
স্রোত – তৃতীয় পর্ব
যশোধরা রায়চৌধুরী
কয়েক বছর আগে আরম্ভ পত্রিকায় কিস্তিতে কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল যশোধরা রায়চৌধুরীর অন্য নামে একটি উপন্যাস, যার উপজীব্য হল, সমসাময়িক কালখন্ড আর কিছু তরুণ তরুণীর লড়াই । গ্রন্থাকারে 'স্রোত' নাম দিয়ে একটি অতি সীমিত প্রকাশনা প্রচেষ্টাও হয়েছিল। তবে প্রকাশক সব কপিশুদ্ধু গায়েব হয়ে যাওয়াতে, স্রোতকে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে এবার আবহমানের পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে হাজির করার প্রচেষ্টা । "সম্পূর্ণ ভাবে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এমন উপন্যাস আমি আগে পড়িনি। নারীবাদী লেখকের লেখা উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু তাতে পুরুষের লোলুপতা কে কাঠগড়ায় দাঁড়করানো আর নারীকে শিকার প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় প্রায়শই অবজেকট্ভিটি থাকেনি। এই উপন্যাসের শিকড় গেছে নারী জীবন যাপনের নানা স্তরে । এর মধ্যে আছে যে ভাষায় পুরুষতন্ত্র জীবনের ন্যারেটিভ এমনকি সাহিত্য ও রচনা করে , তার ইন্টারপ্রিটেশন। এতে স্পষ্ট কথা আছে, অভিমান আছে, হাস্যরস এবং অসহায়তাও আছে । এবং সর্বোপরি পুরুষকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নেওয়ার আকাঙ্খা।..এখনকার ছেলে মেয়ে দের হাতে ই তুলে দেওয়া কাহিনীর ব্যাটন, এদের স্পস্ট করে দেখা, বলতে পারা ও অতীতের বোঝা নামিয়ে রেখে পথ চলার সাহস কে কুর্ণিশ জানিয়েছেন যশোধরা। মুক্তি এরাই আনবে। যৌনতার রহস্যময়তার আবরণ উন্মোচন করে তথ্যের নিরপেক্ষতার মধ্যে উত্তরণ।যশোধরার Clarity of perspective অতি তীক্ষ্ণ। সবমিলিয়ে উপন্যাস টি মনোভংগি ভাষা ও কাহিনী সর্ব অর্থে আধুনিক। একে বারে রিয়েল টাইমে দাঁড়িয়ে লেখা। দেশ কাল সময় ও ব্যক্তি সত্ত্বার বিশাল ব্যাপ্তিকে বিন্দুতে এনে কিভাবে প্রতিবাদের ভাষা নির্মান করেছেন যশোধরা। নির্য্যাস হয়ে মনে রয়ে যায়, পুরুষকে বিযুক্ত করার অভিপ্রায় নয়, তার সংগে আবার প্রথম থেকে পড়া জীবনের পাঠ।" ( অনিতা অগ্নিহোত্রী) "লেখক যশোধরা রায়চৌধুরী, তাঁর চাকুরি প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের, তাঁর গল্পের ভুবন প্রচলিত ভাবনাচিন্তার একেবারেই বাইরে। তিনি তাঁর লেখায় অণুবীক্ষণ দিয়ে মানুষের জীবনযাপনকে দেখতে চান, তাঁর গল্পে সেন্টিমেন্ট কম, বাস্তবতা বেশি। যেমন তাঁর গল্পে এক চাকুরে তরুণী মেল ট্রেনের নাইটজার্নি করে উপরের সিটের কাউকে অনুরোধ করে বার্থ বদলাবদলি করে পট করে উঠে যায় ও ঘুমিয়ে পড়ে। ...তাঁর শেষ উপন্যাস স্রোত -এ নারীস্বাধীনতার চূড়ান্ত ছবি। প্রতিটি নারীচরিত্র স্রোতের বাইরে গিয়ে কথা বলে। পুরনো ধ্যানধারণা ভেঙেচুরে ফেলতে চায়। সাম্প্রতিক কালে কলকাতার কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা প্রতিবাদ করেছিল তাদের অন্তর্বাসের ওপর প্রতিবাদের কথাগুলো লিখে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একের পর এক টাঙিয়ে দিয়ে। স্রোত এমন আধুনিক সব বিষয়ে আলোকপাত করেছে যা কিছুকাল আগেও কল্পনা করা যেত না। এ যুগের নারীসত্তার এক অনন্য প্রতিফলন। " ( তপন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর "ইদানীঙ কার বাংলা গল্প উপন্যাসে লেখিকাদের নারীসত্তার উপস্থিতি" প্রবন্ধ থেকে, প্রকাশিত আরাত্রিক পত্রিকা ২০২১)। তৃতীয় পর্ব।
