
কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১৪
ধর্ষণের উৎসব, খুনের উৎসব
রূপশ্রী ঘোষ
মানসিক ধর্ষণ তো চলছেই প্রতিনিয়ত প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। তারপরও শারীরিক? মানুষ কেন এত অস্থির? কেন এত যৌন ক্ষুধা? প্রতিহিংসাই কি মানুষকে এ পথে ঠেলে দিচ্ছে? যেখানে একটা ন বছরের মেয়েও রেহাই পাচ্ছে না? তর্কের খাতিরে রাজনৈতিক বা পারিবারিক হিংসা, বিদ্বেষ যদি ধরেই নেওয়া হয়, তাবলে সেই প্রতিহিংসা পর্যবসিত হবে খুন ধর্ষণে? এ কোন দেশ? কোন রাজ্য? কোন গ্রাম বা শহর? কারণ অবাধ যৌনতা আমাদের দেশে তো কবেই শুরু হয়ে গেছে। লুকিয়ে, না লুকিয়ে সব ভাবেই। যারা এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত তারা সব মানুষকেই ধরে নিচ্ছে তাদের মতো একই কাজে বুঝি সবাই লিপ্ত। যাহোক সে তো অন্য বিষয়। কিন্তু এই ধর্ষণ কবে থামবে? কীভাবেই বা থামবে? এ উত্তর কি কারো জানা আছে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা মোমবাতি মিছিলই কি এর শেষ কথা? এগুলো করে ধর্ষক বিদায় হবে? জানা নেই। এমন অনেক প্রশ্নের মাকড়সা মাথার মধ্যে জাল বুনে চলেছে অহরহ। এই পুজো ঘিরেও চলবে কত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু প্রকৃত সংস্কৃতির সন্ধান কে বা কারা দেবে? মেধাবীরাই তো আজ অপসংস্কৃতির সিংহদ্বার। খিড়কি পথ বা চোরাগলিরও প্রয়োজন পড়ছে না। এই বিষয়ে দরজা এত হাট করে খোলা না হয়ে সুস্থ সমাজ, সুস্থ সভ্যতা, সুস্থ মন গড়ার দরজা হাট করে খুললে তো ভালো হয়। কোনো দেব-দেবীর হাতে সত্যিই যদি এ ক্ষমতা থাকত, তাহলে হয়তো এতদিনে সুস্থ মন মানসিকতার জন্ম তিনিই দিতেন। তা যখন হয়নি, দেবীর কাছে অন্তত এটুকু প্রার্থনা থাক যেন, ধর্ষণ আর ধর্ষকের বিসর্জনের মধ্য দিয়ে নিজে বিসর্জিত হন। চোদ্দতম পর্বে লিখলেন রূপশ্রী ঘোষ।
“Rape is about power, not sex. It’s about using force or the threat of it to take control over another person.”
