মানস সরকার-এর গল্প

মানস সরকার-এর গল্প

প্রতিদ্বন্দ্বী

আমার উল্টোদিকে বসে ছেলেটা নিজের আলট্রা মড ট্যাবটায় স্লাইড করে মন দিয়ে কিছু পড়ে যাচ্ছিল। এ সব দৃশ্যে এখন আমার ভয় ধরে। এসি মেট্রো ট্রেনের গোটা কামরাটায় যেখানে দেখতে পাচ্ছি, বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মানুষ মনপ্রাণ ঢেলে নিজের মোবাইলে অনলাইন গেম, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি বা ভিডিও, সিনেমা বা অনলাইন চ্যাটে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে সফরের এটুকু সময়ে, তখন এইসব হরিদাস পালকে কিছু পড়তে দেখলে অস্বস্তি শরীরে যেন হুল ফোঁকায়।
প্রায় বছরখানেক পর অশেষ ঘোষালের সঙ্গে নিজের শহর শ্রীরামপুর থেকে কলকাতায় দেখা করতে যাচ্ছি। দেখাটা উনি করতে চেয়েছেন। আমি গুঁইগাঁই করে শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিয়েছি। বলা যায় না, মুখোমুখি দেখা হলে আবার কী কাজ চাপান। শেষ দু-বছরে ওঁর কম কাজ তো উতরে দিইনি।
আসলে আজকাল আমি যে জীবনের একটা ভাসমান ছন্দে আবার ফেরত গেছি, তার কিছুটা কৃতিত্ব পকেটস্থ করতেই পারেন অশেষ ঘোষাল। তাই দেখা করার ব্যাপারটায় নিজের দর বাড়াইনি। তা ছাড়া দেখা বা কথা মানে তো স্বার্থটা শেষ পর্যন্ত আমারই।
এই ২০২৬ সালে পৌঁছে ভাবি, যখন পৃথিবীর আর আমার দেশের বহু মানুষ কর্মচ্যুত, স্বাভাবিক জীবনযাপনও একটা বিলাসিতা, সেখানে আমি তো মোটামুটি ভালই আছি। তার কৃতিত্বটা না হোক শুরুটা তো হয়েছিল এই অশেষ ঘোষালকে দিয়ে। আচ্ছা, একটু খুলেই বলি। মানে, লিখি।
কন্টেন্ট রাইটার হিসেবে আমার নিজে নিজেকে আবিষ্কার কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই। কোভিডের সে বছর টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে হাইসেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরোল। আর্টসে রেজাল্ট আমার বলার মতোই হল। বাংলা অনার্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। অনার্সের একটা বছর কলেজে অনলাইন ক্লাস। কোভিড ও কোভিড পরবর্তী নানা রকম জটিলতা। বাড়িতে অনেকটা সময় বন্দি। অনলাইন ক্লাস, টিউশন করেও ফাঁকা। হাতে পেয়ে গেছি বাবার কিনে দেওয়া ব্র্যান্ড নিউ স্মার্টফোন।
একদিন হঠাৎ করে চোখে পড়ল কনটেন্ট রাইটারের বিজ্ঞাপন। কিছু সে ভাবে না বুঝেই অ্যাপ্লাই করে দিলাম অনলাইনে। বেশ কিছুদিন পর কোম্পানির তরফে ফোন করে যোগাযোগ । ব্যাপারটা কী বুঝিয়ে, তিনটে কনটেন্ট লিখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মেল করতে বলা হল।
সহজ অথচ নিখুঁত ব্যাকরণসম্মত বাংলা বলতে যা বোঝায়, তা লেখার ব্যাপারে হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকেই আত্মবিশ্বাস বীজ থেকে বৃক্ষ হয়ে উঠেছিল। লেগে গেল লেখাগুলো। একটা বছর বাড়িতে কলেজ সামলেও কনটেন্ট ব্যাপারটা আদতে কী, বুঝে ফেললাম। অনেকরকম কনটেন্টের আদল বুঝে কোম্পানি চেঞ্জ করেছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারে গিয়ে কোভিডের নিউ নরম্যালে যখন কলেজ খুলল ভ্যাকসিন-ট্যাকসিন নিয়ে, আমি ততদিনে ‘উইংস’-এর মতো কোম্পানিতে নিজের পা শুধু জমিয়ে ফেলিনি, রোজগার চড়তে শুরু করেছে মই ধরে।
