মিথ ও মাশরুমের শহরে : শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা
সন্দীপন চক্রবর্তী
[মিথ ও মাশরুমের শহরে। শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়। ধানসিড়ি। জানুয়ারি ২০২৩। ১০০টাকা।]
না। ট্রাফিকের দিকে নজর রাখার কোনো দায়িত্ব আপনার নেই। ধরুন, অন্য কারো বাইকের পিছনে বসে আপনি চষে ফেলছেন এই গোটা কলকাতা শহরটা। খেয়াল করছেন চারপাশের জায়গাগুলো, তার চরিত্র লক্ষ করছেন দুচোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে। আর আপনার ভিতর সেসব দৃশ্যের সঙ্গে আপনার কল্পনা মিশে গিয়ে, তৈরি হয়ে উঠছে কবিতা, যেখানে প্রায় মন্তাজের ভঙ্গিতে উঠে আসছে গোটা শহরটাই। স্মার্ট, আরবান চটক-সহ, ছিপছিপে সেই উচ্চারণে উঠে আসছে একেবারে হালফিল সময়ের এই শহরের চরিত্র। হ্যাঁ, তার সঙ্গে মিশে থাকছে এই ভূখণ্ডের খানিক ইতিহাসও।
শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মিথ ও মাশরুমের শহরে’ পড়তে পড়তে যেন এইরকমই মনে হয় বারবার। আর এই বইয়ের সেই চরিত্রটা ধরা পড়ে কবিতাগুলোর নামকরণের মধ্যে দিয়েই– সাউথ সিটি মল, মনুমেন্ট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কৃষ্ণপুর, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কুমোরটুলি থেকে শুরু করে জিপিও, খালাসিটোলা, মেটিয়াবুরুজ, পার্ক স্ট্রিট, আহিরীটোলা, বো ব্যারাক, সেক্টর ফাইভ প্রভৃতি। এবং এর মধ্যেও যদি আবার সংখ্যাগত হিসেব করি, তাহলে দেখবো যে– এ বইয়ের ৩২টি কবিতার মধ্যে ৮টি উত্তর কলকাতা কেন্দ্রিক, ৮টি দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রিক, ১১টি মধ্য কলকাতা কেন্দ্রিক আর ৫টি পূর্বদিকে কলকাতার যে সম্প্রসারিত অংশ, তা নিয়ে। ছোটো ছোটো আয়তনের ছন্দমিলে ঘনবদ্ধ ছবি। যেন একটু তফাতে দাঁড়িয়ে দেখা।
এই সময়ের প্রত্যক্ষ টিপছাপ যেন আঁকা থাকে শাশ্বতর কবিতায়। একেবারে শুরুর কবিতাটির কথাই ধরা যাক। কবিতার নাম ‘সাউথ সিটি মল’। আর শুরুতেই পাই এরকম লাইন—
তোমার হৃৎপিণ্ড যেন বিনামূল্যে
ওয়াই ফাই জোন
ফ্রি সিগন্যাল যাবে তাই
সারাক্ষণ ফোনে রাখি চোখ
অথবা ধরা যাক, বইয়ের শেষ কবিতা ‘নিউটাউন’। পুরো কবিতাটাই দেখা যাক—
এই পথে একদিন
গিয়েছিল চাঁদ সদাগর?
বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী,
কর্পোরেট হাব হবে, ভেবে
চাঁদ সদাগর ফিরলে,
আমাদের সন্ততির হাতে
ক্রিপ্টো কারেন্সির মতো সোনার আধুলি এনে দেবে
এই লাইনগুলো কি আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও লেখা সম্ভব ছিল কলকাতায় বসে? না, সম্ভব ছিল না। এই সমসময়ের চরিত্র ধারণ করে রাখা ছাড়াও, আরেকটি বৈশিষ্ট্য বারেবারেই ঘুরেফিরে আসে শাশ্বতর কবিতায়। তা হল এক দমচাপা যৌনতা, যেন তা ফেটে পড়তে চাইছে, তার জ্বালা, তার যন্ত্রণা, তার ক্ষত কখনো সোজাসুজি আর কখনো বা ঘুরপথে ছায়া ফেলে যায়। আমাদের কারও কারও হয়তো সে ছায়া দেখে এক ঝলক মনে পড়ে যেতে পারে রণজিৎ দাশের কবিতা।
শুরুতেই, সমসময়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এই ভূখণ্ডের পুরনো সময়কে যে ধরে রাখার কথা বলেছিলাম শাশ্বতর কবিতায়, সেই ধরণের একটি লেখা ‘বাগবাজারের ঘাট’—
এখানে এখনও নাকি
ময়ূরপঙ্খী বজরা থামে?