― Michelle Hodkin, The Evolution of Mara Dyer
লেখার নাম লঘু ছলে প্রথমে কিঞ্চিৎ পরচর্চা করা হয়েছে। ঠিক যেমনটা সন্ধেবেলা বা যেকোনো সময়ে পাড়ার বা পরিচিত মানুষ, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাড়ির রোয়াকে বসে বা যেখানেই হোক একত্রিত হয়ে হালকা চালে চর্চা করত, ঠিক তেমনটাই। কিন্তু লেখার বিষয়ে প্রতিদিন মিশে যাচ্ছে রক্ত, যন্ত্রণা, হতাশা, দুঃখ, কষ্ট। এবার শিরোনাম বদলের সময় হল কিনা ভাবতে হবে। আর হালকা চাল কিছুতেই লেখায় স্থান পাচ্ছে না।
পুজো মানে শিশির ভেজা সকাল, হালকা হালকা ঠাণ্ডা, চাদর গায়ে দিয়ে ভোরের অন্ধকারে সন্ধিপুজো দেখা (যদি সে সময়ে পুজো পড়ে), বাচ্চাদের ছুটে বেড়ানো, ক্যাপ বন্দুক, হই হুল্লোড় এটাই বোধহয় আমরা সবাই চাই। বাঙালির সব থেকে বড়ো উৎসব এই দুর্গাপুজো। তাকে ঘিরে আমাদের উন্মাদনা তো থাকেই, এ আর নতুন কী। হ্যাঁ, তবুও এ সময় যে সমস্ত বাড়িতে মৃত্যু ঢোকে সেখানে তাদের বা তার আত্মীয়স্বজনের দুঃখ কষ্ট থাকে ঠিকই, কিন্তু কালের নিয়মে জীবন এগিয়ে যায়। যা ফেরানো যায় না তা নিয়ে তো পড়ে থাকলেও চলে না। তাই জীবন চলে। হঠাৎ কোনো মৃত্যু, অ্যাকসিডেন্ট, বা এমন অসুখ যা চেষ্টা করেও সারানো গেল না, বা হঠাৎ অসুখেও চলে যাওয়া এসব তো লেগেই থাকে। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের যেকোনো অনুষ্ঠানেই এমন ঘটনা ঘটলে সেই পার্বণটা সেই সমস্ত দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাড়ির কাছে প্রত্যেকবারই ভয়ের একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ সবই কাকতালীয় ব্যাপার। এর পিছনে নির্দিষ্ট কোনো বিধি নিয়ম ঠিক করা নেই যে, এই পুজোর আগেই এটা ঘটবে বা ঘটতে হবে। তবে এটা তো সত্যি যে, আমরা আর কেউই এই রক্তস্নাত ভোর, সকাল, দুপুর, সন্ধে, রাত কিছুই দেখতে চাই না। তাই বলে ন বছরের বাচ্চা? তাকে দেখে মানুষের যৌন স্পৃহা জাগে কীভাবে? একজন শিশু জন্ম নেওয়ার পর যেমন থাকে ন, দশ বছরে তার থেকে খুব বেশিকিছু বদলে যায় বলে তো মনে হয় না? এমন লেখা লিখতে চাই না, যেখানে প্রতিদিনই হতাশার কথা লিখতে হয়। এমন দেশ? যেখানে একজন কন্যা শিশুরও রেহাই নেই! উত্তর দিয়ো পুরুষ। আজ গ্রাম একজোট হয়েছে, তারা মশাল হাতে বেরোতে পারছে। কিন্তু এমন অনেক খুন ধর্ষণ আছে কেবল বদনাম হবে এই ভয়ে চাপা দেওয়া হয়। আমারই এক বন্ধুর গাড়ির ড্রাইভারের ছোট্ট মেয়ের ঘটনা। মেয়েটি ছাদে খেলছিল, একটি ষোলো সতেরো বছরের ছেলে মামাবাড়ি ঘুরতে এসে বাচ্চাটিকে রেপ করে। সে নাবালক তার শাস্তি হবে না, আর মেয়েটির বাবা-মায়ের বা তার বাড়ির বদনাম হবে জানাজানি হয়ে গেলে। এতকিছু হিসেব নিকেশ করে এলাকাই ত্যাগ করে গেল তারা। একজন ছেলে যে, ধর্ষণ করতে পারে মানেই তো সে সাবালক বলে পরিচিত হওয়া উচিত। বা