
কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১০
পচা গলা সমাজের বদল চাই
রূপশ্রী ঘোষ
কোটি কোটি সাধারণ মানুষ আজ রাস্তায়। তাঁরা পেশার বা আর্থিক অবস্থার বিচার করবেন না, এটাই আশা করা যায়। সব মেয়ের জন্যই হাতে প্রদীপ, মোমবাতি, শাঁখের আওয়াজ শোনা যাক।কারণ এ ঘটনা থামার নয়। সব আমলেই ঘটে চলেছে। এই ঘটনার শাস্তি জোরদার হলেও আবার ঘটবে। সে সময়ের জন্যই প্রশ্ন রইল। তখন সাধারণ মানুষ এত সক্রিয় হবেন নাকি মানুষকে ক্রমাগত এই ছোটো করাই দেখতে হবে? আশা করি, তা হবে না। কারণ তিলোত্তমার জন্য সাধারণ মানুষের এই আন্দোলনের ফলে চেতনার স্তরে বিপ্লব হবে, এটাই আশা করা যায়। আন্দোলন, বিক্ষোভের ফলে মানুষের চেতনার স্তরে পরিবর্তন হয়। এই বিক্ষোভ মানুষের অন্তরকে আলোকিত করুক। সমাজের সমস্ত বৈষম্য দূর করে দেওয়ার সামগ্রিক এক আন্দোলনে মিশে যাক এই আন্দোলন। মানুষকে অপমান করা, ছোটো করা, কথায় শব্দে মানুষকে ধর্ষণ করা, মানুষের মুখ ম্লান করে দেওয়া, ধর্ম দিয়ে, জাতি দিয়ে, লিঙ্গ দিয়ে সমাজে বৈষম্য তৈরি করা, গোটা সমাজটাকেই এক জঘন্য পচা গলা ব্যবস্থায় পরিণত করে দেওয়া এই সময়ের অবসান হোক। মানুষের আন্দোলনই গড়ে তুলুক এক বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। তিলোত্তমা হয়ে উঠুক সেই পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা। তার জন্য যদি আগুন জ্বলে ওঠে, যদি আমাদের তথাকথিত স্থিতাবস্থা ভেঙে যায়, তো যাক।
পচা গলা সমাজে একাই লড়ব
– শুভ তুমি বিয়ে করেছ
– না
– কেন করোনি?
– কাকে করব? মেয়েই তো পাচ্ছি না।
– কেন? প্রেম করোনি?
– না, মেয়েই কমে গেছে। আর মেয়েদের যা চাহিদা। তারা আমাকে পছন্দ করবে কেন?
– কেন? মেয়েরা কী চায়? মানে তোমার কাছে কী চেয়েছে?
– না, মানে তাদের ভালো চাকরি, উচ্চ পদ, স্ট্যাটাস তেমন হতে হবে। আমি তো তেমন নই।
– কেন? তুমি তো দেখতে খারাপ নও। লেখাপড়াও করেছে যথেষ্ট। গ্রাজুয়েট। নিজের গাড়ি আছে। গাড়ি চালিয়ে ভালোই আয় হয় তো নাকি?
– হ্যাঁ, সেটা ব্যাপার না। আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করিনি। পার্ট টু পর্যন্ত পড়েছি। কিন্তু আমি তো ড্রাইভার। ড্রাইভার পেশায় মেয়েরা কেন পছন্দ করবে?
