে যতই লাগুক কবিতাতেই কোথাও তা যে স্বীকার করে যেতেই হবে! নিজে স্বীকার কি করা যেত না? কিন্তু করলেন না। লোকের ঘাড়ে চাপালেন। আর জানালেন, ‘আগলে জ়মানে মে’, ‘পূর্ব কালে’। অকল্পনীয় এক দু’ ধারে শান দেওয়া তলোয়ার! তাচ্ছিল্য প্রকাশ হল বটে, কিন্তু মেনে নেওয়া হল তার থেকে অনেক বেশি কিছু — ‘লোগ কহতে হ্যায়ঁ’, মানুষ মীরকে মনে রেখেছে, আমি মানি বা না মানি, কিচ্ছু যায় আসে না — of little consequence। তিনি রয়ে গিয়েছেন, তিনি কালোত্তীর্ণ। ওঃ! এই না হলে কবিতা! এই না হলে মির্জা!
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মির্জা মানুষটাই যেন এ দুই পঙ্ক্তিতে পোরা আছে। আশ্চর্য রঙিন এক মানুষ।
কিন্তু কোনও অংশে কম ঘমন্ডি ছিলেন না মীর সাহেব নিজেও। আবু সয়ীদ আইয়ুবই আরও একটা তরজমার বই লিখেছিলেন — মীরের গজ়ল থেকে। সেটাও আমার হাতের কাছে নেই। তাই স্মৃতি থেকেই লিখতে হচ্ছে — কোনও এক নবাব-জাদার ছত্রছায়ায় ছিলেন উস্তাদ তখন। তা নবাব-জাদা বলে কথা, নরেন্দ্রভাই দামোদর মোদীর মতোই তাঁরও বড়ো শখ, কবিতা লেখেন। কে আটকায়? লিখলেন-লিখলেন, আবার সাধ করে গেলেন মীরের কাছে তা দেখাতে, দু’ ছত্র প্রশংসা মিললেই কেল্লা ফতে! মীর বলেছিলেন, লজ্জা করে না, এগুলো আমাকে দেখাতে! মেয়েরা যেখানে হাঁড়ি-কুড়ি নিয়ে খেলাধুলো করে সেখানে গিয়ে এ সব শোনাও। না উস্তাদের গর্দান যায়নি। নিন্দনীয় পুরুষ-অবলোকন সন্দেহ নেই, কিন্তু এই তো জাত কবির স্পর্ধা! এ কাহিনি শুনে আবার নরেন্দ্রভাইয়ের কবিতা নিয়ে স্বাভাবিক দু’ কথা লিখে ফেলতে যাবেন না, তা হলে, মগনলাল মেঘরাজের ভাষায় — আপনার সেফটির গেরান্টি হামি দিতে পারব না, সাফ বলে দিলাম!