যদি নাও হয়, তাহলে আইন কেন বদলানো হবে না? এর উত্তর কে দেবে? অ্যাডোলেশন ঘটে গেলে তার যদি যৌন স্পৃহা জাগে সে যদি বাচ্চা মেয়েকেও না ছাড়ে তার জন্য কিছু শাস্তি তো থাকা উচিত বলেই মনে হয়। শাস্তিটা যদি এমন হত যে, সে যত বছর সাবালক না হচ্ছে ততবছর অন্তত তাকে আটকে রাখা হবে। কারণ একবার সে যেই জেনে গেল তার কিছু হবে না নাবালক থাকাকালীন, ততদিন তো সে একের পর এক শিশুর উপর চেষ্টা চালিয়েই যাবে। হ্যাঁ, খুনটা করবে না এমন গ্যারান্টিও নেই। বড়োরা যেভাবে করছে, বাচ্চা বাড়ি গিয়ে বলে দিতে পারে তাই মেরে লোপাটই করে দাও। ল্যাটা চুকে যাবে ভেবে। কবে আসবে এমন আইন? যেদিনই জানা যাবে কে কাণ্ডটা ঘটিয়েছে তাকে সেদিন থেকে ক্ষণে ক্ষণে ইলেকট্রিক শক দেওয়া? তাদের ফাঁসি হওয়াটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বলে আমার অন্তত মনে হয় না। কারণ ফাঁসি দিলে তো সব শেষ, সে তো মুহূর্তের ঘটনা। মুহূর্তের যন্ত্রণা কাম্য নয়। তাকে প্রতিটা মুহূর্ত বাঁচিয়ে রেখে যন্ত্রণা দেওয়া দরকার। এই শাস্তি এলে হয়তো কিছুটা হলেও ধর্ষণ কমতে পারে কিনা ভেবে দেখা দরকার। কারণ এমন ক্ষণে ক্ষণে দগ্ধ করা দরকার তাদের। আর ফাঁসি তো দেশের স্বাধীনতা আনার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের জন্য। ধর্ষকদের ফাঁসি দিয়ে সেই সমস্ত শহীদদের ছোটো করা হয় না তো? কে জানে। শহীদের মতো মৃত্যু নয়, এরা যেভাবে ধর্ষণ করে খুন করে বা শুধু ধর্ষণ করে, এদেরও সেভাবে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে সবার চোখের সামনে মারা উচিত। যেকোনো ইচ্ছাকৃত মৃত্যুর ক্ষেত্রেই করা উচিত। সেটা একজন মেয়ে বা মহিলাকে মারলেও যেমন আবার একজন বাচ্চাছেলে বা পুরুষকে খুন করলেও তাই। অর্থাৎ খুনি, ধর্ষকদের শাস্তি এমনই কাম্য হোক।
আর একটি ঘটনা, ধর্ষণ নয় খুন। ঠিক পুজোর সময়। আমার চোখে দেখা। খুন করাটা নয়, পরের দিন সকালে বডিটা দেখা। জয়নগরের শ্রীপুর গ্রামে আমার আত্মীয় বাড়ি। দাদা আর দাদার ছোটো শালার সঙ্গে ষষ্ঠীর দিন আমরা যচ্ছিলাম। দাদার শালাকে ছোড়দা ডাকি। বৌদিও ‘ছোড়দা’ ডাকে বলে। ভ্যানে করে যাওয়ার সময় ছোড়দা গল্প করছিল, এই জায়গাটা খুব ভয়ের। এখানে ডাকাতি, খুন সবই হয়। শুনেই গা ছমছম করল। খুবই ডাকাতি হত আগে ওই অঞ্চলে। প্রায় প্রতিদিনই শোনা যেত। যাহোক ভয়ে ভয়ে তাদের বাড়ি তো যাওয়া হল। সপ্তমীর সকালে ঘুম ভাঙল সবার হই হই চিৎকারে। শোনা যাচ্ছিল, বৃহস্পতির (ছেলেটির নাম) বডি ওই জলে ভাসছে। হ্যাঁ, একটা বিশাল বড়ো অশত্থ না বট গাছের তলায় সেই পুকুর। তাকে খুন করে ওখানে জলে ফেলে দিয়ে গেছে। আমরা হয়তো তার ঠিক আগে বা পরে ওই রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। কে করেছে না করেছে তাই নিয়ে অনেক কানাঘুষো চলল। ব্যবসার সূত্রে