এই কথোপকথনটা কানে এল। ড্রাইভার ছেলেটির পেশা ড্রাইভারি, তাই মেয়েরা পছন্দ করছে না। সে কোন ধরনের মেয়েকে পাত্রী হিসেবে চেয়েছে সেটাও কিন্তু একটা প্রশ্ন। কারণ যদি পেশায় ডাক্তার, শিক্ষক, আই পি এস অফিসার, কর্পোরেটে জব করা, বা কোনো সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মী হন, তাহলে কি শুভকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে? মনে হয় না। ঠিক একইভাবে যদি উল্টোদিকটাও দেখা যায় তাহলে আমরা দেখি ছেলেরাও এমন মেয়ে দেখতে গিয়ে মেয়েকেও বাজিয়ে নেন বা নিতেন। উভয় তরফের বাজিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা আছে বলেই পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনগুলো অমন হয়। গৃহকর্মে সুনিপুণা, ফর্সা, সুন্দরী, কর্মরতা ইত্যাদি প্রভৃতির সঙ্গে আবার জাত-পাতও ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ, মাহিষ্য, সদগোপ সব বলে দেওয়া হয়। প্রেম করে বিয়ের হুজুগের আগে তো বাড়িতে মেয়ে দেখতে যাওয়া হত। তার চলন বলন, চুল, গায়ের রঙ, কী কী কাজ জানে, বোনাবুনি, রান্নাবান্না পারে কিনা এবং সর্বোপরি হাতের লেখা। ভানটা এমনই হাতের দেখা ভালো হলে যেন কোনো অফিসের উচ্চপদে নিয়োগ করবেন বউ করে নিয়ে গিয়ে। খুব ছোটোবেলায় শোনা গল্প, থুড়ি গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। পাশের গ্রামের এক বয়স্ক মাস্টারমশাই গল্প করতেন তাঁর মেয়ের সম্বন্ধ দেখা নিয়ে। তিনি বেশ মজা করেই গল্পটা করতেন, বিয়েটা কেন ভেঙে গিয়েছিল সেই বিষয়ে। বলতেন, ‘মেয়েকে দেখতে এসেছিল। পাত্রপক্ষর লোক সবকিছু জানার পর যখন হাতের লেখা দেখতে চাইলেন, মেয়েকে বললেন নাম ঠিকানা লিখে দিতে। ব্যাস, মেয়ে আমার বড়ো বড়ো অক্ষরে নিজের নামটা লিখে দিল ‘দপালী’। সে বিয়ে কি আর হতে পারে? মত নেই জানিয়ে দিয়ে চলে গেলেন’। বানান দেখে আপনারা আশাকরি বুঝেছেন মেয়ের নাম কী? এছাড়াও মেয়েকে হেঁটে দেখাতে হত খোঁড়া কিনা বোঝার জন্য। তার চুল দেখা হত কতট লম্বা। কিন্তু তারমানে এই নয় যে, ঘন কালো লম্বা চুল হলে তাকে নিয়ে গিয়ে কোনো নামি দামি কোম্পানির তেলের বিজ্ঞাপন দেওয়ানো হবে। দেখতে গিয়ে আবার বোকা বোকা প্রশ্নও করত। আমার এক পরিচিতরই অভিজ্ঞতা, তাকে দেখতে গিয়ে ছেলের দাদা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আচ্ছা বলতো, দরজায় এক ভিখারি এসে তোমাকে জল চাইছে আর এদিকে তুমি উনানে দুধ বসিয়েছ। একটু এদিক ওদিক হলেই দুধটা উথলে পড়ে যাবে। তো তুমি কোন কাজটা আগে করবে? আগে দুধটা উনান থেকে নামাবে নাকি আগে ভিখারিকে জল দেবে’? প্রশ্নটা শুনে আপনাদের কী হচ্ছে জানি না, কিন্তু ওই ছোটো বয়সেই ওটা শোনার পর আমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা কিন্তু কলকাতার লোক ছিলেন। যাহোক এরকম বোকা বোকা অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই অনেক আছে। প্রশ্ন সেটা না। প্রশ্ন হল পেশার ভিত্তিতে মানুষকে ছোটো করা। একজন মানুষ নিজে গায়ে গতরে খেটে আয় করছে। কোনো চুরি চামারি করা পয়সা না, তাতেও সে মেয়ে পাচ্ছে না। আবার একইভাবে উল্টোটাও ছেলেরা নিজেদের পছন্দমতো মেয়ে না হলে বিয়ে করবে না। কিন্তু বিয়ের পর কী হয় তার হিসেবটা একটু নেওয়া যাক। যে যেই পেশার মানুষ তাকে কীভাবে সম্বোধন করা হয় সেটা নিয়ে না হয় আর একদিন লেখা হবে, এই যেমন রিক্সাচালক, বাড়ির পরিচারিকা, কুলি, আয়া এসব হলে তাদের ‘তুই’ বলা। বেচারিদের ভাগ্যে ‘তুমি’টুকুও জোটে না সবসময়। বা তাদের চায়ের কাপ, বিস্কুট, বাথরুম, খাবার থালা আলাদা করে দেওয়া এসব তো ছেড়েই দিলাম। এবং এই কাজের লোকরাও কেমন সব মেনে চলেন, তাদের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে ডাকলেও কিন্তু আসে না। সমাজ তাদের মাথায় এমনভাবেই ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, যেন ‘মনিবের'(বা, বাবু) সঙ্গে পাশাপাশি বসে খেতেও নেই। এই প্রসঙ্গে আর একটা সত্যি ঘটনা, হেয়ার স্কুলে পড়া একজন শিক্ষিত ছেলে চাকরি বাকরি না করে ট্যাক্সি চালান, ট্যাক্সির ব্যবসাতেই তাঁর আয় এমন পর্যায়ে যে, শহরের নামকরা প্রাইভেট স্কুলে মেয়েকে পড়াতে পারছেন। মেয়ের স্কুলে গিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার পরিচয় গোপন করতে হয়। নাহলে মেয়েকে স্কুলে অপদস্থ হতে হবে বা মেয়ের বন্ধু বান্ধবদের বাবা মায়েরাও মেয়েটির সঙ্গে বা তার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলবে না, মিশবে না এমন ইত্যাদি ভয় তাড়া করে। আরও অবাক করা বিষয় হল, এই ড্রাইভার যখন একদিন তার ক্লাসে বসা বন্ধুটির ড্রাইভার হয়ে তাকে এক বক্তৃতা সভায় নিয়ে গেলেন, পূর্বপরিচিত বন্ধুকে তুই থেকে তুমি বলতে শুরু করেছেন। এবং কারণ জানতে চাওয়ায় ইতস্তত বোধ করে কেমন একটা আমতা আমতা স্বরে বলেছেন, মানে বুঝতেই তো পারছ আমি এখন ড্রাইভার। এবং সেই বন্ধু তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য অনেক রিকোয়েস্ট করেছিলেন যে, ‘আমার সঙ্গে তুমি ওপরে চলো। শুনবে। তুমি তো এসব বোঝো’। বন্ধু যার পর নাই চেষ্টা করেও বিফল। সেই একই আমতা আমতা সুরে উত্তর, ‘না মানে বুঝতেই তো পারছ, আমি এখন ড্রাইভার। আমার ওসব জায়গায় যেতে লজ্জা করে’। অর্থাৎ সমাজ এভাবেই তাঁদের মানসিকতায় গেঁড়ে বসে আছে যে, যে যেমন পেশার মানুষ তাঁ গন্তব্যস্থলও তেমন হওয়া উচিত। অথচ উচ্চপদস্থ হলে তাঁর গমন যত্রতত্র হতে কোনো বাধা নেই। তিনি যা খুশি করতে পারেন, যেখানে খুশি যেতে পারেন সেটা তাঁদের মর্জি। পেশায় ডাক্তার, শিক্ষক প্রফেসর হয়ে বাথরুম পরিষ্কারও করতে পারেন আবার বেশ্যালয়েও যেতে পারেন। কিন্তু উল্টোটা হলে সমস্যা হতে পারে বা তাঁরাই সাহস করেন না। লোকে কী ভাববে বলে নিজেদের গুটিয়ে নেন।
এই যেমন এবার বাবুদের কথায় আসা যাক। এই মানুষগুলো যাঁরা দিনরাত বাবুদের বাড়িতে সেবা দেন সেখানে কিন্তু কোনো গা ঘিনঘিন ব্যাপার লক্ষ করা যায় না। কারণ তাঁদের হাতেই রান্না করা খাবার খেয়ে, তাঁদের মাজা বাসন দিয়ে, তাঁদের করা ‘ডাস্টিং’, ঘর মোছা ঘরেই কিন্তু বাবুরা কাটান। মুশকিল অন্য জায়গায়। ধরুন এত দেখেশুনে ঘটা করে বিয়ে করে আনেন তো, তারপর সেই মেয়েটির প্রতি কী আচরণ দেখা যায়? দেখা যায়, একজন মেধাবী, উচ্চপদস্থ কর্মী, শিক্ষক, প্রফেসর, অভিনেতা, শিল্পী যেই হন না কেন এমন গালভরা পেশায় থেকে কিন্তু সুযোগ পেলেই লোভ দেখিয়ে একপ্রকার শোষণ করেই পরিচারিকার সঙ্গে যৌন সহবাস করতে ছাড়েন না। বা এটা পাইয়ে দেব ওটা পাইয়ে দেব লোভ দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে যৌনতা করেন। তখন কিন্তু সেই মেয়েদের গায়ের গন্ধ, তাঁদের পেশা কোনোকিছুই ম্যাটার করে না। সুযোগ পেলেই বাড়ির বাবুটি হয়ে সদ্ব্যবহার করে দেন।
এখানে বিবাহিত, অবিবাহিত সুবিধাবাদী নারী পুরুষদের কথা হচ্ছে না। কারণ সেখানে দুতরফেরই মদত থাকে। বাব্বা! ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল’। তুমিও কিছু যৌন ভিডিও পাঠাও আমিও কিছু পাঠাব, বা তুমিও লুকিয়ে আমার ফ্ল্যাটে আসবে, আমিও যাব। তোমার পাশের লোক টেরটি পাবে না। এমন হলে আমরা যৌনকাজে লিপ্ত হব। মুশকিল তখনই এই ধরনের পুরুষ বা নারীরা যখন নিজের আয়নায় তার পাশের লোকটির গায়ে কাদা ছেটায়। ভাবে, ‘আমরা এই কাজ করি যখন তারাও এটা কী আর করে না। শুধু কী ভালো বন্ধু’? এ এক অদ্ভুত সাইকোলজি। বাড়ির লোকটি এমন উদ্দাম হলে চলবে না। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে এমন উদ্দাম পুরুষ বা মহিলার সঙ্গেই মিশতে হবে। ধরো যে সমস্ত পুরুষ বা নারী সাবলম্বী, একা একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে, মিছিলে গলা ফাটায়, যৌনতা নিয়ে ছুঁচিবাই নেই, বাড়ির বাইরে এমনি লোক দরকার কিন্তু তোমার ঘরের বউটি বা বরটি হবে লক্ষ্মীমন্ত, ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানবে না, এবং তোমার কুকীর্তি জানা সত্ত্বেও তোমার মুখোশ গোপন করবে এমনটাই চাই। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন সত্যিই টাকার লোভে বা কাজের লোভে ওই ফাঁদে পা দিয়েই থাকেন। আর কিছু মানুষ আছেন শুধু ভয় দেখিয়েই তাদের ভোগ করে নেওয়া হয়। মুখ খুললে মেরে দেওয়ারই হুমকি দেওয়া হয়। যেভাবে একজন মেধাবী, উচ্চপদে নিযুক্ত মেয়েকে হতে হল। এমনটাই সর্বত্র ঘটছে। যাদের সাহস আছে ফাঁস করছে যাদের নেই তারা করছে না। বিচার টিচার নিয়ে পরের