রামকৃষ্ণ এসেছেন কার বাড়ি
এবারের শীতে?
কিছু দূরে নিমতলা,
হাই তোলে জটাধারী সাধু
তর্কের তুফান ওঠে ছোটো ছোটো চায়ের খুরিতে
আবার কখনো বা নিজের ছোটোবেলা স্পর্শ করে যায় তার উচ্চারণ। যেমন ‘গ্যালিফ স্ট্রিট’ কবিতায় দেখি—
পাহাড়ি ময়নার দল
নীচু হয়ে নেমেছে এখানে
খরগোশ, পায়রা আর
রঙিন মাছের ঝাঁক ছুঁয়ে
রবিবার… মানুষেরা,
মানিব্যাগে রাখা ছোটোবেলা
বাদামের খোসা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি এক ফুঁয়ে
এখানে যেভাবে গ্যালিফ স্ট্রিটের পশুপাখির হাটের ছবিটাও উঠে এলো, সেরকমই নানা স্থানচরিত্র ধরা পড়ে শাশ্বতর কবিতায় এই শহরের ভূগোলে। ‘কলুটোলা স্ট্রিট’ কবিতায় যেমন উঠে আসে ছবি— ‘সারি সারি লেখকের আত্মা / শুধু পরপর শুয়ে’। আর সেখানে ‘সূর্য ডুবছে, ধাপে ধাপে উঠে যাচ্ছে রক্তমাখা সিঁড়ি’।
কিন্তু এই বইয়ের আপাদমস্তক স্মার্ট ঝকঝকে সমসাময়িক উচ্চারণের যে শাশ্বত, তার আড়ালে লুকিয়ে থাকে আরেক শাশ্বত, যে খানিক বিষণ্ণ, খানিক বিপন্ন তার মুখ। কমই দেখা যায় তাকে। কিন্তু যখন ‘কৃষ্ণপুর’ কবিতায় শুনি—
ঈশ্বর আমাকে দাও,
বেশি নয় দেড় কাঠা জমি…
কৃষ্ণের বাঁশির সুরে রাধিকার
বিরহ মিশিয়ে
এত ফ্ল্যাট কবে হল,
যেন দুলে-ওঠা মাশরুম
মিথ ও মাশরুম ঠেলে হেঁটে যাই, থলে হাতে নিয়ে
অথবা ধরা যাক, এই অজস্র লেখালিখির ভিড়ে দাঁড়িয়ে যখন শাশ্বতর ‘কেওড়াতলা’ কবিতায় পড়ি—
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের
তার থেকে দূরে
জীবিকার চাপে আমি
থেকে গেছি গোপনে, অভাবে
আমার কবিতাগুলো
আমারই গরিব ছেলেমেয়ে
তারাই আমাকে কাঁধে শ্মশানের দিকে নিয়ে যাবে
ব্যক্তি, সময় আর স্থানের এই নানামুখের সম্মিলনই একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে এই বইয়ের ক্ষেত্রে। আর কবির স্বরকেও এখানে নির্ভুলভাবে চিনে নেওয়া যায় তার বাচনভঙ্গীর থেকে। শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বইটির একটি অনবদ্য প্রচ্ছদ করেছেন সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়। বইয়ের ভেতরে প্রবেশের আগেই, তা যেন অমোঘ ইশারা দিয়ে যায় বইটির চরিত্র সম্পর্কে।