
সীমিতা মুখোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ
চিত্রাবলী ১
বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গান গায় হাওয়া,
যেন সে কিশোর রাখাল— বরফের পাতার মতো ভঙ্গুর।
একাদশীর নির্জলা থান মেঘ হয়ে উড়ে যায় আকাশে।
উঠোনে ডুব সাঁতার দিয়ে বেড়ায় একটি ছুঁচো।
অঙ্কুরিত যৌবন লিখে চলে দীর্ঘশ্বাস, সামনে জন্মান্ধ দেয়াল।
মাতব্বর বাঁশ গাছ মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন বলে—
তার তৈলঘাম স্পর্শ করে কাকচক্ষু দিঘিতে লাফ দেয় রোদ,
সমান্তরাল শিরাবিন্যাস বেয়ে নামে পাখপাখালির কলতান।
রুক্ষ সরীসৃপ বুকের ওপর উঠে আসে দুপুরের ঘুমে।
পরীক্ষা-ফেরত রমণীবেলা জল ঝরিয়ে শুকোতে থাকে
হেমন্ত-সূর্যের ক্ষীণ হয়ে আসা তেজে।
চিত্রাবলী ২
রোদ্দুর শুয়ে আছে আমাদের বারান্দায়,
পাশে তার জ্যান্ত টেডি— পোষা বিড়ালটি,
গায়ে গ্রিলের নকশাকাটা চাদর।
আমি হাত পেতে ছায়া ধরছি,
রোদের গায়ে জেগে উঠছে কালো রঙের স্পর্শ।
তুমি কি টের পাচ্ছ এই ছোঁয়া?
জানলা ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে বিকেলের আলো।
দুপুরের আলুথালু ঘুমের পর
বিছানা তখন টেনে নিচ্ছে পোশাক।
পর্দা সরাতেই মাতাল কিরণ
জোয়ান মরদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল শয্যায়—
সচকিত আয়না এসব দেখে হাসতে লাগল বিদ্যুৎরেখায়।
তড়িৎ বিদ্যা ১
ধাতব হাতলে নভেম্বরের স্থির তড়িৎ
অপেক্ষায় থাকে, কখন তাকে ছুঁয়ে তুমি
সরিয়ে নেবে হাত—
এ-পোড়া চোখ সেসব দেখতে পাবে ঠিকই।
যেমন দেখতে পাই― নির্লিপ্ত চাদরে অস্পষ্ট মুখ,
বাঁকা আলো আর ত্রিকোণ বিড়াল!
তোমার হাতের পাশে হাতের দূরত্ব মাপতে মাপতে
কেঁচোর খণ্ড ত হয়ে ভেঙে ভেঙে যাই,
ইউটার্ন নিয়ে চাঁদ ধেয়ে যায় অমাবস্যার দিকে
আর প্রকৃত পাপের মতো আমার লেখা এসে যায়।
তড়িৎ বিদ্যা ২
ধূসর এক পূর্ণিমা মেরি বিস্কুটের মতো চাঁদ
ঝুলিয়ে রাখে কোলকাতার আকাশে,
মাথার ভিতরে সুগন্ধি সাপ, সহজপাঠে ডার্ক-ফ্যান্টাসি,
থার্ড লাইন স্পর্শ করে এগিয়ে যায় শয়তানের মেট্রো―
আমিও ফুটিফাটা হই …
প্রেতযোনি চেটে খায় আমার শরীরের নুন।
পড়ে থাকে এক বিদ্যুৎস্পৃষ্ট নারীদেহ―
তার দুই বৃন্তে তখনো জ্বলছে জোনাকিপুরুষ!
মৃত্যুকে অনেকটা নেশার মতো মনে হয়।
পাশের ঘরের মানুষটাকে না ডেকে চুপচাপ
চলে যাওয়ার মধ্যে হয়তো একটা আভিজাত্য আছে …
মাধবীলতার বাড়ি
শিমুলিয়া-বিকেল মাথায় নিয়ে
তুমি ঢুকে গেলে মাধবীলতার বাড়ি।
বন্ধ জানালার কাচে তখন জ্বলন্ত সূর্য।
আমার বিমূঢ়তা নিমগাছ হয়ে ডালপালা বাড়িয়ে দিয়েছে,
আঁকড়ে ধরছে দোতলার বারান্দা,
উৎকন্ঠায় টুকরো হয়ে খসে পড়ছি রঙ্গনের ফুলে।
শিকারী পাখির মতো ঝুপ করে নামল আঁধার,
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে, নিভন্ত ল্যাম্পপোস্ট চোখ মেলল।
ভিতরঘর থেকে শলাকার মতো ধেয়ে আসছে হাসি—
আর কতক্ষণ?
আমার পাশ থেকে সরে যাওয়া তোমাকে
নির্দ্বিধায় মুছে দিতে থাকি ছবিতে ছবিতে।
অভিমানী উচ্চারণের আড়ালে চাপা স্নিগ্ধতা নজর এড়ায় না।