গল্পবিশ্বের নিঃসঙ্গ পর্যটক জীবনানন্দ <br />  নিশীথ ষড়ংগী

গল্পবিশ্বের নিঃসঙ্গ পর্যটক জীবনানন্দ
নিশীথ ষড়ংগী

জীবনানন্দ মূলতঃ কবি হলেও তাঁর অবারিত স্পর্শ পেয়েছে ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ক্ষুদ্র হলেও সঙ্গীতরচনা।কবিতায় তাঁর মানস- সংযোগ অতুলনীয় হয়ে উঠেছে এবং তাঁর মানসিক গড়ন কবিতাধর্মী। দুটো বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী পটভূমিতেই তাঁর রচনাকাল লালিত হয়েছে।রবীন্দ্র-পরবর্তী এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর (১৯১৪ -১৯১৮) জীবনানন্দকে বাংলাসাহিত্যে শ্রেষ্ঠ ভাবুক হিসেবে চিহ্নিত করাটা সম্ভবত অহেতুক হবে না। ইংরেজি সাহিত্যের তাত্ত্বিক পড়ুয়া হিসেবে ইউরোপীয় সাহিত্যকেও তিনি অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করে- ছিলেন। শুধুতাই নয়,বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উপযোগী করে তোলার পরিশ্রমসাধ্য কাজটিতে তিনি সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। স্বল্পবাক,আত্মমগ্ন, প্রচার-বিমুখ,অন্তর্মুখী এই কবি ও চিন্তক তাঁর সময়েতো বটেই , যুগের থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন তিনি তাঁর ভাবনায়। কবিতায় যেমন তিনি (অন্ততঃ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির সময়পর্ব থেকে) সমসাময়িক কবিদের থেকে সচেতনভাবে নিজেকে আলাদা করতে চেয়েছেন,
ঠিক তেমনি করে গল্প উপন্যাস ও প্রবন্ধরচনায়ও এ তাগিদ তাঁর ছিল।
বিবাহপূর্ববর্তী প্রেম, বিবাহ -উত্তর দুঃখময় জীবন, অর্থকষ্ট,স্থায়ী চাকরির অভাব,পূর্ব বাংলার নিসর্গলোক থেকে একপ্রকার নির্বাসিত, প্রায়-অবলম্বনহীন এই মানুষটির মানসিক গঠনটি একেবারেই ছিল আলাদা। সমসময়ের প্রবাহটিকেও তিনি অনুভববেদ্য করে তুলে-
ছিলেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের ভেতর দিয়ে। তাই তাঁর রচনা-
কর্ম –কী কবিতা,কী ছোটগল্প, উপন্যাস অথবা প্রবন্ধ-
গুলিকে এই মানস-অন্তঃপুরের জটিল ও বঙ্কিম ঘুর্ণন
থেকে বিচার করা জরুরি মনে হয় আমাদের।

।।এক।। গল্পরচনায় আত্মজৈবনিকতা
……………………………………..