উইকিপিডিয়ার দাবি এটি ১৭৮৬ সালে আঁকা মীর তাকি মীরের
প্রতিকৃতি। সূত্র অনুল্লিখিত
এহেন মীর লিখলেন —
খুগর নেহি কুছ ইয়ুঁ-হি হাম রেখতা-গোয়ি-কে
মাশুক যো আপনা থা বাশিন্দা-এ-দক্কন থা।।
(অকারণেই রেখতা-কথনে মন মজেনি আমার
আমার ভালোবাসার সে মানুষ যে ছিল বাসিন্দা দখিন-দেশের।।
সত্যি কি সে দখিন দেশের? এ তর্কের শেষ নেই। শত শত বছর ধরে চলেছে দু’ পক্ষে দড়ি টানাটানি — আহমেদাবাদ না অওরঙ্গাবাদ (বর্তমান মহারাষ্ট্রে)। ওয়ালি গুজরাটি না ওয়ালি দক্কনি। তবে অনেক ছানবিন করে মহম্মদ সাদিক সাহেব বলছেন, আসলে ওয়ালির জন্ম আহমেদাবাদেই। সম্ভবত ১৬৬৭ সালে। শাহ্ ওয়াজি-উদ-দিনের মজ়ার সংলগ্ন মাদ্রাসায় তাঁর পড়াশুনা। তারপর অওরঙ্গাবাদ যাত্রা, এবং সেখানেই পাকাপাকি বাসা। কিন্তু মৃত্যুর আগে ফিরে আসেন আহমেদাবাদেই। মৃত্যু ১৭০৭। যুগ যুগ ধরে গুজরাটিরা তাঁকে নিজেদের সাহিত্য পরম্পরার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে জেনে এসেছেন। শত শত বছর ধরে গুজরাটিরাই গোলাপে গোলাপ করে রেখেছেন তাঁর মজ়ার, স্মৃতি সৌধ। তারপর…
তারপর ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০২। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ‘কবি’ (!!) নরেন্দ্র দামোদরভাই মোদী। যে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিল হিন্দুত্ববাদীরা তা অসংখ্য লেখা ও ছবিতে ধরা আছে। এখানে তার ভয়াবহ রক্তস্নাত উল্লাসের পুনর্বিবরণ দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি বা আমার নিজের সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে ঘিনঘিনে ভাবটা নতুন করে জাগিয়ে তুলতে চাই না। শুধু The Times of India সংবাদপত্রে একটি খবরের কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করি বাংলা তরজমায়— ‘‘ওয়ালি আহমেদাবাদে প্রয়াত হন ১৭০৭ সালে। শহরের শাহিবাগ অঞ্চলে তাঁর কবরের ওপর একটি সৌধ তৈরি করা হয়, যে সৌধ ৩০৫ বছর অটুট ছিল, ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দাঙ্গাবাজরা তা ধ্বংস না করে দেওয়া পর্যন্ত, যারা চলে যাওয়ার আগে রেখে গিয়েছিল একটা মূর্তি আর একটা বোর্ড, যাতে লেখা ছিল ‘হুল্লাদিও হনুমান’ (দাঙ্গাকারী হনুমান)।’’
গুজরাটের আহমেদাবাদে হুল্লাদিও হনুমান জায়গা নিল সেই কবির, যাঁর ‘দর ফিরাক-এ-গুজরাট’ (গুজারাটের বিরহে) নামে বহুল পরিচিত একটি গজ়লের দুটি শের এ রকম —
গুজরাট-কে ফিরক-সে হ্যায় খার খার দিল
বেতাব হ্যায় সিনে-মে আতিশ-এ-বাহার দিল।।
মহরম নেহি হ্যায় ইসকে জ়খ্ম-কা জাহাঁ-মে
শমসির-এ-হিজ্র-সে যো হুয়া হ্যায় ফিগার দিল।।
(গুজরাটের বিরহে শুধু কাঁটায় আর কাঁটায় ভরা সারাটা হৃদয়
বুকের মাঝে উত্তাল বসন্তের আগুন লাগা সারাটা হৃদয়
এ ক্ষতের মলম তো নেই কোনওখানে সারা দুনিয়ায়
বিরহের তলোয়ারে ক্ষতবিক্ষত যার সারাটা হৃদয়)
আজকের ভাবনায় ভাবি: সাবাশ — জাতীয়তাবাদের এও দুই বিকল্প বইকি আমাদের সামনে — ‘দর ফিরাক-এ-গুজরাট’ বনাম ‘হুল্লাদিও হনুমান’। বেছে নিতে হবে। আর কোনও পথ খোলা নেই, বেছে নিতেই হবে।
