
রামিজের ভাষা দিবস
সমীরণ চট্টোপাধ্যায়
ভাষা নিয়ে আমার জ্ঞান ভাসা ভাসা। তবু ভেসে থাকতে খড়কুটোর মতো কিছু একটা লাগে। ভাব তেমন না থাকলেও জীবন চালাতে কথা বলতে হয়। তার জন্য বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষায় তত ভরসা নেই আমার। একবারই ইউটিউবে কিছু ইংরেজী বলার চেষ্টা করেছিলাম। হাতে গরম ফলও পেয়েছিলাম। একজন ফলো করে এত ভুল ধরে পোস্ট করল যে বুঝলাম ইংরেজিটা তো হলই না, বাংলাটাও ভুলে গেলাম মনে হল। আমাদের, মানে সাধারণ লোকেদের, না মনে করিয়ে দিলে সব দিবসই সমান। একই রিক্সা টানা। সে কোন্নগরেই হোক আর নব দিগন্তেই হোক। শুধু প্যাডেলে চাপ দাও, চাকা ঘোরাও। ঐ প্যাডেলের আওয়াজেই বাজে গান।
আমরা কি পারব এই দিনটার মান রাখতে? কেউ কেউ জানে, মানে শুনেছে, এই দিনটায় নাকি অনেক মানুষ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল। কিন্তু রামিজ ভাইয়ের ভাষা তো বইয়ের পাতার অক্ষরে আটকে থাকেনা আবার রিক্সার সিটে চেপে বসা প্যাসেঞ্জারের গালাগালির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে না। রামিজের ভাষা একটু আলাদা। ওর ভাষা ‘ওস্তাদ, একটু আস্তে চালান’, ‘ভাই, ভাড়া একটু কমানো যাবে?’, ‘মামা, ভাংতি নাই, কি করি!’—এগুলোর মাঝেই বন্দি। শহরের অলি-গলি চষে বেড়ানো এই লোকের ভাষা টুংটাং ঘন্টার মতো আওয়াজ দেয়। তাতে ছন্দ আছে কিনা কে জানে। রামিজের ভাষার তালিম নেই, শব্দের ব্যাকরণ নেই। অফিসের বাবুরা হয়তো বলে ‘স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন’। আর রামিজ বলে ‘কথা বুঝলেন তো, মামা?’ কথা কিন্তু একই। মাঝে মাঝে মনে হয় রামিজের কথার বেশ মানেও আছে। যেমন, একদিন বলছিল, ‘যেখানে আইন নাই, সেখানে ফাইন লাগে ক্যান?’ এসব কথা রিক্সার হ্যান্ডেলের মতো শক্ত, কিন্তু টানলেই ঘোরে! এই খেয়েছে রিক্সার হ্যান্ডেলেও কী ভাষা আছে নাকি?
এই তো সকালে পরিপাটি সেজে একজন রিক্সায় উঠে আকাশে যাব বলে একটা বিরাট বাড়ির সামনে নামল। সারা রাস্তা কি একটা গুনগুন করে গাইছিল। রামিজ শুধু ‘তোমাকে চাই’ আর ‘এক কাপ চা’ এই দুটো কথাই মনে রাখতে পেরেছিল। নামিয়ে দিয়ে সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে এক কাপ চা খেতে খেতে রামিজ ভাবল একটা প্যাসেঞ্জার ছাড়া সারাদিন আর কী কী সে চাইতে পারে। নিজে ইংরেজি পড়তে পারেনি বলে কোনদিন সিপিএমকে ভোট দেয়নি রামিজ। নিজের মেয়েটাকে একটা ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে পড়াবার খুব শখ। তার রিক্সায় চেপে দুটো মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে। ফটর ফটর করে ইংরেজী বলে। বাংলা বলে একটু থেমে থেমে। আর একদিন এদের মা উঠে ফোনে কাকে বলছিল, ‘মেয়েটাকে সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ হিন্দি দিয়েছি, থার্ড ল্যাংগুয়েজ ভাবছি জার্মান দেব। কী বলছ? বাংলা? না, না একটা বিদেশি ভাষা জানা খুব দরকার। আর হিন্দি না জানলে তো আমার বরের মতো হাঁদা গঙ্গারাম হয়ে থাকতে হবে। কারুর সাথে কথাই বলতে পারবে না।’ না, না সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল না।
রামিজ ভাবে, তার মেয়েকে কী আর ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াতে পারবে? পাড়ার দাদা বলে, “কেন পারবে না? আমাদের সরকার বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোকে ইংলিশ মিডিয়াম করে দিচ্ছে না? সে তো তোমার কথা ভেবেই!” বুকটা ভরে ওঠে রামিজের। দাদা ভাবে ভোটটা বাঁচানো গেল। আজ কিন্তু রমিজের রিক্সায় একটু আলাদা আমেজ। স্কুলের বাচ্চারা ফুল হাতে, কাঁধে কালো ব্যাজ, ঠোঁটে গান। এফএমে বাজছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। এইরে ব্রেকটা ধরছে না। ‘ও ভাই, একটুউউ ধরেন তো, ব্রেক কাজ করতেছে না!’ রামিজের কথায় গানের তাল কাটে। যাত্রীরা হাল্কা বিরক্ত। কেউ একটু ধমক চমক দিয়ে দেয়। এই যে প্যাসেঞ্জারের অকারণ ধমক, পুলিশের ফালতু ফাইন, কিংবা ভাড়ার দরদাম— এর সবকিছুতে ভাষাই কী অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়? এই ভাষা বইয়ের পাতায় না থাকতে পারে কিন্তু রাস্তায় ছড়িয়ে আছে শব্দের মতো—কখনো গম্ভীর, কখনো ঠাট্টা, কখনো দীর্ঘ শ্বাস।
এবার একটু রিক্সা থেকে নামা যাক। আমাদের গ্রামের স্কুলে আজ কচিকাচারাও গান গাইবে, কবিতা পড়বে, বক্তৃতা ঝরবে। কাল একটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম বিন্তিকে। ছোট মেয়ে। মিষ্টি মেয়ে। কিশোরী বলা চলে। ঐ হোয়াটস অ্যাপে। ও আমাদের স্কুলে আগে পড়ত। এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। তা হোয়াটস অ্যাপেই উত্তর এল। ছোট উত্তর। ‘khul6na’। বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ভাগ্যি কাল ভাষা দিবস ছিল না! আজ অবশ্য কোন ভুল হবে না। আজ সব থ্যাঙ্ক ইউ ধন্যবাদ হয়ে যাবে। একদিনের জন্য। একেই বলে দিবস! আমার দাদা যখন আমেরিকা থেকে এল তখন প্রতিজ্ঞা করেছিল যে বাংলা শব্দ ছাড়া কিছু ব্যবহার করবে না। সে খুব গোলমাল হয়েছিল। ওর কথা অনেকে বুঝতেই পারছিল না। শেষে একদিন আমার সঙ্গে বেরিয়ে বাসস্টপে একটা বাসের নম্বর জিজ্ঞেস করায় আমি বলেছিলাম ‘সীমিত চতুর্দশ খ’। দাদা এটা বুঝে ওঠার আগেই বাস চলে গিয়েছিল। দাদা কিন্তু ঐ L14B বাসেই উঠত। যখন বুঝল তখন বাস চলে গেছে। আমাকে খুব বকল। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে সয়ে নিলাম। আমার কী দোষ। আমি তো ওর কথাই শুনেছি। তবে এরপরে একটা ভালো জিনিস হয়েছিল। বাংলায় পাগলামো করার সময় আমাকে দেখতে পেলেই দাদা কেমন একটা গুটিয়ে যেত।
ভাষার কারবার যে শুধু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ তা তো নয়। ভাষার মেজাজ আছে, ধমক আছে, আদর আছে, রাগ আছে। আবার ভাষা শুধু ঠোঁটে না, আছে হ্যান্ডেলে, আছে আছে ক্লান্ত পায়ে। রক্তেও আছে, ঘামেও আছে। যার রক্ত পড়ছে, তার ভাষা শুনছি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে, কবি সম্মেলনে। যে ঘামছে তার গান শুনছি চোখ বুজে। ভাবছি, ‘নিশ্চিন্ত আর থাকা গেলনা।’ যার ভাষা সেই যদি বলতে পারত! বাংলা ভাষা তো হালকা পাতলা চেহারার ভাষা নয়। যেমন ধাক্কা খায় তেমনই পাল্টা দেয়! ‘ভাষা’ তো আসলে রাস্তার ভাষার মতোই, গালি-গল্প, চায়ের দোকানের আলাপ আর বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যার সিটি বাজানো কথোপকথনের মিশেল।
রামিজ দিয়ে শুরু হয়েছিল। তাকে দিয়েই শেষ করি। আজ ভাষা দিবস। সবাই রাস্তায় মিছিল বের করেছে। রামিজও কী আপন মনে তার ভাষা দিবস পালন করে! সে কী আজ একটু ধীরে চালায়, একটু গুনগুন করে গান গায়! সে কী মনে মনে ভাবে, আজকের দিনে তার ঠিক কী করা উচিৎ?’
তখনই হেডলাইটের মতো এক ঝলক হাসি খেলে যায় মুখে। এইটুকুতো সে বোঝে যে ভাষা মানে প্রতিদিনের বেঁচে থাকা।
রামিজদের জন্য আলাদা কোন ভাষা দিবস নেই।