জীবনানন্দ তাঁর বেশিরভাগ গল্পই লিখে উঠেছিলেন
১৯৩১– ১৯৩৬ খ্রি.এবং ১৯৪৬– ১৯৪৮ খ্রি.-এর মধ্যে।
এ সময়ে তিনি ছিলেন প্রায়-কর্মহীন।১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে
তাঁর বিবাহ এবং ১৯৩১খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি কণ্যা
মঞ্জুশ্রীর জন্ম।১৯৩১-এর নভেম্বর থেকে কিছু উপন্যাস-
এর সঙ্গে অবিরল লিখে চলেছেন গল্প। এবং যে দ্রুততা
-র সঙ্গে তিনি গল্প উপন্যাস লিখছেন, তাতে বিস্মিত হতে হয়। যেমন,’বিভা’ উপন্যাস লিখছেন ফেব্রুয়ারি
মাসে,’মৃণাল’ উপন্যাসও ফেব্রুয়ারিতে, ’বিরাজ’
লিখছেন আগষ্টে,’কারুবাসনা’ ও ‘ জীবনপ্রণালী’ উপ-
ন্যাস আগষ্টে এবং ‘ প্রেতিনীর রূপকথা ‘ সেপ্টেম্বরে।
উপন্যাস আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নয় বলেই
আমরা তাঁর গল্পরচনার দিকে যাত্রা করতে চাই।
বিশিষ্ট জীবনানন্দ গবেষক ও মেধাবী শ্রী গৌতম মিত্র
অবশ্য জানাচ্ছেন,১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই গল্পরচনায়
নিবিষ্ট ছিলেন জীবনানন্দ। এ পর্যন্ত কবির লেখা এক
শত সাতাশটি গল্পের খোঁজ তিনি আমাদের দিয়েছেন,
কালানুক্রমিকভাবে। যেখানে দেখা যাচ্ছে,১৯২৫ খ্রি.-এ
জীবনানন্দের ‘গোলাপি’ ও ‘কমলা’ নামে দুটি গল্পরচনা
-র কথা। শ্রদ্ধেয় গৌতম মিত্রের সংগৃহীত এই গল্পগুলো
-র খবর সুধী পাঠকসাধারণের সবারই জানা। তবুও
আমরা,এখানে,পরপর সাল অনুসারে জীবনানন্দের গল্পগুলোকে আর একবার লিপিবদ্ধ করছি মাত্র।
১৯২৫ ১৯২৬
১.গোলাপি ২. কমলা । ৩. করবী
১৯২৯-৩০ ১৯৩০
৪. ভিরমির রোগ ৫.দিল্লীর কলেজের
মাস্টার ৬. ছাদে বসে ৭. বিলাসী ৮. অপূর্ব
৯. রাত প্রায় বারোটার সময়।
১৯৩০-৩১
১০.ভরসা-কথা ১১. নোঙর ১২. বাবলা ১৩.চক্ক
১৪. মেস-বাড়ির মেয়েটা ১৬. দাঁড়কাক ১৭. শৈলেন
১৯৩১
১৮.রাজমোহন ১৯. ছায়ানট ২০. শুধু সাধ, শুধু রক্ত,
শুধু ভালোবাসা ২১. প্রেমিক স্বামী ২২.কুয়াশার ভিতর
মৃত্যুর সময় ২৩. মেয়েমানুষের ঘ্রাণে ২৪. মাংসের ক্লান্তি
২৫. উপেক্ষার শীতে ২৬. পূর্ণিমা ২৭. আকাঙ্ক্ষা –
কামনার বিলাস ২৮. বিবাহিত জীবন ২৯.নকলের খেলায় ৩০. মা হবার কোনো সাধ ৩১. বই
১৯৩২
৩২. পাতা- তরঙ্গের বাজনা ৩৩. আর্টের অত্যাচার
৩৪. মহিষের শিং ৩৫.বিস্ময় ৩৬. শাড়ি ৩৭ হাতের তাস
৩৮. কোনো গন্ধ ৩৯. বেশি বয়সের ভালোবাসা ৪০.বত্রিশ বছর পরে ৪১. তিমিরময় ৪২. সাতকোশের
পথ ৪৩. চাকরি নেই ৪৪.ক্ষণিকের মুক্তি দেয় ভরিয়া
৪৫.শেষ পছন্দের সময় ৪৬. প্রণয় প্রেমের ভার ৪৭. বাসর শয্যার পাশে ৪৮.কুষ্ঠের স্ত্রী ৪৯.সুখের শরীর
৫০. নষ্ট প্রেমের কথা ৫১. বাসর রাত ৫২. প্রণয়- প্রণয়িণী ৫৩.মেয়েমানুষের রক্তমাংস ৫৪. বাসর ও বিচ্ছেদ ৫৫. মেয়েমানুষ ৫৬. হিসেব- নিকেষ ৫৭. কথা
শুধু – কথা,কথা,কথা,কথা,কথা ৫৮. একঘেয়ে জীবন
৫৯. কিন্নরলোক ৬০. হৃদয়হীন গল্প ৬১. বিবাহ-অবিবাহ
৬২. শীতরাতের অন্ধকারে ৬৩. বাসনা কামনার গল্প
৬৪. অঘ্রাণের শীত ৬৫. অশ্বত্থের ডালে ৬৬. সমুদ্রের
স্রোতের কথা ৬৭. বিচ্ছেদের কথা ৬৮. এই শীত- হেমন্ত এই
১৯৩৩
৬৯. তাজের ছবি ৭০. পালিয়ে যেতে ৭১. রক্তমাংসহীন
৭২. জামরুলতলা ৭৩. মজলিশে ৭৪. লোভ ৭৫. মানুষ-
অমানুষ ৭৬. কল্পজিনিসের জন্ম ও যৌবন ৭৭. ঐকান্তিক ৭৮. ক্ষমা-অক্ষমার অতীত ৭৯. স্বপ্নের ভগ্ন-
স্তুপ ৮০. পেঁচা ও জোনাকির মধ্যে ৮১. প্রণয়হীনতা
৮২.আকাঙ্ক্ষার জগৎ ৮৩. সঙ্গ-নিঃসঙ্গ ৮৪. মৃত্যুর গন্ধ
৮৫. প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, দাক্ষিণ্যের তৃষ্ণা ৮৬. লোকসানের মানুষ ৮৭. জীবনের অন্তঃপুর ও তেপান্তর
৮৮.মানুষের মুখের আভা ৮৯.জন্ম মৃত্যুর কাহিনী
৯০.জাদুর দেশ ৯১. নিরুপম যাত্রা
১৯৩৪
৯২. হৈমন্তিক ৯৩. সেই শীতের রাতগুলি
১৯৩৬
৯৪. নক্ষত্রের বিরুদ্ধে মানুষ ৯৫.মেহগনি গাছের ছায়ায়
৯৬. করুণার রূপ ৯৭.এক এক রকম পৃথিবী
৯৮. বাইশ বছর আগের ছবি ৯৯.কবিতা আর কবিতা,
তার পরও আবার কবিতা ১০০. কুড়ি বছর পরে
১০১. রক্তের ভিতর ১০২. মনোবীজ ১০৩. কবিতা নিয়ে
১০৪. রক্তমাংসের স্পন্দন ১০৫. ধূসর পান্ডুলিপি
১০৬. পৃথিবীটা শিশুদের নয় ১০৭. করুণার পথ ধরে
১০৮. মায়াবী প্রাসাদ ১০৯. অস্পষ্ট রহস্যময় সিঁড়ি
১১০. সোনালী আভায় ১১১. বাসনার দেশ ১১২.সাধারণ মানুষ ১১৩. আস্বাদের জন্ম ১১৪. এক
সেতুর ভিতর দিয়ে ১১৫. কুড়ি বছর পর ফিরে এসে
১১৬. বৃত্তের মতো ১১৭.ভালোবাসার সাধ
১৯৪৬
১১৮. সমরেশ ১১৯. পারিজাত ১২০.বাঘিনী ১২১.বিন্দু
বাহিনী ১২২. সোমনাথ ও শ্রীমতী ১২৩. হেমন্তের দিন গুলি
১৯৪৬- ১৯৪৭
১২৪. বিলাস ১২৫. গ্রাম ও শহরের গল্প
১৯৪৭
১২৬. ডাক্তার
১৯৪৮.
১২৭. হুমায়ুন প্রেসের থেকে
শ্রী গৌতম মিত্রের এ হিসেব থেকে সহজেই বোঝা
যায় যে,১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ,গল্প লিখেছেন সবথেকে বেশি,৩৭ টি। ১৯৩৬- এ ২৪ টি, ১৯৩৬- এ ২৪
টি, ১৯৩৩- এ ২৩ টি। ১৯২৫-৩০ খ্রিস্টাব্দে লিখেছেন
মাত্র ৯ টি গল্প। ১৯৩০- ৩১ এ ২২ টি গল্প লেখা হয়েছে।
আর ১৯৪৬- ৪৮ এ ১০ টি গল্প। অর্থাৎ ১৯৩২ এ যখন
তিনি পুরোপুরি বেকার–এক মাসে লিখেছেন ৯ টি গল্প।
ত্রিশ বছর সাহিত্য জীবন ধরলে তিনি আর একটিও ছোটগল্প লিখে উঠতে পারেন নি। তাই সাহিত্যিক জীবনের দুই – তৃতীয়াংশ তিনি গল্প লেখা থেকে বিরত
ছিলেন।
এসবই গবেষক গৌতম মিত্রের লেখা থেকে এখানে
সংগৃহীত হলো।
এর মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৩২-৩৬ এর মধ্যে, জীবনানন্দের
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে দুটি। ঝরাপালক(১৯২৭)–
যা ‘ কল্যাণীয়াষু’ নামে এবং ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)–
যা বুদ্ধদেব বসুকে উৎসর্গীকৃত। ধরে নেওয়া অসঙ্গত হবে না যে, এর মধ্যে মধ্যে তিনি কবিতা, বিশেষ করে,
ধূসর পান্ডুলিপির কবিতাগুলোও লিখছেন। শুধু কি তাই? গল্প ও কবিতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকটি
উপন্যাসও লিখে ফেলছেন,এসময়।১৯৩২-এ লিখছেন-
‘কল্যাণী’ (জুলাই) ও ‘জীবনের উপকরণ ‘(আগষ্ট)।
১৯৩৩- এ লিখছেন – উপন্যাস,’ বিভা’ (ফেব্রুয়ারি),
মৃণাল (ফেব্রুয়ারি), ‘বিরাজ’ (আগষ্ট),’কারুবাসনা’
(আগষ্ট), ‘জীবনপ্রণালী’(আগষ্ট),’প্রেতিনীর রূপকথা’
(সেপ্টেম্বর)। ১৯৩৩-র পরে, প্রায় চোদ্দ বছর আর
উপন্যাস লেখেন নি জীবনানন্দ। ১৯৪৮- এ এসে তিনি
লিখবেন ‘জলপাইহাটি’(এপ্রিল – মে),’মাল্যবান’ (জুন)
এবং ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ ও ‘সুতীর্থ’।
এখন,এই যে বিপুল ও বিস্তৃত গল্পসম্ভার -এর ভেতর
দিয়ে জীবনানন্দ, ঠিক কী ধরণের গল্পসৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন? জীবনানন্দের প্রতিটি গল্প ধরে ধরে হয়তো এ
পর্যালোচনা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব, তবু কিছু কিছু
প্রতিনিধিস্থানীয় গল্পের অভিমুখ হয়তো নির্ধারণ করা যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, এসময় (গল্পগুলো রচনাকালীন সময়পর্ব), ঠিক কী ধরণের মানসিক টানা-
পোড়নের ভেতর দিয়ে জীবনানন্দ যাচ্ছিলেন। শ্রী গৌতম মিত্রের উল্লেখ অনুযায়ী ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দকে গল্প-
রচনার সূচনাপর্ব ধরলে দেখা যাবে, ১৯২৩-এ জীবনানন্দ সিটি কলেজে অধ্যাপনা করছেন তখন।
বরিশাল থেকে ভাই অশোকানন্দ MSc.পড়ার জন্য
কোলকাতায় এলে ১৮/২/এ বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রিটে একটি
ছোট বাড়িভাড়া নিতে হয়। এখান থেকেই সিটি কলেজে
পড়াতে যেতেন জীবনানন্দ। ১৯২৫ -এর ১৬ ই জুন দেশ
বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যান। তখন জীবনানন্দের বয়স ছাব্বিশ বছর। দেশবন্ধুর প্রয়াণে বেদনাহত কবি
লিখেছেন ‘দেশবন্ধু প্রয়াণে ‘ নামে কবিতা – যা বঙ্গবাণী
পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তখনও তাঁর
প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ ঘটেনি। অপ্রাসঙ্গিক হবে না এ
উল্লেখ যে, ১৯২৫-এ এই বঙ্গবাণী পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে শরৎচন্দ্রের ‘ পথের দাবী’ উপন্যাস। ১৯২৩-এ তারাশঙ্করের ‘ রসকলি’,’হারানো
সুর ‘ ও ‘স্থলপদ্ম’ আগেই প্রকাশিত। বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসীতে বের হয়ে গেছে। ১৯২৫-এ জগদীশ গুপ্তের মনস্তাত্ত্বিক গল্প
আত্মপ্রকাশ করেছে। ১৯২৯-এ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘পঞ্চ-
শর’ প্রথম গল্পসঙ্কলন প্রকাশ পেয়েছে। শৈলজানন্দ
মুখোপাধ্যায় ১৯২২-এ প্রথম গল্প ‘কয়লাকুঠি’ প্রকাশ করেছেন। অবশ্য পঞ্চশরের আগেই ১৯২৪-এ প্রেমেন্দ্রে
র আবির্ভাব ‘শুধু কেরাণী’ ও ‘গোপনচারিণী’ – র গল্প –
কার হিসেবে। অনেক পরে ১৯৩৫-এ বেরুচ্ছে মানিক
বন্দোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’,বিচিত্রা পত্রিকায়। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘টুটাফাটা’ প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯২৮-এ। নজরুলের ‘ব্যথার দান’
গল্পসঙ্কলন বের হয় ১৯২২-এ।’রিক্তের বেদনা’ ও ‘শিউলিমালা’ গল্পসঙ্কলনের প্রকাশকাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
-পূর্ব সময়ে,১৯২৫ ও ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।
সমসাময়িক অল্প কিছু গল্পকারের উল্লেখ এখানে করা হলো– পরে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে। কিন্তু আমরা প্রথমেই যে কথা শুরু করেছিলাম – তাঁর
গল্পে আত্মজৈবনিকতা নিয়ে, তার সম্পর্কে আলোচনা
হওয়া দরকার।
জীবনানন্দ তাঁর লেখা গল্পে যেন নিজেকেই প্রকাশিত করে চলেছিলেন। তাঁর ভেতরকার লড়াই, অভিব্যক্তি এবং অস্তিত্বগত উদ্বেগ (existential anxiety) – যা তাঁর ছোটগল্পের চরিত্রগুলোর অন্তর্গত
কাঠামো – তাকেই যেন প্রতিষ্ঠা দিচ্ছিলেন তিনি। তাঁর
ব্যক্তিত্ব, বিশ্ব দর্শন, অভিজ্ঞতা যেন গল্পের প্রোটা- গোনিস্টরা প্রায়শই প্রতিধ্বনিত করছিল। তাঁর এই আত্মদর্শী, গভীরভাবে ব্যক্তিক অভিমুখ তাঁকে তাঁর সময়ের ফলাফলের দিকে চালিত হতে বাধ্য করেছিল। তা যেমন সামাজিক অস্থিরতা, সংস্কৃতিগত উল্লম্ফন এবং তার তেমনই আধুনিকতার বিচ্ছিন্নতাবোধও।

১. আত্মজীবনীমূলক প্রতিফলন – জীবনানন্দের
অনেকানেক ছোটগল্পের চরিত্রগুলো যেন তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। তাঁর নিজস্ব জীবন, তাঁর জীবনের সংগ্রাম, নিজের জীবনকালে প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার বেদনাবোধ– এ সমস্তই গল্পশরীরে স্থায়িত্ব পেয়েছে।
তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো প্রায়ই একাকীত্ব,আত্মদর্শিতা এবং অস্তিত্বগত দ্বিধা ( existential dilemmas) দ্বারা সমাকীর্ণ। তা যেন জীবনানন্দের নিজস্ব দর্শনগত প্রবণতা ও দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিকে মনে করিয়ে দেয়।

২.বিচ্ছিন্নতা ও অস্তিত্বগত দ্বিধার অন্বেষণ– জীবনানন্দের গল্পের চরিত্রগুলো প্রায়শই একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং জীবনের উদ্দেশ্যহীনতার সঙ্গে যেন লড়াই করছে।এবং এটা তাঁর কবিতা ও গদ্যের ক্ষেত্রেও যেন একটি সাধারণ থিম। এই থিমগুলোই তাঁর সময়ের বৃহত্তর উৎকণ্ঠাকেই যেন তুলে ধরছে। তুলে ধরছে উপনিবেশিকতার ফলে উদ্ভুত ডিসলোকেশনকে, নগরায়ণকে এবং চিরায়ত মূল্যবোধের অবনমনকেও।
বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত তাঁর প্রোটাগোনিস্টদেরও আমরা দেখতে পাবো জীবনানন্দের নিজের, মূলধারার সাহিত্য সম্প্রদায়ের অন্তর্গত না হতে পারার, নিজস্ব জীবনবোধের মধ্য দিয়ে।

৩. সমসাময়িক বাস্তবতার বহুস্তরিক প্রকাশ – ক)
কর্মহীনতা ও আর্থিক লড়াই – প্রায় সারাজীবন ধরে
জীবনানন্দ আর্থিক অস্থায়িত্বের মুখোমুখি হয়েছেন।
এবং তা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার প্রকাশ তাঁর
গল্পগুলোতে প্রায়ই ধ্বনিত হয়েছে। চরিত্রগুলো বেকার-
ত্বের বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে এবং তাদের প্রতিটি
কর্মকাণ্ডের অসফলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে লড়াই করতে চেয়েছে অসহায়ভাবে।আর ভোগ করেছে ঔপনিবেশিক বাংলার আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলোকে।
খ) ক্ষয়, ক্ষতি ও বিচ্ছিন্নতা– জীবনানন্দের জীবন চিহ্নিত হয়ে আছে ব্যক্তিক ক্ষয়- ক্ষতি ও মানসিক বিচ্ছিন্নতার সরণি হিসেবে।এসব উপাদানগুলিই থিম আকারে পৌনঃপনিকভাবে চিত্রিত হয়েছে কখনও বিচ্ছিন্নতার সূত্র হিসেবে, কখনও বা অপূর্ণ ভালোবাসা
হিসেবে,আবার কখনও সম্পর্কের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিরূপে
তাঁর গল্পে।
গ) ঔপনিবেশিক মোহভঙ্গ – যেহেতু জীবনানন্দ
প্রকাশ্যভাবে রাজনৈতিক ছিলেন না; তাই তাঁর চরিত্র-
গুলোর হতাশা,শেকড়হীনতা ও মোহভঙ্গ,অপ্রত্যক্ষভাবে
ঔপনিবেশিক সময়ের সামাজিক -রাজনৈতিক আউট-
কামগুলোকে সমালোচনা করেছে।

৪. মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব – আত্ম-
দর্শী ও আধুনিকতম টেকনিকগুলির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন জীবনানন্দ। যা তাঁকে অবচেতনের
অন্বেষণে প্ররোচিত করেছিল। তাঁর ছোটগল্পে চিত্রিত
চরিত্রগুলো যেন প্রায়শই তাদের অন্তর্গত জগতে আটকে পড়েছিল, যা কিনা তাঁর নিজের দর্শনগত লড়াই ও অস্তিত্বেরই ধ্যান।
জটিল মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানকে চিত্রিত করার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিক অভিব্যক্তিকে বৃহত্তর মানব-
অবস্থানে মূর্ত করে দিতে চেয়েছিলেন।

৫. ব্যক্তিক ও সামাজিক পরিণতিকে প্রতীকায়িত-
করণ –জীবনানন্দের ছোটগল্পে প্রকৃতি হচ্ছে একটি
পৌনঃপুনিক মোটিফ,যা প্রায়ই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর অন্তর্জীবনকে প্রতীকের মাধ্যমে তুলে ধরে। এটি তাঁর
প্রাকৃতিক বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তিক সম্পর্কের বিচ্ছুরণও।
সামাজিক অস্তিত্বের সঙ্গে ব্যক্তিক সাযুজ্যের এটি একটি লেন্স।
তাঁর ছোটগল্পের চরিত্রগুলো প্রায়শই ভূদৃশ্য (land-
scape) , ঋতু এবং ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলে।

৬. সময়কালের জটিলতাগুলি প্রকাশে ভিন্নমুখী
দৃষ্টিকোণ –সময়ের একমাত্রিক প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর
গল্পগুলো নিজেদের আবদ্ধ রাখেনি।পরন্তু,বিভিন্ন চরিত্র
ও নির্ধারকগুলির মাধ্যমে তারা সময়ের ভিন্নধর্মী আউট
কামগুলোকে উপস্থাপিত করেছে।
*একজন সংগ্রামী স্কুলশিক্ষক মধ্যবিত্তশ্রেণীর দুঃখ
ময়তাকে প্রকাশ করছেন।
● একজন নিঃসঙ্গ স্বপ্নচারী তাঁর অস্তিত্বগত হতাশাকে মূর্ত করেন।
● এক গ্রাম্য শ্রমিক তাঁর আর্থিক ও সামাজিক
শোষণকে সবার দৃষ্টিগোচর করেন।

বিভিন্ন আর্কেটাইপ ব্যবহার করে তিনি তাঁর ব্যক্তিক
অভিজ্ঞতাগুলো, মানব-অবস্থা ও তার সময়ের সমাজ-
অর্থনীতির বাস্তবতাগুলিকে বৃহত্তর সংলাপ হিসেবে বিস্তৃত করে তুলেছিলেন।

৭. ব্যক্তিক ও সামুহিক থিম হিসেবে বিষাদ ও হতাশা
-বাদ–
জীবনানন্দের গল্পগুলোর বিষাদের টোন প্রায়ই তাঁর
ব্যক্তিগত জীবনদর্শনকে ব্যক্ত করে তোলে। কিন্তু তা
সার্বিক প্রজন্মের মোহভঙ্গকেই অধিকার করে থাকে।
এবং যা মুখোমুখি হয় ঔপনিবেশিক বাংলা এবং প্রথম
বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগের অনিশ্চয়তার।
তাঁর ওপেন-এণ্ডেড ন্যারেটিভস ও অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব,
নিজের জীবনের পরিণতির অভাব এবং তাঁর যুগের
সামুহিক অনিশ্চয়তাকেই ব্যক্ত করে দেয়।

৮. নায়কোচিত অথবা আদর্শিত চরিত্রের পরিহার –
তাঁর অন্যান্য অনেক সমসাময়িকের মতো জীবনানন্দ
আদর্শায়িত অথবা লার্জার – দ্যান-লাইফ চরিত্রসমূহকে
চিত্রিত করেন নি। তাঁর প্রোটাগনিস্টরা প্রায় সবাই
সাধারণ ব্যক্তিবিশেষ, প্রায়ই তাদের, নিয়ন্ত্রণের বাইরের
পরিস্থিতিকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। এই ইচ্ছামূলক বা
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পছন্দ, তাঁর নিজের অবমূল্যায়িত
অস্তিত্বকেই মূর্ত করে তোলে। এবং তা বাস্তবতা এবং
অ্যান্টি- হিরোইক ন্যারেটিভস্ -র আধুনিকতম ফোকাস
হিসেবে চিহ্নিত হয়।

।। দুই।। সমসাময়িকতা, উত্তরণ ও একক পর্যটন –

জীবনানন্দ -সমসাময়িক গল্পকারদের মধ্যে কি তবে এ
সব বৈশিষ্ট্যগুলো অনুপস্থিত ছিল?তাহলে,জীবনানন্দ ই
বা আলাদা হলেন কীভাবে? জীবনানন্দের বৈশিষ্ট্যগুলি,
যেমন – আত্মদর্শন, অস্তিত্ববাদ, মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা,
তাঁর অনন্যভাষা ও ইমেজারিব্যবহার –তাঁর সমসাময়িক
দের সৃষ্টিকর্মে পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল বলা যায় না। তাঁরা তাঁদের তীক্ষ্ণতা, মৌলিকতা ও ফোকাসের দিক থেকে ছিলেন উজ্জ্বল। তবুও জীবনানন্দ কীভাবে তাঁর সমসাময়িকদের থেকে নিজেকে আলাদা করে তুলে,
বাংলা সাহিত্যে অনন্য আইডেন্টিটি নির্মাণ করতে পেরে
ছিলেন, তার পরিচয় দেবার চেষ্টা করবো।

১. আত্মদর্শী ফোকাস বনাম সমাজ-সম্পৃক্ততা–
জীবনানন্দের সমসাময়িক অনেকেই, যেমন – তারা-
শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রমুখ, সামাজিক সংগ্রাম,শ্রেণীদ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক ইস্যু-
গুলোকেই তুলে ধরেছিলেন। এঁদের গল্পগুলো প্রায়ই
মার্ক্সীয় ভাবধারা, গ্রামীণ শোষণ অথবা শাহরিক কোলা
-হলকে লক্ষ্যবস্তু করেছে।জোর দিয়েছে যুথবদ্ধতা বা
বাহ্যিক বাস্তবতা নির্মাণে।
অন্যদিকে, জীবনানন্দ সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে রাজ
নীতি অথবা যুথবদ্ধ লড়াই -সংগ্রামে কদাচিৎ প্রবেশ
করেছেন। তাঁর গল্পগুলো কেন্দ্রীভূত হয়েছে ব্যক্তিক আত্মদর্শনে, অন্তর্গত অশান্তিতে এবং অস্তিত্বমুখী প্রশ্ন-
চিহ্নে। সমষ্টির থেকে বিষয়গত ক্ষেত্রকেই তিনি করে
তুলেছেন মর্যাদাবান। তাঁর মডার্ণিস্ট অ্যাপ্রোচ, ব্যক্তিক
বিচ্ছিন্নতা এবং জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি– এর গভীর
অন্বেষণে উন্মুখ রয়েছে। এই প্রবণতাই তাঁকে সামাজিক
ভাবে জড়িত, বাস্তববাদী সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে একেবারেই।

২. কাব্যিক গদ্য ও সিম্বলিজমের ব্যবহার —
অন্যান্য লেখকরা যখন গদ্যরীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা
করছেন, তখন তার প্রকাশ ঘটেছে প্রায়শই সহজবোধ্য-
ভাবে, গল্পকথন, এবং ন্যারেটিভ ভঙ্গিতে। সিম্বলিজম্ ও
গীতিধর্মী উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে সামান্যই। এবং তা
হয়েছে প্লট বা থিমের অধীনস্থ প্রয়োজন হিসেবে। এর
বেশি কিছু নয়।
অন্যদিকে, জীবনানন্দের গদ্য অনন্যভাবে কাব্যিক,
বিবিধ ইমেজারিতে ধনী, আর বহুস্তৈরিকভাবে প্রতীকা-
য়িত।তার প্রকৃতি,সময় ও স্মৃতির বর্ণনা, তার পরিস্থিতি
র (context)তাৎক্ষণিকতাকে ছাড়িয়ে চলে যায়; বহুদূর
অতিক্রম করে। অস্তিত্বের এবং দার্শনিক রিফ্লেকশনের
মেটাফর হয়ে ওঠে যেন সে বর্ণনা।এই কাব্যিক গুণমান,
যা তাঁর কবিস্বভাবের শেকড়,তা-ই তাঁর লেখা ছোটগল্প
গুলোকে বিশিষ্ট করে তোলে। নির্বিঘ্নে করে তোলে এমন
এক-একটি শিল্পকর্ম,যা, কবিতা এবং গদ্যের এক আশ্চর্য কারুকাজ।

৩. বিচ্ছিন্নতা ও অস্তিত্ববাদের মডার্নিস্ট থিম –
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ছোটগল্পকাররাও এই বিচ্ছিন্নতা ও হতাশার থিম
গুলোর মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু তাঁদের ফোকাস
ছিল মূলত বহির্মুখী।এই বিচ্ছিন্নতা একজন দরিদ্রের,
শোষিতের অথবা তাদের,যারা সামাজিক স্ট্রাকচারের
মেসিনারীর মধ্যে আটকা পড়ে আছে।
কিন্তু জীবনানন্দের বিচ্ছিন্নতা ছিল গভীরভাবে
অন্তর্গত এবং সার্বজনীন; সামাজিক নিপীড়নের পরি-
বর্তে প্রায়শই অস্তিত্বগত দ্বিধাকে যা প্রকাশমুখর করে
তুলতে চায়। তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা নশ্বরতা, একাকীত্ব এবং
ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর অর্থসন্ধানের মোকাবিলায় নিয়োজিত। এই মডার্নিস্ট অস্তিত্ববাদই বাংলাসাহিত্যে
জীবনানন্দকে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করেছে, যেখানে এরকম
থিমই ছিল যথেষ্টভাবে অনায়াসলব্ধ।

৪.ন্যারেটিভ স্টাইল ও স্ট্রাকচার–
তাঁর সময়ের বেশিরভাগ গল্প লেখকরা চিরায়ত ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারকেই মান্যতা দিয়েছেন। গল্পের
আরম্ভটি হয়েছে সুস্পষ্ট, তারপর ক্লাইমেক্স এবং পরে
তার যথাযথ সম্ভাবিত সমাধান। এমনকি প্রেমেন্দ্র মিত্র
প্রমুখ নিরীক্ষাধর্মী লেখকরাও তাঁদের ছোটগল্পের গল্প
বলার ছাঁদটিতে একটি সংসক্তি বা সামঞ্জস্য রক্ষা করে
গেছেন।
জীবনানন্দের গল্পগুলো প্রায়শই খণ্ডিত বা নন-
লিনিয়ার স্ট্রাকচার(অরৈখিক গড়ন)সমৃদ্ধ।প্লটের থেকে
যার অভিনিবেশ পারিপার্শ্বিকতা ও মুডের ওপর অনেক
বেশি বিন্যস্ত। আগেই জেনেছি আমার, তাঁর ন্যারেটিভস্
ওপেন-এণ্ডেড, কখনও বিমূর্ততার কাছাকাছি – যা তাঁর
পাঠককে দীর্ঘস্থায়ী অস্পষ্টতার অনুভূতিরাজ্যে নিক্ষেপ
করে। এই টেকনিক ছিল বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে
সত্যিই বৈপ্লবিক।

৫.সময় ও স্মৃতির মধ্যে সম্পর্ক –জীবনানন্দের কনটেম্
-পোরারিদের কাছে সময় ও স্মৃতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ থিম।
কিন্তু তাঁরা প্রায়ই এদের, বিশেষ ন্যারেটিভ উদ্দেশ্য –
যেমন স্মৃতিবেদনা(nostalgia) বা ঐতিহাসিক প্রতিবিম্ব
(historical reflection) হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
জীবনানন্দ,সময় ও স্মৃতিকে দার্শনিক গঠন হিসেবে
নির্মাণ করেছেন। তাকে ব্যবহার করেছেন জীবনের
অনিত্যতা এবং অস্তিত্বের চক্রাকার প্রকৃতি হিসেবে আবিষ্কার করতে। তাঁর গল্পরচনাকর্মটি প্রায়ই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে দোদুল্যমান –যা, রৈখিক সময়ের সীমানাকে অস্পষ্ট ও ঝাপসা করে দেয়। সাময়িকতার এই ধ্যানমূলক আরোগ্যচেতনাই ছিল
স্বাতন্ত্র্যখচিত তাঁর বিশিষ্টতা।

৬. দার্শনিক সত্তা হিসেবে প্রকৃতি – বিভূতিভূষণের মতো
লেখকরাও প্রকৃতির সৌন্দর্যকে এঁকেছেন তাঁদের গল্পে।
কিন্তু তাঁদের ফোকাস শুধুমাত্র এর বাস্তবতায়– প্রকৃতি
এখানে মানুষের জীবন ও তার সংগ্রামের এক পটভূমি-
মাত্র।
জীবনানন্দের কাছে প্রকৃতি শুধু এক নির্ধারক (সেটিং) নয়, এটি একটি জীবন্ত, শ্বাসপ্রশ্বাসকারী সত্তা,
যার মধ্যে রয়েছে এক প্রতীকী তাৎপর্য। তিনি প্রকৃতিকে
ব্যবহার করেছেন মানুষের আবেগ, অস্তিত্বগত দ্বিধা ও
জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের প্রতিরূপ হিসেবে। তাকে করে
তুলেছেন তাঁর বর্ণনামূলক দর্শনের (narrative philos- ophy) একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

৭. রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন থেকে
বিচ্ছিন্নতা –
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জীবনানন্দ-সঙ্গীরা মার্ক্সীয় মতাদর্শ দ্বারা গভীর- ভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। অথবা ঔপনিবেশিক বাংলার
সামাজিক -রাজনৈতিক আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
তাঁদের গল্পে শ্রেণীগত বিভাগ, জাতীয় আন্দোলন এবং
সে সময়ের সামাজিক উত্থান প্রতিফলিত হয়েছিল।
জীবনানন্দ ছিলেন মূলত অরাজনৈতিক এবং এ
সমস্ত বিষয়বস্তু থেকে তিনি সরাসরি সংযোগ এড়িয়ে
গেছেন। বরং তিনি স্থিত থেকেছেন বৈশ্বিক মানব-অভি-
জ্ঞতা ও নিরবধি অস্তিত্বের প্রশ্নে।এই বিচ্ছিন্নতা তাঁর সৃষ্টিকে তাৎক্ষণিক সামাজিক – রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
অতিক্রম করে যেতে সাহায্য করেছে।

৮. বিষাদ ও হতাশাবাদ–
জীবনানন্দের সমসাময়িকদের লেখায় কষ্ট ও বিষাদ
অবশ্যই ছিল। তাঁরা তাঁদের লেখায় অনেক সময় আশা-
বাদেরআলো দেখিয়েছেন,সমাধানের সন্ধানও দিয়েছেন
–আবার, সামাজিক পুনর্গঠন অথবা বৈপ্লবিক ভাবধারা
সমন্বিত কনটেক্সট-এর ক্ষেত্রে কল্- টু- অ্যাকশন্ -এও
গেছেন।
কিন্তু জীবনানন্দের কাজগুলি ছিল গভীরভাবে
বিষাদময়। এবং প্রায়শই প্রচলিত আশাবাদ অথবা সমা
-ধানসূত্রকে এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন। তিনি
যেন আলিঙ্গন করেছেন ক্ষয়ের অনিবার্যতাকে,মৃত্যুকে।
এবং জীবনকে উপস্থাপিত করছেন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর
পরিঘটনাগুলির(phenomenon) মধ্য দিয়ে।

৯. জীবদ্দশায় সীমিত স্বীকৃতিলাভ–
জীবনানন্দ-সমসাময়িক ছোটগল্পকাররা তাঁদের জীবিত
অবস্থাতেই যথেষ্ট স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছেন। এবং তাঁরা মূলধারার সাহিত্য অঙ্গনে সমন্বিত (integra
ted) হতেও পেরেছেন।
কিন্তু জীবনানন্দ হয়ে থাকলেন অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্ন
মানুষ; অপ্রশংসিত এবং সে সময়ের সাহিত্য পরিমণ্ডলে
ভুলভাবে ব্যাখ্যাত।এই বিচ্ছিন্নতা তাঁকে তাঁর নিজস্ব নতুন স্টাইল নির্মাণে প্ররোচিত করেছিল,যা ছিল প্রভাব
-শালী সাহিত্য-প্রবণতা থেকে অনেকখানি মুক্ত।

১০. সার্বজনীন আবেদন বনাম স্থানিক বাস্তববাদ(loal-
ised realism)– জীবনানন্দ সমসাময়িক গল্পকার
রা ফোকাস করছিলেন বিশেষ সামাজিক অথবা আঞ্চ-
লিক ইস্যুর ওপর; যাতে সময় এবং স্থানের ভর বেশি বেশি করে পড়ে।
অন্যদিকে জীবনানন্দের থিমগুলো,(বাংলায় তার
শেকড় প্রোথিত হলেও) অনুরণিত হয়েছিল আন্তর্জাতিকতায়। অস্তিত্ববাদ ও নৈতিকতা ছিল তাঁর
অনন্য অন্বেষণ। মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ, সাংস্কৃতিক ও
স্থায়িত্বহীনসীমানাগুলি অতিক্রম করে যেতে পেরেছিল
বলে তাঁর ছোটগল্পগুলো নিরবধি গুণমান অর্জন করার
যোগ্য হয়ে উঠেছিল।
মোদ্দা কথা হলো, জীবনানন্দের সমসময়ের গল্প-
কাররা, যেখানে সামাজিক সংগ্রাম,যৌথ আবেগ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে চলেছিলেন, সেখানে, জীবনানন্দের আত্মদর্শী এবং
প্রতীকী স্টাইল, তাঁর গল্পগুলোকে সীমাহীন দার্শনিক অনুসন্ধানের রাজ্যে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিল। মূলধারার
ট্রেন্ড থেকে তাঁর এই স্বেচ্ছাকৃত ডিটাচমেন্ট এবং গল্প-
জগতে বিশিষ্ট হয়ে ওঠার সম্পদ জুগিয়েছিল।

।। তিন।। অন্তর্গত উপলব্ধি নাকি কোনও প্রভাব?

এসব আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের মনে এক প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়।আর তাহলো, জীবনানন্দের গল্পলেখা
র ক্ষেত্রে এই যে বিশিষ্টতা,এর পেছনে তাহলে কি আন্ডারলাইনড্ কিছু ছিল? নাকি কোনও প্রভাব- তা সে
ভারতীয় বা বহিরাগত – যাইহোক না কেন- এর ভেতরে
ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল?
জীবনানন্দীয় ছোটগল্পের স্বতন্ত্র স্টাইল ও থিম হলো
ব্যক্তিক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবেরই সমন্বয়। পাশাপাশি তাঁর অনন্য সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গিও এতে কার্য্য
-কর ছিল। যেখানে তিনি নিঃসন্দেহে তাঁর সময়ের ও
সামাজিক – রাজনৈতিক পরিবেশ এবং চারপাশের সাহিত্যিক স্রোতের মধ্য দিয়ে সুগঠিত হচ্ছিলেন। তার
মধ্য দিয়েই তিনি নির্মাণে প্রয়াসী ছিলেন এক একান্ত
ব্যক্তিগত পথ,যা তাঁকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলে-
ছিল। নীচের উল্লেখগুলো হয়তো আমাদের সন্ধানকে আলোকিত করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

১. ব্যক্তিগত ও মনস্তাত্ত্বিক ফ্যাক্টর –
অন্তর্মুখী প্রকৃতি: জীবনানন্দ ছিলেন গভীরভাবে অন্তর্মুখী ও মননশীল, যা তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ভাষা-
ন্তরিত হয়েছিল। তাঁর লেখা গল্পগুলো প্রায়ই তাঁর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিচ্ছিন্নতা ও অস্তিত্বগত সঙ্গীত থেকে
জন্ম নিয়েছিল, সামাজিক- রাজনৈতিক ভাষ্য থেকে
উদ্ভুত হয়নি।
বিষন্ন স্বভাব:জীবনানন্দ,আর্থিক অনিশ্চয়তা,জীবনে
স্বীকৃতির অভাব এবং মূলধারার সামাজিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্নতার মতো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত সংগ্রামে
র মুখোমুখি হয়েছিলেন।এ সমস্ত অভিজ্ঞতাই, বিষন্নতা
ও আত্মদর্শনের মধ্য দিয়ে তাঁর লেখা গল্পগুলোতে অনু
-প্রবিষ্ট হয়েছিল।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি: অস্তিত্ববাদী ও আধ্যাত্মিক তাগিদ
থেকেই জীবনানন্দ সময়, মরণশীলতা এবং জীবনের
অর্থসন্ধানের মতো থিমগুলোর দিকে তাঁর অন্বেষণ জারি রেখেছিলেন। এবং তা ছিল তাঁর সমসাময়িকদের
থেকে অনেকটাই আলাদা।

২. সাহিত্যগত ও শৈল্পিক প্রভাব –
ক) পশ্চিমী সাহিত্যের আধুনিকতা:
যদিও এটা ঠিক যে,জীবনানন্দ স্পষ্টভাবে পশ্চিমা সাহিত্য-আন্দলনের প্রভাবের সঙ্গে সান্নিধ্য অনুভবের কথা জানান নি, তবুও তাঁর ছোটগল্প T S Eliot, James Joyce এবং Franz Kafka – র মতো মডার্নিস্ট লেখকদের প্রণোদনাকেই প্রতিবিম্বিত করেছে। বিশেষ করে খণ্ডিত আখ্যান,স্ট্রিম-অফ-কনসাসনেস্ ও বিচ্ছিন্নতার অন্বেষণকে গল্পে ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
রোমান্টিক ও প্রতীকের ঐতিহ্য: জীবনানন্দের কাব্যিক সংবেদনশীলতা গভীরতরভাবে প্রভাবিত হয়ে-
ছিল Keats, Shelley ও Baudelaire-এর মতো রোমান্টিক ও সিম্বলিস্ট কবিদের দ্বারা। এই প্রভাব তাঁর
ছোটগল্পের দিগন্তকে প্রসারিত করেছিল, যেখানে প্রকৃতি ও প্রতীকবাদ এক মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

খ) ভারতীয় সাহিত্যগত ঐতিহ্য : জীবনানন্দ, তাঁর
সমসাময়িকদের স্টাইল থেকে দূরত্ব নির্মাণ করলেও,
ভারতীয় গল্পবলার চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্যুত করেন নি। যাইহোক না কেন,সমসময়
-এর ভাববাদ ও বাস্তববাদের কাছে জীবনানন্দের গল্প
গুলো ছিল আরও বেশি ব্যক্তিক, মডার্নিস্ট এবং
মনস্তাত্ত্বিক।

৩. সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট –

ক) ঔপনিবেশিক মোহভঙ্গ: ব্রিটিশ শাসিত ভারতে,
ঔপনিবেশিক শাসন প্রত্যক্ষ করেছিলেন জীবনানন্দ।
প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সেসময়
-এর সমাজ-অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোকেও। এ সমস্ত
বিষয়গুলির প্রত্যক্ষসংযোগ থেকে বিরত থেকেও তিনি
ভেতরের দিকে পরিণত হচ্ছিলেন; মানুষের অবস্থাকে
বৈশ্বিক ও শাশ্বত দৃষ্টিকোণ থেকে অন্বেষণ করছিলেন।
এই উপলব্ধি, জাতীয়তাবাদী বিষয়বস্তুকেই প্রধানভাবে
তুলে ধরা লেখকদের থেকে, তাঁকে পৃথকভাবে চিহ্নিত
করেছিল।
খ) চিরায়ত ও মডার্নিটির মধ্যেকার স্থানান্তর: তিনি
যে সময়ে তাঁর গল্পগুলো লিখছিলেন, তখন বাংলার
সমাজব্যবস্থা, চিরায়ত মূল্যবোধ ও আধুনিক ধারণার,
স্থানান্তর পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর সমসাময়িক অনেক গল্পকার যখন এ সমস্ত পরিবর্তনগুলো গ্রহণ
করছিলেন প্রকাশ্যভাবে,সে সময়ে,জীবনানন্দ, অন্তর্গত
দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতার বোধকেই প্রতিস্থাপিত করছিলেন।

৪.অনন্য বিশ্ববোধ ও ব্যক্তিবাদ–

তাঁর সময়ের জনপ্রিয় লিটারেরি ট্রেন্ডকে প্রতিহত
করার ক্ষেত্রে কাজ করেছিল জীবনানন্দের মধ্যে থাকা এক অনন্য বিশ্ব দর্শন (worldview) । সুক্ষ্ম,আত্মদর্শী ও অস্তিত্বগত বিষয়বস্তুর ওপর তাঁর ফোকাসই প্রধান।
এবং তা দেখিয়ে দেয় যে, উপদেশমূলক বা স্পষ্টতই
আদর্শগত পদ্ধতিকে তিনি ইচ্ছাকৃত পছন্দ হিসেবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন।
জীবনানন্দ যেন নিজেরই জন্য লিখছেন–সাধারণের
বা সমালোচকদের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই ।
এবং এটাই তাঁর গল্পরচনাকে অতুলনীয় সত্যতা দান
করেছিল।

৫. সমসাময়িকতার প্রভাব থেকে দূরত্ব নির্মাণ —

ক) ভারতীয় সমসময় থেকে ন্যূনতম প্রভাব: রবীন্দ্র- নাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ ছোটগল্পকারদের সৃষ্টি সম্পর্কে
সজাগ ও পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ। তবুও এঁদের
স্টাইলকে যেমন তিনি অনুকরণ করেন নি, তেমনই
তাঁদের বিষয়বস্তুকেও সরাসরি অনুসরণ করেন নি। পরিবর্তে, তাঁর রচিত ছোটগল্প, আভ্যন্তরীণ ল্যান্ডস্কেপ-
কেই বরণ করে নিয়েছে,বাহ্যিক সামাজিক ডায়ানামিক্স
কে দূরে সরিয়ে রেখে।
খ) বিদেশি লেখকদের নির্বাচনমূলক পরিগ্রহণ:
ইংরেজি সাহিত্যের অনিসন্ধিৎসু ছাত্র ও পাঠক হিসেবে
জীবনানন্দ বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিশ্চয়ই
পরিচিত ছিলেন।তাই তাঁর লেখা ছোটগল্পে তিনি,যে মুড
,পরিপার্শ্ব ও ইমেজারিকেই মূর্ত করবেন,প্লট বা ডায়াল-
গকে নয়,তা মেনে নিতে আমাদের কুন্ঠা থাকা অনুচিত।
এই কাব্যিক স্টাইলই তাঁর গল্পগুলোকে সমসাময়িক ছোটগল্পকারদের থেকে তাঁকে আলাদা করে তুলেছে।
কারণ, তাঁরা প্রচলিত ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারের চারপাশে
ঘুরপাক খাচ্ছিলেন তখন।
আমরা, জীবনানন্দের গল্পগুলোকে কালানুক্রমিক-
ভাবে পরিবেশন করলে এবং সে সময়ের জাতীয় এবং
আন্তর্জাতিক ঘটনা ও ফ্যাক্টরগুলোকে উদ্দীষ্ট প্রভাবকে
আরও নিখুঁতভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারতাম।
আলোচনার প্রথমদিকে আমরা,জীবনানন্দের গল্পরচনা
র কালানুক্রমিক সূচী অন্তর্ভুক্ত করেছি। কিন্তু তার
পাশাপাশি সেযুগের বিশিষ্ট ঘটনা ও উল্লেখযোগ্য ধারক
গুলোর সঙ্গে তাঁর ইন্টার- অ্যাকশনকে মিলিয়ে দেখিনি।
আমরা বরং তার আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে জীবনানন্দের
গল্পরচনার ওপর সেসবের প্রভাবকেও অনেকটা বুঝে
নেওয়ার উদ্যোগ নিই—
জীবনানন্দ, তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন
কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে।বেশিরভাগই লেখা হয়েছিল ১৯২০
খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫০ খ্রি-র প্রথমভাগ– এই মধ্যবর্তী
সময়ে। যদিও, সবাই একথা জানেন যে, কবিতাই তাঁর
প্রাথমিক উত্তরাধিকার, তাঁর ছোটগল্পগুলো তবে হয়ে ওঠে তাঁর বিশ্বদর্শন, সাহিত্যিক টেকনিক ও জাতীয়-
আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টরগুলোর মিলিত সংযোগের আশ্চর্য
সমাহার। নীচে আমরা, দেখে নেবো তাঁর ছোটগল্পের
কালানুক্রমিক সূচী এবং পাশাপাশি প্রধান জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক প্রভাবের ইতিবৃত্ত।

১৯২০-র দশক: আত্মদর্শনের প্রারম্ভকাল

পরবর্তীকালের লেখার তুলনায় কম সর্বপ্রথম কিছু গল্প
রচনার উদ্যোগ এসময় নিয়েছিলেন জীবনানন্দ। বরং
তাঁর সৃষ্টিশীল অ্যানার্জি নিয়োজিত হয়েছিল কবিতা
রচনায়।
নির্জনতার প্রতি ও গ্রামবাংলার সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ ও সেই সঙ্গে তীব্র বিষাদ ছিল তাঁর থিম।
প্রকৃতি ও মানবিক আবেগের সঙ্গে তার প্রতীকী সম্পর্ক স্থাপনও ছিল তাঁর সৃষ্টির অভিমুখ।
প্রভাব: ক) আন্তর্জাতিক–: প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর মোহভঙ্গ
এবং মডার্নিস্ট আন্দোলনের প্রভাব, তাঁর আত্মদর্শন ও
খণ্ডিত আখ্যান-স্টাইলের ওপর পড়েছিল।
খ) দেশীয়: ১৯২০-১৯২২: খ্রিস্টাব্দের অসহযোগ আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী উৎসাহকে আলোড়িত করে-
ছিল। কিন্তু জীবনানন্দ ছিলেন যেহেতু অরাজনৈতিক,
তিনি বুনে চললেন তাঁর ব্যক্তিক ও অস্তিত্বমূলক বিষয়-
বস্তু।নজর দিলেন ভেতরের দিকে।

১৯৩০-এর দশক: অস্তিত্বের সঙ্কট ও বিচ্ছিন্নতা

জীবনানন্দ লিখে চললেন আরও আরও ছোটগল্প। ঢের
উল্লেখযোগ্য গল্প এসময়ে তিনি লিখে ফেলেছিলেন।
বিচ্ছিন্নতা, অস্তিত্বের সঙ্কট ও মানবচেষ্টার অসার্থকতা
ই ছিল তাঁর অন্যতম থিম।
চরিত্রগুলো প্রায়শই চাকরিহীনতা অথবা বেকারি,নিঃ- সঙ্গতা অথবা অপূর্ণ ইচ্ছার সঙ্গে সংগ্রাম করতে থাকে–
যা সে সময়ে জীবনানন্দের নিজস্ব চ্যালেঞ্জ।
প্রভাব: ক) আন্তর্জাতিক – ১৯২৯-৩৯ খ্রিস্টাব্দে তৈরি
হওয়া পৃথিবীব্যাপী মন্দার সময়ে তাঁর গল্পগুলোতে লিখিত হচ্ছে মধ্যবিত্তের হতাশা ও সংগ্রাম। গল্পের
চরিত্রেরা কর্মহীনতা অথবা চূড়ান্ত আশাহীনতাকেই যেন
আঁকড়ে ধরছে। অস্তিত্ববাদের উত্থান ও মডার্নিস্ট
আন্দোলন, প্রভাবিত করছে তাঁর আত্মদর্শী খণ্ডিত
আখ্যানকে।
খ) জাতীয়: বাংলার নবজাগরণ ও সাহিত্যিক পরীক্ষা-
নিরীক্ষায় উদ্বেল কোলকাতা, বাংলা সাহিত্যের শৈলী-
গত বিবর্তনকে প্রভাবিত করছে।
মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন,
রাজনৈতিক সচেতনতাকে উচ্চতর করে তুলেছে তখন।
কিন্তু জীবনানন্দ তাঁর গল্পে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিকসংযোগ
রক্ষা নাকরে বরং তাকে সরিয়ে রাখছেন নিঃশব্দে।আর
এসব উত্থানগত ঢক্কানিনাদের বিপ্রতীপে মনস্তাত্ত্বিক
বিশ্লেষণকে মূর্ত করে তুলছেন জীবনানন্দ।

১৯৪০-এর দশক: পরিপক্কতা ও এক খণ্ডিত পৃথিবীর
প্রতিফলন –
এ সময়ে জীবনানন্দ, তাঁর বেশকিছু সর্বোত্তম ও সু-
পরিপক্ক ছোটগল্প লিখে ফেলেছেন। অস্তিত্ববাদের ওপর
তীব্রতা, মরণশীলতা, জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি,সম্পর্ক
-র ভঙ্গুরতা, স্বপ্নের অপূর্ণতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা,
প্রকৃতিকে অ-চিরকালীন ও ক্ষয়কারী শক্তি হিসেবে
প্রতীকায়িতকরণ, মানুষের জীবনের হতাশাময় দিক–
প্রভৃতি ছিল তাঁর এসময়ের গল্পরচনার থিম।

প্রভাব: ক) আন্তর্জাতিক –১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত বিধৃত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী পরিস্থিতি
তাঁর হতাশা ও অস্থিরতাকে প্রভাবিত করেছিল। যুদ্ধের
বিধ্বংসী ফলাফল ও বীভৎসতা তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর
ভেতরে ভেতরে অপ্রত্যক্ষভাবে ভঙ্গুরতা ও বিচ্ছিন্নতার
দিকে ভাষা পাচ্ছিল।
খ) জাতীয়: ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার দুর্ভিক্ষ,লোকাল
ক্রাইসিস হিসেবে তাঁর গল্পগুলোকে কম নীরক্ত করেনি।
বাংলায় বেড়ে ওঠা জাতিগত টেনশন, জীবনানন্দের
ছোটগল্পগুলোতে অস্তিত্ববাদী চেতনাকে বাড়িয়ে তুলে-
ছিল।ক্ষয়, অসহায়তা এবং বেঁচেথাকার যে বহিরঙ্গন,তা
থিম হিসেবে গল্পে জায়গা পাচ্ছিল।১৯৪০-এর দশকের
বাংলাসাহিত্য, রবীন্দ্র-সংযুক্ত আদর্শবাদী, আশাবাদী বিশ্ব চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।আর অন্যান্য সম-
সাময়িকদের মতো জীবনানন্দ, অন্ধকারময়, গভীর, আত্মদর্শী চলনটির সঙ্গে সেযুগের সমাজ-রাজনীতির
আবহের হতাশাকে সার্থকভাবে জুড়ে দিচ্ছেন।
এছাড়াও ১৯৩৯-১৯৪৫-এ বিশ্বযুদ্ধজনিত (আগেই
উল্লেখ করেছি) অনিশ্চয়তা,ক্ষয়,ডিসলোকেশন এবং
নিষ্ঠুরতা সারাপৃথিবীর অবলোকনের মতোই জীবনানন্দ
-এর গল্পলোকেও নতুনভাবে দেখতে বাধ্য করেছিল।
মডার্নিস্ট সাহিত্যিক ট্রেন্ড – Franz, Kafka, James
Joyce এবং Virginia Woolf -এর মতো লেখকরা তাঁর গল্পগুলোকে কমবেশি প্রভাবান্বিত করেছিল।

১৯৫০-এর দশক: স্থানচ্যুতি, নাগরিক বিচ্ছিন্নতা ও
পরিচয়ের সঙ্কট–
জীবনানন্দ, কবিতায় অধিকতর মেধাবী, পরিপক্ক ও
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এখনও পর্যন্ত যা জানা গেছে,
তাতে করে ১৯৪৮ খ্রি.-র পর তাঁর লেখা ছোটগল্পের
সন্ধান পাওয়া যায় নি। তবে কবিতায় তাঁর এ বৈশিষ্ট্য
গুলো কমবেশি কাজ করেছে। তাই, আমাদের এখানেই
ইতি টানতে হলো এ আলোচনার।

।।চার।। জীবনের অন্বেষণের গল্প ও জীবনানন্দ

“আমার মতন আর নাই কেউ!… আমার পথের শব্দ
শোনো—/ নতুন এ, আর সব হারানো – পুরোনো।”
প্রতি মুহূর্তে চিরাচরিত, প্রচলিত ও সমসাময়িকতাকে
ভাঙতে ভাঙতে চলছেন জীবনানন্দ। তাঁর গল্পেও ।
শুধু গল্প কেন? তাঁর কবিতায়, উপন্যাসে, প্রবন্ধে এবং
জীবনেও।’ঝরাপালক’ কে সরিয়ে রাখতে পারলেও
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে যে আদ্যন্ত বাঁক তিনি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন, তাতে,তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল মুখ্য।
‘বনলতা সেন’-এ ইতিহাসমুখরিত রোমান্টিকতা, ’মহা-
পৃথিবী’তে বিশ্বগত চেতনা,’সাতটি তারার তিমির ‘-এ
আন্তর্জাতিকতা ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ য় তাঁর
নিজস্ব রাজনৈতিকতা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। ঠিক
তেমনি করে গল্পেও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে
জীবনানন্দ জীবনেরই অন্বেষণ জারি রেখেছেন। বাঁকে
বাঁকে প্রবাহ পেয়েছে মনস্তাত্ত্বিকতা, যৌনতা, সামাজিক
তা, অর্থনীতি, দার্শনিকতা ও বৈজ্ঞানিকতা। অভিজ্ঞতা,
ব্যক্তিকতা, জৈবিকতা ও বাস্তবতা থেকে তা কখনওই
দূরবর্তী নয়– বরং স্পর্শময়, সাযুজ্যময়।
‘ছায়ানট’ ,’ সঙ্গ নিঃসঙ্গ ‘ ,আট বছর আগের এক
দিন’ ,’গ্রাম ও শহরের গল্প ‘ ,’হিসেব- নিকেশ’ ,’মেয়ে-
মানুষ ‘ , ‘কথা শুধু – কথা, কথা,কথা,কথা, কথা –প্রভৃতি গল্পে ব্যক্তিকতা,স্বগোতক্তি, মনস্তাত্ত্বিকতা,বি-
চ্ছেদভাবনা, অর্থনৈতিকতা, মতাদর্শ, প্রেম ও যৌনতার
কৌণিকতা যেভাবে চিত্রিত হয়েছে, তাতে, জীবনের
প্রতি জীবনানন্দের ক্লান্তিহীন অন্বেষণ চিরপ্রবাহমান।
অনুসন্ধানের এবং তা ঘটেছে আশ্চর্য মৌলিকতায়। হয়তো জগদীশ
গুপ্ত এবং মানিক কে আমরা, গল্পরচনায়, জীবনানন্দ- র পাশে রাখতে পারি, নিঃসন্দেহে, এরকমই অগ্রসর-
মানতায়।
আগেই বলেছি আমরা, আলোচনায় আনতে চেয়েছি
যে, তাঁর গল্পগুলোর চরিত্রেরা মধ্যবিত্ত অস্তিত্বেরই
প্রতীকায়িত রূপ। বর্ণনা হলো পরিব্যাপ্ত, ছড়ানো, মন্থর
মনোলগ যেন। শুধু বিচ্ছিন্নতা ও শূন্যতা-অনুভবী মানুষ
-এর একটানা, ক্লান্তিকর, রিপিটেটিভ স্বগতকথন যেন।
মনে হয়, জীবনানন্দ বুঝি গল্পের ভেতর দিয়ে তাঁর জন্ম
-ভূমির নিসর্গমণ্ডিত স্নিগ্ধতা ও নিজস্ব অতি-সংবেদন-
শীল এক মন নিয়ে সমস্ত স্থুলতা,হৃদয়হীনতা,অসচ্ছল-
তা,মেকি ও পাণ্ডুরতা কে প্রত্যক্ষ করেছেন। কখনও
আনন্দিত, কখনও বিমর্ষ। এবং এসবের মধ্য দিয়েই
জীবনের অনুসন্ধানে যেতে যেতে যেন পৌঁছে যান অন্য-
তর এক কাঙ্ক্ষিত – অভীপ্সিত জীবনের দিকে।জীবন-
সত্যের দিকে।
জীবনানন্দের গল্পের ভাষা অন্যধরণের- আলাদা।
এর মধ্যে তিনি যেন অভাব ও কষ্টের এক ভাষাও নির্মাণ করেছেন। উপকরণে নয়– দু’একটি সামান্য কথা
র আঁচড়ে,আপাততুচ্ছ অনুষঙ্গের উল্লেখে। কখনওবা
পারিপার্শ্বিকের আশ্চর্য কুশলী উপস্থাপনে দারিদ্র্যের এ
ভাষাকে রূপ দিতে পেরেছেন তিনি।
জীবনতো কখনও রিক্ত, সর্বস্বান্ত, দুঃখ ও বিষাদময়।
কখনও ক্ষণ-আনন্দপূর্ণ। তাঁর গল্পে রঙের বিভিন্নতা,
বৈপরীত্য,প্রতীকায়ণ– চরিত্রগুলির জীবনময়তার অনেকানেক রূপকে এঁকে রেখেছে।
ব্যক্তি- আমিকে নিয়ে জীবনানন্দ তাঁর গল্পে পর্যটনময়। এই আমি বহুস্তরিক – বহুস্বরিকও। এই আমি- র আয়নায় টুকরো টুকরো ব্যক্তি-আমিকে বিশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন যেন তিনি।
১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে, যখন জীবনানন্দ গল্পরচনার
তুঙ্গসময়ে, তখন, শরৎচন্দ্র নিজস্ব দীপ্তিতে ভাস্বর।
‘কল্লোল -কালিকলম’-এর আধুনিকতা প্রতাপান্বিত। রবীন্দ্রনাথও যেন নতুনত্বে পরিবর্তিত হচ্ছেন,অভিনবত্বে
চমৎকার। জগদীশ গুপ্তের আলাদা মূর্তিনির্মাণের
নিরন্তর চেষ্টা। বিভূতিভূষণ তাঁর পথের পাঁচালী এবং
অপরাজিতা নিয়ে সামনে এসে উপস্থিত। জীবনানন্দ
কিন্তু তাঁর বোধ ও বোধি, ইতিহাস, সমকাল ও সমাজ-
পরিবেশ নিয়ে একক ও স্বরাট। সংশয়, স্বপ্নভঙ্গ, মূল্য –
বোধের অবক্ষয় ও গ্লানি নিয়েও তিনি জীবনের অভি-
জ্ঞতাকে পবিত্র স্পর্শে সত্যস্নিগ্ধ করে রেখেছেন। চ্যূত
হন নি। জীবনের অন্বেষণে ক্লান্ত হয়ে ওঠেন নি কখনও।
জীবনানন্দ, তাঁর দ্বিতীয় পর্বের(১৯৪৬-১৯৪৮)গল্প-
গুলোতে দেশভাগ, স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা- উত্তর স্বপ্ন –
ভঙ্গকেই যে পুরোপুরি আঁকড়ে ধরেছিলেন সর্বার্থে তা
হয়তো বলা যাবে না। তবে প্রভাব তো পড়বেই। অন্তত
তাঁর মতো অনুভূতিশীল একজন কবি-লেখকের পক্ষে!
তবু, সেগুলোতেও তিনি প্রথমার্ধের ব্যক্তিজীবন বা
স্টাইলকে পুরোপুরি নস্যাৎ করেছেন,এমনটা ভাবা অনু-
চিত। যদিও লেখায় এসেছে একধরণের পরিবর্তন।
গল্পে, উপন্যাসে; তাঁর মনোভঙ্গিমায়ও। কিন্তু এ পর্বেও
জীবনের আরেক অনুসন্ধানে তাঁর ক্লান্তিহীন,বিরামহীন,
আধুনিকতার পথচলা। এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি সার্থক
‘স্বৈরাচারী ও স্বেচ্ছাচারী ‘(উত্তম অর্থেই)।’ ব্যক্তিবিস্ফো
রণ’ বজায় রেখেই যথারীতি।
১৯৪৬-এ জীবনানন্দ লিখছেন ‘ সমরেশ’ গল্প।১৯৪৬
৪৭-এ ‘বিলাস’ এবং ‘গ্রাম ও শহরের গল্প ‘ ১৯৪৭-এ
‘ডাক্তার ‘ও ১৯৪৮-এ ‘হুমায়ুন প্রেসের থেকে ‘। আমরা,
এ পর্বের কিছু গল্পকে একবার দেখে নিতে পারি।
‘সমরেশ’ গল্পে আমরা কী প্রভাব দেখতে পাচ্ছি?
ক) দেশভাগের অব্যবহিত আগে ঘটেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যদিও এ গল্প দেশভাগের কথা বলছে না (বলার
সুযোগও নেই),তবুতা খুব সুক্ষ্মভাবে মনস্তাত্ত্বিক অশান্তি
,যা ঐসময় বাংলাকে ঘিরে ধরেছিল,তার কথাও বলছে
অবশ্যই। ব্যাপক ক্ষয় ও স্থানচ্যুতি, গভীর প্রভাব ফেলে-
ছে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে উদ্ভুত অনিশ্চয়তার
ঘেরাটোপে।
খ) অস্তিত্ববাদী ও মনস্তাত্ত্বিক অশান্তি –’সমরেশ’ চিত্রিত
হয়েছে এমন একটি চরিত্র হিসেবে,যে ভোগ করছে এক
নৈতিক ও অস্তিত্বগত দ্বিধা। জীবনের প্রকৃত অর্থ ও
মানুষের অপরিসীম দুঃখকষ্ট –এই বোধ যেন এখনও
তাড়া করে ফিরছে জীবনানন্দকে।
গ) চরিত্রগুলোর আত্মদর্শনের ভেতরে ভেতরে খুব সম্ভবত Jean- Paul Sartre ও Albert Camu – র মতো আন্তর্জাতিক চিন্তাবিদদের ভাবনার প্রতিফলন
ঘটেছে।
ঘ) নৈতিক অস্পষ্টতা– সমরেশের দৃষ্টিভঙ্গি যেন অস্পষ্ট
-তাঘেরা– না আশাবাদ,না পুরোপুরি হতাশাব্যঞ্জক- যেন
বাংলার বিধ্বস্ত পরিবেশকেই দিকনির্দেশ করছে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-জনিত সামাজিক ভাঙনই সম্ভবত এ
চরিত্রনির্মাণের জন্য তাঁকে প্ররোচিত করেছে। প্ররোচিত
করেছে নীতিপরায়ণতা ও ব্যক্তিগতভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে এক ধূসররেখা অঙ্কন করার পথনির্দেশে।
ঙ) শাহরিক বিচ্ছিন্নতা– শহরের নিরপেক্ষতা ও ভঙ্গুরতা
য় তাঁর প্রোটাগোনিস্ট অনুভব করছে জনতার মধ্যেও
বিচ্ছিন্নতা,একা হয়ে যাওয়া, মানুষে মানুষে মানবিক
সম্পর্ক ও নৈকট্যের ক্ষয় ও ক্ষতি।
চ) ন্যারেটিভ স্টাইল – মডার্নিস্ট অ্যাপ্রোচের সঙ্গে এসে
মিশেছে উপসংহারে ওপেন-এণ্ডেডনেস। সেসময়ের
ঐতিহ্যগত ন্যারেটিভ স্টাইলকে ভেঙে ফেলেছে আত্ম-
দর্শী টোন।
বিলাস,গ্রাম ও শহরের গল্প এবং ডাক্তার –এই তিন
গল্পেও দেশভাগ, আইডেন্টিটির ক্ষয়,ক্রূর শাহরিক বাস্ত
-বতা,নৈতিকঅবক্ষয় প্রভূতভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
জীবনানন্দ যেন আরও পেসিমিস্টিক এবং অস্তিত্ব-
সন্ধানী হয়ে উঠেছেন।
তাই,একথা বলার অপেক্ষা থাকে না যে,জীবনানন্দ
তাঁর জীবদ্দশায় উপযুক্ত সমাদর না পেতে পারলেও
(যেহেতু অপ্রকাশিত; কিন্তু প্রকাশ যদি পেতোও) তাঁর
গল্পগুলোর সাহিত্যিক ও নান্দনিক মূল্য, তাঁর মৃত্যুর পর
, অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে চলেছে। তাঁর মৃত্যুর
সত্তর বছর অতিক্রান্তপ্রায়। কিন্তু আজও তাঁর কনট্রি-
বিউশন – আমাদের এই বাংলা গল্পবিশ্বে–তুলে ধরেছে
এক বোল্ড ডেভিয়েশন। পথনির্দেশ করে দিতে পেরেছে
পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে; আরও বেশি আত্মদর্শী, আরও
বেশি এক্সপেরিমেন্টাল ন্যারেটিভস্ -এর জন্ম দিতে
দিতে। তিনি যেন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক
জন স্বপ্নদর্শী মডার্নিস্ট লেখক হিসেবে,যাঁর সৃষ্টি এখনও
অধিকার করে আছে– অনুশাসনের মতো – বাংলা
সাহিত্যের আলোকিত ঢাল। কবিতার মতোই, তাঁর ছোট
গল্পও, তাঁর বিশ্বব্যাপী অস্তিত্ববাদী বোধকে (স্থানীয়
বাস্তবতার মধ্যেও) নিয়ে সমান প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করতে পেরেছে আজও।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

ঋণস্বীকার: –

।।এক।। ভট্টাচার্য,সুখেন্দ্র,’জীবনানন্দের ছোটগল্পে
আধুনিকতা এবং জীবনবোধ,’শিলীন্ধ্র’, জীবনানন্দ
সংখ্যা,৩য় সংখ্যা, কার্তিক,১৪০৫
।। দুই।। রাজা সুব্রত,’ বোধ করোজ্জ্বল কারুভাষা জীবনানন্দের গল্প,’ উত্তর ধ্বনি ‘, কলকাতা,শারদ সংখ্যা ১৪১২
।। তিন।। বন্দোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ,’ জীবনানন্দের গল্প
উপন্যাস: সংলগ্নতা অসংলগ্নতা,’জীবনানন্দ আকাদেমী
পত্রিকা, চার সংখ্যা
।।চার।। পত্রী, পূর্ণেন্দু,’গল্পের জীবনানন্দ ‘,মাঝি,শারদ
সংখ্যা (জীবনানন্দ বিশেষ সংখ্যা), কলকাতা,১৩৮৪
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes