মহিলা কামরা <br /> রূপশ্রী ঘোষ

মহিলা কামরা 
রূপশ্রী ঘোষ

 

 

ঠান্ডা পড়েছে। রঙবেরঙের শাল সোয়েটারে মোড়া মহিলা কামরা। উলের লম্বা কুর্তিও দেখা যাচ্ছে দু একটা। এই তো আজ বাদে কাল স্কুল কলেজ হয়ে এক সপ্তাহের জন্যে নিশ্চিন্ত। ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গল্পরা ছুটে চলেছে নৈনিতাল থেকে গ্যাংটক। মাইনাস সতেরো ডিগ্রি থেকে মাইনাস দশ। গল্পরাও পায় উষ্ণতা। যেমন মোয়ারা পাচ্ছে আদিখ্যেতা। বন্ধ জানলার কাঁচ। তাই ভানুদাকে অনেক ডেকেও সিটি গোল্ডের গয়নার গ্যারান্টি পিরিয়ডটা লিখিয়ে নেওয়া গেল না।

হতাশ গলা — “উফ! আবার সেই কতদিন পরে আসা, মনে থাকবে তো ভানুদার!”

 

এর মধ্যেই একটা বড় সমস্যা! না সমস্যা ঠিক নয়, কারণ ওরাই সমস্যা দূর করে। বলা ভালো একটা সম্পর্কের টানাপোড়েন। দু-তরফের। শহরে। এখন গ্রামেও। আগেও ছিল, এখনো আছে, হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে।

 

এক দিদিমণি তাঁর সমস্যার কথা শুরু করলেন। বাড়িতে  ছোটো বাচ্চা আছে। মূলত তাকে দেখার জন্যেই সবসময়ের জন্যে একজন লোক রেখেছেন। বাড়িতে দিদিমণির মা থাকেন, তিনিই প্রায় সবকিছু করেন। সুবিধার জন্যে একজন লোক রাখা হয়েছে।

 

দিদিমণি বেশ শান্ত গলায় সমস্যাগুলো বলতে থাকলেন। অন্য এক দিদিমণি বেশ জোর গলায় অনেক পরামর্শ দিতে থাকলেন।

 

সেই কাজের মেয়ের মাছ ছাড়া খাবার মুখে রোচে না। বলেছে — “তোমরা নিজেরা মাছ না খাও আমার জন্যে বরফের মাছ এনে রাখবে। আমি খাব। তোমরা যে কি মাছ খাও? শুধু রুই আর কাতলা! কেন? পার্শে, পাবদা কি বাজারে পাওয়া যায় না?”

 

দিদিমণি বলেছেন — “না, যায় না। তুমি কিনে এনো।” এই কথা শুনে অন্য অন্য দিদিমণি টিপ্পনী কাটলেন — “আহা! বাড়িতে যেন রোজ ইলিশ খান!”

 

কাজের মেয়ের কর্ত্রী দিদিমণি অন্য দুই দিদিমণিকে বোঝাতে লাগলেন যে তাঁর এমনিতেই মাছ খাওয়া নিষেধ, ডাক্তার বারণ করেছে। টানের কষ্টের জন্যে। আর ভালোও লাগে না। বর এখন নেই তো। বাবুর জন্যে একটু মৌরলা ভাজা করলেই তার হয়ে যায়। একদিন তিনি আর তাঁর মা ভেবেছিলেন দুজনেরই ষষ্ঠীর ব্রত, রাঁধবেন না, মুড়ি ছোলাভাজি খেয়ে কাটিয়ে দেবেন।

 

তাতে কাজের মেয়ে বলেছে — “আমি থাকতে পারব না। আমি রুটি করে নেব।”

 

মা বলেছিলেন — “কেন? তুমি তো রোজ রাতে বাড়িতে মুড়ি খেয়েই থাক?”

