
পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত: বিবর্তনে ও কবিতার সান্নিধ্যে
গৌতম বসু
সুরজিৎ ঘোষ ও অভিরূপ সরকার সম্পাদিত, শ্রাবণ ১৩৮৩-তে প্রকাশিত, শতভিষা-র রজত জয়ন্তী বর্ষ সংখ্যায় এই প্রবন্ধ আছে। অগ্রন্থিত।
শ্রুতির মূলেই উপকরণ ; নৈসর্গিক কিম্বা মনন-সঞ্জাত শব্দে যেখানে সুর (মেলডি ), সঙ্গতি (হারমনি) প্রভৃতির সূত্র উপস্থিত, উপকরণ ও গ্রাহকে সেখানে সৃষ্টির সম্পর্ক। প্রাকৃতিক নিয়মে শব্দ সঙ্গীতের যুগ একক এবং উপকরণ, ফলে, শব্দই একাধারে প্রেরণা ও প্রকাশমাধ্যম হলে স্বভাবতই, সঙ্গীত প্রথম পর্যায়ের উৎপন্ন শিল্প (first order derivative art) হয়ে দাঁড়ায়। বলা বাহুল্য, শুধু সঙ্গীত নয়, ভিন্ন-ভিন্ন ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে ভিন্ন-ভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্প-সৃষ্টি এই প্রাথমিক পর্যারের অন্তর্গত। কিন্তু সরলীকরণের সম্ভাবনা সীমিত, যেমন, ইতিহাস সাক্ষী, কখনো কখনো শিল্পই শিল্পের প্রেরণা। এই ধরনের সৃষ্টিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎপন্ন শিল্প (second order derivative art ) বলা যেতে পারে। পর্যায়ের ভিন্নতার সঙ্গে অবশ্য আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্বের কোনো তাৎক্ষণিক সম্বন্ধ নেই; এডনা সেণ্ট, ভিন্মেন্ট মিলের ‘On Hearing A Symphony of Beethoven’-এর থেকে যে কীটস্-এর ‘Ode To A Nightingale’ শ্রেষ্ঠতর তার স্বতন্ত্র কারণ আছে। বস্তুত, মূল প্রভাবের শ্রেষ্ঠত্ব অতিক্রম ক’রে দ্বিতীয় পর্যায়ের শিল্প অনেক দৃষ্টান্ত রেখে গেছে। Canteus plamus, plainsong-এর যুগ থেকে প্যালেরিনা এবং তারপর বাখ, বেথোভেন, হয়ে টিপেট পর্যন্ত পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছে; কিন্তু শুধু সাঙ্গীতিক নয়, এক বৃহত্তর শৈল্পিক কাঠামোয় এর বিবর্তন বিচার্য। বিচ্ছুরণ মহৎ শিল্পের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য—তার অর্থ ও আভাসের প্রান্ত নির্ণয় করা শক্ত- পাবলো কাসালস্ যেমন বাখ-এর The Well-tempered Clavier (Das Wohltemperierts Clavier) সম্বন্ধে বলেছিলেন : ‘There is always something left to discover in it’। সম্ভবত এই সত্তাই এক নিটোল গ্রন্থি হয়ে বিভিন্ন শিল্পশাখার মধ্যে রক্তের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সময়ের বিশেষ চরিত্রপ্রভাবে যখন এই সংযোগ ক্ষীণ হয়েছে, তখন শিল্প হয় অন্তর্মুখী উত্তরণের সম্ভাবনায় উজ্জ্বল, নয় তো ক্ষয়ের সম্মুখীন।
