
সৌমী গুপ্ত-র কবিতা
মৃগশিরা
এসো,এইখানে দুদণ্ড বসো,ছায়াপথ থেকে নেমে এসেছে অন্ধকার, স্তিমিত আলো আকাশে উঠোনময়। অন্ধকারের আলপনায় নিকোনো বাতাবী লেবুর বাগান থেকে সুবাস বয়ে আনছে তুলসী মঞ্চের কম্পিত প্রদীপ।তোমার চোখ থেকে অভিযাগ তুলে নাও, ঠোঁট থেকে অভিমান। এসো আমি ধীরে ধীরে সব শব্দসীমা খসিয়ে, পূর্ণতা সরিয়ে দুই হাতের পরিসরে যে শূন্যতা ঘনিয়ে আছে তাকে জড়িয়ে ধরি।এক অভূতপূর্ব লগ্নে নক্ষত্র মৃগশিরার দেখা মিলবে জানি,ঠিক সেই মুহূর্তে আমি তোমার ওষ্ঠ স্পর্শ করব তোমার ইচ্ছেপূরণের মন্ত্রোচ্চারণের আগেই।
অর্থবহ
একটু চুপ করো। কোলাহল ব্যস্ততা পেরিয়ে নির্জন অন্ধকারে শীতের সন্ধ্যায় শিশিরের শব্দ খরচ করা আকাশ, শূন্য সাদা মেঘ, ক্রন্দসী কিংবা যা কিছু বেহিসাবি, নিরর্থক অব্যয় সব সরিয়ে পাশে বসো। বিকেলের ম্লান আলো মুছে দেবে শেষ কথোপকথোন, অতলান্ত সমুদ্র থেকে ঢেউ গোণা অসম্ভব জেনেও পাশাপাশি বসি চলো, আমরা আদরের স্বরলিপি বিছিয়ে দেব স্বৈরিনীর ঢেউতোলা জলে —নিঃশব্দে। পৃথিবীর যাবতীয় লেনদেন,নম্র জোনাকী আলো, এতখানি সাদা মেঘ, সবটুকুর নীরবতাই কখনও কখনও শ্রেষ্ঠ উপায় জানি!নিঃশর্ত প্রেমের নিকট নীরবতার চেয়ে অর্থবহ আর কিছু ছিল কি কখনও?
শূনো মন্দির মোর
আকাশ উপুড় করা কান্নাজলে ধুয়ে যায় যখন দিগ্বলয়, আমার অতলান্ত সমুদ্র মনে হয়। গভীর নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে, শনশন বাতাসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস অরণ্যের গভীরে ঘুরে ঘুরে ফিরে এসে প্রতিবিম্বিত হয় চার দেওয়ালে, শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ভরা বরষায়। শ্রীরাধিকা চুপ করে বসে থাকে অপেক্ষায়—অথচ পরিশেষটুকু অজানা ছিল না কখনোই। এ এক অনন্ত অপেক্ষা,উদ্যম নয়, আলো নয়, অন্ধকারও নয়, শান্তি ও স্থিরতার মাঝে শূন্য মন্দিরে এ এক দীর্ঘ অক্লান্ত অপেক্ষা —যার যন্ত্রণা প্রবহমান ।।
ভয়
সারারাত আমি বসে থাকি অপেক্ষায়, শব্দরা ধুলোখেলা করে, ছুটে বেড়ায়, আলিঙ্গন করে, আমি ধরতে যাই! জোৎস্নায় ধুয়ে যায় অক্ষরসমষ্টি, পিছলে যায় অব্যয়।আমি কবিতা লিখতে চেয়ে ব্যর্থ হই বারবার। রক্তে ধৈর্য্য ধরে রাখা যায় না, শোণিতধারা নেমে আসতে চায় মাসের নির্দিষ্ট দিনের আগেই। কবিতা খরচ হয়ে যায়, কত বিনিদ্র রাত চুম্বনে, আদরে, আহ্বানে শরীরে স্নানধারার মতো বেয়ে নেমে যায় অক্লেশে। শুধু অক্ষরের অভাবে আমি নীরব হয়ে থাকি কতশত রাত। আমার ভয় লাগে, শীত করে। অর্ধেকের বেশি চলে যায়, চলে যায় রাত্রি। পাতার পর পাতা শুধু কবিতা খুঁজতে গিয়ে একটা নিঃশঙ্ক ভয় আমাকে গ্রাস করে নেয়।
বিচ্ছিন্ন
এক একদিন তোমার জন্য খুব মন খারাপ লাগে
আমি নিঃসীম শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরতে পারি না
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না নিশ্চুপ হয়ে
ভাবি সব অভিযোগ তুলে নেব, বিনিময়ে দেব সমস্ত অভিমান
দূরে আকাশে উড়ে যায় বলাকারা , দলছুট পাখিটা ঠিক আমার মত
আমার তোমার কথা মনে পড়ে তখন
অথচ দেখো আমরা যখন একসঙ্গে ছিলাম আমরা শুধু নিজের কথা ভেবেছি, বলে গেছি নিজেদের প্রয়োজন!
এই ভাল বরং। আমরা আলাদা আছি, আলাদাই থাকি চলো! অন্তত আমাদের দুজনের কথা ভাবার দুটি মানুষ থাকবে!