
তিরন্দাজির পথে, জেন পঞ্চম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
'জেন’- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে চলা রহস্যময়, মিস্টিক এক সাধনপদ্ধতি; প্রাচ্যের সুগভীর দর্শনের একটি ধারা, যে ধারার মধ্যে মিশে রয়েছে পারমিতার ছায়া, ‘না-জানা’র মধ্য দিয়ে জানার গূঢ় পদ্ধতি। একটি সুবিখ্যাত জেন-কবিতায় পাওয়া যায়, ‘Sitting quietly, doing nothing / Spring comes, and the grass grows itself’। এই ‘কিছুই না-করা’র পদ্ধতি অর্জন করতে হয় দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের এই ধারার সঙ্গে তিরন্দাজির মতো একটি শৌর্যময় বিষয়ের কি কোনও সংযোগ থাকতে পারে? তিরন্দাজি কি শিল্প? এই শিল্পের মধ্যে দিয়ে কি প্রবেশ করা সম্ভব জেন-এর মিস্টিক পৃথিবীতে? আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অয়গেন হেরিগেল-এর ‘Zen in the Art of Archery’। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ কাহিনি যেন এক রোমাঞ্চকর শান্ত থ্রিলার, ইউরোপের চোখে ‘জেন’ দর্শন অথবা ভিন্নধারার ডিসকোর্স।
গুরুজির সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা এই প্রথম, কিন্তু গুরুজির কথাগুলি আমাকে চরম বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। গুরুজির কথা শুনে বুঝতে পারছিলাম কেন জেন-শিক্ষার জন্য আমাকে তিরন্দাজি বেছে নিতে দেওয়া হয়েছিল।যে নিরাসক্তি ও শূন্যতার কথা বলেন জেন-মহাগুরুরা তিরন্দাজিতেও সে বিষয়টা বহুলাংশে রয়েছে। আমার কাছে তিরন্দাজির সঙ্গে জেন-এর সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। তিরন্দাজির মধ্যেও উদ্দেশ্যবিহীন অপেক্ষার বিষয় আছে; তির ছোড়ার আগে যে অপেক্ষার প্রহর তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজে থেকে পূর্ণ হয়ে ওঠে। এর সব কিছু হয়তো আমি এখনও সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারব না। কারণ এটি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝে ওঠা সম্ভব, শুধু অলীক চিন্তা দিয়ে একে বোঝা যাবে না। এসব অকাজের চিন্তা তাই আমার ছেড়ে দেওয়াই উচিত। মাঝে মাঝে আমি গুরুজির কিছু শিষ্যদের দেখে অবাক হতাম, একটু হিংসাও করতাম তাদের। শিশুর সারল্যে তারা গুরুজির কাছে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন, গুরুজি তাদের হাত ধরে লক্ষ্যের দিকে নিয়ে চলেছেন। মনে কোনও সন্দেহের অবকাশ না-রেখে এ জীবন বেছে নেওয়ার মধ্যে নির্মল আনন্দ আছে। এই পথ আধ্যাত্মিক সংকট থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু শিশুর আরেকটি ধর্ম আছে, সেটাও অস্বীকার করা যায় না; সেটি হল প্রশ্ন করা।
ভেবেছিলাম গুরুজি এবার নতুন কিছু শুরু করবেন, কিন্তু পরের দিনও দেখলাম তিনি একই জিনিস শেখাত শুরু করলেন; সেই ধনুক তোলা, সেটিকে ঠিক মতো ধরা এবং তির ছোড়া। যদিও এত খাটাখাটুনি সার হচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি গুরুজির নির্দেশ মতো, মনকে উদ্বেগশূন্য করবার কথা ভাবছি। ভাবছি এই তির-নিক্ষেপ প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনও বন্ধন নেই, তথাকথিত উদ্দেশ্য নেই; উদ্বেগ এক সময়ে নিশ্চয় নিজে থেকে পূর্ণ হয়ে উঠবে। ধনুকের ছিলা থেকে তির আপনি ছুটে যাবে লক্ষ্যের দিকে, তত ক্ষণ পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
আমি প্রাণপাত করে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ফল সেই এক – তির নড়ে যাচ্ছে, তির এদিক সেদিক উড়ে যাচ্ছে।
দিনের পর দিন মরীচিকার পিছনে ছোটার মতো অবস্থা, যা করছি তাই ব্যর্থ হচ্ছে; ব্যর্থতাই আমার সঙ্গি, এমন একটা ধারণা কুরে কুরে খেতে শুরু করেছিল। এভাবে তিরন্দাজি চালিয়ে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। গুরুজি যেন আমাদের মন পড়তে পারছিলেন; তিনি একদিন নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘এর পরের দিন থেকে যখন তোমরা বাড়ি থেকে এখানে হেঁটে আসবে তখন আর অন্য কোনও দিকে নজর দেবে না। মনে করবে পৃথিবীতে শুধু একটি জিনিসেরও অস্তিত্ব রয়েছে, সেটি তিরন্দাজি এবং তিরন্দাজি।’
নিজের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে বিলীন করে দেওয়ার মধ্যেও অনেকগুলি ধাপ আছে। খুব সাবধানে সেগুলিকে মেনে চলতে হয়। এক্ষেত্রেও গুরুজি বেশি কিছু বলবেন না, কয়েকটি ইশারা দেবেন মাত্র। শিক্ষার্থীদের সেথান থেকেই যা বোঝার বুঝে নিতে হবে, না-বুঝলে আন্দাজে ধরে নিতে হবে যে তার কাছে থেকে ‘জেন’ ঠিক কী চাইছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহু কাজ হয়েছে এ নিয়ে, সেগুলিকে মনে মনে কল্পনার করার দরকার নেই। শয়ে শয়ে বছর ধরে জেন মহাগুরু’রা সাধনা করে গেছেন, আমাদের কৃত্রিম জ্ঞানের থেকে তা অনেক বেশি জীবন্ত। ফলে কল্পনা করে কোনও লাভ নেই, কারণ জেন-পথ সক্রিয় অংশগ্রহণ দাবি করে।
আমি এবং আমার মতো বেশ কয়েকজন জেন-পথে প্রথম কদম ফেলেছি, পথিক হতে চেষ্টা করছি। শারীরিক অস্তিত্বের যে বোধ তাকে বিলীন করে দিতে হবে, বিস্মরণের মধ্যে ডুবে যেতে হবে, তবেই ধনুক হাতে তুলে নেওয়া সম্ভব হবে। যদি তির ঠিকঠাক ছুড়তে হয় তা হলে শারীরিক অস্তিত্বের বিলীন হয়ে যাওয়া অবস্থাকে মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করতে হবে। মন’কে প্রশান্ত ও চিন্তামুক্ত রাখতে হবে। মনের অনন্ত প্রসারণের ক্ষমতা থেকে আসবে সেই প্রশান্তি এবং এই প্রশান্তি’ই নিয়ে আসবে চিত্তের অনন্ত প্রসারণ।
মানসিক স্তরে চিন্তার তৎপরতা দিয়ে আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি তার থেকে এই প্রকৃত প্রশান্তি বহু দূরের গ্যালাক্সি।
জেনের যে পথ দিয়ে আমরা চলেছি তার একদিকে নিরুদ্বেগ শারীরিক অবস্থা আর একদিকে মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও স্বাধীন-অবস্থা… দুটিই সমান ভাবে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু শুধু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া দিয়ে এ দুটিকে অর্জন করা যাবে না। ধীরে ধীর সমস্ত বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে; হয়ে উঠতে হবে অহং-শূন্য। বন্ধনমুক্ত চরম অবস্থায় সত্তা তার পূর্ণ রূপ নিয়ে বিশেষ অবস্থায় ফুটে উঠবে। সে অবস্থাকে কোনও নাম, কোনও পরিচয়, কোনও বিশেষণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, সে সমস্তর অতীত।