Art integral-এর প্রেক্ষিতে পাশ্চাত্য সভ্যতার কয়েকটি প্রধান উৎস লক্ষণীয় : হেলেন্ই্জম, রেনেঁসাস্, খৃষ্টধর্ম এবং লোকশিল্প। প্রভেঁসীয়, বারোক ইত্যাদি অন্যান্য প্রভাব অবশ্যই স্বীকার্য কিন্তু বরাবরই তাদের স্থানগত সংকীর্ণতা ছিল—বারোক-এর প্রধান প্রভাব যেমন কেবল চিত্রকলা, স্থাপত্য এবং সঙ্গীতে, প্রভেঁস-এর প্রধান প্রভাবও তেমন কাব্যসাহিত্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত। যুক্তি- বাদ এই অর্থে সীমিত নয় কিন্তু School of Puritan Ethics-এর ফল- স্বরূপ অতএব স্কুল হিসেবে রেনেসাঁস্ এবং খৃষ্টধর্মের প্রভাবপুষ্ট। বর্তমান প্রবন্ধের মূল বিষয় সঙ্গীত,এবং অন্তত এই ক্ষেত্রে হেলেনইজ ম-এর প্রত্যক্ষ প্রভাব সীমিত । গ্রীস-এর সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যের যে নমুনা পাওয়া যায় তাতে সভ্যতার আভাস নিশ্চয় আছে কিন্তু পরবর্তীকালের সঙ্গীতচিন্তাকে অনুপ্রাণিত করার যথেষ্ট উপকরণ নেই। এ-সত্ত্বেও হেলেনইজম-এর প্রভাব আছে, এবং সেটি অন্তরের। ভাবীকালের জন্য গঠনতত্ত্ব, সমালোচনার মাপকাঠি কিম্বা অসামান্য কোনো সঙ্গীতস্রষ্টার প্রমাণ না রেখে গেলেও গ্রীসিয় সভ্যতা তার বিরাটত্ব, সংযত আবেগ এবং চেতনায় একটি ক্লাসিক বোধ রেখে গেছে।
দ্বিতীয়ত, রেনেসাঁস। ‘নবজাগরণ’ সঙ্গীতের পক্ষে কি যথার্থই নবজাগরণ ছিল ? এই সময়ে পলিফনি কোরাল পলিফনিতে পরিণত হয়, সেক্যুলার মিউজিক, অর্থাৎ ধর্মবহির্ভূত সঙ্গীতেরও এই প্রথম সম্মানের আসন মেলে, কিন্তু চিত্রকলা কিম্বা সাহিত্যের, মহান সঙ্গীতের ভিত্তিতে কোনো ব্যাপক ও দ্রুত রদবদলের সঠিক পরিচয় নেই। বস্তুত, সাঙ্গীতিক রেনে্সাঁস-কে অপেক্ষাকৃত ধীরগতিসম্পন্ন প্রক্রিয়া হিসেবেই চিহ্নিত করা উচিত। সাঙ্গীতিক তত্ত্বের পরিশীলনে এবং পালেস্ট্রিনা, লাসো ইত্যাদি সঙ্গীতস্রষ্টার হাতে আঙ্গিকের ক্রমোন্নতিতে রেনেসাঁস্ সঙ্গীতকে ক্লাসিক যুগের তোরণে পৌঁছে দিয়েছে। এই বিচারে বারোক যুগের বিশিষ্টতা থাকলেও কোনো স্বাতন্ত্র নেই; এটি আশ্চর্যজনক হ’লেও নিতান্ত যুক্তিহীন নয়। রেনে্সাঁস-এ সংযমের আধিপত্যের অব্যবহিত পরে উচ্ছ্বাস ও অতি-অলঙ্করণের যুগ প্রায় অবশ্যম্ভাবী,-নাহ’লে ক্লাসিক যুগে সাময়স্যের অভাব থেকে যেত । বৃহত্তর সংজ্ঞায় রেনে্সাঁস-কে বিচার করলে কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়: প্রথমত, সেক্রেড ও সেক্যুলার, সঙ্গীতের সমান্তরাল অস্তিত্বের প্রথম স্থায়ী চিহ্ন; দ্বিতীয়ত, ৰাখ, ও হ্যানডেল- এর মধ্যে পলিফনি-যুগের উচ্চতম স্তর এবং সেইখানেই যুগের সমাপ্তি এবং তৃতীয়ত, বারোক যুগ সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের হয়েও রেনেসাঁস- এর সঙ্গে যুক্ত। রেনেসাঁস-এর মূল কাঠা্মোয় থেকেও কেবলমাত্র একজনই সদর্থে অভিনৰ হ’তে পেরেছিলেন, তিনি আধুনিক কন্সর্টো-র প্রধানত স্রষ্টা ম্যানটোনিও ভিভালডে। কারমনি প্রধান যুগে মেলডি প্রধান লোক- সঙ্গীত ব্যবহার করেই ভিভালডে নতুন আঙ্গিক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
প্রাক-ক্লাসিকাল যুগ থেকে লোকসঙ্গীতের নতুন প্রয়োগে অনুমান মেলোডি অংশের ঐশ্বর্যই বাড়েনি, আঞ্চলিক স্বাদের ভিন্নতার দরুন বিভিন্ন দেশের সঙ্গীত মিলে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। স্বল্পপরিসরে প্রধান প্রধান লোরসংস্কৃতির মূল্যায়ন করা প্রায় অসম্ভব, শুধু এইটুকুই লক্ষণীয় যে ভিভালডের মধ্যে যেটি কেবল নতুনত্বের স্বাদ ছিল, আধুনিক কালে ডিলিয়ন, কিম্বা অন্ উইলিয়ামস্-এর মধ্যে সেটি পরিণত মাধ্যমের আকার ধারণ করেছে।
যুরোপীয় কল্পনার সময়োচিত স্রফূরণের জন্য খৃষ্টবৃত্তান্তের মতন আধারের ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল। আজ স্বীকার করতে বাধা নেই, মধ্যপ্রাচ্যের রুক্ষ পরিবেশ থেকে একটি religion নির্মাণ অন্ততপক্ষে শিল্পগত দিক থেকে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে । শুধুমাত্র বাইবেল-এর কিং জেমস্, ভাসর্ন-ই- এর যথেষ্ট প্রমাণ– ছত্রে ছত্রে রূপক, প্রতীক এবং সর্বোপরি কবিতায় সমৃদ্ধ হয়ে বইটি নানা শিল্পশাখার সজীব প্রেরণা হয়ে আছে। প্রকাশ্যে, বাইবেল প্রচার এবং প্রশস্তি, মানসিকতয়, শিল্প ও দর্শন। উদাহরণস্বরূপ, চতুর্বিংশ সাম-এর দুটি ছত্র উদ্ধৃত করা যেতে পারে
6. This is the geneation that seek him, that seek thy face. O Jacob. Selah.
7. Hold up’ your heads, O ye gates; and be:ye lift
up ye everlasting doors, and the King of glory shall
come in.