কথা। এই প্রতারণার ফাঁসটাই তো সঠিকভাবে হচ্ছে না। প্রতারকদের মুখোশ লুকোনোর ভারও উভয় তরফ থেকেই নিজের হাতে রেখে দিচ্ছে। তবে সমাজে এটা মেয়েরাই বেশি করছে। তারাই সংখ্যায় বেশি প্রতারকদের মুখোশ লুকোনোর দায়িত্ব নির্বিকারে, নিঃশব্দে পালন করে চলেছে। আগেকার দিনে কী ছিল, বাড়ির বাবুটির রাঁড় বা উপপত্নী থাকে, বাগানবাড়ি, বাইজিবাড়ি যান কিন্তু ঘরের বউটি জানেন। কষ্ট পেলেও সব সহ্য করে মেনে নিয়ে কাটিয়ে দিতেন। এখন মেয়েরা কাজে বেরোয় তাই ব্যাপারটা কম বেশি কাছাকাছি সংখ্যার হলেও একই ব্যাপার ঘটেই চলেছে। তফাৎ এখানে, এখন ডিভোর্স বেড়েছে, মেয়েরা অনেক ভোকাল হয়েছে। সবাই বলব না। কারণ এখনও এমন বহু মেয়েই আছেন উচ্চপদে চাকরি করে, প্রভূত পরিমাণ টাকা আয় করেও বাচ্চার গায়ে যাতে কলঙ্ক না লাগে সে কথা ভেবে অত্যাচার সহ্য করে চলেছেন। আরে এসব সহ্য না করে বাচ্চাকেও বোঝানো উচিত তার বাবা কেমন। মায়েরা অমন হলে তো তাঁরা নিজেরাই বেরিয়ে যান কাউকেই পরোয়া করেন না। কিন্তু এমন বহু মেয়ে আছেন শুধু মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করে চলেছেন। এবং একের পর এক কুকীর্তি দেখা সত্বেও কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উলটে তাদের মুখোশ ঢেকে চলেছেন। সবই কেমন যেন ওই উপরওলার হাতে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার মতো। তিনিও যে কিছু করতে পারেন এটা ভাবতেই পারেন না এখনও বা ভাবলেও করেন না।
এগুলো কিন্তু একেবারেই গল্পে পড়া বিষয় নয়। একেবারে জলজ্যান্ত, টাটকা অভিজ্ঞতা, যা আপনারাও প্রতিনিয়ত শুনছেন এবং দেখছেন। আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি যাঁরা কবি, শিক্ষক, প্রফেসর, শিল্পী যারা জোর করে পরিচারিকাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত। পরিচারিকার বাইরেও, আপনারাও জানেন। পরিচারিকা ছাড়া ঘরের বাইরে অন্য যেকোনো মেয়ের কথা ধরলে তো উদাহরণে উপন্যাস হয়ে যাবে। এবার এগুলোর ভিত্তিতে ভালো খারাপ বিচার করবেন কীভাবে? শুভ ড্রাইভার হয়ে কোনো সামাজিক ক্ষতি না করে খারাপ? নাকি সন্দীপ ঘোষের মতো মেধাবী, সামাজিক সেবার মতো পেশার লোক হয়ে খারাপ? আবারও একটা কথা সন্দীপ ঘোষ কিন্তু একটা নাম। এমন হাজার হাজার সন্দীপ চারপাশে বিরাজমান। মেধাবীও বটে। ঠক বাছলে গাঁ উজাড় হবেই। এবার পেশার ভিত্তিতে যদি একটু অন্যভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই তাহলে কী দেখা যায়? দেখা যাক আজ ডাক্তারি পেশায় নিযুক্ত যে মেয়ে রেপ এবং খুন হল, যার জন্যে আমরা কোটি কোটি মানুষ চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করছি, আমরা কি এমনভাবে একজন পরিচারিকার জন্য যিনিও সামাজিক সেবা দেন, তাঁর জন্যেও এগিয়ে আসব? এখানেই প্রশ্ন। এটাও কি