কিন্তু সে অবধারিত ঘোষিত রাজনৈতিক দায়িত্বের বাইরেও যদি দেখতে চাই এই ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের রক্তরস কী ভাবে গড়িয়ে চলেছে, ছোপ লাগাচ্ছে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর কবিতায়, চকিতে মনে পড়বে এমন শের —
দিল-ও-জাঁ ফিদা-এ-রাহে কভি আকে দেখ হমদম
সর-এ-কু-এ-দিল-ফিগারাঁ শব-এ-আরজ়ু-কা আলম।।
(এই প্রাণ, এ হৃদয় বিলিয়ে দিয়েছি পথে পথে, কখনও তো একবার দেখে যাও এসে চিরসাথি
ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের বসবাস যেই অলি-গলি, কী দশায়, কিসের আকাঙ্খায় সেইখানে কেটে যায় রাতি।।)
রবীন্দ্রনাথের পূজা ও প্রেমের গান কখনও একে অপরে বিলীন হয়েছে। আসলে এ তাঁর রক্তে দীর্ঘ ভক্তি-সুফি-বাউল পরম্পরা। শ্রেষ্ঠ উর্দু কবিতা তা থেকে অনেক দূরে নয়, তা আমরা যাকে বলে যথা সময়ে দেখব নিশ্চয়ই। আপাতত লক্ষ করি শ্রেষ্ঠ উর্দু কবিতায় স্বদেশপ্রেম ও ব্যক্তিগত ভালোবাসার এই মেলামেশা, যা ফয়েজ়ের কবিতার একেবারে ছত্রে ছত্রে, তাও তাহলে তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃষ্ট নয়, সে রক্তের পরম্পরাও বহু শতকের। তবে ছোটো ছোটো ইঙ্গিত থেকে যায়, ইঙ্গিতই কথা বলে উত্তীর্ণ কবিতায়। ওয়ালির যে সুস্পষ্ট ‘গুজরাট’ উচ্চারণ তেমন ‘পাকিস্তান’ আমি অন্তত ফয়েজ়ে কোত্থাও পাইনি। কিন্তু তাঁর বিপুল সংখ্যক কবিতা স্বদেশের ভালোবাসায় টইটম্বুর, যা নিখাদ ব্যক্তিগত প্রেমের কবিতা বলেও পড়া সম্ভব। কেন তা আসলে স্বদেশপ্রেমেরই তার খোঁজও করব, যথা সময়ে। যখন এই গুজ়লটার পূর্ণাঙ্গ তরজমাও দেব। কিন্তু আপাতত আর একবার ফিরতেই হবে টাইম্স অফ ইন্ডিয়ার ওই খবরের টুকরোটাতে।
সে সংবাদ আমাদের এও জানাচ্ছে যে পুলিশি তদন্তে, তদুপরি সুপ্রিম কোর্টের (অবসরপ্রাপ্ত) বিচারপতি নানাবতি কমিশনের ছানবিনে ওয়ালি-র মজ়ার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা লিখিত ভাবে স্বীকার করে নেওয়া সত্বেও জানা যায়নি এই ‘অপকর্মকারী’ কারা!! আরও আছে, Mint পত্রিকায় আকবর প্যাটেল একটি নিবন্ধে জানাচ্ছেন গুজরাটের পুলিশ কমিশনারের অফিসের ঠিক উল্টোদিকে এই কবর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরেই দ্রুত সেখানে তৈরি হয় পিচের রাস্তা। এখন ঠিক সেইখানটিতে ঝাঁ চকচকে ওয়ান ওয়ে দুটি রাস্তার মাঝখানের বিভাজক — ডিভাইডার!! প্যাটেল সাহেব খোদ মুখ্যমন্ত্রী কবি নরেন্দ্র মোদীর কানে বিষয়টি তোলেন। কিন্তু মোদী নাচার — খুঁজে পেতে তিনি যথেষ্ট প্রমাণ পাননি যে ঠিক ওইখানটিতেই ওয়ালি-র মজ়ার-টজার কিছু ছিল! আর প্রমাণ ছাড়া তিনি কী-ই বা করতে পারেন। শ্রীরামচন্দ্র ঠিক কোনখানটিতে জন্মেছিলেন তেমন নিশ্চিত প্রমাণ দরকার বইকি! উত্তেজিত দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে সরকারকে জড়িয়ে ফেলা কি ঠিক হবে? সুদক্ষ রাষ্ট্রীয় তৎপরতায় ওয়ালির কবিতার রক্তের দাগ চিরকালের মতো ঢেকে দেওয়াকে?
