
বেবী সাউ-এর দীর্ঘকবিতা- অকালবোধন
অকালবোধন
শরৎজাতিকা যারা, তারা যদি কখনো সখনো
সময়ের দ্বার ভেঙে চেয়ে বসে উত্থান কাহিনি
তারা যদি কোনো কোনো সময়ের ফাঁদ কেটে
ঘাইহরিণীর মতো
ঘাই মেরে
ভেসে যেতে যায় সেই প্রবল নদীর কাছে
যেখানে মৃতের খুলি হা হা স্বরে হাসে
যেখানে ফ্যাকাশে চোখ অন্ধকার ডেকে আনে আরও
নগরে নগরে ভাসে কূটজাল ভক্ষকের বিজয় কাহিনি
লেখে, মুছে ফেলে…
আবারও…
আবারও?
আর ভয়হীন, কোনো আবেগের বশ ছাড়া
সঙ্কোচের লজ্জা ছেড়ে
কুমিরের চোখে আঁকে
শ্বাপদের নখ
মেয়ে সেই একা, একাকী শহরে
হত্যা নয় প্রেম নয় মৃত্যুও সাধারণত নয়
তার চেয়েও সহজ এক জন্ম আর মৃত্যুর ভেতর
কীভাবে যে হেঁটে যাওয়া যায় সেই নরম ভঙ্গিতে
শহরের রাজপথ দেখে
বিপ্লবের ডাক আসে মৃতদেহটির বুক থেকে,
মন থেকে…
আর গভীর রাতের পথে
অন্ধকার ভেঙে ফেলে হেঁটে যায়
মাইল মাইল পথ,
হাজারো হাজারো পা তাদের,
কাটা গলা, ফাটা স্বরতন্ত্র
তাও তারা মোমবাতি, কান্না, চিৎকার নিয়ে
পথের ওপরে লেখে:
বিচারক যারা তাদেরও বিচার চাই
তাদেরও বিচার চাই বিচারক যারা…
দেশ কেঁপে ওঠে
কেঁপে ওঠে রাষ্ট্র, রাজনীতি আর কূটের বলয়
সিংহাসনচ্যুত হবে ভেবে রাতের নিস্তব্ধ ঘুম
বিনিদ্র রজনী দেখে
দুঃস্বপ্নের মতো শোনে
পদশব্দে কীভাবে রচিত এক যুগসন্ধিকাল!
কীভাবে ভরেছে আজ চিৎকার পথ, ঘাট, নদী, নালা,
আকাশ ও ভূমি…
আশার ভেতর দিয়ে সাধারণ যারা
আরও একবার স্বপ্ন দেখে জীবনের
বাঁচানোর এবং বাঁচার
হাতে হাত রেখে
দই পাতে, খই দিয়ে লিখে রাখে শতকের শোক
আর ভাবে, ভাবে—
শেখাবে শেখাবে তারা অকালবোধনে,
যারা সেই শরৎজাতিকা
ভয় নেই, দ্বিধাহীন
আশ্চর্য সুন্দর করে লিখে দেবে চণ্ডী পুরাণের স্তোত্র
শহরের রাজপথ থেকে তুলে নেবে মুণ্ডুর খুলিকা
বুক চিরে পান করবে আরেকবার
এই পৃথিবীর প্ররোচিত সময়ের কাল…
আর অপরাধীদের দল ভয় পাবে।
রুমাল লুকানো ছলে
বারবার দাঁড়াবে সেই জাতিকা সদনে
খিলখিল হাসি দেখে
অতিপ্রাকৃত কোনো সে ঘটনার কাছে
মাথা নত, পরাজিত চোখ নিয়ে ছুটে যাবে
ক্ষুধিতপাষাণ
অহল্যার মতো কিংবা অহল্যা নয়
সীতার পাতালপথে? অথবা সেসবও নয়
সাধারণ মানবীটি যেন
তেল, ঝুল, কালি মেখে
ঘুরে দাঁড়াবে পুরুষ তোমারই দিকে…
আর সমস্ত ভাস্কর্য, টেরাকোটা সেই মূর্তি দেখে
টান দেবে ছিনি হাতুড়িতে
তখন কি পাথর বানাবে তাকে নির্জীব নিষ্ক্রিয়?
ততক্ষণে সারা জনপদ,
ঘৃণা আর লজ্জা ভরা গড়ে ওঠা ইতিহাস নিয়ে
এবং সামান্য আশা আর বিবেকের ধ্বনিসহ
ত্রাহি ত্রাহি রব নিয়ে
মরে যাবে বোধন প্রাক্কালে
পৃথিবী হয়ত তখন সে গল্পটির কাছে
সেই মায়াময় ভোরটিকে
ভেবে নেবে দেবীর সময়
বোধনের কাল
কিংবা কোনো সন্ধিক্ষণ
যার ক্ষমতার বলে পৃথিবীও মুক্ত হবে
স্বেচ্ছাচারিতার কোল থেকে
হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যাবে ধর্ষণের কাল
ভণিতা ভণিতা জুড়ে লিখে যাবে মন্ত্র আর স্তোত্রগান যত
লিপিতে লিপিতে ঝরবে সকাল আর শিশিরের বিন্দু, ধ্বনি
আলোর ভেতর থেকে হেঁটে আসা শব্দ, অক্ষরের মাধুকরী নিয়ে
আরও পথ রচনার ছলে
কত কত পরিব্রাজকের দল
উপমহাদেশটিতে জিরোবে খানিক
ফিসফিস করে সেই
গতজন্ম আর ঘাতকের কথা আলোচনা হবে:
দেখো, দেখো, পৃথিবী মানব,
ছোট্ট এই উপমহাদেশটিতে
ঘটে গেছে
কী নিপুণ সংহার কৌশল
আশ্চর্য অথচ আশ্চর্যের নয়
ভ্রমের মতন কিন্তু ভ্রম নয়
সত্যকে চাপা দিতে দিতে শাসকের দল
একদিন মিথ্যা হয়ে গেছে
হত্যার কৌশল থেকে বের করে আনা গেছে জন্মের কাহিনি
আর এই শরৎজাতিকা
মনোময় বায়ু আর আলো নিয়ে
রচিত করেছে আজ ধর্ষণহীন সংসার এক
এখানে পুরুষ নেই
এখানে নারীও নেই
কে কার ধর্ষক হবে
কে কার লোভের পাপ
মাথা পেতে নেবে?
সব আজ তৃতীয় পুরুষ, সব লিঙ্গহীনকূল
জন্ম নেই, মৃত্যুর লহর নিয়ে হেঁটে যাবে সভ্যতার মায়া
বেশ হবে, বেশ হবে
হাততালি দিতে দিতে সময়ও নির্মোহ সন্ন্যাসীর মতো
খিল খিল হেসে উঠে
আর তখনই
এত সোজা নয় এই সমাজ পাল্টানো
এত সহজে যাবে না তো
পাপীদের মন থেকে ক্ষুধা আর লোভ
অত সোজা নাকি!
অত সোজা!
সাপেদের ফোঁস ধ্বনি বেজে ওঠে আড়ালের চোখে
বিচিত্র বিচিত্র দেশ— বলে চিৎকার করে ওঠে নগর সমাজ
সেলুকাস তারা অবাক দৃষ্টি নিয়ে
নগর উপান্তে এসে
বাণিজ্যের ফাঁদ পাতে
সেই ফাঁদে একে একে ঢুকে যায় ধন, মান নারীর ইজ্জত
ইজ্জত? ইজ্জত দূর অস্ত কাল, আসলেই নারীর শরীর
আর সমস্ত নগর যেন
মৃত নগরীর মতো চুপচাপ পানশালাটির কাছে গিয়ে
তুলে নেয় সুরা পাত্র
প্রাচীন প্রাচীন মদে মত্ত হয়ে
কোমরের হিল্লোল তরঙ্গ তুলে
নারী দেখে… নারী…
স্তন আর…
নেশা জাগে
নেশা জানে কীভাবে রচনা হয় শাসকের ইতিহাস
ইস্তেহারে ঢুকে যায় সাধারণ নাগরিকদল
তারা শুধু মরে আর সিংহাসনে পা তুলে
তোয়াজে বলতে হবে, তুমিই ঈশ্বর
রাজা রাজা রূপে
তুমিই পূজিত হও যুগ যুগান্তরে…
শরৎজাতিকা সেও
ধীরে ধীরে বুঝে যায় কলা ও কৌশল
একদিন পৃথিবীর বুক থেকে সব কিছু হ্রাস হবে
কমে যাবে ধন ও সম্পদ
যৌবন হারাবে
নাম, যশ, প্রতিপত্তি, শত্রু কিংবা বন্ধুত্ব
বিলুপ্ত কালের কাছে ভেসে যাবে শুধু
কখনো চাহিদা কিন্তু
নারীদেহটির ফুরোবে না
মৃত হোক কিংবা জীবিত
ঘাতকের দল খাবে চেটেপুটে বুভুক্ষের মতো
স্তন আর যোনিপথ ঘিরে
মাছিদের মতো উড়ে বেড়াবেই তারা…
ফলতঃ বারবার
সহজ নারীর প্রতি
প্রথমতঃ সম্মানপূর্বকমিদং মুগ্ধ কোনো পুরুষের দল
দ্বিতীয়তঃ ভোগসুখ মনে
তৃতীয়তঃ নারীকে সম্পূর্ণ কব্জাগত করে…ইত্যাদি… ইত্যাদি
জাগাবে জাগাবে তাকে, দেবী রূপে, সেই ঘাতকের প্রাণ নিতে
একমাত্র তখনই, তখনই
নারী হবে দেবী আর শক্তির চালিকা
কেননা, মৃত্যুর কাছে সব শয়তানও অসহায়
ভয়ভীত…
জীবনের প্রতি লোভী আর কামুক প্রবণ
সেই পুরুষ সমাজ
নিজেকে বাঁচাতে তাই
মৃত্যু-মুখে ছুঁড়ে দেবে নারীকেই
নারীকেই বশীভূত করা হবে তন্ত্র-মন্ত্র-ধ্বনি সহযোগে
এই প্রথা, এ নিয়ম পালিত হয়েছে নিয়মিতভাবে
সব মহাকাব্য এবং পুরাণে
বেদে ও সাহিত্যে
ধর্ম আর অধর্মেও
যে নারীকে বলা হয়, সহজ অবলা
অসহায়
হঠাৎই একদিন শারদ প্রভাতে
ঘুম থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে
বসানো হবে কোনও দেবীর আসনে
সুরা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, গলায় রক্তজবার মালা
অথবা আরও কোনো বিপুল বিশাল উদ্যোগের সঙ্গে
শুরু হবে তোয়াজ তাহার
সেসব পুরুষ যারা মৃত্যুভয়ে ভীত
কিংবা সিংহাসনের লোভে মত্ত
নারীটির দিকে জোড় হাতে
ভিক্ষা করে জীবনের খোঁজ
প্রকৃতির ধর্ম শুধু ক্ষমা করে যাওয়া
প্রকৃতির মন জানে উপেক্ষিত যে জীবন
খানিকটা প্রেম পেলে
সম্মানের লোভে
হাসিমুখে পান করে নিতে পারে
তরল জহর…
নারী যদি এত শক্তিশালী হত
নারী যদি শারীরিকভাবে নিজেকে নিজেই নিয়ে
গড়ে নিতে শিখে যেত কৌশল কৌতুক
এ ধর্ষণ আর হত্যা-খুন দেখতো না মহানগরীর জনপদ!
পুরুষের হাত এত লম্বা হতো না কোনো ভাবে!
সবকিছু ভ্রম আর ভ্রমণের গল্প ছাড়া
মিথ আর কৌশল ছাড়া
আর কিছু নেই তো আসলে
কিছু নেই তাও আছে
এই ডানা, ডানা নয়
এই দেবী, দেবী নয়
এই সময় আসলেই নয় সুসময়
সত্য— মিথ্যার আগেই
এই মিথ্যা রচিত হয়েছে সত্যের পেছনে
একেকটি সত্যের আগে যেভাবে রচিত হয়
মিথ্যার কাহিনি
মিথ্যার আগেও দেখো
কতবার রচিত হয়েছে মিথ পুরাণের ইতিহাস
সত্য আর মিথ্যা
মিথ্যা আর সত্য
কোনটাই কিছু নয়
শুধু খেলা আর খেলা
রাষ্ট্র নায়কেরা তাই দিয়ে বেঁধে রাখে সিংহাসন, মর্যাদা
আর বলি হয় নারীদের
কখনো বা কালী সে কিংবা দুর্গা
কখনো কামদুনি, কখনো মনিপুর কিংবা দিল্লির রাজপথে
শুয়ে থাকা রড গোঁজা দেহ
বারবার কতবার?
কতবার এসব হিংসা দ্বন্দ্ব
ভয় আর দ্বিধা নিয়ে হেঁটে যাব আমি?
কত বার তোমাদের চোখ দিয়ে নিজেকে নিজের কাছে চেনাব, জানব?
কারা তারা? পিতা? ভাই? কিংবা প্রেমিক?
সবাই তো বশীভূত করে রাখে
সবাই আমাকে চায় তার মতো করে
প্রশ্ন করো, প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি আজও
তুমিও দাঁড়াও মেয়ে
প্রশ্ন চিহ্ন হাতে
শুধু মনে রেখো প্রশ্নচিহ্ন হারিয়ে ফেলার মানে
নিজেই নিজের হার মেনে নেওয়া
শরৎজাতিকা আমি
তাই এই শরৎ প্রভাতে
নিজেকে নিজের মতো করে আরেকবার বাঁচাতে চাই
আরেকবার সমস্ত দেবীভাব ভুলে
মন্ত্র স্তোত্রগান ভুলে
সর্বশক্তিমান কিংবা দশভুজা মিথ ভেঙে
এই বোধন প্রাক্কালে
নিজেই নিজেকে বাঁচানোর অধিকার চাই…
ভুল হলো, অধিকার চাই নয়
নতি কিংবা বিনতি নয়
মিনতিকেও ঘৃণার পরতে
চাপা দিয়ে,
অধিকার নিজেই নিজেকে এনে দেব
অকালবোধনে বসে…
নিবিড় বন্ধনে
দুই হাত আজ তাই শিরে রেখে
নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাব…
আর বহু বহু যুগ অতিক্রান্ত
কালী নয়, দুর্গা নয়
কোনো পুরুষের অহংকারে নয়
নাকি প্রয়োজনে…
সাধারণ নারী রূপে, মানুষের রূপে
পূজিত হয়েছি নিজের কাছেই
নিজেরই অধিকারে…
অসাধারণ এক দীর্ঘ কবিতা।