৩
প্রিয়নাথের ব্যাকরণ
এ পাড়ায় একজ্যাক্টলি সকাল সাতটার সময় একটা গরম তাজা হাওয়ার ঢেউ খেলে যায়।
পুরনো বাংলা গানের গমকী প্যাঁচপয়জার ও শোনা যায়। আর হুলুস্থুল কথা।
প্রিয়নাথবাবু। বেঁটে, চৌকো। মশলাঠাশা তুবড়ির মত। হাফ হাতা শার্ট। ওপরে
হাতকাটা সোয়েটার। ধূসর প্যান্ট, একটু ঝুলে ছোট। পায়ে রাবারের স্যান্ডাল।
একটা হালকা সবুজ স্কুটার, আদ্যিকালের, সেইটে চেপে আসেন। মাথার চুল ছোট
করে ছাঁটা। দেখলেই সত্যিই মনে হয় খেলার মাঠে পিঁ পিঁ করে হুইসেল বাজিয়ে
ছেলেদের ডনবৈঠক করাচ্ছেন, অথবা ফুটবল খেলাচ্ছেন। বাস্তবে কর্মজীবনে ঐ ঐ
গুলোই করতেন তিনি। এখন অবসৃত। ছোটখাট, সলিড চেহারা। শরীরচর্চা করে করে
ওয়েল বিল্ট। বেশ গাট্টাগোঁট্টা যাকে বলে।
ফ্ল্যাটে আট ঘর। সবাই মাঝারি , বয়স্ক। ওঠার আগেই চত্বরে দেখা হল একজনের
সঙ্গে। দোতলার তিন নম্বরের শ্যামলবাবু। কানে মাঙ্কিক্যাপ। বয়সের আগেই
বুড়িয়ে গেছে।
-কী খবর? কেমন আছেন প্রিয়নাথদা?
ফার্স্ট ক্লাস ভায়া , ফার্স্ট ক্লাস, তোমরা সব কেমন?
হেঁ হেঁ, ঠিক…
কোথায় চললে, মর্নিং ওয়াক? করো , করো , ঐটির মত ওষুধ আর নেই।
হেঁ, আজ্ঞে, আমার আবার বাতের ব্যথাটা…
আরে আমার বয়স তিয়াত্তর আর তোমার তো পঁয়ষট্টিও হয়নি হে। কোথায় বাত, দাঁড়াও
ধরছি তোমাকে এবার… বাত বাছাধন পালাতে পথ পাবে না… একেবারে এমন মালিশ
দিয়ে দেব না।
শ্যামল মর্নিং ওয়াকের স্পিড বাড়ালেন। কথা না বাড়ানোর একটাই পন্থা। বাঁই
করে ঘুরে, ওর দিকে দৃকপাত না করে, মায়ামোহহীন প্রিয়নাথ গলা ছেড়ে গান
ধরলেন।
শ্যামা মা কি আমার কালো রে! …
গিটকিরি, গমকে মোটা ভারি গলাটা গানের তান ফেঁদে উঠতেই, পাড়ার ঘুমভাব
উধাও। বাড়িতে লোকজনের কান খাড়া। কোন ফ্ল্যাটে এলেন উনি? বেশ মানুষটি।
তিনতলার ছ নম্বরের তন্বী ধবধবে ফর্সা নাতনিটি লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে
নামছে। স্কুলবাস ধরবে।
ও মা! আজ আমার কী সৌভাগ্য, একেবারে মিঠি দিদিমণির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
ওয়াহ ওয়াহ, খুব সুন্দর লম্বা হচ্ছ দিদি।
মাথায় গায়ে পিঠে সুগোল নিটোল বেঁটেখাটো পুরুষ্টু হাতটি একবার বুলিয়ে
নিলেন। মেয়েটা তিড়িক করে টিকটিকির মত পিছলে নেমে গেল। উনি উঠতে থাকলেন।
নামেই ফিজিওথেরাপিস্ট। আসলে সাইকোথেরাপিও করেন। আসতে যেতে গান করেন গলা
খুলে। পুরনো বাংলা গানের দারুণ কালেকশন। আর, কথার মার প্যাঁচে মন খারাপকে
হাওয়া করে দিতে পারেন। দারুণ জমাতে পারেন আড্ডা। লোককে কুশল জিগ্যেস করার
আর্ট জানেন।
দোতলার চার নম্বরের বাসুবাবু নামছেন বাজারের থলি হাতে। সত্তরের ওপর বয়স।
দরকার না থাকলেও ডাক্তার বলেছেন, রোজ একবার করে বাজার যাওয়ার নাম করে
বেরোবেন। নইলে কলকব্জাগুলো জং ধরে যাবে যে। … কথা শোনেন ডাক্তারের,
নামেন।
মুখোমুখি হলেন প্রিয়নাথের।
কী, সব ভাল তো? প্রিয়নাথ এক গাল হেসে বল্লেন।
চলছে। এই আর কী। আপনি?
বাসুবাবু করুণ একটা ভঙ্গি করলেন। ভাল আছি বললেন না। চলছে বললেন।
বুদ্ধিমানের মত। এ দেশের বুদ্ধিমানরা ‘ভাল আছি’ বলতে ভুলে গেছেন বহুদিন।
উল্টোদিকে প্রিয়নাথ উৎসাহে টগবগ করে বললেন, আমার তো সবসময়েই দা-রুণ,
দাদা…
হুম, এখন কোথায় চললেন, বোসদার বাড়ি?
হ্যাঁ, বোসদার শরীর তো খুব খারাপ।
তাই বুঝি? আবার কি কিছু হয়েছে? সেই স্ট্রোকের পর থেকেই অবশ্য ভাল নেই।
ভাবছি একদিন দেখে আসব গিয়ে…
হ্যাঁ দেখলে চোখে বিশ্বাস করা যায়না এমন হাল হয়েছে আমাদের জাঁদরেল
হেডস্যারের। বৌদির জন্য দুঃখ হয় খুব। রাতের ঘুম উড়ে গেছে…
ইয়ে, বাজারে যাই, বেলা ছোট…আবার অফিস আছে…
যান গিয়ে , এগোন। আমি নরেনদার বাড়িটা একবার ঢুঁ মেরে যাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ…কেমন কুয়াশা করেছে দেখুন।
হবে না, আজ যা ঠান্ডাটা পড়েচে। আজ তো নলেন গুড় খাওয়ার দিন বাসুদা।
বাসুবাবুর মন ভাল হল।
রোজই প্রিয়নাথের উপস্থিতি শ্যামলবাবু, বাসুবাবু, বোসবাবু, নরেনবাবুদের
ফ্ল্যাটবাড়িটার ঠান্ডা মিইয়ে থাকা অবস্থাটা পালটে দেয়। সকাল সকাল জমজমাট
একটা গলার উত্তাপ পাড়ার নিস্তব্ধতাকে খান খান করে। গরম চায়ের গন্ধের মত
চাঙ্গা করে তোলে ম্রিয়মান সিনিয়র সিটিজেনদের।
মন ভাল হল সনাতন প্রধানের। সাত নম্বর ফ্ল্যাটের সিনিয়র সিটিজেন। প্রাংশু
হাজরা আট নম্বরের। সনাতন বেরিয়ে বারান্দার গ্রিলে জং লেগেছে কিনা
পর্যবেক্ষণ করছিলেন। উনিও খুশি খুশি মুখে ঘরে ঢোকেন। গিন্নিকে শুধোন,
প্রিয়নাথবাবুর আজ আসার দিন নাকি?
প্রাংশু হাজরার ছোট ছেলে ছেলের বউ নাতি অবশ্য ওঁদের সঙ্গেই থাকে। সেদিন
প্রাংশু রসিয়ে গিন্নিকে বলেছিলেন। আমাকে আগে খোঁটা দিতে তো, দুই ছেলেকে
ইঞ্জিনিয়ার করিনি কেন ? বাসুবাবুর ছেলে অ্যামেরিকা চলে গেল। বোসদার দুই
মেয়ে ক্যানাডা আর ব্যাঙ্গালোরে সেটল্ড। বোঝ এবার। বুড়ো হয়ে কী দুর্দশা।
প্রাংশুর ছেলে , ছোট ছেলে, সোমদত্তর বউ স্বস্তিকাটা বেশ। এমনিতে
মোটাসোটা, চাপা গায়ের রং হয়ে কী হবে। মুখে বেশ লাবণ্য । পড়াশুনো করেছে,
ভাল চাকরিও পেয়েছে সরকারি।
রোজ যখন আসেন প্রিয়নাথ, ডাইনিং কাম ড্রইং রুমেই বসেন। প্রাংশুবাবুকে
মালিশ করতে শুধু নয়, প্রাংশুবাবুর স্ত্রী, যাকে বউদি বলে ডাকেন
প্রিয়নাথ, তাঁরও হাত পায়ের কিছুটা দলাইমলাই, খানিক ব্যায়ামের ব্যবস্থা
করাতে হয়। তখন মুখ চলে। গান গাইতে গাইতে কথা। কথা বলতে বলতে গান। বেশ
মজার ব্যাপার। সিনে ঢুকে আসে সোমদত্ত। স্বস্তিকা ছেলের ব্রেকফাস্ট বানায়,
টিফিন বানায়।
স্বস্তিকা প্রিয়নাথকে চা করে দেয়। আগে গল্প করত, এখন একটু এড়িয়ে যায়।
অতটা উষ্ণতা নেই। পুরনো হয়ে গেছেন প্রিয়নাথ। বোঝেন।
তবে তাও। প্রিয়নাথ দুর্দমনীয়। কথা বলতে থাকেন। গান গাইতে থাকেন। নিজের
চোখের কোণ দিয়ে প্রিয়নাথ দেখতেও থাকেন। স্বস্তিকার ছেলেকে দুদ্দাড় বেগে
ইস্কুলের জন্য তৈরি করা, দিয়ে আসা ইস্কুলে। সব কিছুর মধ্যে চোরাটানের মত
স্বস্তিকার আঁটোসাঁটো শরীরটা উঠছে পড়ছে নিচু হচ্ছে লাফিয়ে উঠছে, দৌড়ে
যাচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে নামছে।
আজকালকার মেয়েগুলোকে সত্যি, দেখলেও মনে আনন্দ। শাড়ির বালাই নেই। আঁট
সালোয়ার কামিজ পরে সর্বক্ষণ আছে। বুকে ওড়নাও থাকে না সবসময়। সমস্ত শরীর
থেকে ফুটে বেরোচ্ছে কনফিডেন্স।
এক এক বাড়ির বসবার ঘরে এক এক রকমের বিষয় ওঠে আড্ডায়। প্রাংশুবাবুর
বাড়িতে, লক্ষ্য করেছেন প্রিয়নাথ , এই সময়ে সোমদত্ত বসে কাগজ পড়ে। অন্তত
চার পাঁচটা কাগজ রাখে এরা। এই কাগজ ছড়াছড়ি করা টেবিলে , একটা কুড়িয়ে
নেওয়া কাগজ নিয়ে প্রিয়নাথ একটা হেডলাইন পড়েন, তোলেন একটা প্রশ্ন। কী
দাঁড়াল ব্যাপারটা, তাহলে , দাদা?
হাসি হাসি মুখে বলেন প্রিয়নাথ।
এই যে, কাগজে লিখল, নতুন সরকার সবার গ্যাসের কানেকশনগুলো ব্যাঙ্কের সঙ্গে
লিংক করে দেবে, কী দারুণ ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন? সবার সব কিছু ওদের
হাতের মুঠোয় নিয়ে নেবে।
আরে না না , সাবসিডির জন্য করছে তো। গলা খাদে নামিয়ে বলল সোমদত্ত। বাংলা
কাগজ স্ক্যানিং সেরে তখন সে ইংরিজির মধ্যে ঢুকেছে।
না সেটা তো জানি, আমি তো নিজেই পেয়ে গেছি সাবসিডি। আপনারা পেয়েছেন?
বৌদি বাতের ব্যথায় কাতর। স্বামী প্রাংশুর সুগার আর হার্টের ওপরে ওঠাতে
পারেন না নিজের চিন্তাকে। চুপ করে থাকেন। ঘোলাটে চোখে।
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের খাতাটা ভাল করে দেখবেন বৌদি।
প্রসঙ্গ পালটান প্রিয়নাথ।
যাদবপুরের ব্যাপারটা দেখেছ তো সোমদত্ত? ছ্যা ছ্যা ছ্যা।
প্রিয়নাথ মাথা দুলিয়ে হাসেন। চোখের কোণদুটো ঝিকিয়ে ওঠে বাচ্চা দুষ্টু ছেলেদের মত।
কোন ব্যাপারটা?
সোমদত্ত খুব নিরুত্তাপ গলায় বলে।
ওই যে, হোক…
হোক ঝঞ্ঝা তো? হ্যাঁ খুব ক্লোজলি ফলো করছি আমি ওটা।
আরে ওটা তো শুরু। কীভাবে পথভ্রষ্ট করা হল দেখলে তারপর ছেলেমেয়েগুলোকে?
বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে তো সব। ওদের বুদ্ধি আর কতটুকু। দিদিমণির বিরোধিতা
ওরা করতে পারে, কিন্তু এটা কি! প্রকাশ্য দিবালোকে চুম্বন!
চুম্বন শব্দটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, লজ্জা পেলেন না প্রিয়নাথ। কেননা তিনি
সত্তরোর্ধ। তাঁর লাইসেন্স আছে।
বলে, নিজস্ব বক্তব্যের রসে বশে বিগলিত হয়ে, মুখ টেপা হাসিতে গোল মুখ
টুলটুলে করে, একবার রান্নাঘরের দিকটায় চোখ বুলিয়ে আনেন ।
এক দু মুহূর্ত পরেই, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে, স্বস্তিকা ঠকাস করে চায়ের কাপ
নামিয়ে রাখে দুটো বিস্কুট সহ। টেবিলের কাগজগুলো একটু সরিয়ে।
পাশে, রুটি ডিম, সোমদত্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নাও, নাও, আমার তাড়া আছে।
এই যে এসে গেছেন স্বস্তিকা মা আমার। শ্যামা মা কী আমার কালো রে!
গমগমে গলায় গেয়ে ওঠেন প্রিয়নাথ। স্বস্তিকার সঙ্গে চোখে চোখে চারিচক্ষের
মিলন হয়না। বরং, ওর চেষ্টা করেই, ওঁর চোখ এড়িয়ে যাওয়াটা প্রিয়নাথকে
সুড়সুড়ি দেয় আরো। “আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ” মাথা দুলিয়ে গাইছেন এখন
প্রিয়নাথ।
হঠাৎ ভেতরের বেডরুমটা থেকে বেরিয়ে আসে ঢ্যাঙা অর্চি। ঝলঝলে বার্মুডা,
হাতকাটা গেঞ্জি। এই মিঠেকড়া শীতে, যখন সবাই একটা আধটা করে সোয়েটার
চাপাচ্ছে গায়ে, তখন ছেলেটা এই পরে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ঘুম থেকে
উঠল। অলস মন্থর হেঁটে ফ্রিজ খুলে একটা বোতল বার করে ঢকঢক করে কোকাকোলা
গলায় ঢালল।
অর্চি প্রাংশু হাজরার বড় ছেলের একমাত্র সন্তান।
স্বস্তিকা দাঁড়িয়ে গেল। কী রে অর্চি, তোর এখন কোক খাওয়ার সময়?
অর্চি কাকিমাকে পাত্তা দিল না। উলটে কটমট করে একবার প্রিয়নাথের দিকে তাকাল।
প্রিয়নাথ গদগদ স্বরে বলল, এই তো, এসে গেছে। আহা , ওর ভারি গরম লেগেছে। যা
গরম পড়েছে , হ্যা হ্যা হ্যা।
অর্চি প্রিয়নাথের কথা শুনে হাসা দূরস্থান , একটা অসম্ভব তাচ্ছিল্যের লুক
দিল। এই বুডঢাটা কে? এমন একটা মুখ।
আমারো গরম লাগছে, সোয়েটারটা খুলেই ফেলি । বেলা বাড়লে আর গায়ে রাখা যায় না।
অর্চির তাচ্ছিল্য পেয়ে নড়ে চড়ে বসেন। কটা বাজে? ও বাবা, এতটা বেজে গেছে।
যাই। আবার বাজার যেতে হয় ।
অর্চি রান্নাঘরে একবার ঢুকে, ব্রেকফাস্টে কী রান্না হয়েছে দেখে নিয়ে
বেরিয়ে, আবার বেডরুমের দিকে পা বাড়াল। অপাঙ্গে প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে
বলে গেল, হোক চুম্বনের ব্যাপারটা আপনার মাথার ওপর দিয়ে যাবে তো, ওটা
বোঝার চেষ্টা করবেন না দাদু। আমাদের জিনিশ আমাদের বুঝতে দিন।
প্রিয়নাথ নিজের যাবতীয় বক্তব্য গপ করে গিলে নিলেন। একটু পরেই দেখা যাবে,
উনি ছোট্ট হালকা সবুজ স্কুটারটায় স্টার্ট দিচ্ছেন।