পারস্পরিক রাগ বা আরো হাজার কারণ যোগ বিয়োগ করে সাধারণ মানুষ সারাদিন কাটিয়ে দিল। পুজো থমথমে হল। শ্রীপুর থেকে কাশীপুর, রামকৃষ্ণপুর আরো যে সমস্ত এলাকা ঘুরে মানুষ পুজো দেখত সেসব দমে গেল। থমথমে মুখ নিয়ে সবার পুজো কাটল। খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা ফিরলাম। ওখানে সবার মুখে মুখে একটাই কথা ছিল এসব ডমিন্যান্ট দলই করাচ্ছে। তারা সব জানে। তাই কথায় কথায় এত ডাকাতি, খুন এসব লেগেই থাকে। ওদিককার প্রতিটি গ্রামই খুব সুন্দর। ঘন সবুজ গাছে ঢাকা। বাড়িঘর প্রায় দেখা যেত না। মনে হত শুধুই গাছে ঘেরা গ্রাম। নারকেল, সুপারি, সবেদা, আম, জাম, জামরুল থেকে শুরু করে কী নেই সেইসব গ্রামে। ইট আর পিচের ছায়াঘেরা পথ দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগত। কিন্তু সন্ধে হলে ভয়ও করত। এই লালের কারণে প্রায় দিনই লাল হয়ে উঠত গ্রামগুলো। এখনকার পরিস্থিতি একদম অজানা। সবুজের কারণে সবুজ লাল হয়ে উঠছে শোনা যাচ্ছে। আগের থেকে সংখ্যায় কম কিনা খোঁজ নেওয়া হয়নি। কিন্তু কবে থামবে রক্ত, হুমকি, চোখ রাঙানি? আরামবাগ, বাঁকুড়ার দিকে গ্রামগুলো এত ছায়াঘেরা সবুজ ছিল না। এখনও নেই। কিন্তু ছোটোবেলায় ওই লালের দাপট দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি। ওখানেও একদিন স্কুল যাওয়ার পথে দেখতে হয়েছিল একটি অচেনা মেয়েকে দূরের গাছে মেরে ঝুলিয়ে দিতে। সেই মেয়ের পরিচয় আজও কেউ জানে না। এত ভয়, এত আতঙ্ক এই ভবিতব্য নিয়েই কি তাহলে জীবন শেষ হবে? ভয় নানাভাবেই আসে জীবনে। বাড়ির ক্ষমতারাও হুমকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে। এই সমস্ত ধরনের ভয়ের শেষ কোথায়? মানুষ কেবল মানুষকে ভয়ই পাবে? আট থেকে আশি প্রতিটি বয়সের স্ত্রীলিঙ্গের ভবিতব্যই এটা?
তাহলে যেকোনো ঘটনার পিছনেই যদি এমন শাসক দল কলঙ্কিত হয় তাহলে গণতান্ত্রিক দেশে এর থেকে লজ্জার আর কীই বা হতে পারে। আমরা কবে এমন দল দেখব? যারা ক্ষমতায় এসে নিজেরা ক্ষমতা হয়ে যাবে না? কবে তাদের গায়ে কলঙ্ক লাগবে না? এরকম ঘটনা যদি পারস্পরিক রাগ থেকেও কোনো মানুষ ঘটিয়ে থাকে তাদের শাস্তির ভার তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শাসক দলের নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া উচিত। কেন এত অপেক্ষা? কেন এত নৃশংস ঘটনা দিনের পর দিন দেখতে হবে? আসলে মানুষকে শিক্ষিত করার দায়িত্বও তো শাসকের নিতে হবে। যে সমস্ত দল ক্ষমতায় থেকে অন্যায় করেছিল তাদের শাস্তি না দেওয়াটাই অন্যদলের ভুল পদক্ষেপ। তাদের শাস্তি দিলে ক্ষমতায় থাকা দল এত অত্যাচার চালিয়ে জেলে যেত না। আগের দলের অন্যায়কারিদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হত। আর যাইহোক না কেন এটাকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিও বলতে দ্বিধা হয় মানুষের।