এই শিল্পবোধ সংক্রামক। সামান্য ব্যবহারিক কারণে রচিত ক্যান্টাটা, প্রেলিউড, প্রভৃতির অলঙ্করণ সর্বতোভাবে এই বিশিষ্ট শিল্পবোধ প্রসূত। কিন্তু অলংকরণ বাহ্যিক। ফিউগ্, মাস ও ওরাটোরিওর মতন গভীরতর সৃষ্টি কখনোই নিছক অলংকরণে সীমাবদ্ধ নয়। হ্যানডেল-এর ‘The Messiah কিম্বা বাখ, এর “The Passion according to Se Matthew’ অন্তরের কোনো ঈশ্বরসন্ধান- সঙ্গীত ও religion অবলম্বন মাত্র। প্রতিষ্ঠানিকতার অন্তরায়ের জন্য ক্লাসিকাল যুগ অর্থাৎ হাইডন-এর সময় থেকেই গির্জাপ্রাঙ্গন কিছুটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। স্তরীভূত অভিজ্ঞতা পেরিয়ে ব্যক্তিচেতনা ক্রমশই নিজের এবং ঈশ্বরের সান্নিধ্যে ফিরে আসে, যেমন বেথোভেন। Eroica অর্থাৎ তৃতীয় সিমফনি-তে যিনি অস্থির, পঞ্চম সিম্ফনি-তে যিনি নিয়তির তাড়নায় জর্জরিত, নবম সিম্ফনি ও শেষ কয়েকটি কোয়ার্টেট-এ ( A Minor. B flat Major, C sharp Minor, F Major) তিনিই আবার প্রজ্ঞায় স্থিত। দীর্ঘ সাত বছর প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকার পর বেথোভেন যখন Hammerclavier Sonata লেখেন তখন তিনি সমাজ, religion এমন কি সমস্ত বাহ্যিক শব্দ থেকে বিচ্ছিন্ন। এ একরকম ভালো; শিল্পী যখন সব স্ববিরোধের ঊর্ধ্বে তখন পৃথিবীও নতুন কিছু শেখাতে অক্ষম। তখনকার অভিব্যক্তির দুর্গম পথে বাখ- এর religion. আশ্রয়ী আড়ম্বর অবান্তর। নিঃসঙ্গ বেথোভেন হয়তো সেই জন্যই কোয়ার্টেট এর ক্ষুদ্র পরিসরে তার উপলব্ধ সঙ্গতির সূত্র রেখে গেলেন। বাইবেল-প্রেরিত ধর্মবোধ শেষে উৎস অতিক্রম করলো।
প্রধানত সেক্যুলর সঙ্গীতের কল্যাণে ক্লাসিক যুগ বহু স্রোতের পটভূমিতে আসায় তার আঙ্গিক ও পরিধিতে সম্প্রসারণের পরিচয় মেলে। সিমফনি, সোনাটা প্রভৃতি আধুনিকতর আঙ্গিকের গঠনে, প্রভাব এবং নাট্য ও কাব্যসাহিত্যের অনুষঙ্গ ইত্যাদির ফলে সাঙ্গীতিক অনুভূতিসম্পন্ন একটি সঙ্গীতোত্তর বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। অথচ বাথ-এর ঈশ্বরপ্রাপ্তিতে নয়, নিতান্ত সাধারণ মানুষ ও জীবন সংক্রান্ত অস্ফূট ভালো লাগার বোধগুলি জাগিয়ে তোলায় এর সিদ্ধি। এই যুগে কবিতার থেকে নাটকের প্রভাব তীক্ষ্ণতর হলেও, উফ সঙ্গীতোত্তর পর্যায় স্পষ্টতই কাব্যিক—এবং লিরিক কবিতার অর্থে। বেথোভেন-এর পাসটোৱাল সিম্ফনি বা মুনলাইট, সোনাটার মতো দৃষ্টান্তে তো আধুনিক কালের Tone- Poem -এর পদক্ষেপও চিনে নিতে কষ্ট হয় না। এ-জাতীয় রচনায় অবশ্য ক্লাসিকতার সঙ্গে সহাবস্থান ঘটেছে, কিন্তু মোজার্ট-এর E flat Major-এ Horn Concerto-র মতন সম্পূর্ণ ক্লাসিক রচনা ধরা গেলেও কাব্যিক চেহারার স্পষ্টতা থেকে যায় । অথচ হাইডন, মোট্জার্ট ও বেথোভেন-এর মধ্যে কেউই খুব একটা সঙ্গীতাচর্যার বাইরে এসে যুগের হাওয়ার পরিমাপ করেননি। অপেরা লেখার সুবাদে সমকালীন নাটক সম্বন্ধে ধারণা থাকলেও, লিরিক কবিতার বিশারদ এঁরা নন। তবু কবিতা কাজ করেছে; সৃজনশক্তি কয়েকটি কবিতার সুরারোপ করেই ক্ষান্ত হয়নি, সঙ্গীতরচনার সর্বাঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছে। বেথোভেন সাধারণত শেষ ক্লাসিকাল এবং প্রথম রোম্যান্টিক হিসাবে সমাদৃত, (যথার্থই তিনি জীবনের দুই প্রান্ত দিয়ে দুই যুগ দাঁড় করিয়ে রেখেছেন) কিন্তু বিশ্লেষিত নন। লিরিকবোধের প্রেরণায় তিনি ক্লাসিকাল যুগের উচ্চতম চূড়ার নির্মাতা, কিন্তু যখন এই কাঠামোয় লিরিকবোধের আর ঠাই রইল না তখন তিনি রোম্যান্টিকতার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
ক্লাসিকতার সামঞ্জস্যবোধকে প্রত্যাখানের মধ্যবর্তিতায় জার্মানির লিরিক কবিতা আবেগে প্রাণ সঞ্চার করতেই সঙ্গীতে ও বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে তার প্রথাবিরুদ্ধতা প্রতিভাত হয়। রোম্যান্টিক মানসিকতার উন্মুক্ত পরিবেশে ওয়েবার, শুবার্ট, বারলিওজ, শুমান এবং বিমূর্ততর স্তরে মেনডেলসেন, শঁপ্যা, ব্রামস ও লিস্ট প্রভৃতির সমবেত চেষ্টায় উনবিংশ শতাব্দীর সঙ্গীতপ্রবাহ প্রায় আন্দোলনের সামিল। ১৮২• থেকে এই আন্দোলনের বরাবরই বৃহত্তর সাহিত্যক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া আশ্চর্যের নয় কারণ সঙ্গীতস্রষ্টার মেজাজের উপযোগী উপকরণের ্সম্ভার ছিল বিস্তৃত। গ্যেটের- ‘Faust’ থেকে বারলিজ- এর ‘The Damnation of Faust’ ও বাইরন-এর ‘Childe Harold’s Pilgrimage’ থেকে ‘Childe Harold In Italy’, বিভিন্ন কবির (বিশেষত হাইনের) কবিতা থেকে শুমান-এর ‘Romances and Ballads, শেক্সপিয়র-এর ‘A Midsummer Night’s Dream’ প্রভাবিত মেনডেলসন- এর একই নামে বিমূর্ত রচনা— ফর্দের যেন শেষ নেই। অথচ এই সম্পর্ককে নিছক প্রাথমিক বিষয় ব্যবহারে সীমাবদ্ধ মনে করলে ভুল হবে। সেই অর্থে শঁপ্যা-র কোনো বহিরাগত উপকরণ নেই, অথচ শোপ্যা-ই রোম্যান্টিকতায় সর্বাপেক্ষা হয়। তর্কের খাতিরে ( এবং আধুনিক মতের বিরুদ্ধে ) যদি মেনেও নেওয়া হয় যে শোগা-র ব্যাপার গুলি আসলে তাঁর বন্ধু অ্যাডম্ মিকিউ-এর কবিতা ভালো লাগার ফল, তাহলেও প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের মেজাজের পার্থক্য দেখে প্রেরণার যথার্থতা সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠে। আসলে সম্পর্ক মূলত ভাবের। সেইজন্যই লীস্ট-এর Symphonic poem বা মেনডেলসেন-এর Song Without Words সম্পূর্ণ সঙ্গীত হয়েই সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে ওঠে। শুধু মাধ্যমের পার্থক্যে যেমন কবিতা-অকবিতার বিচার চলে না, প্রতিটি প্রাসঙ্গিক মাধ্যম উত্তীর্ণ হলেই একটি গান, ছবি কিম্বা মূর্তি কবিতা হয় ।
সমকালীন কবিতায় সুরারোপের প্রবণতা রোম্যান্টিক যুগের থেকে অক্ষত আকারে একশো বছরের বেশি টেকেনি কিন্তু সঙ্গীতের ইতিহাসে দাগ কেটে গেছে। প্রধান চারজন সুরকার শ্যুবার্ট, শুমান, ব্রা্মস, ও উল্ফ-এর মধ্যে শ্যুবার্টই শ্রেষ্ঠতম, তার The Winter Journey (Die Winterreise) কিম্বা গ্যেটের কবিতা অবলম্বনে The Erl King (Der Erlkonig) শুনলেই সুরারোপের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন শোনা হয়ে যাবে। কিন্তু সুরারোপ শুধু সাফল্যই দেয়নি, কবিতা ও সঙ্গীতের সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলেছে। কবিতাকে সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ করতে গেলে একে অপরের পরিপূরক না হয়ে বিরোধী হয়ে যেতে পারে। একটি কবিতাকে যদি সম্পূর্ণ শিল্পবস্তু হিসেবে গণ্য করা যায় তাহলে সঠিক অনুবাদেও (তা সে সঙ্গীতে কী অন্য ভাষাতেই হোক) কিছুট শিল্পক্ষয় প্রায় অবধারিত, কিন্তু মূলের সঙ্গে কোনো বিরোধ কবির পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যক্তিগতভাবে গ্যোয়েঠে শুবার্ট-এর বেশ কিছু সুরারোপের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন, ব্রাম্স্ তো গোয়েঠে-শিলার-হাইনের থেকে অপ্রধান কবি ডাইমেরর কবিতাই বেশী সুর দিয়েছেন। অপরপক্ষে, ভিন্ন সাহিত্যিক আন্দোলনের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও মেজাজের বিশিষ্ট মিলের জনাই দেবুদি ভাবলেন, মালার্মে ইত্যাদির কবিতার উৎকৃষ্ট সুরারোপ করেছেন।
বস্তুত, রোম্যান্টিক কাঠামোর প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকে তৎকালীন বিংশ শতাব্দীর কাব্যসাহিত্যে গীতিরণ-প্রদানের মধ্যে একটি বিরোধ ছিল। শুবার্ট প্রবর্তিত কণ্ঠও সঙ্গ অর্থাৎ কণ্ঠ ও পিয়ানোর মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষার পথ অনুসরণ না ক’রে শুমান সঙ্গতকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন; ব্রামস্ তাঁর মেলডির প্রতি দুর্বলতার জন্য লোকসঙ্গীত ভিন্ন লিরিকের ভাবগত সুর বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে ধরতে পারেননি, কিন্তু হিউগো উলফ-এর কৃতিত্ব যথার্থই স্বীকার্য।
শুমান-এর সমস্ত প্রধান পদ্ধতি মেনে নিয়ে তিনি পিয়ানোকে লিরিকের সঙ্গে না বেঁধে, লিরিকের অন্তরালে, অর্থাৎ কবির মানসিকতায় পৌঁছে দিলেন । ফলে সাঙ্গীতিক চরিত্র স্পষ্ট রেখেও কবিতার নিজস্ব স্বাধীনতাকে হেয় করা হয়নি। দেবুসির সুরারোপের সময় রোম্যান্টিকতার পরিবেশ অনেক দুর্বল, কাব্যসাহিত্যও অপেক্ষাকৃত বিমূর্ত হয়ে ওঠে— মালার্মের The Afternoon of A Faun-এর জন্য প্রেলিউড রচনা কিছুটা সহজসাধ্য হয়েছিল। চারিত্রিক পার্থক্য সত্ত্বেও দেবুসি ও উলফ -এর সুরারোপের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। পরবর্তী- কালে মালার্মের বহু কবিতার গীতিরূপ হয়েছে, বিশেষত পিয়ের বূলের হাতে, এবং প্রায় সব সকল দৃষ্টান্তই দেবুসির ধর্মানুসারী।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে সঙ্গীতচিন্তায় ব্যাপক ভাঙাগড়ার প্রবাহে সিমফনি, সোনাটা প্রভৃতি কোনো আঙ্গিকই অক্ষত থাকেনি। রোমান্টিকতার পরে ইমপ্রেশনইজম, নিও ক্লাসিকাল যুগ এবং তারও পরে সিরিয়াল ইজম-এর (serialism ) বিকীর্ণতার ফলে প্রতিষ্ঠিত আঙ্গিকগুলি ভেঙে গিয়ে পরস্পরের হিশ্রণের ফলে নতুন এবং ব্যাপকতর কয়েকটি আঙ্গিক সৃষ্টি হয়। নতুন আঙ্গিকের মধ্যে লীস্ট-এর Symphonic Foem-এর কিছু পরিমাণে একতার অভাব ছিল— রিচার্ড স্ট্রাউস-এর প্রচেষ্টায় এবং সোনাটা, ফিউগ ইত্যাদির উপযুক্ত প্রয়োগে এই আঙ্গিক উন্নততর স্তরে পৌঁছোয়। স্ট্রাউস-এরই জন্য এই আঙ্গিকের পক্ষে শুধুমাত্র Don Juan’ নয়, শেক্সপিয়র-এর Macbeth- এর নিয়তির গতিবিধি, এমনকি, নিৎসের ‘Also Sprach Zarathrustra দার্শনিকতাকে সুরে প্রতিফলিত করা সম্ভব হয়।
এই আলোড়ন সত্ত্বেও আধুনিক যুগ ক্লাসিক ও রোম্যান্টিক যুগের সঙ্গে একটি গ্রন্থিতে যুক্ত থেকে গেছিল— প্রতি ক্ষেত্রেই ধ্রুপদী সঙ্গীত tonal method- এর উপর নির্ভরশীল। এই সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে শোনবার্গ atonal method- এর প্রবর্তন করেন। একটি স্বরকে (note ) প্ৰত্যক্ষভাবে চিহ্নিত না ক’রে তার চারপাশের স্বরের মধ্যবর্তীতায় উক্ত স্বরকে প্রকাশ করাই এর প্রধান লক্ষ্য। প্রথাসিদ্ধ রীতিবদ্ধতার বিকল্প হিসেবে শোনবার্গ atonal method- note method Serialism-এর প্রচলন করে সাঙ্গীতিক তত্ত্বের যে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেন তা প্রথমে তিরস্কৃত হলেও আজ অভিনন্দিত। আঙ্গিকের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবিতা ও সঙ্গীতের বোধ বদলে অনভ্যস্ত কানের কাছে পাউণ্ড ও শোনবার্গ সমান দুর্বোধ্য, কিন্তু অভ্যস্ত ও শিক্ষিতের কাছে দু’জনেই বিংশ শতাব্দীর কবিতা ও সঙ্গীতের মূল স্তম্ভের মতন। এই আপাত-দুর্বোধ্যতার জন্য সঙ্গীত ও কবিতার মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হতে চলেছে ব’লে অনেকেই মনে ক’রে থাকেন । বস্তুতপক্ষে আধুনিক কবিতার সুরারোপ স্ট্রাভিনস্কির হাতে খুব সফল হয়নি, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয় । ক্লাসিকাল যুগের মতন আজও সঙ্গীত এবং কবিতার সম্পর্ক অনেকটা ফল্গুধারার মতন—সেই শক্তিতেই মালহর-এর Song of The Earth-এর মতন সিমফনি আকারের সৃষ্টিতে প্রাচীন চৈনিক কবিতার ব্যবহার হয়, ভন উইলিয়াম্স-এর Sea Symphony-তে ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর Leaves of Grass প্রায় কোরাল সিমফনির কাছাকাছি এবং এলিয়ট-এর Four Quartets শুধু চেম্বার মিউজিক নয়, শেষ পর্যায়ের বেথোভেন-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবনের মূলেই আজ যখন সংশয়, সুখ আর দুঃখের ব্যাপ্তি, শিল্পচেতনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা টানা আদৌ কি সম্ভব ?