
ধারাবাহিক গদ্য
সেপিয়া রঙের গলি – চতুর্থ পর্ব
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা…’
হরলিক্সের শিশির মতো চশমাটা নাকে তুলে নিয়ে দিবু বলল, ‘সত্যিইইইই?’
হরলিক্সের কাচের গায়ে লাইটিং খেলছে। রাস্তাটা প্রায়ান্ধকার। নর্দমার ধারে লম্বা পাঁচিলের গায়ে খানিক দূরে দূরে তিনখানা টিউবের ত্রিভুজ। কাচপোকা-শ্যামাপোকার আখড়া। কিছু দূরে নানান রঙের টুনি-তোরণ দেখা যায়। অল্পক্ষণ আগে সেই তোরণদ্বার পেরোতে গিয়ে ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। স্টান্ট দেখাতে চাওয়া কোনও এক সাইকেল আরোহী বেচারা দিবুর কাপ-আইসক্রিমের কচি কলাপাতা রঙের নিরীহ চামচটা ফেলে দিয়েছেন। এখন সারমেয়-সুলভ ভঙ্গিমায় কাপ-আইসক্রিমের অনির্বচনীয় স্বাদ গ্রহণ করতে করতে তার চোখে লাইটিং খেলে গেল। সে বলল, ‘সত্যিইইইই?’
সঙ্গে থাকা বব-কাট মেয়েটার মেজাজ খারাপ হতে আধ সেকেন্ডও সময় লাগে না। সে বলল, ‘দ্যাখ ভাই, সব করবি। ডাউট করবি না। বলছি যখন, সত্যি!’
‘ফালতু বকিস না। পাড়ায় কেউ বলেনি তো!’
‘তোর পাড়া!’ মেয়েটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ‘জানে নাকি কেউ কিছু!’
‘আমার ইস্কুল, আমি জানলাম না। তুই জেনে গেলি?’
‘জানতে গেলে পত্র-পত্রিকা পড়তে হয়। ’
দিবুর তবু ঘোর কাটে না। ফাঁকা কাপটায় শট মেরে সে বলল, ‘সত্যি এসেছিল ভাই? বল না?’
এই মুহূর্তে উৎসাহ পেয়ে মেয়েটা বলতে শুরু করল, ‘সে কি আর যেমন তেমন রাজকন্যা! সুদূর ডেনমার্কের রাজকন্যা। পুতুল পুতুল মেয়ে। লেসের ফ্রক পরে, সোনালি চুল রিবন দিয়ে বেঁধে, জুতো-মোজা মসমসিয়ে বিশাল গাড়ি থেকে নামল। ’
নিজের গলায় চিমটে কেটে মেয়েটা বলল, ‘মা কালীর দিব্যি, এই তোদের শ্রীরামপুর ইউনিয়নের পাঁচিলের সামনে ডেনমার্কের রাজকন্যা এসেছিল। ’
খুদে খুদে চোখ দুটো গোল করে দিবু বলল, ‘ভাই রে ভাই! এসব গল্প জানতামই না আমি! তোকে কে জানাল?’
‘একজন কবি জানালেন। তাঁর নাম মৃদুল দাশগুপ্ত। তোর শহরেই থাকেন বোধহয়। প্রতি রবিবার কাগজে লেখেন। ‘ফুল ফল মফস্বল’। তিনি লিখেছেন রাজকন্যা দেখার গল্প। তখন তুই আমি কেউ ধরাধামে আসিনি। কবি তখন অনেক ছোট্ট। ইস্কুলের পাঁচিলে বসে থাকতে থাকতে কবি দেখলেন তাঁর শহরে রাজার কন্যা এল। ’
‘তারপর?’
‘তার পরে আর কী! রাজকুমারী সেন্ট ওলাফ চার্চের দিকে চলে গেল। ’
দিবু একগাল হেসে বলল, ‘তুই কত রাজা রানির গল্প বলিস রে! রাজার বাড়ি দেখতে যাবি? রিটার্ন গিফট!’
হন্টন শুরু হল। পুজোর সন্ধে। ভুরভুরে আলো, ভিড়। খাবারের গন্ধ। মাইকে অমুক-তমুক ক্লাবের পক্ষ থেকে সকলকে জানানো হচ্ছে ‘শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা’। হাতে হাতে ঘুরছে এগরোল, তাওয়ায় খুন্তির ঠং ঠং। আধোঘুমে অলি-গলি। মফস্বলের পুজো। রাজার বাড়ি দেখতে চেয়ে দুই কিশোর-কিশোরী হাঁটছে। বাতাসে টুপটাপ হিম পড়ে।
অচেনা গলিপথ ছাড়িয়ে একটা মাঠ। মাঠে থিমপুজো চলছে। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে বিরক্ত বব-কাট বলে উঠল, ‘ভাই, কোথায় তোর রাজবাড়ি?’
‘প্যান্ডেলের পিছনে। এটা না দেখলে যাওয়া যাবে না। রাস্তা বন্ধ। ’
তারপরে ‘প্রস্থান’ দরজা দিয়ে বেরোতে ঘেমে স্নান কিশোরী রেগে একশা হয়েও মুহূর্তে চুপ। চারিদিকে পাঁচ তলা, সাত তলা বর্তমানের মাঝে ঢাল খাওয়া মাঠ জুড়ে সুবিস্তৃত হলদে রঙের প্রাসাদ। আঁধার ঘেরা, একা, নিশ্চুপ এক ছড়ানো প্রাসাদ। রাজবাড়ি!
খড়খড়ির দেওয়া দালান, ও ভেনিস উইন্ডো মিলিয়ে ইউরোপীয় ধাঁচের তিন মহলা বাড়ি। কাল খেয়েছে জৌলুস, তবু তার রেশ মোছেনি এখনও। সময়ের কাছে হার মেনে ভাগে ভাগে ভাগ হয়ে গেছে রাজার মহল। একটি ভাগে ছোট্ট ইস্কুল। একটি ভাগে চুনকাম ধরেছে, আজকের অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয় সেই ভাগ, নাম তার ‘রাজবাড়ি ভবন’। আরেকটি ভাগে সুদৃশ্য ভেনিসিয়ান প্রবেশতোরণ। ভিতরে ঢুকতে পেলে অবাক-রাজ্য। তার পাশে শেষভাগের একতলায় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের আপিস। কিছুকাল পরে আশায় বুক বেঁধে সেই কিশোর কিশোরী ফের আসবে কার্ড করাতে। আপাতত রাজবাড়ি দেখে জীবনকে ধুলোখেলা মনে হচ্ছে যাদের।
ঢাকের শব্দ এল। ক্ষীণ। একজন ঢাকি, আরতি চলছে। দিবু বলল, ‘রাজবাড়ির পুজো। দেখবি চ। আজ নিষেধ নেই। ’
প্রাচুর্যের কাছে মাথা নুয়ে পড়ে। একটি বাড়ি, একটি পারিবারিক পুজো। বাইরের মাঠের থিমপুজোর অর্ধেক আলোও নেই ঠাকুরদালানের সিঁড়িতে। উঠোনের নাটমন্দির ফাঁকা, ময়লা। একটা ঢাক বাজছে, বংশবদ পুরোহিত অপূর্ব নৃত্যে আরতি করছেন। একচালার দুগগা সপরিবারে সামনে তাকিয়ে রয়েছেন। দু’চারজন ঢুকছে, ঘুরে ঘুরে দেখছে নাটমন্দির, দালান, টিমটিমে টিউবে চুনকাম করা অন্দরমহল। তাদের সুগন্ধি আতর ঢালছে রাজবাড়ির উঠোন-বাতাসে। তারা নির্বাক সন্ধে ভাঙছে। হারিয়ে যাবার মরশুম।
দালানে উঠে ভয়ে ভয়ে কিশোরীটি বলল, ‘ঠাকুরমশাই আসব?’
ঠাকুরমশাই হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘আরে এসো এসো, লোকে শ্যুটিং করে চলে যাচ্ছে আর তুমি একটু ঠাকুর দেখতে আসতে পারবে না?’
এমন হাসিমুখের আহ্বান পেলে কে না ছুটবে? ভিতরে জ্বলছে কিছু টিউব। দালানের মাথায় একটা ঝাড়বাতি। একটাই। ডানদিকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়, সেখানে প্রবেশ নিষেধ। শুধু একটিমাত্র ঝাড়বাতি আলাদা করে দিল কিশোরীটির সন্ধে। স্থানে স্থানে অন্ধকার লেগে থাকা শহর পাল্টে যায় একটিমাত্র ঝাড়বাতিতে।
কথিত আছে, শ্রীপুর, গোপীনাথপুর, ও মোহনপুর নামের তিনটি গ্রাম সংযুক্ত করে গঠিত হয় শ্রীরামপুর। শেওড়াফুলি রাজের অধীনে ছিল রামচন্দ্র জীউ-এর মন্দির সংলগ্ন শ্রীপুর গ্রাম। মসনদে তখন নবাব আলিবর্দী খাঁ। ক্ষণে ক্ষণে বর্গী আক্রমণ থিতু হওয়ার পরের দশকে ড্যানিশরা এল এই অঞ্চলে। ১৭৫৫ সালে নবাব আলিবর্দী খাঁ-র থেকে এক লক্ষ ষাট হাজার সিক্কার বিনিময়ে শ্রীরামপুরে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে তারা। ড্যানিশ বা দিনেমারদের সম্রাট ষষ্ঠ ফ্রেডেরিকের নামে এই স্থানের নাম হল ফ্রেডেরিকনগর। ১৮০০ সালে উইলিয়াম কেরির ছাপাখানা তৈরি হতে এই শহরকে চিনল দেশ। পরবর্তী নব্বই বছর শ্রীরামপুরের শাসনভার রইল দিনেমারদের হাতে। ১৮৪৫ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল ব্রিটিশদের হাতে।
শ্রীরামপুর রাজবাড়ি স্থাপন করে প্রাচীন জমিদার গোস্বামী পরিবার। সেকালে বর্ধমান জেলার ভাগীরথী নদীর পশ্চিমপাড়ে পাটুলি গ্রামের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য ও চৈতন্য দর্শনের পণ্ডিত লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর বিবাহ হয় নদিয়ার শান্তিপুরে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের পার্ষদ শ্রী আচার্য অদ্বৈত গোস্বামীর বংশধর পণ্ডিত ভীম তর্কপঞ্চাননের কন্যার সাথে। লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর পুত্র রামগোবিন্দ মাতামহের কাছে পালিত হন এবং পরবর্তীকালে ভাগবত শাস্ত্রে দীক্ষিত তিনি ‘গোস্বামী’ পদবী গ্রহণ করেন।
এই প্রসঙ্গে যে গল্প প্রচলিত, তা হল, একবার রামগোবিন্দ গোস্বামী শান্তিপুর থেকে জলপথে গঙ্গাসাগরে যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিলেন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মনোরমাদেবী। পথের মাঝে স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠলে শ্রীরামপুরের ঘাটে নৌকা ভিড়ানো হয়। আজ শ্রীরামপুর শহরের বিবেকানন্দ নিধির স্থানে পর্ণকুটিরে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। পরম ভাগবত রামগোবিন্দ গোস্বামীর পুত্রসন্তান এই রাজত্বে জন্মেছেন জেনে শেওড়াফুলি রাজ সেই সম্পত্তি রামগোবিন্দ গোস্বামীকে দান করতে চাইলে পণ্ডিত রামগোবিন্দ সেই দান নিতে সবিনয়ে অস্বীকার করেন ও এক টাকার বিনিময়ে তা কিনে নেন।
রামগোবিন্দ গোস্বামীর কনিষ্ঠ পৌত্র হরিনারায়ণ গোস্বামী ছিলেন ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ফ্রান্স ও হল্যান্ডের বাণিজ্য যুদ্ধের কালে ভারত থেকে রপ্তানিকৃত বিপুল পরিমাণ পণ্যসামগ্রীর মাঝসমুদ্রে লুঠ হওয়া রুখতে ড্যানিশদের সাহায্য চাইল ব্রিটিশরা। চড়া দামে ড্যানিশ জাহাজে উঠে যেত পণ্যসামগ্রী, অতিরিক্ত লাভের মুখ দেখত কোম্পানি। দেওয়ান হরিনারায়ণ গোস্বামী এই সময়ে বহু অর্থ উপার্জন করেন। শ্রীরামপুরে প্রতিষ্ঠা করেন রাধামাধব জীউয়ের মন্দির, রাসমঞ্চ, ও স্নানঘাট।
হরিনারায়ণ গোস্বামীর পুত্র রঘুরাম গোস্বামী ছিলেন সেকালে বিখ্যাত জন পামার কোম্পানির মুৎসুদ্দি। প্রভূত অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ইউনিয়ন ব্যাঙ্কেও তাঁর শেয়ার ছিল। দু’টি কোম্পানিই বন্ধ হলে আর্থিক ক্ষতির বদলে ঠিক বিপুল অর্থের মালিক হন রঘুরাম। ব্রিটিশরা তের লক্ষ টাকার বিনিময়ে ফ্রেডরিক নগর কিনে নিলেও শ্রীরামপুরে আর্থিক প্রতিপত্তি বিস্তার করেন রঘুরাম গোস্বামী। পৈতৃক ভদ্রাসনের কাছেই স্থাপিত করেন ইউরোপীয় ধাঁচের আজকের শ্রীরামপুর রাজবাড়ি। যদিও রঘুরাম গোস্বামীর পৌত্র রায় বাহাদুর কিশোরীলাল গোস্বামী বাঙ্গালা গভর্নরের শাসন-পরিষদের প্রথম ভারতীয় সদস্য হয়ে ‘রাজা’ উপাধি পাওয়ার পর লোকমুখে এই বাড়ি রাজবাড়ি হিসেবে প্রচারিত হয়।
রামগোবিন্দ গোস্বামী অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে পরিবারে দুর্গাপূজা শুরু করেন। আজকের নীরব পুজোয় এককালে গান গেয়েছেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা, রূপচাঁদ পক্ষীর দল। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি আজকের শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রঘুরাম গোস্বামী। কিশোরীটির চোখে সময়ের ঝাড়বাতি।
এবাড়ির নাটমন্দিরের নাম ‘চাঁদনি’। চাঁদনি আদপে ছিল এক জলাশয়। অন্দরমহলের মেয়েদের স্নানঘাট। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর খিলান তুলে নাটমন্দির স্থাপিত হয়। পায়রার বাসা চাঁদনি খাঁ খাঁ করছে পুজোর সন্ধেয়।
চক্রবর্তী ঘাটের অদূরে বিবেকানন্দ নিধি। ঘাটে বসে কিশোরী বলল, ‘তোর শহর ভূতের শহর!’
সদ্য সিগারেট ধরা দিবু খং খং কেশে বলল, ‘কেন? কেন?’
‘এই যে ঘাট, এখানে পড়ে থাকত সতীর আধপোড়া দেহ। শেয়াল কুকুরে টানত। এই যে ভাগীরথী-হুগলী, কোন দূরের সওদাগর ডিঙি ভাসাত। কলকাতা, ফরাসডাঙ্গা, সপ্তগ্রাম, যশোর… সেই যে কোর্টের কাছে কবরখানা, সেখানে ভিনদেশীরা ঘুমিয়ে। এই যে একফালি মফস্বল, প্রথম ছাপাখানার আঁতুড়। হারানো মানুষের কাজ থেকে গেছে শহর জুড়ে। যখন তখন রাজকন্যা নামে শহরে। তাই তোর শহর ভূতের শহর। ’
কিছুক্ষণ ভুতগ্রস্তের মতো চেয়ে থেকে থেকে দিবু বলল, ‘এইসব রাজা-রানির গল্প তুই লিখতে পারিস না রে?’
একালের সবুজ লোকাল ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে ভিড়ের রাতে। সিগন্যাল পেল। দরজার বাইরে এক কিশোরের উদ্বিগ্ন মুখ। হরলিক্সের কাচের মতো চশমায় দুর্গাষ্টমীর লাইটিং যেন হাজার টাকার ঝাড়বাতি জ্বালিয়েছে। রাত দিন হওয়া ভাবনায় হাতে তার কায়দার সিগারেট পুড়ছে।
এখানে এক কিশোর পাঁচিলে বসে রাজকন্যা দেখেছিল। এখানে এক কিশোর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রাজকন্যা ভাবছে।
ক্রমশ…
তথ্যঋণ- একদা ‘রোববার’ পত্রিকায় প্রকাশিত মৃদুল দাশগুপ্তের ধারাবাহিক গদ্য ‘ফুল ফল মফস্বল’