
রবীন্দ্র সংখ্যায় নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ শ্যামাশীষ জানা, তপনজ্যোতি মিত্র, পীযূষ কান্তি সরকার, দেবলীনা চক্রবর্তী, শর্বরী চৌধুরী
ভাসান
শ্যামাশীষ জানা
আমার ভেতর দিয়ে হেঁটে যায় এক অরণ্যপথ
সে পথের পাশে এক বুড়ো কদমের ক্লান্ত ছায়ায়
আকাশের নক্ষত্রের মত ধ্যানস্থ এক অজ্ঞাত ঋষি,
অবচেতনের মৌন পরিসরে গড়ে ওঠে আত্মগত স্বর
সেখানে মগ্নচৈতন্যর সাথে একটু কথাবার্তা হয় নিজের
তাই এত অবিষয়ের সুখ, মধ্যপন্থা ও স্ববিরোধিতার কোলাজ
তাঁর চরণপদ্মে সমর্পন করে গীতবিতানে ঘুমোতে যাই
ঘুমের মধ্যে অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ে কত গ্রহ, তারা, ছায়াপথ
ভবিষ্যৎ ও অতীতের মধ্যে তেমন কোনো হাতে হাত রাখা নেই
সংবেদনশীলতা নেই, ডানা মেলে উড়তে চাওয়া নেই
আজ সমর্পণের অহংকার কাঁধে নিয়ে কাছে গিয়ে দেখি
সমগ্র মহাকাশ জুড়ে কেবলই ঋষির অনিমেষ আঁখি
আমার ধ্বংসস্তূপের ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায় বাতাসে বাতাসে
যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত সৈনিকের মত পরেছি চমৎকার মিথ্যাবর্ম
পিঠে আঁকা চাবুকের দাগগুলি যেন এক সুরের স্পর্শ পায়
কত বিস্মৃত জন্মের ছায়ালোকে সমস্ত ভাবনা ভেসে যায়
তোমায় গান শোনাবো
তপনজ্যোতি মিত্র
ফিরে যাওয়ার দরোজা বন্ধ হয়ে গেলেও বেঁচে থেকো,
তবু ভালোবাসা রেখো,
যেভাবে কবি মিলিয়ে দিয়েছিলেন পূজা আর প্রেমের আবাহন ।
আজ সারাদিন সেই হলুদ মলাটের বইটা হাতে নিয়ে ঘুরছ,
হয়ে যাচ্ছ আনমনা,
মাঝে মাঝে গেয়ে উঠছো বিষণ্ণ পাতা ঝরার গান,
লিখে রাখছো শূন্যতা থেকে জীবনে ফেরার রূপকথামালা ।
তোমার চোখ দেখছে মহাপৃথিবী, মায়াপৃথিবীর রূপোলী পর্যটন ।
এই কি স্তব্ধতার সময় ?
যে স্তব্ধতা নিয়ে তার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকছে কাজলকন্যা ।
মৃদু স্বরে কে গাইছে –
‘তোমায় গান শোনাবো তাইতো আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুম ভাঙানিয়া’
আশাবরী আলো তখন যে ছড়িয়েছে দশ দিগন্ত !
সে -বৃষ্টি কই
=
পীযূষ কান্তি সরকার
একশো ষাট পূর্ণ হলেও
ধুনি-জ্বালা সেই সন্ন্যাসী কই !
আলপনা যে পারত দিতে
কৃষ্ঞমেঘের আবাহনে।
কই কবি ! সেই লেখনী কই !
নামাত যে বৃষ্টিধারা !
র-বী-ন্দ্র-না-থ র-বী-ন্দ্র-না-থ —
নামেই বাজে মেঘমল্লার।
সে-বৃষ্টি কই ! আর আসে না
কবিগুরুর জোড়াসাঁকোয় —
ছু-ট-তে ছু-ট-তে পৌঁছে যেত
পূর্ণ হত শীর্ণ খোয়াই ।
সে-বৃষ্টি কই ! আর আসে না
ডোবা হত পূর্ণ পুকুর —
সেই পুকুরে ডুব দিয়ে তো
মনের গ্লানি ধুয়ে যেত।
সে-বৃষ্টি কই ! আর আসে না
যোগাতো মে পূর্ণ-রসদ —
ছুটতো মনের রেলগাড়িটা
দিগ্বীদিকশূন্য হয়ে।
সে-বৃষ্টি কই ! আর আসে না…
আর আসে না… আর আসে না।
————-
তোমার আলোয়….
দেবলীনা চক্রবর্তী
এত আড়ম্বর এত জাঁকজমকের মধ্যেও আলো আঁধারির এক অলৌকিক প্রেক্ষাপট তোমায় ঘিরে।
তোমার প্রিয় আদি বৃক্ষের পদতলে
বসে আছো আজও তুমি শান্ত ,ধীর ,আত্মস্থ।
প্রতিদিন তোমার থেকে বিচ্ছুরিত কিছু আলো
এসে পড়ে আমার উপর
যেন –
শিশুর সারল্যে
কখনো প্রেমিক হয়ে
কখনো চিরসখা বান্ধব হয়ে
অথবা, জীবন স্বামী বা পরম আরাধ্য রূপে।
প্রতিবার আলোয় দেখি তোমারই প্রতিভূ
খন্ডে খন্ডে
কিন্তু তুমি তো আছো সেই অখন্ডে
অথচ এত আলো, এত রঙ , এত উচ্ছ্বাস
এত সজীবতার আড়ালে
তুমি আছো সেই একাকী, নিমগ্ন
আপন আলোয় সমাহিত।
আমার রবীন্দ্রনাথ
শর্বরী চৌধুরী
তোমাকে দেখিনি কখনো
তবু দেখি প্রতি মুহূর্তে
বৈশাখী সন্ধ্যার ঝড়ে
বর্ষার নিবিড় জলসিঞ্চনে
অথবা শীতের অবাক বিকেলে
তুমি থাকো সবখানে।
একাকীত্বের দহনে পুড়ি যখন
তুমি এসে হাত ধরো পরম মমতায়
ভিড়ের মাঝে যখন দিশাহারা
পথ দেখাও নির্বিকল্প সহনশীলতায়।
গীতবিতানের পাতা থেকে উঠে এসে
তুমি ছড়িয়ে গেছো সমস্ত চরাচরে।