
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
চতুর্বিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ২৪তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
২৪
চক চৌধুরীতলার ফ্ল্যাটে এসে মোহরমালা তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে ঘর পরিষ্কার করতে লেগে যান, এখানে তিনি কোন কাজের লোক রাখেননি, ডাস্টিং, ক্লিনিং সব একাই করেন।
ফ্ল্যাটটা ইচ্ছে করেই ছোট কিনেছেন, যাতে একে পরিষ্কার রাখার কাজটা তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে না যায়, ঘন্টাখানেকও লাগে না তাঁর ঘর পরিষ্কার করতে, তারপর গা ধুয়ে এক বড় মাগ কফি বানিয়ে ব্যালকনিতে বসেন। কলকাতার এই দিকটা খুব সুন্দর। অনেক সবুজ, বড় বড় দিঘি, আকাশ ছায়া ফেলতে পারে এখনো সেই দীঘির জলে।ছোট্ট ছোট্ট মানুষ মানুষী সান্ধ্য পরিক্রমা করে জলের চারপাশ ঘিরে। পাখিরা চ্যাঁ চ্যাঁ করে কৃষ্ণচূড়া, কাঠবাদামের মাথায় বসে। ঝাঁক ঝাঁক টিয়া মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। দূরের কোন গাছে তাদের বাসা, তাদের ঘরে ফেরার ঠিকানা। মোহর ভাবেন তাঁর কি কোন ঠিকানা আছে ঘরে ফেরার? যা আছে তা শুধু পোস্টাল অ্যাড্রেস।শুধুই খবর আসবে, মানুষ এসে পৌঁছতে পারবে না কখনো। কোন শোক নয়, একধরনের মিহি বিষাদ জড়িয়ে ধরে তাঁকে। ঠিক যে মনে হয় জীবনটা নষ্ট হল তা নয়, হাহাকার উঠে আসে না বুক থেকে, বরং আশ্চর্য এক নির্লিপ্ততায় অনেক দূর থেকে নিজেকে দেখতে পান। যেমন ন তলার ব্যালকনি থেকে দেখতে পান দিঘির জলে সূর্য ডুবছে । চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও বসে থাকেন, উঠতে ইচ্ছে হয় না। তাঁর তো অন্ধকারে বসে থাকার সুযোগ হয় না এখন। শুধু তাঁর কেন, এই শহরের কেউই আর অন্ধকার উপভোগ করতে পারে না, আর কিছু না থাকলেও হাতের মোবাইল আলো ফেলে মুখের ওপর ক্রমাগত।
মোহরের সোশ্যাল মিডিয়ার নেশা নেই। ফেসবুক হোয়াটস্যাপ টুইটারে অ্যাকাউন্ট আছে, কিন্তু খুব অনিয়মিত তিনি সেখানে। এসব জায়গায় ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ফাঁদ পাতা থাকে। আড়াল থেকে কেউ বা কারা সব জেনে যায়, কে কী পরতে ভালবাসে, কী খেতে, কী সিনেমা দেখতে, কী গান শুনতে। মনে হয় যেন কেউ তাঁর ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখছে। না, অনেক পরিশ্রমে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে এই জায়গাটায় পৌঁছেছেন, এখন আর কারো নজরদারিই সহ্য হবে না তাঁর।
সন্ধে আর একটু ঘন হলে ব্যালকনি থেকে উঠে ঘরে আসেন, কিঞ্জলকে ফোন করেন একটা, মাত্র একটা রাতের জন্যে আসেন, তাও সবে এই বছর দুই এমন আসার শুরু, মেয়েও সে নিয়ে কিছুই বলেনি কোনদিন, সে তার বন্ধুবৃত্ত আর পড়াশোনা নিয়ে আছে, বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে, সেসব খোঁজ খবর নেওয়া চলছে, মোহর না ফিরলে কিঞ্জলও বাড়ি ফেরে না, বন্ধুর বাড়ি থেকে যায়, সেই নিয়ে একবার উদবেগ প্রকাশ করলে মেয়ে বলেছিল ‘আই ক্যান টেক কেয়ার অব মাইসেলফ’
মোহর আর কিছু বলেননি। তবু ভেতরে ভেতরে মায়ের একটা উদবেগ তো থাকেই। তার ওপর আবার আজ বেরোবার সময় মেয়ের ফোন এল ‘তুমি কি আজ বাড়ি ফিরছ?’
এ কেমন প্রশ্ন! কিঞ্জল তো জানেই তিনি সাধারণত শনিবারগুলো চক চৌধুরীতলাতে কাটান, সপ্তায় একবারও না গেলে নষ্ট হয়ে যাবে না ঘর দোর?
তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে কিঞ্জল বলল ‘ওহ, সারা সপ্তা খালি পড়ে থাকা ফ্ল্যাট, নষ্ট হয়ে যাবে দেখাশোনা না করলে। আচ্ছা, আমিও তো যেতে পারি একদিন তোমার সঙ্গে, থাকতে পারি। এই অন্ধকার বাড়িটায় তুমি ছাড়া একা লাগে মা, দম আটকে আসে আমার’
মোহরমালার শরীর বেয়ে একটা কাঁপুনি নেমে গেছিল।
তিনি বলেছিলেন ‘কী হয়েছে সোনা? আমি ফিরে আসছি আজ, যাব না কোথাও’
অমনি খিলখিল করে হেসে উঠেছিল কিঞ্জল
‘জাস্ট কিডিং ইয়ার। কাল বিকেলের মধ্যে ফিরছ তো? দুজনে মিলে একটা কাফেতে যাব। একটু চিল করব’ বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল কিঞ্জল। খানিকক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন মোহর, মেয়েকে নিয়ে ভাবছিলেন।বড় ভালো মেয়ে তাঁর। কোনদিন ওকে নিয়ে কোন সমস্যা হয়নি তাঁর। ভবানীর সঙ্গে সেপারেশ্নের কথা মনেই হয়নি শুধু মেয়ের জন্যেই। এত সুন্দর ছন্দে বাঁধা তাঁদের মে মেয়ের সম্পর্ক। দুজন দুজনকে খুব ভালো বোঝেন। কিন্ত সম্প্রতি ওর মধ্যে কিছু কি বদল এসেছে? ইদানীং খুব শান্ত আর বিষণ্ণ লাগে ওকে, যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন না কি তিনি?এই বয়সে এখনো ওর কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। থাকলে সবার আগে তিনি জানতেন। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক লাগে তাঁর।
শোবার ঘরে খাটে বসে ফোন করেন কিঞ্জলকে। ধরে না। বেজে যায় ফোন। মোহর তখন ক্যাবিনেট থেকে ইলেক্ট্রনিক তানপুরাটা বার করে আনেন, সারা সপ্তা রেওয়াজে বসা হয় না, এখানে অনেকটা অবসর শনিবারের এই সন্ধেবেলা। অজিত আসতে চাইলেও কোনদিন নটার আগে আসতে পারে না, ততক্ষণ অব্দি সময়টা তাঁর একার। এই সময় তিনি গান করেন, বই পড়েন, টিভিটা চালানো থাকে বসার ঘরে, কানে আসে সব, তেমন তেমন খবর হলে গিয়ে বসেন টিভির সামনে। আজ গেলেন না, বিছানায় বসে তানপুরা নিয়ে পিলু ধরলেন। বেডসাইড টেবিলে একটা মাটির থালায় একটা জুঁই ফুলের মালা রেখেছেন। আসর সময় দেখলেন সামনের মোড়ে বিক্রি করছে। তার গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধের হাওয়ায়। মন ভালো হয়ে গেল।
‘বাতিয়া বানাও নেহি বারবার মোসে
বিনতি করত তুমে হার হার তোসে’
যখন গানটার মধ্যের অভিমানে, সংরাগে হারিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই ফোন বাজল। কিঞ্জল রিং ব্যাক করছে, ‘আচ্ছা মা, আজ ফিরতে ফিরতে দেখলাম দেওয়ালে লেখা- শহীদ স্মরণে আপন মরণে রক্ত ঋণ শোধ করো। আমাদের সবাইকেই কি শুধতে হবে রক্ত ঋণ?’
শিউরে উঠলেন মোহর। যদি সামনে কেউ থাকত তবে স্পষ্ট দেখতে পেত মোহরের শরীর ভূমিকম্পে দোলা বাড়ির মতো কেঁপে উঠল। কিঞ্জল সামনে থাকলে নিশ্চয় ওঁকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠত ‘একি মা! তুমি কাঁপছ কেন?’