পেশার ভিত্তির উপর নির্ভর করছে, নাকি, এমন ঘটে যাওয়া ঘটনায় সব মেয়েই তিলোত্তমা বা গ্রামসুন্দরী হবেন? কারণ এমন ঘটনা গ্রামে অহরহ ঘটেই চলেছে। গলা কেটে, গলার নলি কেটে রেপ করে ধানখেতে ফেলে দিয়ে যায়। আরজি করের মেয়েটির জন্য গ্রাম থেকে শহর, দেশ থেকে বিদেশ সর্বত্র প্রতিবাদ হচ্ছে। আমার গ্রামের লোকজনকেও মোমবাতি হাতে অন্ধকারে হাঁটতে দেখা গেছে। কিন্তু আগামী দিনে ওই গ্রামের লোকরাই তার পাশের বাড়ির মেয়েটির জন্য বা কলকাতা শহর, দেশ, বিদেশের লোকরা হাঁটবেন তো? সত্যিই মানুষের চেতনায় পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষকামের নিবৃত্তির জন্য লড়াই শুরু হলে, এমন ঘটনাকেই আমরা আটকে দিতে পারি।
আরজি কর বলে সবাই খবরটা পেয়েছেন, গ্রাম বলে খবর পান না তা কিন্তু আজকাল বলা যাবে না। প্রিন্ট মিডিয়া, ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে কিন্তু সব খবরই আজ সবার কাছে পৌঁছে যায়। সবাই সব জানতে পারেন। তাহলে কি এটা আশা করা যায় যে, আমরা গ্রাম, শহর, গরিব, বড়োলোক, পেশার মান এসবের বিচার না করে সমস্ত মেয়ের জন্য গলার স্বর উঁচু করব? ‘চিৎকার কর মেয়ে’ বলব? অরিজিৎ সিংয়ের গান পাব? কবিতা লিখব? বা যেকোনো লেখা? নাকি এখানেও পেশার ভিত্তিতে, আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে কিছু মানুষের জন্য প্রতিবাদ হবে আবার কিছু মানুষের জন্য কিছুই হবে না? কোটি কোটি সাধারণ মানুষ আজ রাস্তায়। তাঁরা পেশার বা আর্থিক অবস্থার বিচার করবেন না, এটাই আশা করা যায়। সব মেয়ের জন্যই হাতে প্রদীপ, মোমবাতি, শাঁখের আওয়াজ শোনা যাক।কারণ এ ঘটনা থামার নয়। সব আমলেই ঘটে চলেছে। এই ঘটনার শাস্তি জোরদার হলেও আবার ঘটবে। সে সময়ের জন্যই প্রশ্ন রইল। তখন সাধারণ মানুষ এত সক্রিয় হবেন নাকি মানুষকে ক্রমাগত এই ছোটো করাই দেখতে হবে? আশা করি, তা হবে না। কারণ তিলোত্তমার জন্য সাধারণ মানুষের এই আন্দোলনের ফলে চেতনার স্তরে বিপ্লব হবে, এটাই আশা করা যায়। আন্দোলন, বিক্ষোভের ফলে মানুষের চেতনার স্তরে পরিবর্তন হয়। এই বিক্ষোভ মানুষের অন্তরকে আলোকিত করুক। সমাজের সমস্ত বৈষম্য দূর করে দেওয়ার সামগ্রিক এক আন্দোলনে মিশে যাক এই আন্দোলন। মানুষকে অপমান করা, ছোটো করা, কথায় শব্দে মানুষকে ধর্ষণ করা, মানুষের মুখ ম্লান করে দেওয়া, ধর্ম দিয়ে, জাতি দিয়ে, লিঙ্গ দিয়ে সমাজে বৈষম্য তৈরি করা, গোটা সমাজটাকেই এক জঘন্য পচা গলা ব্যবস্থায় পরিণত করে দেওয়া এই সময়ের অবসান হোক। মানুষের আন্দোলনই গড়ে তুলুক এক বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। তিলোত্তমা হয়ে উঠুক সেই পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা।
তার জন্য যদি আগুন জ্বলে ওঠে, যদি আমাদের তথাকথিত স্থিতাবস্থা ভেঙে যায়, তো যাক।