
অরিন্দম ঘোষ -এর গল্প
ওডার নদীর ধারে
–
রাত বাড়ার সঙ্গে আবার জ্বর এল। বছর দুয়েক এভাবেই ভূতুড়ে তাপমাত্রা নিকোলাজের শরীরকে কাহিল করে তুলেছে। আগস্ট শেষ হতে না হতেই হাড়কাঁপা শীত হাজির। ওডার নদীর ধারে বরফ জমতে শুরু করেছে। প্রকৃতির কেন এত তাড়া, বোঝা মুশকিল। সকলের অগোচরে যেন ফেয়ারি টেল শুরু হওয়ার উপক্রম। নিকোলাজ দু-একটা ওকের টুকরো খোঁজে বেসমেন্টে। কয়েকদিন হল ফায়ার প্লেসে আগুন নেই। ধোঁয়া ওঠা কফিই একমাত্র ভরসা। গত মাসে ডরিয়ান দম্পতি বড় রেশন দিয়ে গেছে। আজকাল ওক, অ্যাস, ম্যাপলের গুড়ি, লরি বোঝাই করে চলে যাচ্ছে ওয়ারস, টোরানে। ফলে রোইজের শীতরাতগুলো আগুনের স্পর্শ পায়না। নিকোলাজের সারা শরীর কাঁপে, কুঁকড়ে যায় ঠাণ্ডায়। হঠাৎ জানলার পর্দা সরাতেই সামনে দেখা যায় বিরাট চাঁদ। নির্জন সেন্ট এভিনিউ হালকা বরফের চাদরে ঢেকে গেছে। ঝরে পড়ছে উইলো আর ম্যাপল পাতা। স্বপ্নের মতো সুন্দর পোল্যান্ডের এই শহর, রোইজ।
তিন বছর হল ডরিয়ানরা প্লক শহরে আস্তানা গেড়েছে। নিকোলাজ অবশ্য রোইজের একাকী জীবনকে স্বেচ্ছায় মেনে নেয়। পঁচিশের দোরগোড়ায় পৌঁছে, উপন্যাসের সাদা-কালো পাতা আর ওডার নদীতরঙ্গে বেশ খুঁজে পায় নিজের জীবনকে। পোল্যান্ডের পশ্চিম প্রান্ত থেকে মানুষজন রোজ দলে দলে লাব্লিন, র্যাডোম, বিয়ালস্টক চলে যাচ্ছে ঘরবাড়ি ছেড়ে। হিটলারের নাজি বাহিনী নাকি শীঘ্রই পোল্যান্ডকে গ্রাস করবে। কিন্তু নিজের বাড়িঘর, বাগানকে মানুষ ত্যাগ করছে কিভাবে ? নিকোলাজ জানেনা যুদ্ধ কেন হয় ! ওডার নদীর জল তো ফ্রাঙ্কফুর্ট, বার্লিনেও গেছে। তবে পোল্যান্ডকে দখল করে জার্মানির কি লাভ ? যদিও ব্যক্তিজীবন বা রাষ্ট্রজীবনের সব অঙ্কেই নিকোলাজ বড় কাঁচা। তাই আশেপাশের বাই লেনগুলো ফাঁকা হয়ে গেলেও, সে তার বাড়িতেই থাকে।
ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতাল থেকে আনা ওষুধগুলো নিয়মিত খেলেও জ্বর কমার নাম নেই। চোখ-নাক দিয়ে জল গড়িয়ে যায় একনাগাড়ে। মাথা ভার। ক্লান্তি আর দুর্বলতা ক্রমবর্ধমান। দুটো কম্বল, হট ব্যাগ নিয়েও যেন শান্তি নেই। বিকেলে কিছু পপি ফুল সংগ্রহ করে ফেরার সময় মানেকিন প্লাজার সামনে দাঁড়ায় নিকোলাজ। এখানে সে খাবার পরিবেশনের কাজ করত। মনে পড়ে ক্লারার কথা। প্রত্যেক ছুটির দিন বিকেলে ক্লারা আসত আলুর প্যানকেক খেতে। দুজনের মধ্যে অল্পদিনেই গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। ওরা জিউশ থিয়েটারে গেছে, ম্যাপল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আইস রোল খেয়েছে, ওডার নদীর ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে কেঁপেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ক্যাথিড্রালে প্রার্থনা করেছে মোমবাতি জ্বালিয়ে। সাইকেল নিয়ে জার্মান বর্ডার ঘুরে এসেছে কয়েকবার ! কিন্তু গত এক বছর নিকোলাজের শারীরিক অবস্থার বিপুল অবনতি ঘটে। ছাড়তে হয় মানেকিনের চাকরি। ম্লান হয়ে আসে ক্লারার সঙ্গে যোগাযোগ।
আগস্টের এক সন্ধ্যায় ক্লারা এসে বাড়ির সবকিছু গুছিয়ে দেয়। গৃহকর্ত্রীর সর্বময় কর্তৃত্ব যেমন থাকে সংসারে, ঠিক তেমনভাবে। আদেশের সুরে বলে,
– তোমার আর বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করা চলবে না। অনেকদিন তো হল, কুইনাইনে কাজ হচ্ছে কই ? এবার হাসপাতালে ভর্তি হও।
– কেন ? তোমার কি মনে হয় আমার দিন ফুরিয়ে আসছে ?
– আমি কি তাই বলেছি ? তোমার জ্বর সারার কোন চিহ্ন নেই। তাছাড়া আমরা রোইজ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। সোভিয়েতের কাছে সুয়াল্কিতে বাড়ি ভাড়া করেছে সেবেস্তিয়ান। রোইজের থেকে অনেক উন্নত শহর সুয়াল্কি। ওখানকার সুরক্ষাব্যবস্থাও শক্তপোক্ত। কাছেই থাকবে পোলিশ সেনা এবং রেড আর্মি। নাজিদের থেকে সেখানে ভয় কিছুটা কম। বাঁচতে হলে যতটা সম্ভব পূর্বে যেতে হবে।
– তুমি যুদ্ধের কারণে আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছ ? ভয়টা তোমার কোথায় ? নাজি বুলেটে, নাকি আমার রোগে ?
– রাগ করছ কেন সুইটহার্ট ? তুমি তো জানো, আমি তোমায় কতটা ভালবাসি ! তাছাড়া স্বপ্নপূরণ করতে হলে আগে তো বাঁচতে হবে !
– ওডার, উইলো, ভ্যালি, ম্যাপল, ক্যাথিড্রাল, আমি – এই সবকিছু ছেড়ে থাকতে পারবে ?
– আমার কিছু করার নেই, নিক। মা-বাবা রেডি হয়ে গেছেন। প্যাকিং কমপ্লিট। তাছাড়া ইন্টেলিজেন্সের খবর আছে দিন কয়েকের মধ্যেই হিটলার বাহিনী রোইজে ঢুকে পড়বে।
– বেশ। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক। বেঁচে থেকো ক্লারা।
চোখের জল মুছে নিকোলাজ বিছানা থেকে নামে। ঘড়িতে তখন রাত একটা। ক্লারার কথা মনে এলেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। কতই না স্বপ্ন ছিল ! সিগারেট ধরিয়ে চেয়ার টেনে বসে। জ্বরটা বোধহয় কমতির দিকে। শরীরে বল আসছে। কোথাও এতটুকু সাড়াশব্দ নেই। মেয়র অফিসের স্বেচ্ছাসেবক বলে গেছে, সন্ধ্যা থেকে সব আলো নিভিয়ে অন্ধকার বজায় রাখতে এবং জল ও খাবার সংরক্ষণ করতে। আত্মগোপনের বাঙ্কার প্রস্তুত রাখার সঙ্গে ঈশ্বরকে স্মরণ করা চাই প্রতিমুহূর্তে। সিগারেটে কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে দোতলায় উঠে আসে নিকোলাজ। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া প্রকৃতি খুবই মনোমুগ্ধকর। চাঁদকে মনে হচ্ছে কত কাছের। রুপালি আলোর প্রতিটি বিন্দু উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছে। কে জানে, এরপর হয়ত বিচ্ছুরণের আর সুযোগ পাবে না। ওডার নদীর জল আজ রূপোর অলঙ্কারে ঠাসা। ঝলমল করছে বড়দিনের মত। ওপারের উপত্যকা ওকের ছায়ায় আচ্ছন্ন, মাঝ রাতে। সাদা ক্যাথিড্রালের গায়ের রঙ যেন আরো মায়াবী। নদীতীরের খামারে একটা ঘোড়া কেবল গোলাকার পথে দৌড়ে যাচ্ছে। আজকের রাত ওর মনেও প্রেমসঞ্চার করেছে। ম্যাপলের প্রতিটি পাতায় মোম পালিশের আবরণ। জ্যোৎস্না পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে আলো। পথের দু-ধারে পপি ফুলগুলো হিমেল বাতাসের সঙ্গে দুলেই চলেছে। রোইজের এমন অপরূপ সৌন্দর্য নিকোলাজ আগে দেখেনি। একাই সাক্ষী রইল অপার্থিব রাতটির। আদিগন্তের এই ক্যানভাস দেখে, জার্মান কি ওডার পেরিয়ে ধ্বংসযুদ্ধ চালাবে ?
পরের দিন সকালে নিকোলাজের ঘুম ভাঙলো দেরিতে। জ্বর বেড়েছে আবার। থার্মোমিটারে মাপা হয় না। মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনরকমে কফি বানিয়ে চুমুক দিতেই একটা ঘোষণা কানে এলো। ‘এই মুহূর্তে শহর ছেড়ে সবাই পূর্ব দিকে চলে যান। সোভিয়েত সীমান্তের কাছে থাকার চেষ্টা করুন। আমাদের বীর সেনা মরণপণ লড়াই করে আপনাদের ও দেশকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে।’ নিকোলাজ ভাবছে কাদের উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা ? শহরে কি কেউ আছে ? দুপুরে আকাশ কালো হয়ে এল। এদিকে ঠাণ্ডা উত্তরে বাতাসও বইছে শব্দ করে। নিকোলাজ ডাবল কোট পরে, ছাতা হাতে বের হল। ইচ্ছে করছে একবার প্রার্থনা করার। কিন্তু মার্শেলকে খুঁজে পাওয়া গেল না কমপ্লেক্সে। মোমবাতি জ্বালিয়ে নতজানু অবস্থায় কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলো নিকোলাজ। ‘হে ঈশ্বর, তোমার রোইজ শহরকে বাঁচাও, বাচ্চা-বুড়ো পোলিশদের বাঁচাও, ওক উইলো ওডারকে রক্ষা করো, পপি ফুলগুলোকে নাচতে দাও। আমি হয়ত আর বাঁচব না, কিন্তু নাজি সেনার হাত থেকে তোমার সৃষ্টিকে রক্ষা করো। মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করো, হে প্রভু।’
ওল্ড ক্যাথিড্রাল স্ট্রীট হয়ে ফেরার সময় ক্লারার কথা মনে এল। তিনটে বাইলেন পেরিয়ে ক্লারার বাড়ির সামনে দাঁড়ায় নিকোলাজ। এদিকের পথঘাটেও মানুষ, পশু, পাখি অনুপস্থিত। বারকয়েক ডেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। দরজা-জানলা বন্ধ। ক্লারা এতক্ষণ দেশের পূর্ব প্রান্তে পৌঁছে গেছে। খুব ইচ্ছে করছিল ক্লারার হাতটা শক্ত করে ধরার, তর্জনীতে আদরের কামড় দিয়ে হৃদপিণ্ডের উপর অনেকক্ষণ রাখার, সুগন্ধিময় কানের গন্ধ নিয়ে চোখের পাতায় ঠোঁট ছোঁয়াতে। কোথা থেকে এক কুকুর এসে লেজ নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু নিকোলাজের শরীরের ভেতরে দলা পাকিয়ে উঠতে থাকল গভীর এক যন্ত্রণা। এত হাওয়ার মধ্যেও যেন শ্বাস নেওয়া যায় না। ছাতার ওপর ভর দিয়ে কোনওক্রমে বাড়ি ফিরে আসে। চারিদিকে কেবল নীরবতা আর নিঃসঙ্গতা। সন্ধ্যের পর মহাকাশের এক রাশ অন্ধকার নেমে আসে। কালকের চাঁদ নিমিষে অদৃশ্য। এক চিলতে আলোর বিন্দুও কোথাও নেই। এই অন্ধকার আয়োজন কি কমব্যাট বেয়নেটের হাত থেকে নিরীহ পোলিশদের রক্ষা করবে ?
ক্লারার সঙ্গে প্রথম আলাপের মুহূর্তটা ভেবে নিকোলাজের আবার হাসি পায়। আজও উজ্জ্বল সেই বিকেল, যেন কালকের ঘটনা। আকাশ পরিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও কোথা থেকে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে এল। শুরু হয় ঠাণ্ডা বাতাসের অত্যাচার। তাপমাত্রার গতি নিম্নমুখী। মানেকিনের সবকটা টেবিল তখন ফাঁকা। এডভান্স বুকিং নেই। নিকোলাজ কোটটা রেলিংয়ে রেখে সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। পাশের পাইন গাছটার শরীর বেয়ে নেমে আসছে অঝোরধারে বৃষ্টি। প্রতিটি পাতার কোণে জমছে বিন্দু-বিন্দু জল। সরু জলধারা সাপের মত এঁকেবেঁকে নেমে যাচ্ছে ওডারের বুকে। ফুলেফেঁপে ওঠা তরঙ্গ আবেশময়। পাইনের বন আবছা। যতদূর চোখ যায় কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি। নিকোলাজ উদাসমনে হারিয়ে যায় দূরে-কাছের নরম আর্দ্রতায়। এদিকে কাকভেজা থেকে বাঁচতে ক্লারা উঠে আসে মানেকিনের বারান্দায়। রেলিংয়ের কোটটা দেখে গোপনে নিজের ভেজা সোয়েটারের সঙ্গে পালটে নেয়। অতঃপর কফি আর কুকিজ সার্ভ করার পর নিকোলাজ বলে,
– শুভ সন্ধ্যা ম্যাম। আপনি কি প্যান কেকের স্বাদ গ্রহণ করবেন ?
– নো থ্যাংকস। কফি খুব সুন্দর হয়েছে।
– আপনাকে মানেকিনে আগে দেখিনি। রোইজে কি আপনি নতুন এসেছেন ?
– সাউথ পোল্যান্ড মানে ক্র্যাকাও থেকে আমরা এখানে এসেছি মাস খানেক হল। আমার বাবা মিস্টার দ্যব্রস্কি সেবেস্তিয়ান এই শহরে তার ফিনান্সিয়াল ফার্ম খুলেছেন। আর আমিও স্কুল অফ ইকোনমিক্সে ভর্তি হয়েছি। তাই আপাতত আমরা রোইজের বাসিন্দা।
– ওডার নদীর ধারে আপনাকে স্বাগত ম্যাম। আমার নাম নিকোলাজ। মানেকিনে আমি একজন স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট।
– আমি ক্লারা। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালো লাগলো।
– ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে ম্যাম। মানেকিনের বিখ্যাত প্যানকেক খেতে অবশ্যই আসবেন।
– নিশ্চয়।
– আর একটা কথা, ডোর সেলফে আপনার সোয়েটার ড্রাই করা আছে। আমার জ্যাকেটটা অনুগ্রহ করে রেখে যাবেন।
মুহূর্তের মধ্যে ক্লারার মুখ সূর্যাস্তের সূর্যের মত লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। ব্যালেন্স না নিয়েই প্রায় দৌড়ে পালিয়ে যায়। নিকোলাজ খুব হেসেছিল ক্যাশ-কাউণ্টারে যেতে যেতে।
ভোর তখনও হয়নি। সূচ ফোটানো কোমর, পিঠের অসহ্য ব্যথায় নিকোলাজের পক্ষে আর শুয়ে থাকা সম্ভব হল না। জোরালো একটা যান্ত্রিক শব্দ একনাগাড়ে শোনা যাচ্ছে। জানলার পর্দা সরাতেই ভীষণ কেঁপে উঠে দুর্বল পা। জীবনের প্রতি উদাসীনতা স্বত্বেও মৃত্যুভয় এসে আঁকড়ে ধরে। সময় বাকি আর কয়েক মুহূর্ত। ওডার নদীর ধার দিয়ে সারি সারি জার্মান টাইগার ট্যাঙ্ক চলেছে। সঙ্গে নাজি বাহিনীর লম্বা লাইন। নদীবাঁধ দিয়ে হিটলারের দলবল কেন পোল্যান্ডে ঢুকছে, বুঝতে পারল না নিকোলাজ। নিঃশব্দে জানলার পর্দাগুলো টেনে বেসমেন্টের নিচে ঢাকনা সরিয়ে বাঙ্কারে শুয়ে পড়ে। জীবনের শেষ সময় হাজির। বাইরের শব্দমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। বার্লিনের সমস্ত ট্যাঙ্ক আজ বর্ডার পার করে দ্রুত। একটি পোলিশকেও এরা বাঁচতে দেবে না। যদিও এই দেশের নিরীহ নাগরিকরা হিটলারের কোনো পাকা ধানে মই দেয়নি। অপরাধ একটাই – এরা জন্মসুত্রে অধিকাংশই ইহুদী। নিকোলাজ চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে, কেন ইহুদীদের জীবনপ্রবাহ এত কাঁটাময়। ফ্যারাওদের আমলে মিশরে বিনা কারণে ইহুদীদের মেরে ফেলা হত হাজারে হাজারে। আজও চলছে নিধনপর্ব। লোহিতসাগর পার করে সেদিন মোজেস প্রাণে বাঁচিয়েছিল ইহুদীদের। আজকের এক্সোডাসে কে নেতৃত্ব দেবে ? ইহুদীদের কি কেউ বাঁচাবে না ?
হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে বিস্ফোরণ হল। পরপর পাঁচটি। কিন্তু আর্তনাদের শব্দ নেই। ক্ষণিকের বিরতি। তারপর শুরু গুলিবর্ষণ। খুব কাছ দিয়ে বুলেটগুলো ছুটে যাচ্ছে। বারুদের গন্ধে বাতাস হল ভারী। প্রচণ্ড ধাক্কায় সদর দরজা ভেঙ্গে পড়ল। ভেতরে ঢুকেই নাজি বাহিনী এলোমেলোভাবে গুলি চালাল। বিছানা, ওয়ারড্রোব, সিলিং, স্টোর বক্স, কাঠের মেঝে, সিঁড়ি সব জায়গা গুলিবিদ্ধ হল। একজন নাজি চিৎকার করে উঠল – ‘যা, তোরা নরকে যা, সেখানে দাসত্ব কর। তোদের কোন জায়গা নেই পৃথিবীতে। পাপী সব। জার্মান রক্তের জয় হোক। হিটলারের জয়।’ কিছুক্ষণ আবার নীরবতা। নিকোলাজ ভাবে, তার মৃত্যু হয়েছে গুলির আঘাতে। বাঙ্কারের ছাদ ফুটো করে ঢুকেছে একটা বুলেট। নিকোলাজের কানের পাশে কাঠের দেওয়ালে বারুদ মাখা বুলেটটি কোনাকুনি গেঁথে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে যখন গুলির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না, নিকোলাজ বাঙ্কারের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। নিজের বাড়িটাকে আর চিনতে পারে না। প্রায় সব জানলার কাঁচ ভাঙ্গা, দরজার পাল্লা মেঝেতে পড়ে, কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সর্বত্র। বাথ টাব ফুটো, পিয়ানো ভাঙা, পাইপ ফেটে জল চারিদিকে নরকের কোলাজ তৈরি করেছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিকোলাজ বুঝতে পারল, ভেতর আর বাইরের চিত্র এক শিল্পীরই আঁকা।
নদীবাঁধ রাস্তায় পাঁচটি জার্মান ট্যাঙ্কে আগুন জ্বলছে। কয়েকটা নাজির মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। পোলিশ সেনা কখন যে ল্যান্ডমাইন বিছিয়ে রেখেছে, কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। ওল্ড ক্যাথিড্রাল স্ট্রীটের দুপাশে বেশিরভাগ বাড়িগুলি আগুনে পুড়ছে। তবু নেই কোন হাহাকার, নেই মরাকান্না। দিনের আলো দেখা দিলেও চারিদিকে কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পবিত্র রক্তের নাজি বাহিনীর রক্ত-পিপাসা নিশ্চয় মেটেনি এই ফাঁকা শহর আক্রমণ করে। নিরীহ পোলিশরা কতদূর পৌঁছালো ঈশ্বর জানেন। আগের রাতে খাওয়া হয়নি কিছুই। বড় ক্লান্ত লাগছে। একটা সিগারেট ধরাতে যাবে, হঠাৎ মনে পড়ল স্নাইপারের কথা। আগুনের ফুলকি যেখানেই দেখা যাবে, অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুটে আসবে বুলেট।
দুপুরে মেঘ-ভাঙা রোদ চকচক করে উঠে। ঠাণ্ডা বাতাসও সুযোগ বুঝে বেপাত্তা। খানিকটা নিজের উপর বিরক্ত হয় নিকোলাজ। মুখের ভেতরের কষা ভাবটা কমছেই না। শরীরময় বিষণ্ণ পেশীরা যেন অবসর নিয়েছে। আজকাল দুচোখ সবসময় জলে ভরা থাকে, ঝাপসা দৃষ্টি কিছুতেই পরিষ্কার হয় না। সেদিন ক্লারার বাড়ির সামনে কুকুরটি লেজ নাড়িয়ে কি বোঝাতে চেয়েছিল ! বাড়িতে কি কেউ আছে ? ক্লারা নিজে নয়তো …. ! ভাবনাটা মাথায় আসতেই নিকোলাজ চঞ্চল হয়ে উঠে। ক্লারার বাড়ির পেছনের দরজাটা জোরে ঠেলা দিতেই খুলে যায়। জানলার পর্দা সরালে পরিপাটি সাজানো ড্রয়িং রুম ঝলমল করে উঠল। স্ট্যান্ড হুকে ওভারকোট, ছাতা, গাড়ির চাবি এখনও ঝুলছে। পিন পড়ার শব্দ পর্যন্ত নেই। বেডরুম, ডাইনিং হল, কিচেন, বাথরুম, চিলেকোঠা, স্টোর রুম কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্রায় ত্রিশ মিনিটের চিরুনি-তল্লাশির পর বাঙ্কারের সন্ধান পাওয়া গেল, বাথরুমের পাশে স্টোর রুমের পেছন কোণে। সর্বশক্তি দিয়ে ঢাকনা তুলে নিকোলাজ চমকে উঠল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ভেতরে চওড়া বিছানার এককোণে ক্লারা ঘুমাচ্ছে। বালিশের পাশে কয়েকটা কেক বিস্কুটের টিন। গায়ে প্রথম আলাপের সেই উলেন সোয়েটার। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা নিকোলাজের উপহার, Eaternal Love.
– একি ক্লারা, তুমি এখানে ? কি ব্যাপার ? সুয়াল্কিতে যাওনি ? মিঃ অ্যান্ড মিসেস দ্যব্রস্কি কোথায় ?
– এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে দেব কিভাবে ? আমি একাই আছি। ওরা চলে গেছে সোভিয়েত সীমান্তে। ক্রনায়া হাঞ্জার ধারে এখন বেড়াচ্ছে নিশ্চয়ই। তোমার মত আমারও জ্বর শুরু হয়েছে। তাই ভাবলাম ওডার, ম্যাপল, নিকোলাজকে ছেড়ে গিয়ে লাভ নেই। দূরে তাচ্ছিল্য নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে, কাছে ভালোবাসার হাত ধরে মরে যাওয়া ঢের ভালো।
– তুমি জানাওনি কেন বাড়িতে আছো ? আমি কত খুঁজেছি তোমায় !
– আমি জানতাম, আমার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ একদিন তুমি ঠিক খুঁজে পাবে। কিন্তু সৌভাগ্য দেখো, জীবন থাকতেই দেখা হয়ে গেল। আর ভয় নেই জার্মান ক্রসের।
নিকোলাজ বাঙ্কারে নেমে ক্লারাকে বুকে টেনে নেয়। অনেকদিনের খরা-ফাটা জমিতে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। সেই জল দিনের পর দিন পৌঁছাতে চেয়েছে হাহাকারের উৎসে। কিন্তু চাওয়া এবং পাওয়ার অঙ্কে ভাগশেষ পড়ে থাকে। সেটুকু নিজের বুকে নীরবে লালন করা ছাড়া বিকল্প আর থাকে কি ? শুকনো ঠোঁটে ও গলায় ঠোঁট ছুঁয়ে নিকোলাজ পরম সুখের আবেদন রাখে। ক্লারাও হারিয়ে যায় চওড়া বুকের উষ্ণতায়। দুটি প্রাণ একে অপরকে আবিষ্কারের নেশায় উঠে মেতে। শূন্য শহরের ধ্বংস স্তূপের মধ্যেও এক টুকরো বাঁচার তাগিত থেকে যায় ! ট্যাঙ্ক, বারুদ, বুলেটের ভিড়েও যে ভালোবাসা শেষ হয়না ! শরীরদুটো মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে অনুভবে হাসে, কেবল হাসে। মৃত্যুকে ব্যঙ্গ করে সিক্ত হয় সৃষ্টিরসে। হিটলারের আস্ফালন, নাজি বাহিনীর নির্মমতা ভালোবাসার অন্দরমহলে ধস নামাতে পারেনি। বরং শরীর-মন গভীর যত্নে তল ছুঁয়ে বাস্তবের বিচ্ছেদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে নিরন্তর। হায় জীবন …. হায় ভালোবাসা। খুব কাছ থেকে হঠাৎ গুলিবর্ষণ হতে থাকে। মাটি কেঁপে উঠল। জোরালো শব্দে দরজা ভাঙ্গা হয়। এলোপাথাড়ি বুলেট সবকিছুকে এলোমেলো করে। নেমে আসে শ্মশানের নীরবতা। মেঝেময় গড়িয়ে যাচ্ছে দাঁত বের করা অজস্র বুলেটের খোল। আর বারুদের উগ্র গন্ধে মিশে যায় সুগন্ধি …. Eaternal Love.