এমন মর্মন্তুদ ছবি আমি কমই দেখেছি। এইখানে তিনশো বছর ধরে ছিল ওয়ালি
গুজরাটির মজ়ার। চিহ্নমাত্র নেই। তবু কে জানে কারা যেন আজও ফুল দিয়ে যায়।
ছবি সৌজন্য দ্য টাম্স অফ ইন্ডিয়া।
মুশকিল হলো কবিতায় এবং একমাত্র কবিতাতেই ভবিষ্যৎ প্রতিফলিত হতে থাকে —
কবির নিজের কণ্ঠে — https://www.youtube.com/watch?v=t81zYNDRMaU
নেই, কোনওখানে নেই আর রক্তের দাগ এক চুলও
ঘাতকের হাতে-নখে, আস্তিনেও তো কোনও চিহ্ন নেই
ছোরার ফলার লালে, তলোয়ারেও তো কোনও রঙ নেই
ধুলোতে তো নেই ছোপছোপ, দেয়ালে বা ছাদে কোনও দাগ নেই
নেই, কোনওখানে নেই আর রক্তের দাগ এক চুলও
কে দেবে ক্ষতিপূরণ, শাসকের প্রয়োজন বুঝে ঝরেনি তো,
কে দেবে আগাম প্রতিদান, নৈবেদ্যে কাজে লাগেনি তো,
ঝরেনি তো যুদ্ধের কোনও ময়দানে, বিশ্বস্ত কতো তা যে প্রমাণিত হবে
অক্ষর হয়ে রাঙায়নি কোনও পতাকাও, দিকে দিকে নাম রটে যাবে
অসহায় অনাথ রক্ত শুধু ডেকে ডেকে যায়
শুনবে যে, না আছে ইচ্ছেটুকু কারও, না আছে সময়
বাদি-ফরিয়াদি নেই, সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই, হিসেব পরিষ্কার
পথের ধুলোয় বাস যার, এ রক্ত তার, চেটে নিল ধুলো
(রক্তের দাগ। মূল কবিতা ‘লহু কা সুরাগ’। ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়। জানুয়ারি, ১৯৬৫। সর-এ-ওয়াদি-এ-সিনা। নুসখাহা-এ-বফা, এজুকেশনাল পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৮৬। পৃ ৪০১।)
সব শেষে দেখুন ‘লহু কা সুরাঘ’ কবিতায় অনুপ্রাণিত বিখ্যাত শিল্পী নলিনী মালিনীর ভিডিও ইনস্টলেশন ‘In Search of Vanished Blood’-এর (২০১২) একটি সংক্ষেপিত ভিডিও। মূল ‘সিক্স-চ্যানেল ইনস্টলেশন’-টি নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ প্রদর্শিত হয় ২০১৭ সালে। https://www.youtube.com/watch?v=6uK9iRoPds8
The Urdu Premchand and the Hindi Premchand. Harish Trivedi. Abralic. V. 19. N. 30 (2017). https://revista.abralic.org.br/index.php/revista/article/view/379/628
সূত্র — https://m.timesofindia.com/city/ahmedabad/no-one-razed-wali-gujaratis-mazaar/amp_articleshow/72703885.cms?fbclid=IwAR2hTqbKchM7tMzgL8sFMMz1G3LMBS1F0ZP4EDCcXgWNV6nLH_9MTCdnLNM
সূত্র — https://www.livemint.com/Opinion/83aeFFG0sv4NkWsd4zJdoN/Wali-vs-Modi-the-tale-of-two-poets.html
(ক্রমশ)
লেখাটা পড়লাম। বেশ ভালো। লেখার মধ্যে ব্যবহৃত একটি ছবি মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়। ডিভাইডারের মাঝখানে কারা যেন এখনো ফুল রেখে যায়
A cute, affordable product.