সেপিয়া রঙের গলি – ষষ্ঠ পর্ব <br />  অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সেপিয়া রঙের গলি – ষষ্ঠ পর্ব
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

চাঁদের কণার খোঁজে…

আমাদের শহরে শীত আসেনি বহুকাল। শিয়ালদা স্টেশনে, এম.জি রোডের ভাতের হোটেলে, ফুটপাতের আয়নাবাড়ি সেলুনে, একাত্তর নম্বর বাসে শীত এসেছিল কত যুগ আগে! হাঁসফাঁস মানুষের ঘাম-খিদে-উল্লাসের ভিড়ে ডিসেম্বর পড়ে এল, সাধু যোহনের গির্জায় শীত পড়ল না তবু।

আমাদের মুখে ভোরের মফসসলি কুয়াশা কেটে গেছে অনেকক্ষণ। আমরা একটি বন্ধ দরজার এপারে এসে দাঁড়িয়েছি, চাঁদের কণা দেখব বলে।

দুই ধারে সারি বাঁধা পাথরের ঘর। উৎসুক মুখের ভিড়ে ঠান্ডা, উঁচু ঘরে বেলা বাড়লেও টের পাওয়া যায় না। শেষপ্রান্তে বন্ধ দরজার গায়ে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে ছিলেন এক মধ্যবয়স্ক। পাথরের ঘরে বসে বসে ঈষৎ ঢুলছিলেন। ঝড়ের মতো প্রশ্ন করলাম, ‘মুনস্টোন-টা কোথায় বলতে পারবেন প্লিজ?’

ভদ্রলোক প্রশ্ন ও কৌতূহল মেখে তাকিয়ে রইলেন। ফের ব্যাখ্যাসমেত আমার প্রশ্ন তাঁর ঘুম ভাঙা চেহারায় আছড়ে পড়ল প্রায়, ‘চাঁদের পাথরটা স্যর? ভারতকে যে উপহার… নাইন্টিন সিক্সটি নাইন!’

তাঁর চেয়ার টেবিলের পিছনে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত বিস্তৃত সাহেবি আমলের বন্ধ দরজায় দিক নির্দেশ করে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, ‘এই ঘরে আছে বোধহয়!’

‘কিন্তু এটা তো বন্ধ!’

‘এখন বন্ধই থাকে!’

আমাদের খটখটে চোখ থেকে বিস্ময়ের পাথরকুচি তবু যায় না, ‘এই বন্ধ ঘরে চাঁদের পাথর আছে?’

ভদ্রলোক অবলীলায় ওপর নীচে মাথা নাড়লেন!

এইমাত্র শহরতলির স্কুলের শিশুরা সারি বেঁধে ঢুকে এল বাড়িটায়। ফুটপাতের রাস্তার খাবারের দোকানী ভিড় সামলে জামার হাতায় মুখ মুছে মনে মনে অভিশপ্ত গরম ডিসেম্বরকে দুষল। ফোমের টিয়া বিক্রি করতে গিয়ে থুতু ফেলে জীবনকে গালাগালি দিল লিন্ডসে স্ট্রিটের লোকটা। বিদেশী খদ্দেরকে কুড়ি টাকার রুমাল একশকুড়িতে বেচে ‘মার দিয়া কেল্লা’ ভাবল মাথায় রুমাল বাঁধা রোগা ছেলেটা। ময়দানে লাল চা নিয়ে বসে শুকনো ঘাসের দিকে অর্থহীন তাকিয়ে রইল কেউ। আরও দূরে গঙ্গায় হয়ত জেটি ও জলের ফাঁক বাঁচিয়ে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চে উঠে পড়ে নিজেকে বাহাদুরি দিল সদ্য ইন্টারভিউতে সুবিধে করতে না পারা মানুষ। সমগ্র তিলোত্তমা রোদে, গরমে ছুটছে। শুধু খিদে পেটে আকাশ দেখা দুটো প্রাণ বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারা ভাবছে, ভিতরে চাঁদের কণা আছে!

এ আমাদের বিস্ময়বাড়ি। রোদের তেজ সামলাতে না পেরে দুটো টিকিট কিনে ভিতরে ঢুকে আসি। বিস্মিত হতে বেঁচে থাকা দু’টি প্রাণ এই প্রাসাদের আনাচেকানাচে বিস্মিত হতে আসে।

শ্রীরামপুরের যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলেন ডাচ উদ্ভিদবিদ নাথানিয়েল ওয়ালিচ। মুক্ত হয়ে ১৮১৪-র ২ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি কাউন্সিলে তাঁর সংগ্রহের কথা জানিয়ে একটি জাদুঘর গঠনের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লেখেন ওয়ালিচ। ১৭৮৪ সালে স্যর উইলিয়াম জোন্সের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। এই সোসাইটির সদস্যগণ ১৭৯৬ সালে একটি জাদুঘর গঠনের প্রস্তাব দিলেও ১৮০৮ সালে ভারত সরকারের তরফ থেকে কলকাতার চৌরঙ্গী এলাকায় জাদুঘরের জন্য জমি প্রদান করা হয়।

ওয়ালিচের চিঠির অব্যবহিত পরেই ওরিয়েন্টাল মিউজিয়াম অফ এশিয়াটিক সোসাইটি গঠিত হয় এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহ প্রদানের পাশাপাশি নাথানিয়েল ওয়ালিচ প্রথম সাম্মানিক কিউরেটর ও পরবর্তীকালে সুপারিন্টেনডেন্টের পদ অধিগ্রহণ করেন। শুরুর দিনগুলিতে আজকের ভারতীয় জাদুঘর প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রযুক্তিগত, ভূতাত্ত্বিক এবং প্রাণীবিদ্যা- পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত ছিল।

মাসিক পঞ্চাশটাকা বেতন থেকে শুরু করে কিউরেটরের বেতন মাসিক দু’শো টাকা হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩৬-এ মূল পামার অ্যান্ড কোম্পানির ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত হলে কিউরেটরদের বেতনের ভার নেয় সরকার।

১৮৬৬-তে প্রথম ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম আইন পাশ হয়। আজকের চৌরঙ্গীর ভারতীয় জাদুঘরের প্রাসাদটি নির্মাণ শুরু হয় ১৮৬৭ সালে। স্যর থমাস হল্যান্ড ও ডব্লিউ.এল গ্রেনভিলের তত্ত্বাবধানে ১৮৭৫ সালে এই নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। তদানীন্তনকালীন এশিয়াটিক সোসাইটি, ওরিয়েন্টাল মিউজিয়াম অফ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কার্যালয় উঠে আসে এই প্রাসাদে।

যা আমাদের হাতে আসেনি, তা নিয়ে আমাদের বিস্ময় চিরকালের। ফলে চাঁদের কণার ঘোর কাটল না, আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম সাঁওতাল রমণীর ছবির পাশে। ছবির পর ছবি, তবু চোখ আটকায় এখানে। এতক্ষণ যে উপগ্রহের কথা ভেবে মন সরিয়েছি, মন ফিরে আসে হলুদ সবুজ ক্যানভাসে। ঘন বনের ধারে কালো মেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছে, তার সাদা খোলের শাড়ি যেন আস্ত মহানগর। কলকাতা আমাদের আর কত অবাক করবে?

আমাদের অবিশ্বাসী প্রাণ বারবার ঘুরে যায় কাচের দেয়ালের এপারে। চেয়ারে বসে থাকা মানুষটিকে বারংবার ব্যতিব্যস্ত করে নানান প্রশ্ন করে। আমাদের চোখে ছোট্ট একটি কৌটো। কাচের বদ্ধতায় সুরক্ষিত, যেন একফালি পাউডার কৌটো, তার ভিতরে হাড়ের অবশেষ। ভগবান বুদ্ধের হাড়ের অবশেষ! সঙ্গে রয়েছে একটি কারুকার্যখচিত স্ফটিক আধার। সেখানে সংরক্ষিত ছিল ভগবান বুদ্ধের দাঁত!

ঘরখানা ছোট্ট ও চৌকো। চারিধারে ঘিরে রয়েছে প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের নিদর্শন। আধুনিক কাচের ওপারে রাখা। ভিড় বাড়ছে ঘরটায়। কেন্দ্রে একটা ছোট্ট মন্দির। সেখানে দুটো হাড়ের টুকরো। চেয়ে রইলে আজকের পৃথিবী আবছা হয়। সংশয় যে আসে না, তা নয়। তবু শিরায় রক্ত চলাচল বাড়ে। আমাদের বেঁধে দেওয়া সময় ফুরিয়ে আসে।

দু’ধারে সিঁড়ি, ভরা দুপুর বাড়িটাকে রোদ-ছায়ায় ভাগ করেছে। আমরা মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মিশরীয় সভ্যতার আলাদা ঘর, তার পাশে মমির ঘর। মনে পড়ে, তখন শীত পড়ত শহরে। মনে পড়ে বাবার ছাইরঙের উইন্ডচিটার। সেই ছাইরঙের উইন্ডচিটারের সঙ্গে হঠাৎ আমার সখ্য বেড়ে গিয়েছিল। ভিড় উপেক্ষা করে যতই কাচের বাক্সের দিকে ঝুঁকিয়ে দিচ্ছিল বাবা, ততই ভয়ে বাবার শীত আটকানোর জ্যাকেটে মুখ গুঁজে দিচ্ছিলাম। বাবা শেষে হাল ছেড়ে দিল। জাদুঘরের দোতলার বারান্দায় আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ভীতু একটা! ভয়ের কী ছিল! ওটা তো মমি। কত হাজার বছর পুরনো মানুষ দেখলি জানিস!’

যে সকল রিহার্সালে আমাকে বাদ দেওয়া হত, সেখানে আমি গাছ অথবা মমি সাজতাম বেশ। হাত দুটো বুকের কাছে রেখে শুয়ে ভাবতাম শীতের সকাল। ভিড়ের ঘরে সবুজ টিমটিমে আলো জ্বলছে। আর বারান্দায় বেরিয়ে এসে বাবা পৃথিবীতে মাত্র বছর চারেক পুরনো আমাকে ভীতু বলছে!

ছাইরঙের উইন্ডচিটারটা কবেই হারিয়ে গেছে। ধূসর রঙের সারকোফেগাসে আজও ঘুমিয়ে হাজার বছর পুরনো মানুষ। আমার ভয় পাওয়ার বয়স উবে গেছে। বাবাকে ছাড়া কতবার চলে আসি এই বাড়িতে। আমার সঙ্গী পাল্টে গেছে।

সদর স্ট্রিটের দিকের বাড়িটা তৈরি হয় ১৮৯১-এ। সদর স্ট্রিটের ডান কোণের অংশ তৈরি শেষ ১৮৯৪-এ। প্রাসাদের টান, প্রাচীন দুনিয়ার টান, পালি- প্রাকৃত- ব্রাহ্মী লিপির টান… কীসের টানে যে আসি, ইতিউতি ঘুরি… আমরা বুঝি না।

মনে পড়ে, একশ বছর পুরনো একটি গোলাপি বালুচরির প্রতি টানেও কত শীতে ঘুরে গেছি হঠাৎ। স্বচ্ছ দেয়ালের এপারে দাঁড়িয়ে ভেবেছি, কার অঙ্গে উঠত সেই শাড়ি। ইতিহাস না জানা কত সাধারণ মানুষ শুধু এটুকু ভাবতেই আসেন প্রতি শীতে। ফেঁসে যাওয়া বেগুনি ঢাকাই, গোলাপি বালুচরি, বা কালো জরিদার জীর্ণ শাড়িখানার মালকিন একদা ছিল পৃথিবীতে। না থাকার আখ্যান এই প্রাসাদ জুড়ে। পৃথিবীর প্রতিটি জাদুঘর আমাদের অর্থ ও অর্থহীনতা বোঝাতে গঠিত হয়।

বিকেল নামে। আমরা পাথর হওয়া গাছ পেরিয়ে ফের বন্ধ দরজাটার কাছে দাঁড়ালাম। সামনের চেয়ার-টেবিল ফাঁকা। ভিতরে চাঁদের কণা রয়েছে, আমাদের বিশ্বাস দিয়ে ভদ্রলোক কোথায় গেলেন কে জানে! আমরা তখনও ভরসা রাখছি, ১৯৬৯ সালে ইউএসএ-র তরফ থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি গিরিকে যে চাঁদের পাথরের টুকরো উপহার পাঠানো হয়, সেটা রাষ্ট্রপতি ভবনের মিউজিয়ামে নয়, বরং রয়েছে ঐ সাহেবি আমলের বন্ধ দরজাটার ভিতরে! আমাদের এমন বিশ্বাস জুগিয়ে এক ডিউটি দেওয়া মানুষ হারিয়ে গেছেন। বাইরে একটা ধুলোময় ঘিঞ্জি কলকাতায় দিন ফুরচ্ছে। শীতবিহীন ডিসেম্বরে মানুষ অসহায়বোধ করছে। শহরতলির স্কুলের সারিবাঁধা শিশুমুখ এককালের সেই চারবছরের শিশুকন্যাটির মতো অবাক পৃথিবী নিয়ে সারি বেঁধেই ফিরে যাচ্ছে। অর্থহীন আসা, অর্থহীন যাওয়ার মাঝখানে আমরা দেখি শহরের সকল মুখ মনে মনে ভুল স্থানে চাঁদের কণা খুঁজছে। কেউ তাঁদের বিশ্বাস জুগিয়ে গেছেন, বন্ধ দরজার ওপারে চাঁদের কণা রয়েছে। ভুল স্থানে খুঁজতে এসেছি বলেই আমাদের ভ্রমণ আশ্চর্য হয়ে উঠছে।

ক্রমশ…

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
404 Not Found

Not Found

The requested URL was not found on this server.


Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80