
মোহনা মজুমদার-এর গদ্য
আর্ট-অফ-লিভিং
“gain I am beside the lake,
The lonely lake which used to be
The wide world of the beating heart,
When I was, love, with thee.”
– Letitia Elizabeth Landon
কোমো লেকের পাশে ভিলা বালবিয়ানেলোতে বসে আছি এখন । পড়ছি এলিজাবেথ ল্যানডনের ‘THE LAKE OF COMO’ কবিতাটি। আপাতত কদিন বিশ্রাম এখানে। এখান থেকে যাবো জেনেভা। বেলাজিও য় একটা এয়ারবিএনবি পেয়েছি । লেকের কাছেই, হাঁটা পথে সব কিছু অ্যাক্সেস করা যায় । এই পিৎজা ,পাস্তা, লাজানিয়া এসব আর ভালো লাগছে না, সবেতেই চীজ আর চীজ। বহুদিন ভাত খাইনি, তাই লোকাল মার্কেট থেকে খুঁজে খুঁজে কাল কিছুটা চাল ডাল আলু নিয়ে এসে খিঁচুড়ি রেঁধে খেয়েছি । এখানে জলের থেকে ওয়াইন বেশি খায় মানুষজন । আমিও খেতে শিখছি , মন্দ লাগছেনা । ভেতরটা বেশ ফুরফুরে লাগে ।
চারপাশটা বেশ ঠাণ্ডা । টলটলে নীলচে সবুজ জলে ফেরী পারাপার করছে। বৃষ্টি নেমেছে এখন। চুপচাপ স্থির তাকিয়ে আছি । এক এক ফোঁটা মিশে যাচ্ছে বৃহৎ কোনো ফোঁটার ভেতর। তারপর এক হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে তারা গোপনে । তোমার প্রতিটা ফোঁটা যেভাবে আমার ভেতর হারিয়ে যেতো, আমি এভাবেই কেঁপে উঠতাম । নুন যেভাবে জলের ভেতর মিশে যায় সেভাবেই আমার ভেতর মিশে যেতে তুমি। লুডোর গুটির মতো ভাবনা গুলো আঁকিবুঁকি কেটে আবার তোমার ভাবনার ঘরেই ঢুকে যায় কি করে বুঝিনা। যাই দেখি , যাই করি সব কিছুর ভেতর কেমন করে তোমায় জড়িয়ে ফেলি। জানো ,ভেবে দেখলাম, তোমাকে ছেড়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও বলেছি তোমায় সেসব কথা ,বারবার, বহুবার । আজ আর সেসব ছাইপাশ বলছি না । শুধু এটুকু বলছি , আমাকে নিংড়ে দেখো , নিজেকে ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাবেনা । কিন্তু একথা বলার মধ্যেও তো কোথাও নিজেকে জোর করে মেলে ধরার তাগিদ লুকিয়ে আছে । কেন এমনটা হবে ? কেন এতো হাহাকার এসে পথ আটকাবে তোমার পথ ? দরজা বন্ধ হয়ে যায় আড়াল থেকে। শব্দ পাই । নৈঃশব্দের শব্দ । ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে আর ছোট হয়ে যাচ্ছে একটা অস্তিত্ব।
সত্যিই কি এভাবে আবছা হয় কিছু ? তোমাকে ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর এই দীর্ঘ সফরে বহু মানুষের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি , কখনও কেউ কাছে আমার কাছে আসার পথ খুঁজেছে, কখনও আমি কারোর কাছে যাওয়ার পথ খুঁড়েছি। কিন্তু কোনো প্রক্রিয়াই তোমার গন্ধ ভুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে হয়নি । ব্যর্থতা স্বীকার করে দিনশেষে তোমার সামনে ধরা দিয়েছি আবার নিজেকে। তুমি ম্লান হেসে জয়ের হাসি হেসেছো । তুমি কি এমন করেই আমায় যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখতে চেয়েছিলে ? হঠাৎ দেখি পাহাড়ের ঢাল বেড়ে গড়িয়ে নামছে পাথর । কে জ্যানো ফিসফিস করে বলছে, তুমি বহু নারীতে আসক্ত হয়েছো , এ কথা জানার পরে তীব্র ঘৃণায় ভরে উঠছে যাবতীয় স্নান। দূরে সরে আসতে আসতে নিজেকে বোঝাতে চাইছি ‘চলে তো এসেছি , এতদূর.. ‘ । হঠাৎ ভেতর থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরে বললো ‘কতদিন দেখিনি তোমায়’ । সাধ হয় ছুটে যাই,দু চোখ ভরে দেখি তোমায় , দু চোখ ভরে । দেখিনি কতকাল । ভেতরটা তেষ্টায় শুকিয়ে গেছে ।