ভূমিকম্পই হয়তো। এই সব ফ্ল্যাটগুলো সবই তো জলাজমি বুজিয়ে,, লোকের পৈতৃক বাড়ি ভয় দেখিয়ে নামমাত্র টাকায় কিনে তৈরি করা। এর তলায় কত শতাব্দীর জল, কত মানুষের বেদনা, দীর্ঘশ্বাস। আজকাল কেন জানি শনিবার শনিবার এই ফ্ল্যাটে এলে কেমন হাঁফ ধরে তাঁর। এমন নয় যে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠেন। লিফটে ওঠেন, তাও। এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরলে মনে হয় পেছন পেছন কে যেন হাঁটছে। হতে পারে এখানে অনেকখানি সময় তাঁকে একা থাকতে হয়।অজিত কত রাতে আসে। ততক্ষণ নিজের মতো থাকা।মাঝে মাঝে একটু সাজগোজের ভূত চাপে মাথায়। আয়নার সামনে দাঁড়ান সেজেগুজে। কিন্তু আয়না দেখে সেদিন চমকে উঠেছিলেন। আয়নায় তিনি কোথায়? একটা মেয়ে সিলিং
থেকে ঝুলছে। তার পা দুটো আয়না জুড়ে।
প্রথম যেদিন দেখেছিলেন, স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী সব খাওয়া ছিল। সাধারণত তিনি বাইরের হাবিজাবি এড়িয়ে চলেন। প্যাকেট বাড়িতেই যায়। কিঞ্জল এইসব ভালবাসে, বিশেষ করে বিরিয়ানি। সেদিন বিরিয়ানি হয়েছিল। কর্মচারীরা জোর করে চার প্যাকেট দিয়ে দিল। প্যাকেট নাকি প্রচুর বেশি। মিটিং এ অত লোক হয়নি। এই অংকটা তিনি বোঝেন জলের মতো।প্যাকেট কত অর্ডার দেওয়া হয়েছে সেই সংখ্যাটা ঈশ্বরের মতো। ঈশ্বর আছেন না নেই? কোথায় আছেন, যদি থাকেন আদৌ? এটা এক রহস্যময় অজ্ঞেয়। এরা যেভাবে মিটিং- এ প্যাকেট সার্ভ করে তা একটা শিল্প। এরকম ঘটনা আছে, যে অধ্যাপক ওয়াশরুমে গেছেন মিটিং এর মধ্যে, এসে দেখেছেন তাঁর সামনের কাজু, ফিশফ্রাই বা ভেজ চপ, বিস্কিট ভরতি প্লেট হাওয়া, পড়ে আছে শুধু আধ খাওয়া কফি বা কোল্ড ড্রিংক। ‘অনুপস্থিতির’ অপরাধে তাঁকে লাঞ্চ প্যাকেট দেওয়াই হল না সেদিন। তাঁকে হয়তো সামনের ক্যান্টিনে গিয়ে রুটি আর সোয়াবিন মটরের অখাদ্য ঝোল খেতে হল। যেদিন বেশি অর্ডার দেবার সুবিধে থাকে না, সেদিন এইভাবেই এরা তক্কে তক্কে থাকে খাবারের প্যাকেট সংগ্রহ করার জন্যে। বাড়িতে বাচ্চাদের জন্যে প্যাকেট নিয়ে যাওয়ার মধ্যে পিতৃ বা মাতৃ হৃদয়ের একটা করুণ মধুর রূপ ফুটে ওঠে ঠিকই, কিন্তু তার জন্যে, যে অধ্যাপক সারাদিন মিটিং করলেন শুধু চা বা কফি খেয়ে, তাঁকে তাঁর প্রাপ্য প্যাকেট থেকে বঞ্চিত করে অভুক্ত রাখাটা জাস্ট মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু শিক্ষকতা থেকে প্রশাসনিক কাজে সরে এসে মোহরমালা শিখেছেন যে কিছু কিছু বিষয়ে চোখ বুজে থাকাই দস্তুর, চোখ বুজে না থাকতে পারলে অফিস চালানো যায় না। এই যে তিনি বুঝতে পারলেন চারটে প্যাকেট তাঁকে ধরানো মানে আজ ওরা প্রচুর প্যাকেট সরিয়েছে। কিন্তু বললেন না। এটা যদি তিনি না আনেন, তবে তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত নীতিবাগীশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। একদিনও টিকতে পারবেন না কাজের জায়গায়। লোকে সৎ লোকের সান্নিধ্যে খুব কমফোর্টেবল ফিল করে না। মোহরমালার মনে হয় সততা জিনিসটাও ধর্মাচরণের মতো, গোপন ও ব্যাক্তিগত থাকাই ভালো। ধর্মের মতো সততার ঢাক পেটালেও কাজ করতে অসুবিধে হয়।
তাই তিনি বরাবর যেমন চুপচাপ প্যাকেট নিয়ে নেন, এবারও নিলেন। দুটি প্যাকেট ড্রাইভারের হাতে দিয়ে কিঞ্জলকে পৌঁছে দিতে বললেন। তিনি ক্যাব ধরবেন। শনিবার তিনি নিজের গাড়ি নেন না। ক্যাবে ওঠার সময় দেখলেন তূণীর একটি মেয়ের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে মগ্ন হয়ে কথা বলতে বলতে। তূণীর একা থাকলে ওকে ডেকে এই প্যাকেট দুটো দিয়ে দিতেন। কিন্তু্… গাড়ির সিটে গা এলিয়ে তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, তাঁর বুকে কেমন একটা তিরতিরে ব্যথা। তূণীরের পাশে অন্য মেয়ে কেন? ও যে বলেছিল আগের জি এফ এর সঙ্গে ওর ব্রেক আপ হয়ে গেছে এই চাকরিতে ঢোকার পর। এরকম বোকা মেয়ে এখনকার দিনে আছে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন মোহর। কোথায় বয়ফ্রেন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করল সেটা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিবি, তা না। বলে কিনা শাসক দলকে ধরে ঢুকেছে, তাই আদর্শচ্যুত তূণীর। হাঃ আদর্শ। মোহরের কাছে নিজের কাজটা ঠিক করে করাই আদর্শ। সেটা করতে গিয়ে কোন রঙের লোককে ধরতে হবে সেসব অবান্তর কথা। পাশে পড়ে থাকা বিরিয়ানির প্যাকেট দুটো দেখলেন একবার। এ দুটোও কি বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে হত? নাহ
ভবানী তো আজ বাড়ি ফিরবেন না। ভালই হল। আজ গিয়ে কোন রান্না করতে হবে না। তিনি তো পাঁচ ছ স্পুন খাবেন মাত্র। বাকিটা অজিত।
সেদিন ফ্ল্যাটের চাবি খুলে ঢুকে হাউসকোট গলিয়ে পরিষ্কার করতে শুরু করেছিলেন রোজকার মতো। তারপর গা ধুয়ে কফি নিয়ে ব্যালকনিতে। সন্ধে নেমে এলে ঘরে এসে ভাবলেন একটু সাজবেন আজ। অজিত একটা শাড়ি দিয়েছে আগের সপ্তায়। এমনিতে কিছুই কিনতে পারে না, কোয়ালিটি সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য। ক্যাটকেটে রঙের সিন্থেটিক যত ওর কেনার দৌড়। কিন্তু অবাক কাণ্ড, এটা ভালো কিনেছে, একটা সুতির বমকাই, কালো রঙের। ভাবলেন পরেন আজ। আয়নার সামনে এসে চুল আঁচড়াচ্চিলেন প্রথমে। এখনো কী ঘন আর লম্বা চুল তাঁর।এই চুলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কতদিন কেঁদেছে অজিত। চুলে আস্তে আস্তে চিরুনি চালাচ্ছিলেন মোহর, হঠাৎ দেখলেন তাঁর মাথার ওপর দুটো পা দুলছে আয়নায়। পা দুটি একটি মেয়ের, তার আঙ্গুলে রুপোর চুটকি মল, ঝামা পাথর দিয়ে ঘষা পা, প্রতিটি নখে সুন্দর করে নেলপালিশ লাগানো ফ্রস্টেড নীল রঙের। কিন্তু কোথায় একটা অস্বাভাবিকতা আছে যেন। কোন মেয়ের পা কি এত বড় হয়? পা দুটি যেন পুরো আয়না জুড়ে আছে। আর আস্তে আস্তে নেমে আসছে মোহরের মাথার ওপর। এবার কি ওঁর গলায় চেপে বসবে ওই দুটি পা? বাড়িতে তো আর কেউ নেই।এই পা দুটো কোত্থেকে এল?
অন্য কেউ হলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেত কিংবা চিৎকার করে উঠত। কিন্তু মোহর শুধু যে শক্ত ধাতুর মেয়ে তাই নয়, ভবানীর ভবিষ্যৎ গণনা যেন তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। তাঁর তো কোন আশু বিপদের কথা বলেননি ভবানী। ভয় পেলেন, ভীষণ ভয়, তবু পেছনে ফিরে তাকালেন তিনি। সিলিং ফ্যান থেকে একটা মেয়ে ঝুলছে, গোলাপি চুড়িদার পরা শ্যামলা রঙের গোলগাল মেয়ে একটা, গোলাপি ওড়নার ফাঁস বেঁধে। কিন্তু তা কী করে হবে? পাখাটা তো চলছে। সন্ধের দিকে মোহর এসি চালান না, পাখাই চলে, জানলা দরজা দিয়ে হাওয়া যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। নতলার ওপর ফ্ল্যাট, খুব ভ্যাপসা গরম না পড়লে এসি লাগে না। তাহলে এই মেয়েটা কি চলন্ত পাখা থেকে ঝুলে পড়ল? এরকম অদ্ভুত চিন্তা তাঁর মাথায় এল এই সময়। তাঁর মনে হল সবার আগে পাখার সুইচটা অফ করে দেন। নইলে তো মেয়েটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তিনি ছুটে গিয়ে পাখা বন্ধ করতে গেলেন। অফ করে তাকিয়ে দেখলেন কোথায় কে? পাখাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনটে ব্লেড স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সন্ধের হাওয়া দীঘির জল মেখে ঘরে এসে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছে শরীরে। তিনি খাটে বসলেন, জলের বোতল থেকে জল খেলেন ঢকঢক করে। তারপর একটা বই পড়ার চেষ্টা করলেন, মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল কে এ? কাকে দেখলেন? না অজিতকে বলেননি কোনদিন, কাউকেই না। কিন্তু মাঝে মাঝেই দেখেছেন এই দৃশ্য। আজকাল দেখলেই মনে হয় বাড়িটা নড়ছে, ওই পা দুটি অতিকায় হয়ে সারা বাড়িকে মাটির নিচে ডুবিয়ে দিতে পারে। কেউ, কেউ বাঁচবে না। তবু আসেন মোহর, প্রতি শনিবার, মনে হয় অজিত তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে, আগে আসতেন অজিতের কাছ থেকে গরমাগরম খবর পাওয়া যাবে এই ভেবে। এখন তো খবর পাবার আরও সোর্স হয়েছে তাঁর। তবু আসেন কেন তিনি অজিতের কাছে? তাহলে কি ওর ওপর মায়া পড়ে গেল?
অজিত একবার কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল বৌ চলে গিয়েছে তাকে ছেড়ে। খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছিল সেই কথা। এইসব লোকের বৌ থাকে নাকি? কখন কোথায় পড়ে থাকে, ঘরে ফেরে কি ফেরে না, একেক জায়গায় একেকটা মেয়ে রাখে। বৌ যে কিছুদিন ছিল সেটাই আশ্চর্য। না, এ অজিতের কেউ নয়, নিশ্চয় এ জমি যাদের, তাদেরই বাড়ির কেউ । ভবানীকে বলবেন? ভবানী তাহলে একটা যজ্ঞ করে আত্মা তাড়িয়ে দেবে নিশ্চয়ই।কিন্তু আজকাল ভবানীকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। কেন জানি কিঞ্জলের কথাটা মাথায় ঘোরে। হি ক্যান প্লে ইভিল। কিঞ্জল আজ কোন কারণে খুব ডিসটার্বড। মনটা খারাপ লাগে।কী অদ্ভুত একটা কথা বলছে সে, কোথায় কোন দেওয়ালে দেখেছে লেখা – ‘শহিদ স্মরণে আপন মরণে রক্ত ঋণ শোধ করো’। কে লেখে এমন আত্মঘাতী পোস্টার। তাঁদের ছেলেবেলায় দেওয়াল লিখনের একটা মান ছিল, কী চমৎকার সব ছড়া পড়েছেন, শ্লোগানগুলোও দুর্দান্ত ছিল। আর এখন সেখানেও ধস নেমে গেছে। তিনি কিঞ্জলকে বলেন ‘আমিও একটা পোস্টার দেখেছি ক্যাম্পাসে। তাতে লেখা ছিল-
‘সাবধান
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের দিন আসন্ন। এর জন্য প্রয়োজন অরিষ্টনেমি যজ্ঞ।
যোগাযোগ করুন ভবানী শাস্ত্রীর সঙ্গে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন এসে গেছে নাকি?’
কিঞ্জল বলে ‘আচ্ছা মা, মাঝি যো নাও ডুবোয়ে উসে কোন বাঁচায়ে?’
‘মানে?’
‘মানে, কোনদিন যদি জানতে পারো যাকে সবচেয়ে বিশ্বাস করো, সে-ই তোমার জীবনের পরম শত্রু, তাকে আটকাবার জন্যে কাকে দিয়ে যজ্ঞ করাবে ভেবে রেখেছ তো, হ্যাঁ?’
হাসিতে ফেটে পড়ে কিঞ্জল। মোহর ভাবেন মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি মেয়ের?
(ক্রমশ)