রিপু ও ইন্দ্রিয়ের দ্বার ধীরে ধীরে বন্ধ করে ফেলতে হবে জেনের পথে চলতে গেলে। অনেকে খুব চেষ্টা করে তেড়েফুঁড়ে কোমর বেঁধে এটা করতে যায়, কোনও লাভ হয় না। বরং কোনও প্রতিরোধের থেকে সমর্পণ বেশি প্রয়োজন। এই সমর্পণ পেতে গেলে মনের সংযম দরকার, প্রতিটি কাজ যেন নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে সহজ ভাবে হতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। এ সংযম শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার মাধ্যমে অনেকাংশে অর্জন করা যায়, কোনও রকম পণ্ডিতির দরকার হয় না। নিঃশ্বাস ছাড়ার মতো শ্বাস নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এবং এটি সাবধানে করতে হয়। ফল পাবার জল্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে নজর দিলে বাইরের কোলাহল মিলিয়ে যেতে শুরু করে। ধাপে ধাপে এই মিলিয়ে যাবার ঘটনা ঘটে; প্রথম প্রথম মনে হবে কানে আঙুল দেওয়া অবস্থাতেও যেন ঢুকে পড়ছে কিছু শব্দ, কোলাহল। শ্বাস-প্রক্রিয়ায় মনোনিবেশ করলে সে আওয়াজ আরও ফিকে হয়ে আসবে, মনে হবে অনেক দূর-সমুদ্র থেকে ভেসে আসছে ঢেউয়ের শব্দ। আরও কিছু দিন পর সে আওয়াজ মনোসংযোগ টলাতে পারবে না। কারণ ততদিনে একজন শিক্ষার্থী অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী এ পথ ধরে আরও বড় বড় বাহ্যিক হাতছানি এড়াতে পারবে; বাহ্যিক সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করা তার পক্ষে সহজতর হয়ে উঠবে। শুধু মাথায় রাখতে হবে শোয়া বসা দাঁড়ানো… যে অবস্থাতেই হোক না-কেন শরীরকে শিথিল রাখতে হবে; শিথিল শরীরে ঠিক মতো শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া অনুশীলন করলে যে কোনও জেন শিক্ষার্থী স্তব্ধতার সমুদ্রে ডুবে যাবে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবারও দরকার নেই; কারণ এই প্রক্রিয়াটি নিজে থেকেই ধীর হয়ে আসবে। শিক্ষার্থী নিজে মেপে শ্বাস নেওয়া অভ্যাস করে ফেলবে; এ ভাবে শেষ পর্যন্ত সে দূরের অস্পষ্ট-ধূসর অথচ নিরুদ্বেগ জগতে প্রবেশ করবে।
অপার্থিব এই আত্মনিমজ্জনের স্থায়িত্ব যদিও খুব বেশিক্ষণ হয় না; কারণ ভেতর থেকেই বিশৃঙ্খলার উপাদান উঠে আসতে শুরু করে। কোথা থেকে যেন আশা-আকাঙ্ক্ষা-হতাশা-দুঃখ অনবরত ছুটে আসে। অদ্ভুত সব চিন্তার সঙ্গে সে সময়ের মনের অবস্থার হয়তো কোনও সম্পর্ক নেই; কিন্তু তারা মনের সে শান্ত অবস্থাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেবেই। তারা যেন মনের এই শান্ত অবস্থার জন্য অপেক্ষা করছিল, ক্ষেত্র প্রস্তুত; এবার প্রতিশোধ নেবার পালা। জেন শিক্ষার্থীর কাছে এর থেকে মুক্তি পাবার একটাই উপায় – শ্বাস’কে নিয়ন্ত্রণ করে আরও ধীর করে ফেলা। মনে যে চিন্তা আছড়ে পড়ছে তার থেকে জোর করে পালানো নয়; বরং সেগুলির দিকে তাকানো। একটা সময় নিজে থেকেই আসবে যখন তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে বিরক্ত হয়ে যাবে। এই সময়টি অনেকটা গোধূলি’র মতো, ঘুম আর তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যবর্তী একটা সময়।
এই পর্যায়টির মধ্যে কিন্তু একটা বিপদ ওঁত পেতে থাকে, সেটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো দরকার। এ সময়ে অদ্ভুতভাবে মনোসংযোগ এক ধাক্কার বহুগুণ বেড়ে যায়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যেতে পারে, ধরা যাক কোনও ব্যক্তির জীবন-মরণ নির্ভর করছে রাতভোর জেগে থাকার উপর। ভোর- রাতে হয়তো তার ঘুম এসেছে, সে ঢুলছে এবং ঢুলুনির ভেতর থেকে ধড়ফড় করে উঠে আবার টান টান হয়ে বসছে।
একবার মনোসংযোগের এই স্তরে পৌঁছাতে পারলে পরে বারবার সে জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়। এ সময় আত্মা নিজের ভেতর নিজে স্পন্দিত হতে শুরু করে; তীব্র স্পন্দন। চারদিক থেকে যেন শক্তির স্রোত ছুটে আসছে; সে শক্তি মনের ভেতর জমে থাকা উত্তেজনাকে বিমোচন অথবা ধারণ – দুটিই করতে পারে।
মনের এই স্তরটির অনেকগুলি রূপ আছে, এ সময়ে মন কোনও কিছু চিন্তা করে না, কোনও পরিকল্পনা করে না; কিছু আশা যেমন করে না ঠিক তেমনই তার কাছে সম্ভব–অসম্ভব বিষয় বলেও কিছু নেই। স্থির অচঞ্চল তার অবস্থা। সে সময়ে তার কোনও উদ্দেশ্য নেই, কোনও অহং নেই। জেন মহাগুরুরা মনের এই অবস্থাকেই প্রকৃত অর্থে ‘আধ্যাত্মিক’ অবস্থা বলে গণ্য করেন। এ সময়ে মন আধ্যাত্মিক সচেতনতায় পূর্ণ হয়ে থাকে, এই অবস্থাটিই মনের সব থেকে যথাযথ অবস্থা। এর অর্থ হল, এ সময়ে মন সর্বত্র বিরাজমান; কারণ তখন মন কোনও একটি বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। এ সময়ে মনের অবস্থা হয় অনেকটা জলের মতো। বৃষ্টির জল জলাশয় পূর্ণ করে, কিন্তু সে আবার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে যেতে পারে। কারণ সে স্বাধীন, তার গতি রোধ করবার মতো কিছু নেই।
একমাত্র শূন্যই সব দিক থেকে, সমস্ত বিষয়ের কাছে মুক্ত। শূন্যাকার বৃত্ত দিয়ে এই বিষয়টিকে বোঝানো যায়। যদিও এ শূন্যের ভেতর যে দাঁড়িয়ে রয়েছে বা অবস্থান করছে তার কাছে এ-শূন্য শূন্য নয়।
এ সময়ে শিল্প-শিক্ষা করবার সব থেকে আদর্শ সময়, কারণ মন তখন পূর্ণ। মনের ভেতর কোনও অসৎ প্ররোচনা নেই, সে তখন সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত। সে যদি নির্জনে শিল্পের সৃজণশীল পথে থিতু থাকতে চায় তার কাছে বিষয়টি আরও সহজ হয়ে ওঠে। প্রথমবার নিজের ভেতর নিজে ডুব দিতে গিয়ে সে হয়তো এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়ে ছিল যার মধ্যে সে সহজাত ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি। সে ক্ষেত্রে তাকে আবার সচেতন হয় উঠতে হবে; এক সময়ে যে সব বিষয় ও বস্তুর থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছে সে সবের মধ্যে তাকে আবার প্রবেশ করতে হবে।
সে তখন পুনর্জাগ্রত একজন মানুষ, জাগরণের মধ্য দিয়ে তাকে বেশ কয়েকটি কাজ করে ফেলতে হবে। কিন্তু তখন তাকে বোধিপ্রাপ্ত বলা যাবে না।
সে সময়ে তাঁর শিল্পের বিভিন্ন ছোট ছোট ধাপ নিজে থেকে সম্পন্ন হয়ে, তার মনেই হবে না যে কোনও বৃহৎ শক্তির হাতে সেগুলি ঘটছে। চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ ও বস্তুপুঞ্জ থেকে তরঙ্গের পর তরঙ্গ যেন এসে আছড়ে পড়বে তার ভেতর, সে শুধু অপার্থিব স্পন্দনে স্পন্দিত হতে থাকবে। সমস্তই তার দ্বারা ঘটবে, কিন্তু সে বোঝার আগেই সেগুলি ঘটে যাবে।
ঠিক এ কারণেই নিজেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া প্রয়োজন চারপাশ থেকে, প্রয়োজন সত্তার স্বাধীনতা খোঁজা, নিজের ভেতর নিজে ডুব দেওয়া। একমাত্র তবেই মানসিকভাবে পূর্ণতা পাওয়া সম্ভব। আর এই পূর্ণতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় সহায়ক পরিস্থিতি বলে কিছু হয় না। বরং শিল্পের এ প্রক্রিয়ায় এই ধারণাকে বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই দস্তুর। শিল্পীর ভেতরেই রয়েছে সে ক্ষমতা, তার ভেতর থেকে সাবলীলভাবে উৎসারিত হবে সেটি।
সমস্ত প্রক্রিয়াটিতে শিল্পীর ভূমিকা অসীম, কারণ নিজেকে শিল্পের কাছে উৎসর্গ করার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় তার কাজ। চেতনার সন্ধানে রত হতে হয় তাকে, বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে সেটির নাগাল পেতে হয়। প্রথম প্রথম দীর্ঘ সময় পর পর সে মনের একটি বিশেষ অবস্থায় উপনীত হতে পারে; কিন্তু ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলনের মাধ্যমে সে সমস্ত বিষয়টিকে নখদর্পণে পায়। একমাত্র তখনই সেটিকে তিরন্দাজির সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভবপর হয়। তখন তার কাছে ধনুক তুলে ধরা, তির সংযোজন করা অনেক সহজ হয়ে আসে। সে একটি হাঁটু মুড়ে বসে, মনোসংযোগ করে, উঠে দাঁড়ায়, ধীর পায়ে সমর্পিত মানুষের মত লক্ষ্যের দিকে হেঁটে যায়। তির তখন তার কাছে পবিত্র অর্ঘ্য, সে ছিলায় তির সংযোগ করে গভীরতম মনোযোগ সহকারে অপেক্ষা করতে থাকে। বিদ্যুতবেগে তির ছুটে যায় ছিলা থেকে, তিরন্দাজ একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে, ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর তার প্রসারিত বাহু গুটিয়ে নিয়ে লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করে। যদি আর তির ছোড়ার না থাকে, সে খুব শান্ত ধীরস্থির ভাবে পিছনের দিকে সরে যায়।
তিরন্দাজির সুমহান ঐতিহ্য এভাবেই বাহিত হয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
অনেকের পক্ষেই এ সময়ে তির-ছোড়ার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না; কিন্তু সে বুঝতে পারে কেন তিরন্দাজি আর পাঁচটা খেলার মতো নিছক একটি খেলা নয়। সে এটাও বুঝতে পারে তিরন্দাজির যে অংশটি গুরুর কাছ থেকে শেখা যায় তাকে বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে নিখুঁত করে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীকে হয়ে উঠতে হবে উদ্বেগ ও উদ্দেশ্য শূন্য, সমস্ত রকম কোলাহল থেকে দূরে থেকে তাকে অনুশীলন করে যেতে হবে। এটি করতে পারলে বাকি বোধের ক্ষেত্রগুলি নিজে নিজেই তৈরি হয়ে যাবে, সেগুলির জন্য আলাদা করে বুদ্ধির আশ্রয় নিতে হবে না।