কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১৯ <br />  অসুন্দর সময়ে সুন্দরের সত্য  <br /> রূপশ্রী ঘোষ

কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১৯
অসুন্দর সময়ে সুন্দরের সত্য
রূপশ্রী ঘোষ

যখন অন্ধকার চেপে বসে, তখনই আসলে আলোর প্রয়োজন। কিন্তু তা হ্যালোজেনের আলো নয় কিংবা ফ্ল্যাশলাইটেরও আলো নয়। এ আলো অন্তরের। এ আলো স্বাভাবিক। আমাদের বাংলা সিনেমার দিকে তাকালে 'মানিকবাবুর মেঘ' -এর মতো অল্প দু একটি ছবি ছাড়া তেমন আলো আর চোখেই পড়ে না। কিন্তু সিনেমার প্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে দক্ষিণে মারমারকাটকাট সিনেমার পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে এমন কিছু সিনেমা, যেগুলির জন্য ভারতীয় সিনেমা গর্ব করতে পারে। Meiyazhagan ( মেইয়াঝাগন) এমনই এক ছবি। অসুন্দর সময়ে সুন্দরের কথা বলাই যে প্রকৃত প্রতিবাদ। লিখলেন রূপশ্রী ঘোষ।

সিনেমা একটা যৌথ শিল্প মাধ্যম। কোনো ভাষা যদি খুব ভালোমতো দখলে নাও থাকে তাও, অজানা ভাষার একটা সিনেমা দেখেও আনন্দ পাওয়া যায়। কারণ এর দৈহিক ভাষা থেকেই আমরা একটা গল্প খুব সহজে অনায়াসে বুঝে নিতে পারি। নির্বাক চিত্র দেখে মজা পাওয়ার কথা তো নতুন নয়। তবে কমেডি বা হাসির সিনেমা হলে আলাদা কথা, কারণ সেখানে শরীরী ভাষাকেও ছাপিয়ে যায় মৌখিক ভাষার সূক্ষ্মরস। এক্ষেত্রে ভাষাটা জানা থাকলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হাস্যরসটা উপভোগ করা যায়। সেক্ষেত্রে গোদা গোদা, গোল গোল ভাষার উপর নির্ভর করলে চলে না। তবে হাস্যরসের ছবি ছাড়া অন্য যেকোনো ছবির উপস্থাপন, তার কাহিনি বা প্লট, গল্প বলার ধরন, গান, নাচ, অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয় গুণ সবটা মিলেই উপভোগ করা যেতে পারে। আর হাতের পাঁচ সাবটাইটেল তো আছেই। সব মিলিয়ে সিনেমা যেহেতু একটা সম্পূর্ণ শিল্প, তাই, এর সবগুলো দিক গুণমানে দারুণ না হলেও দু একটা দিকের গুণমানেই ছবিটা প্রশংসা পেয়ে যেতে পারে। এমনই একটি তামিল ভাষার ছবি মেইয়াঝগান (অনুবাদ। ম্যান উইথ ট্রুথ অ্যাজ বিউটি)। ২০২৪ সালের একটি ভারতীয় তামিল-ভাষার চিত্রনাট্য, গল্প এবং পরিচালক সি প্রেম কুমার। সত্যি কথা বলতে ছবিটার মধ্যে কোনও তথাকথিত ধুমধারাক্কা অতিনাটকীয়তা নেই। নেই কোনো ঝিংচ্যাক গান বা নাচ, কাটাকাটি, মারামারি, রক্ত, খুন কিছুই নেই। আছে কেবল চাপা অভিমানে দু একফোঁটা চোখের জল। অভিনেতা অভিনেত্রী বলতে কোনো দারুণ নাম করাও কেউ নয়। তবে নায়কের ভূমিকায় আছেন অবশ্য অরবিন্দ স্বামী। তিনি একাই একশো চিরকালই। যেভাবে ‘রোজা’, ‘বোম্বে’তেও বলা যায়। পার্শ্বচরিত্র কার্তিও খুব জনপ্রিয় বলে মনে হয় না। তবে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন অসাধারণ। একটা ছবি দর্শককে টেনে রাখে তার টানটান উত্তেজনা, তার গল্প বলার ধরনে। এটি এমনিতেই যেন একটা শান্ত শিষ্ট নিরীহ ছবি। ঠিক যেমন নায়ক, তেমনই অনেকটা বলা যায়। ধীর, স্থির, শান্ত অথচ মনকাড়া গল্প বলে গেল ছবিটা। ভালো গল্পের বই যেমন একটানে পড়ে ফেলা যায়, তেমনই এটিও একটানে দেখা ফেলার মতো একটি ছবি। বাইশ বছর আগে ছেড়ে আসা একটি গ্রাম। সেই গ্রামেই বেড়ে ওঠা নায়ক আরুলের। বাইশ বছর পর আবার যেতে হয় ওই গ্রামে মামাতো বোনের বিয়েতে। তাদের বাড়ি আগেই বিক্রি হয়ে যাওয়ায় ওই গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। তারপর চেন্নাইতে থেকে পড়াশুনো। তারপর বিয়ে বাচ্চা, মা বাবার সঙ্গে থাকা একটা পরিবার। বাবা স্কুল শিক্ষক। মামাতো বোনের বিয়েতে যাওয়া থেকেই যেন গল্প শুরু এবং গল্প মোড় নেয় ওই বিয়ে বাড়ি থেকেই। এক নাম না জানা আত্মীয় এবং নায়ক মিলেই পুরো গল্প চলেছে। তার মাঝের যে দৃশ্য, যে ছোটো ছোটো বিষয় পুরোটা জুড়ে বোনা এ সিনেমা। একটা অজানা চরিত্রের পরিচয় উন্মোচনের মধ্য দিয়েই আছে একটা জানা চরিত্রের আত্ম উন্মোচন। এবং আত্ম উন্মোচনের মধ্য দিয়ে গ্লানি। একজন মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে বা খ্যাতির চূড়ায় উঠে গেলে সে তার জীবনের পিছনে ফেলা ইতিহাসকে কীভাবে ভুলে যায়, বা কীভাবে মুখ লুকিয়ে বাঁচতে চায় তাও এই গল্পে বলা আছে। একজন মানুষের শুদ্ধ মনের পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত তার থেকে পালিয়ে বাঁচতে ফোন নম্বর পযর্ন্ত ভুল দিতে হওয়াটাও যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আর একজন যে অজানা চরিত্র অর্থাৎ পার্শ্বচরিত্র সে তার ছোটোবেলাকে এতটাই অন্তরে লালন করে যে, নিজের সন্তানের নামকরণ সেই পছন্দের মানুষটার নামেই করতে চেয়েছে। এই অজানা পার্শ্বচরিত্র হয়তো স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তার পছন্দের মানুষের আর কখনো দেখা পাবে কিনা। সবটা না জেনেই একটা বড়োসড়ো পদক্ষেপ বলা যায় তার না জন্মানো সন্তানের নাম ভাবটা। এবং এতটাই পছন্দের যে, মাদ্রাস ফেরার বাস পর্যন্ত মিস করিয়ে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়। এবং সেটা দেওয়ার জন্যই বাস মিস করানো। ইতিমধ্যে যাঁরা সিনেমাটা দেখে ফেলেছেন তাঁরা বুঝবেন। তবে সব শেষে এই দুটো চরিত্রের কনফেশনের মধ্য দিয়েই আত্মপরিচয়, এবং আত্মপরিচয়ের কাছে বিনয় যে, কতখানি বড়ো হয়ে উঠেছে তা এই গল্পেই দেখা যায়। গ্রাম্য মানুষের সহজ সরল মন, তাদের ভালোবাসা, আন্তরিক টান, তাদের আতিথেয়তা সবটা মিলে এ ছবি। এবং মামাতো বোনের পছন্দের গয়না নিয়ে গিয়ে তাকে যখন পরিয়ে দিচ্ছে তার প্রিয় দাদা সেখানেও যেন সিনেমার মধ্যে একটা সিনেমা হয়ে উঠছে। বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রিত অতিথিরা দর্শকের মতো চেয়ারে বসে সেই গয়না পরানোর দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে। এবং