তুমি কি ছুঁতে পারো আমার এই আর্তি ? টের পাও আমি কাদঁছি? আমার চোখের জল শুকিয়ে যাচ্ছে তবু আমি কেঁদেই চলেছি , হাজার বছর ধরে।বহুকাল পথ হাটছি। একা। বাকিটা পথ একাই হাঁটবো ,এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বেড়িয়ে পড়েছি গন্তব্যহীন পথে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বলছেন “The human foot is a masterpiece of engineering and a work of art” । একা থাকার ভেতর অদ্ভুত এক হিন্দোল আনন্দ আছে ।আমি নিজের ইচ্ছে মত রঙে , ইচ্ছে মতো নেশায় পোট্রেট করি তোমার ছায়া ঘেরা এই নির্জনতা। সন্তর্পনে হেঁটে যাই সেই ছায়ার ভেতর দিয়ে । যাপন করি অমেয় এক ক্ষুধা ।যদিও বহন করা আর যাপন করার ভেতর ঈষৎ ফারাক আছে । ‘বহন’ শব্দটির নিজস্ব একটা বোঝা আছে , যা ‘যাপন’ শব্দটির সাথে জড়িয়ে থাকেনা । এখানে সব বাড়ির ছাদ দুপাশে ঢালু , লাল । জল জমেনা , গড়িয়ে যায় । যেন দুঃখগুলো সব ধুয়ে যায় ওই জলে । উত্তর ইতালির এই উল্টানো ‘Y’ আকৃতির হ্রদটিকে ঘিরে রয়েছে ভারেনা , বেলাজিও, কোমো, মেনাজিও , ইত্যাদি নানা শহর যেখানে প্রাচীন রোমের স্থাপত্য, ভাষ্কর্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি সেসব । এক একজন শিল্পী কতো যত্নে খোদাই করেছেন এক একটি আত্মিক দৃশ্য।এই যেমন, ওই দূরে বেহালা বাজাচ্ছে লোকটি। কী করুণ প্রতিটি সুর ! শুনলে মনে হয় কতো ব্যাথা লুকিয়ে আছে প্রতিটি মূর্ছনায় তার জীবনেও কী তবে কোনও বেদনা আছে ?সেইসব বেদনা এসে স্তুপের মতো জমা হয়েছে রিক্ত চেতনায় । একজন স্রষ্টা যখন কোনো শিল্পের জন্ম দেন , তার জীবনের না পাওয়া, ক্ষোভ, তৃষ্ণা, দুঃখ , সুখ উগরে দেন সৃষ্টির ভেতর । অসহনীয় এক অস্থির আলোর পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রসবযন্ত্রনা ভোগ করে স্রষ্টা জন্ম দেন সৃষ্টির । ঈশ্বর এই সৃজনকার্যের ভার মানুষকেই দিয়েছেন । তবে কখনও কখনও মানুষ আবার দুঃখবিলাসী হতেও ভালোবাসে। অর্থাৎ সইচ্ছেয় দুঃখকে নিজের জীবনে বাঁচিয়ে রাখা। এই যেমন , তোমায় ভালবাসতে চাওয়ার মতো বড়ো বেদনাদায়ক সত্যি তো আমার জীবনে আর কিছু নেই । এ ছিল আমার নিয়তি। মানুষ নিয়তি কখনও বদলাতে পারেনা । কষ্ট পাবো , জেনেও ভালোবেসেছি , ঘৃণা করতে চেয়েও ভালই বেসেছি । নিষ্প্রয়োজন ভাবেই সেইসব জ্বালিয়ে রেখেছি ঘরের কোণে। আমাদের সাজানো যে খেলাঘর তুমি ভেঙে দিয়ে চলে গেছো , তা আমি যত্ন করে গড়েছি, রোজ। সাজিয়েছি , অদল বদল করেছি ইট, কাঠ , পাথর । তোমার ফেলে যাওয়া চশমা, লেখার খাতা টেবিলে গুছিয়ে রেখেছি । এও কি খানিক বিলাসিতা নয়? নাকি অসহায়তা ?
ভাস্কর চক্রবর্তী লিখে গেছেন
” পিছনে যে শব্দ শুনেছো সেই শব্দ উন্মাদনার
সে তোমার বিগত দিনের।
হাহাকার যদি কিছু ভেসে আসে, সে তোমার গাঢ় অতীতের
যে তোমার ভবিষ্যতের জন্য একবার মুখ খুলেছিলো।
এ তোমার বর্তমান, ঘৃণা আর ঘৃণা দিয়ে
জড়িয়ে রেখেছো, তাকে দাও নিশ্চিন্তে উড়িয়ে
ভালোবাসতে শেখো। ”
হ্যা, ভালবাসতে শিখতে হয় , নিজেকেও । তবেই অন্যকে নিভৃতে ভালোবেসে যাওয়া যায় । আপাতত এভাবেই ঠিক আছি , জানো, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি । একা থাকার স্বাধীনতা আমায় উড়িয়ে নিয়ে যায় পাহাড়ের চূড়োয়। ভাসতে ভাসতে এতটাই হালকা হয়ে যাই যে দূর থেকে অদৃশ্য হয়ে তোমায় জাপটে ধরি, তুমি টের পাওনা । চাইলেও আমায় দূরে সরাতে পারোনা । তাই এতটাও কাছে এমন কোনো এক্সট্রিম পয়েন্টে যেতে চাইনা যে যেখান থেকে পেন্ডুলামের মত দূরে সরিয়ে দিতে তোমায় তীব্র শক্তি প্রয়োগ করতে হয় । ভাসতে ভাসতে আমি এখন সেই স্থিতিশীল বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছি, কোনোপ্রকার বাহ্যিক বল আমায় তোমার থেকে দূরে সরাতেও পারবেনা আবার কাছে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতেও পারবেনা । আর এটাই বোধহয় ‘আর্ট-অফ-লিভিং’ ।
কোমো লেকের জলে ধীরে ধীরে গোলাপী রঙের সন্ধ্যা নামছে । দূরের পাহাড়ে মেঘ জমেছিল কিছুক্ষণ আগে । এখন পরিষ্কার আকাশ । যা বলা হলো, তার বাইরে অনেক বড় একটা বৃত্ত রয়ে গেলো , না বলা কথারা সেখানে হাত পা মেলে নিঃশ্বাস নিতে চাইছে , আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে । যেতে হবে আমায় সেখানে , ওই যে দূরে, গোধূলির বেড়াজাল কেটে মন উড়ে যাবে ডানা মেলে , যেখানে দৃশ্যগুলো ছোটো হতে হতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে..