
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘সাদা’ তৃতীয় পর্ব
পূর্বে প্রকাশিত– প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব
লাল
রক্ত গড়িয়ে নামছিল লাল সুরকির রাস্তায়। নতুনপল্লী থেকে মাঠের দিকে বেঁকে যাওয়া নতুন লাল সুরকির রাস্তায় ছেতরে নিয়ে যাওয়ার রক্ত পড়ছিল টপ টপ। মেয়েটার ঠোঁটের কোণ বেয়ে, হাঁটুর ক্ষত বেয়ে, কনুই দিয়ে রক্ত গড়িয়ে রাস্তা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। তখন আকাশ লাল।
আজ, এখন আকাশ লাল। সেদিনের সূর্যাস্ত ফিরে এসেছে সূর্যোদয়ের আভাস নিয়ে। জানালা খোলা, গরম দিন। সারারাত তাকিয়ে থাকার পর আকাশটা প্রথমে বেগুনি, তারপর লাল হয়ে এল। আকাশ জোড়া লাল রং দেখে পরিতোষের মনে পড়ল, সেদিনও আকাশ লাল ছিল। নীলার রক্তে নতুনপল্লী থেকে মাঠের রাস্তা ভিজেছিল। দূরের নাগরদোলায় তখন তীব্র টিউবের আলো জ্বলে উঠছিল। মাটির পুতুলগুলি ঘাড় নেড়ে দিনের শেষতম আলোকে বিদায় জানাছিল। তেলচিটে গন্ধে জিলিপি ভাজা শুরু হয়েছিল। মোনালিসা সার্কাসের সোনালী হলুদ ময়লা তাঁবু বসন্তের মন কেমন হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। কান পাতলেই সস্তা ডুগডুগির শব্দ এখনও পাওয়া যাবে। কান পাতলেই নীলার গলার স্বর এখনও পাওয়া যাবে।
হাত ধরে টানছে নীলা, একবার, দুইবার নয়। বারবার এক তীব্র জেদে হাত ধরে টানছে নীলা। ঘ্যানঘ্যানে অথচ দৃঢ় একটা স্বর থেকে পালাতে চাইছে পরিতোষ। কিন্তু মেয়েটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটার থেকে মুখ লুকোতে চাইছে পরিতোষ। কিন্তু হায়, সে নিজেই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে মোনালিসা সার্কাসের হাতে আঁকা সাইনবোর্ডের নীচে, মেলার এই অদ্ভুত সার্কাসে। হ্যাঁ, সবটাই সার্কাস। আজকাল পরিতোষের মনে হয়, দারিদ্র্য এক অমোঘ সার্কাস। এই সার্কাসের ভিতর এতটুকু নীলার জেদি পা দুটো মাটি আটকে ফেলছে। অতঃপর শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করছে তীব্র হতাশ লোকটা। এক চড়ে শান্ত করবার প্রয়াস কাজে লাগছে না। একগুঁয়ে মেয়েটা মাটি কামড়ে ধরছে যেন। তার কষ বেয়ে সরু লাল রেখা দেখা দিল। তবু সে মাটি ছাড়ছে না। কোথায় যেন সে যেতে চাইছে। মোনালিসা সার্কাসের তাঁবুর ভিতরে, নাকি মাটির পুতুলের বিরাট পসরার মাঝ মধ্যিখানে, তা আজ আর সঠিক মনে পড়ে না পরিতোষের। কিন্তু কষের রক্তও যখন থামাতে পারছে না নয় বছরের মেয়েটাকে, তখন আর হুঁশ থাকছে না পরিতোষের। শাস্তি, তীব্র শাস্তি চাই। যে শাস্তি সে নিজেকে দিতে চায়, যে শাস্তির ভিতর সে মুখ লুকিয়ে আড়াল হতে চায়, সেই শাস্তির মারে ভরা মেলার মাঠে রক্তাক্ত হচ্ছে সদ্য নয়ে পা দেওয়া মেয়েটা। তবু কী জেদ তার! হাঁটু থেকে গোড়ালি ছেতরে যাচ্ছে এবড়োখেবড়ো রাস্তায়, সাদা লাল ফ্রক আলুথালু, অল্প কিছুক্ষণ আগে মেলায় আসবার শখের চুল বাঁধা খুলে গেছে, রাস্তায় রক্ত, তবু সে জেদ থামাচ্ছে না। নুইয়ে পড়ছে না। ঠিক কখন নুইয়ে পড়তে হয়, শেখেনি কেন মেয়ে! ফলে পরিতোষ নিজেকে থামাতে পারছে না। আকাশ লাল থেকে কালো হয়ে গেল।
সন্ধে নামল কি? তা’ই বা কী করে হবে! মেঘ করছে। ভোর থেকে মেঘ করে আসছে নদী শহরে। জানালার কাছ থেকে সরে এল পরিতোষ। ওধারের ঘরখানার দরজা খোলা। জানালাগুলি বন্ধ। বারান্দার দরজাও বন্ধ। কারণ ঘরটা ফাঁকা।
পরিতোষের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর শ্বাস ঘরটার দিকে ভেসে গেল।
ঠাকুর ঘরের দরজার পিছনে মা তারা মিষ্টান্ন ভান্ডারের ক্যালেন্ডারে একটা দাগ দিয়ে রাখল পরিতোষ। দুই মাস পর ভোট। নীলা আসবে ভোটের দিন। দুটো মাস, দুই আলোকবর্ষের সমান মনে হয়। পায়ে পায়ে ও ঘরটায় এল পরিতোষ। সকালবেলার তীব্র কাঁচা সোনা রোদ্দুর ভরে গেছে। জানালাগুলি খুলে দিল সে। পর্দা সরিয়ে মনে হল, এখুনি নীলা ডেকে উঠবে। একমাস হয়ে গেল, এখনও অভ্যেস হল কই! বারান্দার দরজা খুলতে খুলতে রোদ পড়ল বইয়ের আলমারির কাচে। জেদি মেয়েটার বাতিল চশমা ধুলো মেখে পড়ে আছে ভিতরে। অগোছালো বইয়ের মাঝে চারটে ছোট বড়ো স্মারক, নীলার নাম লেখা। সবটা একই আছে, যেন এখুনি কলঘর থেকে বেরিয়ে লম্বাটে আয়নার সামনে দাঁড়াবে। পুকুরপাড়ের মাছ চোর আধপাগল লোকটার চিৎকার, গালাগালি শুনতে শুনতে অন্য পৃথিবীতে হারিয়ে যাবে। সকালবেলার রোদ্দুরে জলের ঝিলমিল দেখবে। সোসাইটির বাগানের কোকিলটাকে বড্ড জ্বালাতন করতে করতে খুব তাড়ায় ঘর অগোছালো রেখে জুতো মসমসিয়ে বেরিয়ে যাবে। আছে সে আছে, ঘাম লেগে থাকা পুরনো জামাগুলোয়, বইয়ের আলমারিটায়, ভাঙা ভাঙা ঝুটো গয়নায়, কালি ফুরোনো কলমটায়, ছেলেবেলার পুতুলটায় রয়ে গেছে। পরিতোষ ভাবে, কত দূরের শহরে নীলার নতুন পুতুলখেলা শুরু হয়েছে। নীলার বুঝি আর বাবাকে মনে থাকবে না।
দু’দিনের চেনা ছেলেটার হাত ধরে অত দূরে চলে গেল পোষা চন্দনার মতো বেইমান মেয়েটা! একবারও অন্যকিছু ভেবে দেখল না। সকালবেলার মারাত্মক একাকীত্বে অভিমানে ফুলতে থাকে পরিতোষ। ঘরবারান্দা জুড়ে স্মৃতি ছড়িয়ে রেখে এরা পালিয়ে যায়। এজন্যই শুধু একটি পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। নীলাকে পরিতোষ কোনোদিনই চায়নি।
শীতের সকালে কুয়াশা ভাঙলেও বৃষ্টি ছিল সেদিন। একার বাজার করতে বেরিয়ে আনমনে ভাবতে থাকে পরিতোষ। একার বাজার, একার খাওয়ার মাঝে গরম দিনে নদীর শহরটা ঝিলিমিলি রং ছড়িয়ে সেজে বসে আছে। তারই মধ্যে কুয়াশা ভাঙা বৃষ্টি ভেজা শীতের সকাল উঁকি দিয়ে যায় চোখে। মন ভেঙে গিয়েছিল পরিতোষের। কন্যা সন্তান চায়নি সে। রেলপাড়ের ঝিলের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে করার চেষ্টা করল পরিতোষ। নীলা নামটা কে যে দিল ওকে! পুত্রসন্তানের নাম ঠিক করে রেখেছিলেন নীলাঞ্জন। সেখান থেকেই ছোট করে নীলা নামটা চলে গেল। চাইলে একটা অন্য নাম, যত্নের নাম কি দেওয়া যেত না মেয়েটাকে? ভাবতে ভাবতে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে পরিতোষের।
সামান্য বাজার করে ফেরার পথে নতুনপল্লী দিয়ে মাঠের রাস্তাটা ধরল পরিতোষ। চড়া রোদ, ঘুরপথ। তবু উঠে আসা পুরনো সুরকি, খোয়ায় তার হাঁটতে ভাল লাগছে। এই রাস্তায় একদিন ছোট্ট নীলার রক্ত ঝরিয়েছিলেন। আজ তার থেকে দূরে এসে এই রাস্তাটাকেই নীলা বলে মনে হচ্ছে। এক্ষুনি ডেকে উঠবে, “বাবা, ওই বাবা!”
শুধু কোন জ্বালায় বাপ হয়ে সেদিন ওভাবে রক্ত ঝরিয়েছিলেন, তা যেন কোনোদিনও নীলাকে জানতে না হয়।
নুয়ে পড়া অসুস্থ একা লোকটা প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রার্থনা করে, “ঠাকুর তুমি দেখো!”
ক্রমশ….