ভাই-বোনের ভালোবাসার যে আনন্দ অশ্রু সেটাও তারা সকলে মিলে ভাগ করে নিচ্ছে। বাগান বাড়িতে বসে বিয়ার নিয়ে বিয়ার খাওয়ার যে দৃশ্য, তার যে পরিবেশ, সেখানে বসেই ছোটোবেলার গল্প বলতে বলতে এই অজানা চরিত্রের একটু একটু করে নিজেকে মেলে ধরা দর্শককে অভিভূত করে। পুরো গল্প বলে দিলে সিনেমাটা দেখার কোনো মজা থাকবে না, তাই পুরোটা হুবহু না বলে আবছা আবছা সামান্য ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। দেখুন ছবিটা দেখতে আপনাদের আগ্রহ জাগে কিনা।

সাবটাইলের উপর আমরা ভর করে তো বিশ্ব-চলচ্চিত্র সাপটে খাচ্ছি। যেভাবে গিলে খাচ্ছে আমাদের বাঙালি বাচ্চারা বাংলা অনুবাদ ছেড়ে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত রামায়ণ মহাভারত পূরাণ। সেভাবেই ভারতীয় এই সিনেমাটাও একবার চাইলে দেখে নিতে পারেন। খুবই সাধারণ একটা সিনেমা, কিন্তু মন ভালো করা ছবি বলা যায়। আমাদের বাংলা সিনেমায় শেষ কবে একটা মন ভালো করা ছবি দেখেছি মনে করতে পারব না। বাংলার থেকে অন্যান্য দেশি ভাষা বিশেষ করে মালায়লম, তামিল এগুলো মনে হয় অনেক এগিয়ে। এটা আমার ব্যক্তিগত মত, অন্যদের মত অন্য হবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ বা বক্তব্য নেই। তবে যাঁরা সিনেমা প্রেমী তাঁরা এটা দেখে নিতে পারেন। নেটফ্লিক্সে আছে। কে বলতে পারে? এ সিনেমা আপনার ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো উস্কে দিয়ে আপনাকে একটা অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করবে না? আসলে বাড়ি মানে তো চারটে দেওয়াল, ইট, পাথর আর ছাউনি বা ছাদ নয়। বাড়ি মানে ভালোবাসা, একটা নস্টালজিয়া একটা ভালোলাগা। জন্মস্থান, শৈশব, বেড়ে ওঠা সবটা মানেই ভালোবাসা, ভালোলাগা। এই ছবিতে একটা সাইকেলজুড়ে যে গল্প সে সাইকেল আমাকেও নিয়ে গেছে আমার ছোটোবেলায়। ওই সাইকেলটা দেখেই মনে এল আমার প্রথম সাইকেল কেনার দিনটার কথা, এবং সেই দিনটাজুড়ে সমস্ত মানুষের কথা। আমার সাইকেল ঘিরেও অনেক স্মৃতি। হয়তো পুরোটা কোনোদিন লিখব কিন্তু সিনেমাটা সমস্ত স্মৃতি উস্কে দিয়ে গেছে। আবার ভালোবাসা মানে যন্ত্রণাও বটে। না পাওয়ার যন্ত্রণা। এই গল্পের পরতে পরতে ভালোবাসার মোড়কেই লুকিয়ে আছে যন্ত্রণা। এখানে, সিনেমায় প্রতিটি জিনিস, প্রতিটি জীব, প্রতিটি প্রাণী, প্রত্যেকটি মানুষই যেন ভালোবাসার গল্প হয়ে উঠেছে। এবং সবকটা দৃশ্যই ঘুরে ফিরে আমার ছোটোবেলাকে হাজির করেছে। হয়তো অনেকের ছোটোবেলাকেই হাজির করবে। আসলে আমরা জোর করে স্মৃতিকে বিস্মৃতি করে বিস্মৃত হয়ে থাকতে চাই। কিন্তু তা আসলে সম্ভব নয়। এ সিনেমাতেও নায়ক যেমন শুরুতে খুব গম্ভীর, কা্রোর সঙ্গেই মন খুলে মিশতে পারছে না, একটা বিয়েবাড়ি যেতে হয় বলে যাচ্ছে তেমনটাই দেখিয়েছে। আবার গিয়ে পড়েছে বলে চেনা মানুষদের সঙ্গে সহজ হতে চেষ্টা করছে, কিন্তু শুরুতে তা অকপটে পারছেও না। কিছুটা সময় সে ওখানে কাটানোর পর স্মৃতির মধ্য দিয়ে যখন তার ছোটোবেলাকে ফিরে পেল, তখন কিন্তু সে আর গম্ভীর রাম গড়ুরের ছানা হয়ে থাকেনি। এবং আরও কিছু কিছু ছোটো খাটো দু একটা বিষয় মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। প্রবাদ হিসেবে আমরা যেমন জানি অন্যের জুতোয় যে পা গলাতে নেই, তা কেবল প্রবাদই নয়, জীবনেও স্পষ্ট। যা এই সিনেমা তুলে ধরেছে। নায়ক অন্যের জুতো পরে পালাতে চাইছে, বাঁচতে চাইছে কিন্তু পারছে না। আবার জিনিসটাকে এতটাই ভালোবাসে যে, সেটা ছেড়েও যেতে পারছে না। তখন তাকে নিয়ে হাতে করেই দৌড়চ্ছে। তারপর গিয়ে এক মন্দিরের সামনে ফুল ওয়ালির কাছে বসা। ফুল ওয়ালি জানতে চাইছে কারও নামে পুজো দেওয়ার আছে? তখন বলছে, না। কিন্তু শেষে যখন তার ছোটোবেলাকে ফিরে পাওয়ার উপলব্ধিতে পৌঁছল তখন কিন্তু ওই গ্রামে যেতে তার আর বেশি সময় লাগেনি। এবং তখন নিজেই গিয়ে ওই ফুল ওয়ালির কাছে গিয়ে নায়ক বলছে কারও নামে পুজো দিতে। কিন্তু কার নামে তা কিন্তু দর্শক শুনতে পায় না। এই অশ্রুত নাম হয়তো হতে পারে যে শিশু এখনো জন্মায়নি, জন্মাবে তার নাম নিয়ে, হতে পারে সেই শিশুর উদ্দেশ্যে দেওয়া পুজো। এবং সিনেমার শেষে একেবারে শৈশব ঘেঁষা আনন্দ দিয়েই শেষ হয়েছে। অর্থাৎ এটা যে কেবল তামিল ভাষার আনন্দ তা কিন্তু নয়। এটা যেকোনো ভাষারই শৈশবের, কৈশোরের আনন্দ হতে পারে। যারা ছিন্নমূল হয়েছে তারা এ বিষয়টা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। কীভাবে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছিন্নমূল জীবনের শৈশবকে তুলে ধরেছে এ তারই গল্প। আমি সিনেমাটা দেখতে দেখতে কতবার ঘুরে এসেছি আমার গ্রাম, আমার বাড়ি, আমার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া, আমার বাড়ি ফেরা। কতবার আমার মামাবাড়ির বাগান ঘুরে ঘুরে দুহাত ভরে ফল, ফুল কুড়িয়ে এনেছি। কতবার হারিয়ে গেছি আম, জাম, কাঁঠালের বনে। আসলে সবকিছু ভুলে যেতে চাইলেই ভুলে যাওয়া যায় না। জোর করে ভুলে থাকতে হয়। ইতিহাস অতীত হতে পারে, অতীত পিছু ছাড়ে না তাই বলে। জীবনের সঙ্গে লেগে থেকেই ঘুরে ফিরে ঠিক একটা আবর্ত তৈরি করে দেয়। এ সিনেমা সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে, দিয়েছে এক অভূতপূর্ব আনন্দ। সবাইকে দেবে কিনা বলা যায় না, কারণ এ আনন্দ উপভোগ করতে একটা মন লাগে। বেড়ে ওঠার এমন একটা পরিবেশ লাগে। সে মন বা পরিবেশ সবাই পেয়েছে কিনা জানা নেই, তবে যাদের আছে তারা নিশ্চয়ই এ সিনেমা দেখে আনন্দ পাবে। সুযোগ থাকলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, অনেককিছুকে উস্কিয়ে দেবে, নাড়িয়ে দেবে। শহুরে জটিল, যান্ত্রিক জীবনের ঊর্ধ্বে ওঠা এক জীবন, এক বিশুদ্ধ মনের গল্প। এমন সিনেমা আমাদের ভাষাতেও তৈরি হোক। আশাকরি হবেও।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes