
অভিষেক বসু-র গল্প
আদি ও অকৃত্রিম
কোথায় আমার বেশী অস্বস্তি? অচেনা জায়গায়? অচেনা লোকের মাঝে? না কি এমন মানুষের মাঝে যাদের সংস্কৃতি একেবারে আলাদা? অচেনা নয়, আলাদা। অপছন্দের। ছোটলোকের।
শহরতলী ছাড়িয়ে ট্রেন চলেছে আরো দূরে। দঁড়িয়ে ছিলাম, সামনের জন সরে বসার জায়গা দিলেন। তিনজনের বসার জায়গায় কষ্টে-শীষ্টে চারজন। তেমন অসুবিধা নেই, তবে অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ? কোনো প্রত্যক্ষ কারণ নেই ছোটবেলা থেকে বয়ে চলা দূরত্ব ছাড়া। সবার বেশভূষায় আভিজাত্যের ছোঁয়া না থাকলেও যথাযথ, কথাবার্তা ভালো। পাশে বসা লোকটি তো নিতান্তই অমায়িক। সৌজন্য বজায় রয়েছে। অস্বস্তিও।
আরো অস্বস্তি হয় কিছু খুঁজে না পেলে। আসলে, পারিবারিক শিক্ষা দীক্ষা, সভ্যতার ব্যাপারটাই এমন, অন্তসলিলা, উপরটা না খোঁচালে চট করে ধরা যায় না। সবসময় দরকারও পড়ে না। দরিদ্রদের নিয়ে ওসব ভাবার কিছু নেই। ক্ষয়িষ্ঞু ভদ্রলোককেও প্রতীকী সম্মানটুকু দিলেই যথেষ্ট। মুশকিল হয় উঠতি বড়লোক নিয়ে, যদি তারা নেশা করে না ছড়ায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মদ্যপদের তবু একটা শিল্পী সত্তা থাকতো; উঠতিদের পয়সা ছাড়া থাকার মধ্যে ঐ নেশাটুকুই।
অবসরের পর আজকাল এই পার্থক্যগুলো চোখে পড়ে। একেই ফর্মুলার মত প্রয়োগ করি, একে দিয়েই ব্যাখা করি, বোঝার চেষ্টা করি। যেখানে পারি না, যেমন এই ট্রেনের কামরার লোক, বিশেষত পাশে বসা লোকটির ক্ষেত্রে, বড় অস্বস্তি হয়। কোনো দলেই ফেলা যাচ্ছে না। সমগোত্রীয় মেনে নিতে বাধো বাধো ঠেকছে, অথচ না মেনে নেওয়ার কারণ পাওয়া যাচ্ছে না।
নিখুঁত ব্যবহারে মনটা বসে যাচ্ছে কেমন। একবার বিদ্রোহী হয়ে ভাবি, কেনই বা মেনে নিচ্ছি না? শহর থেকে এত দূরে কি শিক্ষিত ভদ্রলোক থাকতে পারে না? বনেদি পরিবারগুলো ছিল না একসময়?
সব তো ধ্বংস করে দিয়ে গেল। ভদ্রলোকের ছেলেরাই ভদ্রলোককে টেনে নামালো নেতার জায়গা থেকে, আর তারপর নিজেরাই চলে গেল ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে। অশিক্ষিত ভুঁইফোঁড়দের রমরমা। কান্ডজ্ঞানের অভাব। ধরা পড়ে যাবেই।
ঠিক সেরকমও নয় লোকটা। আবার আমাদের মতোও নয়। তবে ফ্যাসাদ এটাই যে কিন্তু তাতে তাকে কম কিছু মনে হচ্ছে না। আমাদের মত, আমাদের মনের মত না হয়েও সবটুকু ঠিকঠাক, মেনে নেওয়া যায় না।
না কি সবাইয়ের মত আমাকেও মেনে নিতে হবে? পরিবার-পরিজন, বন্ধু -বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীর জীবনযাপনে বা সংবাদ মাধ্যমে যে অবক্ষয়ের ছবি ধরা পড়ে, তার মাঝে একা তালগাছের মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আমার সংস্কৃতি নেহাতই কূপমন্ডুকের সমুদ্র-ধারণা বা অন্ধের হস্তি-দর্শন? আমাদের সুপরামর্শ ছাড়াই পৃথিবী ঠিক চলতে পারে? এত পুরুষের উচ্চশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের জীবন-দর্শন ছাড়া অন্য উদ্ধারকর্তা আছে এই নৈরাজ্যে? এতকাল যাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালিত এবং পরিশীলিত বিচক্ষণতা, কৌলিন্য জেনে এসেছি, যার অভাবে, যাকে অবহেলা করে আজ এই সমাজ এমন পতনোন্মুখ বলে বিশ্বাস করে এসেছি, তা অপরিহার্য নয় প্রকৃতপক্ষে?
হঠাৎই এক কটু পচা গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। পাশের লোকটি কি একটু নড়লেন তার আগে? আমার আশঙ্কাকে সঠিক প্রমাণিত করে নাকে হাত উঠলো কিছু, অন্যরা উশখুশ করে উঠলো। স্বাভাবিক। বাতকর্মের কুফল ভোগ করেছি আগেও, কিন্তু এমন বিরল দুর্গন্ধের সঙ্গে পরিচয় হয়নি কখনো। কি ধরনের খাদ্যাভ্যাস থেকে এমন হতে পারে, কে জানে?
স্বস্তি পেলেম; মনে রহস্য উন্মোচনের গর্ব। ধরা পড়ে গেল এতক্ষণে! এক মূহুর্তে খামতিটা এই উৎকট গন্ধের মতো জানান দিচ্ছে অস্তিত্ব। দেখতেই এমন! ভিতর ভিতর অভ্যাস, যেমন খাদ্যাভ্যাস সেই আদিম যুগেই পড়ে রয়েছে; একেবারে অনুন্নত, প্রিমিটিভ।
চেপেচুপে সবার মধ্যে বসলেও ভদ্রলোকের নিজস্ব আদি ও অকৃত্রিম জায়গা আজও সুরক্ষিত।