নিজের গ্রাজুয়েশন সামলে যাকে বলে দুর্ধর্ষ চালাচ্ছিলাম। বুঝে নিয়েছিলাম টাকার মশলা যে কোনও অবস্থায় জীবনের স্বাদকে বদলে দেয়।
বিপর্যয়টা ঘটল পারমানবিক চেন রিঅ্যাকশনের মতো গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল সেমিস্টারের পর থেকেই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কানাঘুষোয় এদিক-ওদিক থেকে মাছির ভনভন । ততদিনে নিজের ল্যাপটপ কিনে কেরিয়ার কনটেন্ট রাইটিং-এ-ই করব, সিদ্ধান্তে অটল। মোটামুটি একটা রেজাল্টের ফ্ল্যাগও উড়িয়ে দিয়েছি গ্রাজুয়েশনে।
‘টক জিপিটি’ লঞ্চ হবার পরও প্রথম দু-তিন মাস যে তার খুব সরাসরি প্রভাব পড়ছিল এমন নয়। খোঁজখবর নিয়ে দেখেছিলাম। অনেকটা গুগল’এর মতোই তথ্য দেয়। কিন্তু একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে। প্রয়োজনের আকারে। কিন্তু ভার্সন ইমপ্রুভ করতেই মাথা ঘুরে গেছিল। দেখলাম অংক, এডিটিং, ভিডিও অ্যাকুরেসি, সিচুয়েশন হ্যান্ডলিং, পারমুটেশন-কম্বিনেশন, পলিসি মেকিং, হিউম্যান লাইক ফিডব্যাক, স্ট্যাটেসটিক্স, রেকর্ড বিল্ডিং, সব রকম ইনোভেটিভ আইডিয়া, নতুন সফটওয়্যার ডেভলপ সবই প্রায় একটা ইলেকট্রনিক মস্তিষ্ক করে ফেলছে। বিপদের আঁচ করলাম যখন দেখলাম ক্রিয়েটিভ সেক্টরেও এর দাঁত বসছে। কোনও পরিচিত প্রবন্ধ, গল্পের রিভিউ, কবিতা থেকে লিরিক্স, বা বিষয় দিলে তা থেকে সাজিয়ে দিচ্ছে কবিতা ,গল্পও। দু-তিনটে নতুন ভার্সনের পর দেখলাম স্মার্টফোন প্লে-স্টোরে, এমনকী র‌্যাপচ্যাটের রোবট ফিচারেও ঢুকে পড়ল এর করাল গ্রাস। অ্যাসাইনমেন্ট ক্রমশ কমছিল আমার। বুঝতে পারছিলাম, বিভিন্ন কোম্পানি পয়সা খরচ করে কর্মী রেখে ক্রিয়েটিভ আইডিয়া বা রাইটিং-এর জন্য পয়সা খরচ করতে চাইছে না। সফটওয়্যার, টিচিং, ব্যাঙ্কিং, আর্ট ডিজাইন বিভিন্ন সেক্টরে কর্মী ছাঁটাই বেড়ে যাচ্ছিল। রক্তচাপ বাড়ছিল আমার।
সব সেক্টরে কর্মী সংকোচন, চাকরির বাজারের হতকুচ্ছিত অবস্থা পুষ্টি দিচ্ছিল আমার হতাশাকে। একটা ভয় পেয়ে বসছিল। বাবার রিটারমেন্ট এগিয়ে আসছে, সরকারি খুব টপ লেভেলে সীমিত সংখ্যক চাকরির জন্য যে ধৈর্য আর প্রতিযোগিতার দৈত্যদের মুখোমুখি হতে হত, সে যাদুক্ষমতা আমার ছিল না। ব্যবসাতেও খুব একটা স্কিল নেই। সামান্য যে কটা টাকা আছে, তা ইনভেস্ট করে রিটার্ন পাবার আশাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। সেলস, মার্কেটিং-এ চেষ্টা করেও সুবিধে করতে পারলাম না। যে সব সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি চলছে, তাও কুঁচকে আসছে। উপরন্তু আমার ডিগ্রি নেই সেখানে কাজ করার। ‘না’-শব্দটা সেঁধিয়ে গিয়ে আমার মস্তিষ্ককে বিকারের বিছানায় শুইয়ে ফেলেছিল।
একটা প্রকাশনায় সাব-এডিটরের জন্য চরম খারাপ ইন্টারভিউ দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেরই একটা ক্যাফেতে বসে এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ব্যাজার মুখে বসেছিলাম। মনে পড়ছিল, অম্বল রুগীর মতো চেহারার ভ্রঁ কুঁচকে থাকা প্রকাশনার মালিককে। যতক্ষণ বসে কথা বলছিলেন, একটা বাডস দিয়ে কান খোঁচাচ্ছিলেন। একটা চোখ প্রায় আধবোজা হয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। এখন বই বিক্রি হয় না। পাঠক নেই। যে কটা কাজ আসছে, তাও যে কোনওদিন থেমে গিয়ে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি আমাকে দিলেও মাইনে সে রকম কিছুই দিতে পারবেন না। তার উপর আমার তো আবার সম্পাদনায় কোনও অভিজ্ঞতার ময়ুর পালক নেই।
কনটেন্টের অভিজ্ঞতা আমাকে এই কাজে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাবে, বোঝানোর চেষ্টা করেও যখন ওনার দুটো চোখই বুজে আসছিল, নিজের এক্সপেরিয়েন্সের আর মার্কশিটের ফটোকপিগুলো ওনার হাতে জোর করে ধরিয়ে দিয়ে চলে এসে কফির অপেক্ষা করছি।
‘না, না প্লিজ, আপনি আর একটু ধৈর্য ধরুন’, কাতর গলার কথাটা শুনে পিছনের টেবিলে ঘুরে চোখ রেখেছিলাম।
ফিটিংস’এর দামি জামাপ্যান্ট ও ব্লু-টুথে ভদ্রলোককে প্রথম দফায় দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিজনেসম্যান, বুঝি কিছু বিজনেস ডিল করছেন। আমার সঙ্গে চোখাচুখি হতেই অল্প হাসলেন। মনে হল, জোর করে। ঘুরে আবার কফির কাপে চুমুক দিয়েছিলাম। বিচ্ছিন্ন কথাগুলো কানে আসাকে যদিও আটকাতে পারছিলাম না।
‘সে হোক। কিন্তু আমার বিশ্বাস পড়বেই।’
‘………………….।’
‘উই’এর ওষুধ দিন। সে নয় ও খরচটাও দিয়ে দেবো।’
‘…………………….।’
‘ঠিক আছে। পুজো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তার মধ্যে দেখে নিচ্ছি।’
‘……………………..।’
‘সে জানি। লোকে এখন পড়ে না। সাহিত্য তো একদম নয়। ঠিক আছে….।’
‘………………………।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ নমস্কার।’
এবার পিছন না ফিরেই বুঝতে পেরেছিলাম ভদ্রলোক বেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন।
কফি শেষ করে পালাচ্ছিলাম, ভদ্রলোকের সঙ্গে আবারও চোখাচুখি। ব্রেক দিয়েছিলাম পায়ে। মুখ থেকে বেরিয়ে গেছিল ‘সব ওয়ার্ক সেক্টরেই অবস্থাটা একইরকম।’
ভ্রু তুলেছিলেন উনি, ‘আমার ব্যাপারটা সে রকম নয়।’
আমার মুখে বোধহয় অবাকভাব ছিল। ইশারায় ওঁর টেবিলে বসতে বলে বলেছিলেন, ‘আর একটু কফি চলতে পারে?’
‘পারে।’
আজকাল কেউই কারোর সঙ্গে অযাচিত বাক্যালাপ করে না, পরিচিত হতে চায় না। নিজের সমস্যায় নিজেই তখন উচাটন। তবুও কফির অফার মাথায় রেখেই বলেছিলাম, ‘আপনি বোধহয় কোনও ব্যাপারে টেন্সড। আসলে সব একেবারে গুলিয়ে গেছে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স।’
‘আমার ব্যাপারটা ঠিক তা নয়’, আমার কথার মানেটা মনে হয়েছিল উনি না বুঝেই মধ্যিখানে বলে উঠেছিলেন।
ঠিক কী জন্য, কীসের ডাকে বসে পড়েছিলাম, জানি না। এখন মনে হয়, যা হয়েছিল, ঠিকই হয়েছিল। সামান্য ইতঃস্তত করে বলেছিলাম, ‘কী রকম?’
‘কলেজ স্ট্রিটে যখন আসা হয়েছে, তখন বই-লেখালিখি ব্যাপারটা জানা আছে, ধরে নিতে পারি।’
মনে হয়েছিল, আমাদের বয়সের পার্থক্যটা উনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু একেবারে অচেনা বলে এখনও আপনি না তুমি, ঠিক কী সম্বোধন করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। সহজ গলায় বলেছিলাম, ‘তা মোটামুটি আছে। ইনফ্যাক্ট আমার কাজটা লেখালিখির সঙ্গেই যুক্ত।’
ওঁর ভ্রু গভীর হয়ে কুঁচকেছিল, ‘তাই নাকি! আজকাল তো সবাই লেখক। পাঠক বলে কিছু হয় না।’
ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি চলকেছিল আমার, ‘আপনি যে-অর্থে ভাবছেন, আমি সে অর্থে লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত নয়।’
চুপ করে চেয়েছিলেন আমার দিকে উনি। কনটেন্ট রাইটিং’এর ব্যাপারটা ভেঙে, খুলে বোঝাতে হয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর উনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ ব্যাপারটা হালকা হলেও কিছুটা জানা।’
‘কিন্তু এখন এই সেক্টরেও ভয়ংকর কোপ পড়েছে।’
‘সেটা আর কোথায় পড়েনি! ওই যে বললাম, সাহিত্যের লেখালিখিও গভীর জলে। সবাই লিখছে। তবে বেশিরভাগই শখে। লক্ষ করলে বোঝা যায়, গরিব অন্য জায়গায় থাকলেও গরিব লেখক বলে এখন কিছু হয় না। সিরিয়াস লেখা প্রায় নেই বললেই চলে। সাধারণ মানুষ জীবনযুদ্ধে প্রচন্ড ব্যস্ত। তারা সাহিত্য-টাহিত্য ব্যাপারটা নিয়ে কেউ এত মাথা ঘামায় না।’
‘সেটা তো চিরকালই ছিল।’
এক পলক বলা কথাটার জন্য উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, আমার পাকামিতে উনি দুর্গন্ধ পাচ্ছেন।
‘না, না, চিরকাল নয়। কিছু বছর আগেও মানুষ অন্তত বাঙালির এন্টারটেইনমেন্টে সাহিত্যের একটা বড় ভূমিকা ছিল। টেকনোলজির অ্যাডভান্সমেন্ট সব নয় ছয় করে দিল।’
উপর-নীচে ঘাড় নেড়ে সমর্থন করেছিলাম ওঁকে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে উনি বলেছিলেন, ‘চলো, বেরনো যাক।’
কফি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আপত্তি না করে বেরিয়ে দিঘির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম আমরা দু’জন। চারপাশে নানা দেশের খাবার আর ড্রিঙ্কের স্টল। কলেজ স্ট্রিটে এখন লোকে বইয়ের ঐতিহাসিক জায়গা হিসেবে দেখতে আসে। কেনাকাটা নেইই।
‘আমার একটা প্রস্তাব আছে,’ হাঁটা থামিয়ে ছিলেন উনি।
অবাক হয়েছিলাম, ‘কীরকম।’
‘আমি কিছু বই ছাপিয়েছিলাম। সেগুলো স্ট্যাক হয়ে পাবলিশারের ঘরে পড়ে আছে। কয়েকটা আমি তুলে এনেছি,’ ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে পিঠের ব্যাগ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘অনেককে পড়ার জন্য বলেছি। বিনা পয়সায়। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। তুমি একটা বই নিয়ে একটু পড়বে?’
ভেতরে বিরক্তির বুড়বুড়ি চেপে বলেছিলাম, ‘কিন্তু আপনার বই আমি পড়তে যাব কেন!’
‘না, না, দাম দিতে হবে না।’ দিঘির জলে সামান্য ঢেউ মনে হল। একটা কাক ডানা ঝাপটে এসে দিঘির রেলিং’এর উপর বসল। কী মনে হল, বলে দিয়েছিলাম, ‘দাম আমি দেব না। আপনি দেবেন।’
‘মানে!’
‘আমি আপনার বই, লেখা পড়তে পারি। কিন্তু সেটা একটা পরিশ্রম। আর তার পারিশ্রমিক আপনাকে দিতে হবে।’
চোখগুলো হঠাৎ ওর খুব উজ্জ্বল লেগেছিল। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বলেছিলেন, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও। এটা তো দারুণ বললে। কিন্তু আমি জানব কী করে, তুমি আমার বই বা লেখা পড়েছ।’
‘আপনাকে আমি রিভিউ দেব লিখিত। যে ভাবে আমি আগে কোনও কনটেন্টকে ক্রিটিক্যালি রিভিউ করতাম।’
‘বাহ্, অসাধারণ। কিন্তু লেখা খারাপ লাগলে?’
মনে সাহস বাড়ছিল। বলেছিলাম, ‘আমি কায়দা করে লেখার ভাল দিকটাই বলব।’
চোয়াল শক্ত করে উনি বলেছিলেন, ‘আমার প্রচুর পয়সা। তুমি পড়ো আর লেখো। পয়সার জন্য ভেবো না।’
না, ভাবতে হয়নি। মাত্র কয়েকমাসেই আমার পড়ার সত্তাকে কাজে লাগিয়ে যে প্ল্যাটফর্ম নিজের সম্পর্কে তৈরি করলাম, তাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলাম। বলতে গেলে আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীই তৈরি হল না। সদ্য লেখা যে বই সম্পর্কে ভাঁড়ারে তথ্য নেই, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তখনও পর্যন্ত তার রিভিউ লিখতে পারে না। এমনকী সাধারণ কিছু তথ্য তাকে দিলেও তা খুব কংক্রিট লেখায় পরিণত হয় না। ফলে দ্রুতই বেড়ে উঠেছিলাম।
ভদ্রলোকের নাম সেদিনই জেনে গিয়েছিলাম। অশেষ ঘোষাল। নিজের বই এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি পড়ে রিভিউ দাও, আমি তোমাকে টাকা দিতে রাজি।’
বুকে যথেষ্ট হাওয়া ভরে বলেছিলাম, ‘আমিও রাজি। কিন্তু ওই পেমেন্ট মোডটা ঠিক রাখতে হবে।’
‘ডান। তুমি রিভিউ আমাকে পাঠাবে। আমি পড়ে দেখব। পরিচিতদের পাঠাবো চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তোমাকে অনলাইন পেমেন্ট। তবে একটা কথা।’
‘কী’, সামান্য দুরু দুরু হয়েছিল বুক।
‘তুমি লোকেন মল্লিকের নাম শুনেছ?’
‘না।’
‘গুড। শুনে লাভও নেই। তুমি কাজ চালিয়ে যাও। যোগাযোগ থাকবে।’
যোগাযোগ এখনও পর্যন্ত ঠিকঠাকই রেখেছি। শুধু অশেষ ঘোষাল কেন, অনেক লেখকের সঙ্গেই এই মুহূর্তে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। নিজের পেজ খুলেছি, গ্রুপও। নামে। বেশ কয়েকটা বেনামে। নিজের নামে যে পেজ সেখানে অশেষ ঘোষালের লেখা পড়ার পর প্রতিক্রিয়া দিই। কখনও দারুণ প্রশংসা করে। কখনও লেখাটার গঠনগত দিক দেখিয়ে। কখনও নিন্দেও করি। ব্যালেন্স করতে। সেটা অবশ্য ওঁর সঙ্গে আলোচনা করে। উনি আমার মতো এ ধরনের লেখা লিখতে পারেন না। কিন্তু কোয়ালিটি বোঝেন। ছোটখাটো বেশ কয়েকজন লেখকের লেখাও দিই সেখানে। আবার অন্য পেজে অন্য নামে যা আছে সেখানে লিখি অন্য লেখকদের নিয়ে। সেখান থেকেও আসছে রোজগার।
একটা জিনিস স্পষ্ট। লেখক ভুরি ভুরি থাকলেও বাংলা লেখার বাজারে পাঠক বিরল, দুষ্প্রাপ্য প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। যারা লিখছে, বই বিক্রি না হলেও তারা মানুষকে জানান দিতে চায়। ফলে যে কজনের কাজ করছি এই মুহূর্তে, তাদের কাছে আমার ডিমান্ড গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। আমার কাজ খুব খেটে, ডিটেলে। নিন্দে প্রশংসা যাই-ই করি, তাতে ঠিকরে বেরোয় আমার সাহিত্য জ্ঞান। ফলে বাজারে এই মুহূর্তে কোনও কম্পিটিটর নেই আমার। টাকা আসছে। কাজ চালাচ্ছি। তবে আমি সিলেকটিভ। লোভের বশে সব অফারই নিই না। পেজ, অ্যাকাউন্টে হুটহাট কারোর কোয়্যারীর উত্তর বা ফোন নং দিই না। কাজ যা নিই, পার্সোনাল কনট্যাক্টে। ফলে এখনও পর্যন্ত কোয়ালিটির পোষ্টার পড়েছে আমার সাইনবোর্ডে। সবচেয়ে বড় কথা, কোনও লেখক অপরকে আমার পেমেন্টের ব্যাপারটা ফাঁস করেনি। ফলে কনটেন্ট রাইটারের কাজ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেও, আমি কাজের নতুন দিশা খুঁজে নিয়েছি।
এখন অশেষ ঘোষাল কী জন্য ডাকল সেটাই চিন্তা করছি। লেখকদের সঙ্গে সাধারণত মুখোমুখি হই না। এটাও আমার একটা পলিসি। বেশিরভাগই এইসময় ‘ই-বুক’। সামান্য যা বই আকারে প্রিন্ট হয়, তা আসে আমার অন্য একটা ঠিকানায়।

এতদিন পর অশেষ ঘোষালকে দেখে বেশ লাগল। চেহারায় বেশ একটা চিকনাইভাব এসেছে। বই বিক্রি করে টুপাইস ইনকাম করার লক্ষ্য ওঁর অন্য বড়লোক লেখকদের মতো কোনওদিনই ছিল না। শুধু নাম। প্রচার। তার অনেকটা না হলেও কিছুটা আমি দিয়েছি। সেই নামের ছোঁয়ায় চেহারায় বেশ একটা জেল্লা। তাতে অবশ্য আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার গাঢ় ভাবটা এতটুকু লঘু হয়নি।
আজ ডেকেছেন পার্ক স্ট্রিটের একটা অত্যন্ত দামি ও নামী পানশালায়।
‘তুমি সিঙ্গেল মল্ট নেবে তো’, চেয়ারে বসেই আপন করা ভাবের প্রথম তিরটা ছুঁড়লেন।
দামি জিনিস খাওয়াচ্ছেন বলেই যে খেতে বা পান করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। দোনামোনা করে বললাম, ‘একটা।’ ড্রিঙ্কসের সঙ্গে উনি দুটো চিকেন সিজলারেও অর্ডার দিলেন। অপেক্ষা করছিলাম। শুরুটা উনিই করুন।
করলেনও, ‘তোমার শুনলে ভাল লাগবে আমার একটা গল্প থেকে ফুল লেন্থ ফিচার ফিল্ম হচ্ছে ওটিটিতে।’
পানীয় গলা দিয়ে কিছুটা নামিয়ে বললাম, ‘আনন্দের খবর। অভিনন্দন।’
‘কিন্তু সিনেমাটা রিলিজ হলে এটা নিয়ে তোমাকে পজিটিভ কিছু লিখতে হবে।’
‘কিন্তু আমার কাজ তো লেখা নিয়ে লেখা। সিনেমা নিয়ে……’
‘তোমার এই লেখাটা মূলত ফোকাস থাকা উচিত আমার গল্প নিয়ে। এ বার তোমাকে আমি ডবল পেমেন্ট করব।’
গ্লাসটা ঠোঁটে ছুঁইয়েও নামিয়ে রাখি। মাপতে থাকি ওঁর অফারটা। ভাবতে থাকি আলাদা করে আবার কোনও পেজ খুলবো কিনা যেখানে শুধু আলোচনা করব সিনেমা নিয়ে। সেটা আমার প্রফেশনের আর একটা দিক হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সিনেমা নিয়ে লেখার অভিজ্ঞতা নেই আমার। আবার নতুন করে তৈরি হওয়ার ব্যাপার থাকছে। সবচেয়ে বড় কথা, সময়ের বড় অভাব।
‘ভেবো না। রাজি হয়ে যাও। শুরু করলে তরতর করে এগিয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত।’
অনিশ্চিত লাগছিল। বললাম, ‘সেটা নয় ভাবছি। কিন্তু আপনি কি শুধু এটা বলার জন্যই ডাকলেন আজ?’
উশখুশ করছিলেন অশেষ ঘোষালও। ভাবটা যেন, ঠিক তা নয়। পরপর গ্লাস থেকে দু তিন চুমুক দিয়ে আমার চোখে চোখ রাখলেন উনি, ‘একটা কথা বলার ছিল।’
‘বেশ তো। বলুন না।’
সামান্য সময় চুপ করে থাকলেন অশেষ ঘোষাল। বোধহয় ঠিক করে নিলেন কী বলবেন।
‘যতটুকু যা জানতে পেরেছি, তুমি অন্য কয়েকজন লেখককেও নাকি একটু মার্জিন দিচ্ছ আজকাল।’
প্রস্তুতই ছিলাম এ রকম কথা শোনার জন্য। বললাম, ‘তাতে আপনার তো কোনও ক্ষতি হয়নি।’
‘তা হয়নি,’ বলে আবারও কিছু ভাবলেন উনি।
সিজলার ট্রে টেবিলে হাজির হয়েছিল। হিসহিস শব্দ করে ধোঁয়া আর শব্দ আমাদের দুজনের মধ্যিখানে কেবলই ফণা তুলছে। এ বার উনি বললেন, ‘আচ্ছা ওনাদের ব্যাপারে না লেখার জন্য যদি তোমাকে পেমেন্ট করি, কেমন হয়?’
চমকে গেলাম। এ অফারটা আসবে আশা করিনি। এ যেন সাক্ষীকে মুখ বন্ধ রাখার অদ্ভুত টোপ। যদিও আজকের এই পৃথিবীতে ভয়ংকর অপরাধের বেশিরভাগটাই সাইবার কেন্দ্রিক। তবুও যেন কেমন একটা গন্ধ। সিজলারের ট্রেতে শুয়ে থাকা চিকেনে ফর্ক আর ছুরি গেঁথে বলি, ‘সেটা আলোচনা সাপেক্ষ।’
‘বেশ। আর একটা কথা।’
চোখ তুলি আমি।
‘লোকেন মল্লিক কি এর মধ্যে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল?’
আয়েশ করে নরম, সুস্বাদু মুরগি চিবোচ্ছিলাম। কথা বলতে গিয়ে গাল কামড়ে ফেলেছি। একটু ধাতস্থ হয়ে বলি, ‘আপনাকে তো এর আগেও বলেছি, আমি ওই নামে কাউকে চিনি না।’

হাওড়া ময়দান থেকে মেট্রো ধরে ঝড়ের গতিতে ফিরছি। এখন মেট্রোর সম্প্রসারণ হয়েছে শ্রীরামপুর পর্যন্ত। এই ক’বছরেই শহর, নগর মেট্রোর মতোই ঝড়ের গতিতে তার উন্নয়ন নিয়ে ঢুকে পড়েছে শহরতলীতে। জীবনের কত নতুন নতুন দিক চোখে পড়ছে…
অশেষ ঘোষালের সঙ্গে ডিলটা সেরে ফেলেছি। উনিই এগিয়ে এসে করেছেন। মনোপলি ব্যবসা বা কাজের মজা নিচ্ছি, নিতে হয়। কিসের শ্রেণিভেদ! হয় এ পক্ষ, নয় অসহায় ওপক্ষ।
ফোনটা এলো ঠিক শ্রীরামপুরে নামার সামান্য আগে, ‘আমি কি ‘পাঠকসহায়’ গ্রুপ ও পেজ-এর সুমিতেশের সঙ্গে কথা বলছি?’
‘বলছেন।’ বেশ ভিড়। কলারে দেখে নেবার সুযোগ নেই কোনও নাম।
‘আপনার সঙ্গে দু-মিনিট কথা বলা সম্ভব?’
‘সোজা পয়েন্টে বলুন। এক মিনিটে’, বিরক্ত হচ্ছিলাম।
‘নমস্কার। আমার নাম লোকেন মল্লিক। একটু আধটু লিখি। একটা জায়গা থেকে আমার লেখার আলোচনা নিয়মিত বেরোয়। ব্যাপারটা আপনি জানবেন নিশ্চই। আপস্টার্ট ব্যবসা এখন। কিন্তু রেটটা ইদানিং একটু বেশি পড়ছে আমার। আপনার সঙ্গে একটু বসা যায় আলোচনার জন্য?’
প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছি। পা যেন টলছে। তরলের কি এফেক্ট দেরিতে হচ্ছে! জিব অবশ। কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। শুধু মনে হচ্ছে, যুগের সঙ্গে, পৃথিবীর অন্য সব শব্দের মতোই ‘মনোপলি’ শব্দটারও কোনও চিরস্থায়ী অস্তিত্ব নেই।
ব্লু-টুথে অবশ্য লোকেন মল্লিক এক নাগাড়ে বলে চলেছে, ‘হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন…….’

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes