
সুদেষ্ণা ঘোষ-এর কবিতা
কুয়াশা ও আয়নার সংলাপ
তুমি বললে, প্রথম যখন তোমায় দেখি…
আমি দেখলাম পৃথিবীর কিনার দিয়ে একটা কাচের গ্লাস গড়িয়ে যাচ্ছে।
কোনও শব্দ হচ্ছে না।
তুমি বললে, শেষ স্টিমারের আওয়াজ মনে আছে?
আমি দেখলাম, একটা সাদা ধবধবে পায়রার পাশে এক বেহালাবাদক।
মুখ দেখা যাচ্ছে না।
তুমি বললে, কবে যে মুক্তি পাব?
আমি দেখলাম, রক্তঠোঁট মেয়েদের গায়ে বিষাদবর্ণ শাড়ি।
তবু কেউ অন্ধ হচ্ছে না।
তুমি বললে, কতদিন বইব এই রেডরোড, এই অন্ধকার?
আমি দেখলাম, খুনখারাপি রঙের সূর্যাস্ত, কুয়াশার আর্তনাদ আর অনেক চোখের জলের ওপারে একটা নীল তারা
মৃত্যুর ভয়ে কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না।
কিছুতেই না…
অরণি আর আমার ভুলে যাওয়া সংলাপ
অরণি বলেছিল আমাদের বাড়ি হবে সমুদ্রের ফেনা দিয়ে।
বলা বাহুল্য সমুদ্রের নামে অরণির চোখ পালটে যেত।
‘ম্যাজেস্টিক’ অরণি বলেছিল, ‘ম্যাজেস্টিক’।
সেই ম্যাজেস্টিক বুড়ো বাজের ডানায় ভর দিয়ে নেমে আসত স্বপ্ন-সম্ভব সন্ধে।
একটা ফোন নিয়ম করে আসত বিকেলবেলার দিকে।
আর আমাদের ইট হাঁ করা বাড়ির দেওয়াল থেকে কান্নার মতো চুঁইয়ে নামত বালির ধারা।
আমার পোষা ম্যাজেন্টা, সায়ান মাছগুলো মরে যাচ্ছিল একটার পর-এক।
রোগটা ধরা যায়নি।
ধরা যায়নি কেন হঠাৎ একদিন সস্তা লিপস্টিকের বিজ্ঞাপনে আমাদের ছোট্ট শহরের দেওয়াল উপচে পড়ল।
ঘুম আর স্বপ্নের মাঝখান দিয়ে আমি দেখতাম টাওয়ার আর ঝড়ের ফাঁক দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে খুব ছোট একটা তারা উঠছে তো উঠছেই।
সমস্ত শোক আমি ঘরে বন্ধ করে রাখতাম।
খেতে দিতাম না কোনওবেলা।
আমরা কথায়-কথায় অনেক দূরের এক গানপাগল শহরের কথা তুলতাম
যার একদিকে বরফের মতো জ্যোৎস্না হু হু গান গাইছে
অন্যদিকে ফিকে হলুদ ফুলের গাছ পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাইল-মাইল অন্ধকারে।
কে জানে কখন অরণির নাম জলের ভিতর ফুটে উঠত।
আবার মিলিয়ে যেত। কে জানে!
গোলাপফুল আঁকা আলোর নীচে ঝকঝকে কুশনের মাঝখানে ছেলে হাসতে-হাসতে বলত, ‘গুড বাই ড্রয়িংখাতা’
‘গুড বাই চাউমিন’
গুড বাই ডিমলাইট’
আর আমার গলা শুকিয়ে যেত।
মাথা কুটে মরে গেলেও কেউ সত্যি বলত না।
বাথরুমের বুড়ো আয়না খালি অনেক চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু ও একদম একা।
তাই ছোটবেলার ফাঁকা গানের ইসকুলের দিকে প্রাণপণে ছুটে মিলিয়ে গেল রাতের করিডর।
আর ভোরের নীল আলো যখন তারাটাকে ওসকানি দিত পালানোর
আমি মন দিয়ে দেখতাম দুটো খুব উঁচু ধূসর বাড়ির মধ্যে একটা সেতু তৈরি হচ্ছে আকাশে।
অরণি সমুদ্রের মতো গলায় বলে উঠছে, ‘ম্যাজেস্টিক’।
এদিকে হোর্ডিংয়ের মেয়েরা হইহই করতে-করতে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে।
একজনের ঠোঁটে তখনও গত সন্ধের আধভাঙা ইয়ার্কি।
কিন্তু খুব নরম তুষারপাতের মতো মৃত্যু ছাড়া মাছেদের কিচ্ছু ভাল লাগছে না।