এক সুগন্ধি রং-মশাল <br /> সৈকত ঘোষ

এক সুগন্ধি রং-মশাল
সৈকত ঘোষ

দ্বিষো জহি অরিজিৎ চক্রবর্তী প্রকাশক: আলোপৃথিবী মূল্য: ৪০টাকা। বইটি পাওয়া যাচ্ছে কলেজস্ট্রিট, কলকাতা: ধ্যানবিন্দু, যাপনচিত্র, আদম, দে'জ, ক্ৰৌঞ্চদীপ, কাটোয়া: ঐশ্বর্য, অন্নপূর্ণা কৃষ্ণনগর: সংকলন বাংলাদেশ: পাঠক সমাবেশ, বুকস, বাতিঘর, বইচিত্র তক্ষশীলা, উজান, একা এবং কয়েকজন। অনলাইনে পাওয়া যাবে: www.bitanika.com www.haritbooks.com www.boighar.in এছাড়া বাড়িতে বসে বই পেতে যোগাযোগ করুন ৯০০২৪৯৮৩০৭ নম্বরে।

“চক্ষু দানের পর তুমি আরো দেবী হয়ে যাও
চক্ষু দানের পর তুমি কেন আমাকে কাঁদাও”

কিছু লেখা এমন হয়, হঠাৎ করে সবকিছু নিভিয়ে দিতে পারে। আবার উল্টোটাও। সময়ের ভিতর যেন থমকে দাঁড়াতে চায় অক্ষর। একটা অন্ধ টানেলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অজান্তেই জন্ম নেয় আলো। তারপর মাঠ পেরিয়ে দিঘি পেরিয়ে চেনা আকাশ পেরিয়ে সেই জন্মকে নতুন চোখ দিয়ে উপলব্ধি করা। কবি অরিজিৎ চক্রবর্তী ঠিক এই কাজটিই করেছেন তার সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই
‘দ্বিষো জহি’তে।

“আমি মুন্ডহীন করোটির প্রাখর্যে
প্রত্যেকটা সত্যি জোৎস্না দিয়ে রঙ করবো”

সেই ভাবে দেখলে এই একফর্মা বইটি আসলে কবির নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে দেখা। প্রতি লাইনে তিনি নিজেকে স্থির করেছেন। ধ্যানের গভীরে এ যেন এক নিজস্ব চলন। বিভিন্ন অনুষঙ্গে বারবার উঠে এসেছে পুরাণ, লোককথা থেকে দৈনন্দিন জীবনের অতি সামান্য কথাবার্তা, যা নির্মাণ গুণে হয়ে উঠেছে অসামান্য।

“প্রতিবার কবিতা যেভাবে
অনভিজ্ঞ করেছে আমায়
তার দায় কাকে দিই?”

সমুদ্র মন্থন করে তুলে আনা অমৃত নয়, এ বই আসলে নিজেকে খুঁড়ে নিজেকেই আবিষ্কার। প্রসঙ্গত গোটা বইটিই একটি দীর্ঘ কবিতা, যার চলনে অযথা কোনও চমক নেই বরং একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে দিঘির মতো স্থির স্থবির বয়ে চলা। চেনা ছক ভেঙে এ যেন এক বৌদ্ধিক বিনির্মাণ। পাঠক যতো গভীরে প্রবেশ করবে এক অনাবিল ঘোর আচ্ছন্ন করবে তাকে। বেটোফেনের সিম্ফনি নয়, ভেতর ভেতর একটা চোরা মনখারাপের আটপৌরে নদী বয়ে যাবে রিনিঝিনি। অপেক্ষার বালুতটে বদলে যাবে অপেক্ষার ডিসকোর্স। আর এখানেই কবি হয়তো অজান্তেই একটা নতুন সম্ভাবনার জিনম্যাপ তৈরি করেছেন। যা অনেকটা হাইজেনবার্গের আনসারটিনিটি প্রিন্সিপালের মতো জীবনের কগনিটিভ স্তরে পৌঁছে উদ্ভাসিত, কবিতা হয়ে ওঠার সমস্ত জাগতিক মহাজাগতিক সীমা এবং তার একটা ভিস্যুয়াল। এখানে কবির দেখা এবং তার অনুভব অসংখ্য চোখ হয়ে পাঠকের হৃদয়ে তাদের মতো করে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ঠিক যেন ট্রান্সমিটার এবং রিসিভারের মধ্যে একটা প্রপার কমিউনিকেশন চ্যানেল।

কবি লিখছেন-

“কতদিন আরক্তিম করিনি তোমাকে
ঘোড়ার লাগাম ধরে শুধু ছুটে গেছি”

আর এখানেই দ্বিষো জহি দেবীর মন্ত্র থেকে জীবনের মন্ত্র হয়ে উঠেছে। বিজয় মন্ত্র। এক রূপ থেকে অন্য রূপে, এক আঙ্গিক থেকে অন্য আঙ্গিকে সঞ্চারিত হয়েছে অনুভব। লার্জ-স্কেলে বিচার করলে এ লেখার দর্শন আদপে কবির বৃহত্তর জীবন-দর্শন। সাব-কন্সিয়াসে চেতনার সঙ্গে অতিচেতনার একটা সমীকরণ। এই বিস্ময়ঘোর, এই খেলাটুকই হয়ে উঠেছে কবিতা। জীবনের নানা পরিচিত অনুষঙ্গে কবি আমাদের চেনা এক একটা ফ্রেম তুলে ধরেছেন। যা প্রচণ্ড ভাবে জীবনেরই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ। চেতনার গভীরতা এবং দার্শনিক ডিসেকশন থেকে উঠে আসা এই অদৃশ্য ডাইভিংফোর্স অনেকটা প্রসব যন্ত্রণার মতো যা অনেকাংশে কবির মধ্যে অলিখিত দায়বদ্ধতা তৈরি করেছে লেখাটিকে জন্ম দেওয়ার জন্য।

“কিছু দূরে দরবেশী গান
কানে আসে–
যেভাবে তোমার চোখে
চোখ রেখে আড়ি পাতে কেউ”

এ লেখায় প্রেম এক জীবন্ত অন্তঃসলিলা নদী। এক আশ্চর্য ছায়াপথ ঘুরে সে জেগে থাকে ঘুমের তৃতীয় প্রহরে। কবি অরিজিৎ চক্রবর্তী এ রক্ত-মাংসের কাব্যে কোনও ভয়ঙ্কর সুন্দরকে আঁকার চেষ্টা করেননি। বরং মনের ঈশান কোণে জেগে থাকা পুরোনো প্রেম ধূময়মান বন্দিশের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এ লেখার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর হয়ে।
উচিত অনুচিতের সরল সমীকরণকে যাপনের অ্যালফাবেটস দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন কবি। আর তাই এ প্রেমে যেমন কোনও বাড়তি উচ্ছ্বস নেই, তেমন নেই জাগতিক প্রশ্ন-চিহ্ন। গোটা লেখাটা জুড়ে এক বিপদজনক ঘোর মারাত্মক ভাবে পাঠককে আচ্ছন্ন করে। মাথাব্যথার ইতিহাস ভূগোল আর সামাজিক জ্যামিতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রতিষ্ঠা করে প্রেমের এক নতুন ভরকেন্দ্র।

কবির কথায়-
“আমি কি তোমার ভুল?
পথ মাঝে ফুল হয়ে ফুটি
ভালোবাসা জেগে থাক,
জেগে থাক রঙিন ভ্রুকুটি”

এ কাব্যের ভাঁজে ভাঁজে স্বযত্নে লালিত আছে দুর্গাপুজো এবং তার নানা অনুষঙ্গ। সন্ধি-পুজো থেকে মহাষ্টমীর অঞ্জলি কলাবৌ স্নান থেকে দেবীর চক্ষুদান। পরতে পরতে ক্ষণে ক্ষণে এক অদ্ভুত মায়াবলে যেন দেবীর মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রক্তমাংসের দেবী। যার শরীর আজও প্রেম নামে এক ধর্ম-সংকটে কবিকে আহত করে, মুগ্ধ করে। সেই দৃষ্টি সেই আঁখি-পল্লব সেই কাঁপা কাঁপা অক্ষরে প্রথম তাকে লেখা, যেন সময়ের চাকায় আটকে যায় সময়। কি অবলীলায় সরল ঘাসের ওপর হেসে ওঠে শিশিরবিন্দু। মধ্য যৌবনে প্রেমের সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে প্রেমিকার সেই ফেলে আসা দৃষ্টি কখন অজান্তেই মা হয়ে যায়। আর এখানেই ‘দ্বিষো জহি’ কবির অন্য সবকটি কাব্যগ্রন্থের চেয়ে আলাদা। শরীরকে অতিক্রম করে প্রেম এখানে দেবী হয়ে উঠেছে। আর তাই অনুভবে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে দুর্গাপুজোর নানা অনুষঙ্গ

“ভূমাবোধ থেকে দূরে
আলোক প্রবল
ছায়াকে গভীরতর
করে আমি রোজ
দেবী দৃশ্য দেখি”

এ পংক্তিগুলি থেকে নির্গত চেতনার রিফ্লেকশন অন্তত সে কথাই বলে। কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথের প্রেম-প্রকৃতির দর্শনকে কবি লেট-নাইনটিজ এর হোয়াইট কলার বাঙালির ক্রাইসিস থেকে উঠে আসা জীবনদর্শন দিয়ে ছুঁতে চেয়েছেন যার ফলে স্ট্রাকচারালি এই অদ্ভুত ফিউশন তৈরি হয়েছে। আর তাই অধিবিদ্যার আলোছায়ায় কবি লিখেছেন-

“চাঁদ যেন কমন্ডুলু স্তন!
মাধুর্য অতসীর ঘোর

কোনো বিস্মিত দৃশ্যের দিকে
ঈর্ষা করার মতন নিজেকে
লুকিয়ে রেখেছি”

নয়টি পর্বে রচিত দীর্ঘ কবিতার আঙ্গিকে এ যেন জীবনের এক চিরায়ত ক্যালাইডোস্কোপ। এখানে জীবনের পল অণুপল নানা রঙে উদ্ভাসিত হয়েছে। আলোছায়ার মুগ্ধতায় যে অভিসার সেখানে বারবার বেজে উঠেছে অন্তরাত্মার সুর। শব্দ জানলা খুলে দিয়েছে অসীমের। আর এখান থেকেই এক নতুন আলোকবর্ষের সূচনা।

ফর্ম নিয়ে যদি আমরা দেখি, সেখানেও সুরের মৌতাত চেনা জলবায়ু ছাড়িয়ে আলোকিত সঙ্গমের দিকে নিয়ে যায় পাঠককে। প্রতিটি পর্বের পংক্তি বিন্যাস এবং স্পেস এখানে সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখায় শুধুমাত্র অন্তর্নিহিত সুর নয় চমৎকার নির্মাণ কৌশলও পাঠকের অভিনিবেশ দাবি করে। সপ্তম পর্বে ‘এখানেই শেষ নয়’ পংক্তিটি সিনেমার মতো আমাদের ফ্লাশব্যাকে নিয়ে যায় যেখানে কবির কথায়-

“এই প্রতি জাগরণ পার্থিব সম্ভাবনার বাইরে
আবদ্ধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক”
আপাত সহজ এই দীর্ঘ-লেখাটি পড়তে পড়তে যত গভীরে যাওয়া যায় পাঠকও নতুন ভাবে আবার ফেলে আসা নিজেকে আবিষ্কার করে। এ বিনির্মাণ আসলে শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া, কিছুক্ষণের জন্য সময়কে থামিয়ে দিয়ে একটা রি-ওয়াইন্ড বাটন এক সুগন্ধি রং-মশাল জ্বালিয়ে দেয়। যার আলোয় ফিকে হয়ে যায় গ্লোবালাইজেশন, ঝাঁ-চকচকে ব্র্যান্ডেড জীবন, হোয়াইট কলার জব, অ্যান্ড্রয়েড পৃথিবী। আর এখানেই অরিজিতের কবিতার ম্যাজিক।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)