
পর্ণশবরীর কথকতা ৬
প্রাপ্তি চক্রবর্তী
একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের শেষে নিজের বাড়িতে ফিরলে চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করে। ‘নিজের বাড়ি’ অর্থাৎ বাবা-মায়ের, যে বাড়িতে আমার বাল্য আর কৈশোরের প্রায় শেষাংশ পর্যন্ত কেটেছে । যে বাড়িতে আমি হরলিক্স থেকে লাল-চায়ের যাত্রা শুরু করেছি, যে বাড়িতে আমার মাকে যৌবন থেকে ক্রমে প্রৌঢ়ত্বে ঢলে যেতে দেখেছি। দীর্ঘ ষোলো বছর এ বাড়ি ছেড়ে ক্রমাগত স্থান-কাল এবং বাসস্থান বদল করতে করতে এখানে ফিরলে দু-চোখে ভেঙে আসে ঘুম, মাথার ভেতর টুপটাপ কুয়াশা পড়ার শব্দ শুনতে পাই, বুকের ধুকপুকুনি স্তিমিত হয়ে আসে। আমার মতি অনিশ্চিত জীবনের চক্রব্যূহ ঠেলে এখানে এসে স্থিতিশীল হয়। যদিও এ বাড়ির কিছুই আর আমার পছন্দের সঙ্গে মেলে না … অগোছালো, প্রচুর আসবাব আর ততোধিক শব্দ-কল্প-দ্রুমের জন্য এ বাড়ির বাহ্যিক চেহারা আমার বাহ্য-মনের না-পসন্দ, সে আজ বহু বছর হল। তবু গোপন কথাটি এই, এর আত্মার সঙ্গে আমার আত্মা বন্ধুভাব নিয়ে চলে। এখানে আমার শান্তি, এখানেই নিশ্চিন্তের ঘুম।
মাধ্যমিকের বছর থেকে যে বিছানায় আমি ঘুমোতে শুরু করি তার পালঙ্কখানি মা-বাবার বিবাহের যৌতুক হিসেবে পাওয়া। ঐ একটি মাত্র পুরাতন আসবাব এখনো এই ক্ষুদ্র বাসার কিছু অংশ দখল করে রয়েছে। ময়ূর আর তার পেখমের কারুকাজ করা কালো কাঠের পুরাতন এই পালঙ্কখানি আমাকে আশ্রয় দিয়েছে আজ দীর্ঘকাল হল। বাড়ি ফিরে একবার এ ঘরটিতে উঁকি দেওয়া আমার চেতনার সঙ্গে মিশে রয়েছে। জ্ঞানে-অজ্ঞানে এই ঘরের চৌকাঠটিতে থমকে থাকা অভ্যেস আমার। কী দেখি তা নির্দিষ্ট থাকে না, তবু দেখি। আমাকেই দেখি হয়তো। বাল্যের আমি, কৈশোরের আমি… আমার পুতুলের সংসারের কর্ত্রী আমি, বাবার অফিসের ডায়ারি নিয়ে হিজিবিজি কেটেঅফিস যাওয়া আমি.. এ ঘরের মাথার দিকে শ্রীরামকৃষ্ণ, এখানে সেই ময়ূর-পালঙ্ক, ওখানে আটাশ বছরের পুরাতন ছ’তারের তানপুরাখানি আর ঐ দেওয়াল জোড়া বইয়ের তাক। তাক আর তার সংলগ্ন টেবিলে দাঁড়িয়ে দেখি কী আছে আর কী নেই.. ফি-বারই ফিরে দেখি অযত্নের ধুলো কোণা-খামচিতে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত ফিরেই মায়ের ওপর অযথা রাগ-অভিমান দেখনো একখানা নিয়ম হয়ে উঠেছিল আমার জন্য। এখন মা ছুটিতে রয়েছেন, আর আমি চির-শান্ত।
জীবন এমনই। কোনো কোণে ধুলো জমে মলিন, ওপর তলা অগোছালো, মুখে রাগ, মনে অভিমান, বুক চাপা কান্না…. তবু শেষ পর্যন্ত আত্মার মিলেই পরিসমাপ্তির ঘোষণা হয় আজও। দীর্ঘদিন বাস করতে করতে এই ইঁটকাঠের ক্ষুদ্র বাসার মধ্যে যেমন প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তেমনই এর আত্মা আমার আত্মার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আমারই বাহ্য-মনের ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে। আমি যেখানেই থাকি, যত দূরে কিংবা যত পারিপাট্যেই যাপন করি- এ বাসার সঙ্গে আমার নাড়ির বাঁধন।
শেষের কথাটাই তাই, মিল খোঁজা। বেলাগাম নিয়মের মাঝে নিজের কোণটুকু খুঁজে একফোঁটা বাসা গড়ে নিয়ে স্থির থাকা। এটুকুর জন্যেই এত সব- এত শ্রম, এত নুন-জল, এত বিরহ; …
বাকি যা কিছু তার সবই পরিবর্তনশীল।