
ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ
জয়দেব ভট্টাচার্য
জন্মের পর থেকেই সময়ে-অসময়ে রবীন্দ্রকবিতা আমার কানে এসে পৌঁছাত – বাবার কন্ঠে। রবীন্দ্রনাথের কত কবিতা, কত গানের বাণী যে তাঁর কন্ঠস্থ ছিল! কখনো কখনো আমাকে শোনাতেন ‘বীরপুরুষ’, ‘লুকোচুরি’, আরো কত কবিতা। সে সব আমার মনে খুব যে দাগ ফেলত এমন নয়। বড়জোর কল্পনায় ভেসে উঠত কয়েকটি লোকের ছবি, তাদের হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল। তারা লম্ফ দিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠত, “হাঁরে রে রে রে রে।” ব্যাস, এই পর্যন্ত। তারপর হাতে এল ‘সহজ পাঠ’। ভালোলাগা স্কুলপাঠ্য হয়েই থেকে গেল তা। পঁচিশে বৈশাখ স্কুল প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মাল্যদান, কিছু কবিতা পাঠ, কিছু গান, আমি দর্শক-শ্রোতা হয়েই থেকে যেতাম। বিপদ ঘটল, ক্লাস ফাইভে নতুন স্কুলে ভর্তির পর যখন পঁচিশে বৈশাখ এগিয়ে এল। ‘ঐক্যতান’ কবিতাটি মুখস্থ করে আমায় আবৃত্তি করতে হবে, মাস্টারমশায়দের নির্দেশ। আমার মত একটি অবোধ বালককে কেন যে এমন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, জানি না। একই স্কুলে একটু উঁচু ক্লাসে দাদা-দিদি পড়তো, সুতরাং সংবাদটি বাড়িতে পৌঁছালো। মা-বাবার কাছে আমার পক্ষে মাস্টারমশায়দের নির্দেশ অমান্য করা যে কত বড় গর্হিত অপরাধ বলে বিবেচিত হবে তা আমার সম্যক রূপে জানা ছিল। সুতরাং বাড়ির সঞ্চয়িতাটি আমার সঙ্গী হল। কবিতার কথাগুলি কিছুতেই আমার বোধগম্য হয়ে উঠছে না, মুখস্থ করব কেমন করে! নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে লুকিয়ে লুকিয়ে কত কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করি। একটি কবিতায় গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়। প্রথম স্তবকটি ঠিকঠিক বুঝতে না পারলেও দ্বিতীয় স্তবক থেকে সব আমার জানা কথা, চেনা ছবি, পরিচিত ঘটনা। যেন এই কবিতার সুরের সঙ্গে আমার সুরের প্রকৃত ঐক্যতান গড়ে উঠল। কবিতায় একটি ছেলের কথা – আমারই সমবয়সী। আমার সঙ্গে কোথাও কোথাও মিলও তার, তবে বেশি মিল আমার ক্লাসের কয়েকটি ছেলের সঙ্গে – যারা পড়া না পারায় প্রতিদিন মাস্টারমশায়দের হাতে মার খায় বিস্তর, স্কুলের বাইরে জাম, বৈঁচি, পদ্মের বীজ খায় আরো অনেক বেশি। ক্লাসে ওই ছেলেরা মার খেলে আমার খুব কষ্ট হয়। কবিতার ছেলেটার কষ্টেও আমি তেমনি কষ্ট অনুভব করি। পোষা কুকুরের মৃত্যুতে ও যখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে তখন আমারও দু চোখ জলে ভরে ওঠে। কেন ওদের পড়ায় মন থাকে না, আমাদের মাস্টারমশায়রা কি কখনো ভেবে দেখেছেন! কবি কিন্তু খুঁজে পেয়েছেন কারণ। তাই তো তাঁর স্বীকারোক্তি,
“সে ত্রুটি আমারই,
থাকত ওর নিজের জগতের কবি
তা হলে গুবরে পোকা এত স্পষ্ট হত তার ছন্দে
ও ছাড়তে পারত না।
কোনোদিন ব্যাঙের খাঁটি কথাটি কি পেরেছি লিখতে,
আর সেই নেড়ি কুকুরের ট্রাজেডি।”
হ্যাঁ, কবিতার নাম ‘ছেলেটা’। ভালবেসে ফেললাম কবিতাটিকে। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রথম এলেন আমার সামনে। যদিও সাময়িকভাবে ভুলে গিয়েছিলাম ‘ঐক্যতান’ কবিতাটির কথা। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে বুড়ো হতে চলেছি, এখন আমার ষাট। জীবনের কত মুহূর্তে কত রূপে তিনি এসেছেন আমার চেতনায়, তবুও ভুলতে পারি না ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের বৈশাখের কোন একটি দিনের কথা, যেদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার সেতু বন্ধন করে দিয়েছিল ওই ‘ছেলেটা’।