পুজো আসে পুজো যায়। মৃত্যুও আসে। বাড়িতে ফোন করলে আমিও আমার মেজোমার বুকফাটা হাহাকার শুনি। কিছুদিন আগেই বড়ো ছেলেকে হারাতে হয়েছে। কিন্তু তাই বলে গ্রামে পুজো থেমে থাকবে না। প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক সব নিয়মকেই মেনে নিয়ে আমাদের এগোতে হয়। হ্যাঁ, হয়তো পুজো একটু ম্রিয়মান থাকবে। বাড়ির মানুষের মন খারাপ থাকবে। এমনিতেও গ্রামের পুজোয় আড়ম্বর সেভাবে থাকে না। অষ্টমীর দিন ছাড়া পুজো সেভাবে বোঝাও যেত না। ওইদিনই বাড়ির ছেলে থেকে বুড়ো, মেয়ে থেকে বউ সবাই একটা গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম ঘুরে ঠাকুর দেখতে যেত হেঁটেহেঁটে। দূরে কোথাও ঠাকুর দেখা মানে বাড়ির বড়োরা আয়োজন করে নিয়ে গেলে তবে, তার আগে নয়। এখন হয়তো ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়েছে। টোটো, অটো, বাইক, সেই সঙ্গে ভালো রাস্তার কারণে বাড়ির মেয়েরা দল বেঁধে নিজেরাই একটা গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে পারে। আগে পারত না। আমি কোনোদিন রামনগর, খানাকুল, রাজহাটি, আরামবাগ এসব শহর মফস্সলের ঠাকুর দেখিনি। ঠাকুর দেখা বলতে ওই নিজের গ্রাম আর পাশের গ্রাম। তাও বাড়ির বড়োদের হাত ধরে। ওই অষ্টমীর দিনটাই গ্রামে সব মানুষের কাছেই যেন মিলনমেলা ছিল। ঠাকুর দেখতে গিয়ে একে অপরের বাড়িও যেত হাতে সময় নিয়ে। সব থেকে বড়ো কথা পুজোয় নতুন জামা হবে কিনা সেটাও যতদিন না দিচ্ছে তার আগে পর্যন্ত টের পাওয়া যেত না। পুজোর আড়ম্বর শহরে এসে দেখা। বহু আগে থেকে জামাকাপড় কেনা, কোনদিন কোনটা পরবে ঠিক করে রাখা, ম্যাচিং ব্লাউজ কেনা, জামা বানাতে হলে বহু আগে দর্জিকে দিয়ে দেওয়া এসব শহরে এসেই দেখা। এখন গ্রামেও হয়ে গেছে। একটার জায়গায় দশটা পোশাক আগে থেকেই এসে যায়। এবং শহরের মতোই ক্ষমতা অনুযায়ী আত্মীস্বজনকেও জামাকাপড় দেওয়া হয়। আমিও ওই ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় বাড়তি জামা পেয়েছিলাম দাদার শ্বশুরবাড়ি থেকে। কিন্তু পুজোর অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। খুনটা ঘটার জন্যই। থমথমে মন নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল।
প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপের বিরুদ্ধে মানুষের কিছু করার থাকে না। করোনার মতো মহামারিও অনেক মানুষ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সেখানে মানুষ অসহায়, লকডাউন, মাস্ক, স্যানিটাইজার, কোয়ারেন্টাইন বা দূরত্ব বিধি মানা, ডাক্তারদের প্রচেষ্টা সব মিলেমিশে একটা মাহামারি সামাল দিতে দু বছর লেগে গিয়েছিল। ভূমিকম্প, ঝড়, বন্যা এসবদের বিরুদ্ধেও কিছু করার থাকে না মানুষের। কিন্তু যেগুলোয় করার থাকে, যে মৃত্যুগুলো বন্ধ করা গেলেও করা যেতে পারে, সেগুলোর প্রচেষ্টা কবে শুরু হবে? সমস্ত মানুষকে নম্বর দিয়ে নয়, প্রকৃত শিক্ষিত কবে করা হবে? হাজার হাজার প্রশ্ন মাথায় ঘোরে। এতটাই আতঙ্কে কাটানো মানুষ যে, জার্মানি গিয়েও প্রথম প্রথম রাস্তায় একা বেরোতে, মাতাল দেখে ভয় পেতাম। তারপর ওখানকার কালচার জানার পর মনে হয়েছিল কবে এমন দেশ আমরা পাব? ‘এমন দেশটি কোথাও পাবে নাকো তুমি’ সেখানে তো এই দেশের কথা বলা হয় না। আমরা সকল দেশের ‘সেরা দেশটা’ সত্যিই এবার চাই। যে সময় এ গান লেখা তখনও সেরা ছিল না, তবুও লেখা হয়েছে। এবার আর তবুও লেখা নয়, সত্যি সত্যি সেরা দেশ হোক। এটাই বাঞ্ছনীয়।
মানসিক ধর্ষণ তো চলছেই প্রতিনিয়ত প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। তারপরও শারীরিক? মানুষ কেন এত অস্থির? কেন এত যৌন ক্ষুধা? প্রতিহিংসাই কি মানুষকে এ পথে ঠেলে দিচ্ছে? যেখানে একটা ন বছরের মেয়েও রেহাই পাচ্ছে না? তর্কের খাতিরে রাজনৈতিক বা পারিবারিক হিংসা, বিদ্বেষ যদি ধরেই নেওয়া হয়, তাবলে সেই প্রতিহিংসা পর্যবসিত হবে খুন ধর্ষণে? এ কোন দেশ? কোন রাজ্য? কোন গ্রাম বা শহর? কারণ অবাধ যৌনতা আমাদের দেশে তো কবেই শুরু হয়ে গেছে। লুকিয়ে, না লুকিয়ে সব ভাবেই। যারা এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত তারা সব মানুষকেই ধরে নিচ্ছে তাদের মতো একই কাজে বুঝি সবাই লিপ্ত। যাহোক সে তো অন্য বিষয়। কিন্তু এই ধর্ষণ কবে থামবে? কীভাবেই বা থামবে? এ উত্তর কি কারো জানা আছে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা মোমবাতি মিছিলই কি এর শেষ কথা? এগুলো করে ধর্ষক বিদায় হবে? জানা নেই। এমন অনেক প্রশ্নের মাকড়সা মাথার মধ্যে জাল বুনে চলেছে অহরহ। এই পুজো ঘিরেও চলবে কত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু প্রকৃত সংস্কৃতির সন্ধান কে বা কারা দেবে? মেধাবীরাই তো আজ অপসংস্কৃতির সিংহদ্বার। খিড়কি পথ বা চোরাগলিরও প্রয়োজন পড়ছে না। এই বিষয়ে দরজা এত হাট করে খোলা না হয়ে সুস্থ সমাজ, সুস্থ সভ্যতা, সুস্থ মন গড়ার দরজা হাট করে খুললে তো ভালো হয়। কোনো দেব-দেবীর হাতে সত্যিই যদি এ ক্ষমতা থাকত, তাহলে হয়তো এতদিনে সুস্থ মন মানসিকতার জন্ম তিনিই দিতেন। তা যখন হয়নি, দেবীর কাছে অন্তত এটুকু প্রার্থনা থাক যেন, ধর্ষণ আর ধর্ষকের বিসর্জনের মধ্য দিয়ে নিজে বিসর্জিত হন। মাটির মূর্তি জলে গুলে যাওয়ার মতোই গুলে যাক ধর্ষণ এবং ধর্ষক উভয়েই। পুজো যার যেমন কাটানোর কাটান। সরলীকরণ করে পুজো সবার ভালো কাটুক বলা অনুচিত। সবার জন্য এটুকু কামনা করাই যায় এমন দুর্ঘটনা, এমন অন্ধকার দিন, রাত যেন কারোর জীবনেই আর না আসে। ধর্ষণ আর ধর্ষকের বিসর্জন দিয়েই পুজো শেষ হোক। যাতে আগামীর পুজোয় সবাই উৎসবে মেতে উঠতে পারে। ‘উৎশবে’ নয়।