 

— “রাতে পারি, সকালে পারব না।” বলেই বাবুর রুটি করার সময় তিনখানা রুটি করে নিয়েছিল। একটা বাবুর। দুটো তার নিজের। দিদিমণি  আর তাঁর মা মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছিলেন।

 

পাশের দিদিমণি বললেন — “শোন? একদম বলে দিবি যে, আমাদের বাড়িতে থাকতে হলে আমাদের মতোই থাকতে হবে। আমরা যা খাই তাই খেতে হবে।”

 

— “মা, আমি, বলি তো। কিন্তু আজকাল মুখে মুখে কথার উত্তর দেয়।”

— “শোন এইভাবে বলবি – বলবি আমি একটা লোক ঠিক করে রেখেছি, তুমি আমার কথা শুনে চলবে নাকি বলো, না হলে তাকে রাখব। আসলে ও তোকে ব্ল্যাকমেল করে। ভাবে এরা চাকরি করে এদের লোক না হলে চলবে না। তাই এমন করে। তুইও এইভাবে অন্য লোকের কথা বলে ব্ল্যাকমেল করবি।”

 

— “আরে সেদিন কি করেছে জানো? আমি দুটো কুর্তি গোছাতে দিয়েছি। যাহোক তাহোক একটা ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে। আমি দেখিয়ে বললাম এটা তোমার কি ভাঁজ হয়েছে? বলল — ‘এমনই আমি পারি এর থেকে ভালো পারি না।’ আমি বললাম — ‘পারো না যখন বলতে পারতে, বৌদি একটু দেখিয়ে দেবে? আমি এসে দেখিয়ে দিতাম।’ সঙ্গে সঙ্গে মুখের ওপর বলল — ‘সকালবেলা তোমাকেই বা এত ফিরিস্তি দিতে হবে কেন?’ বললাম — ‘তুমি কি আমার শাশুড়ি নাকি? তুমি আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছ?’

বোঝা গেল, শাশুড়ি এভাবে বললে আপত্তি নেই।

 

— “বারবার বলছি শোন, ওকে বল। না হলে তুই মিছিমিছি এই কাজের লোক নিয়ে টেনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়বি।”

 

— “এই তো দেখো না – আমি এখান থেকে ফিরব সে চেয়ারে বসে থাকবে। আমি বাবুকে জামা পরাব, পাউডার মাখাব, ফ্রেশ করাব সে চেয়ারে বসে থাকবে। তারপর আমি চাবি আর সাইকেল হাতে দেব, তবে আমার বাবু সাইকেল চালাতে যাবে। সে তার পিছু পিছু যাবে। আবার ফেরার পর আমি জামা-প্যান্ট ছাড়িয়ে ডেটল দিয়ে হাত পা ধোয়াব, সে বসে থাকবে। সকালে তাও মা সব করে। চান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো। আর ওনার শুধু মুখে বড় বড় কথা। — ‘তোমাদের তরকারি আমি খেতে পারি না, প্রেসারের ভাত – ওই দলা দলা ভাত আমি খাই না। তোমাদের কত গ্যাস বাঁচে গো? একটু ফ্যান গেলে ভাত করলে কি হয়?’ আমি বলি বাঁচে।”

 

অন্য দিদিমণি — “না না এমন বলবি না। বলবি কি বাঁচে না বাঁচে সে আমি বুঝব। তোমাকে এত ভাবতে হবে না।”

 

— “একদিন দেখি এত উচ্ছে কেটে রেখে দিয়েছে। বললাম – ‘উচ্ছে কি হবে?’ বলল – ‘ভাজা’। ‘কে খাবে? আমি বা মা কেউই তো খাই না।’ ‘আমি খাই।’ বললাম – ‘এমন তুমি খাও বলেই চলবে না। আমরা খেলে করবে।’ ‘কেন? ভাজব তো দু ফোঁটা মোটে তেল দিয়ে। তাতে কি এমন হয়ে যাবে?’ ”

 

বলতে বলতেই খেয়াল হল রাজকুমার এসেছে। কথা থামিয়ে বললেন — “এই রাজকুমার পেয়ারা দিয়ো।”

অন্য দিদিমণিও বললেন — “ও! রাজকুমার এসেছে? রাজকুমার পেয়ারা দিয়ো।”

 

বলেই উনি বাড়িতে  কারো কাছে ফোন করে বলতে লাগলেন — “দিদিভাই উঠেছে? দিদিভাই? শোনো দুটো ডিম সিদ্ধ আছে। একটা সে উঠলে দিয়ো। আর একটা? আর একটা তুমি খেয়ে নিয়ো, এখন বা দুপুরে। সে উঠেছে?”

 

উত্তর পেলেন কিনা জানি না। ফোন রেখে দিয়ে ‘রাজকুমার রাজকুমার’ করতে লাগলেন।

 

আর ওই দিদিমণি  তখন তাঁর বাঁ পাশের জনকে বলতে লাগলেন — “আগের মেয়েটা ছিল ভালো। সে বাবুকে যত্ন করে, গল্প করে খাওয়াতো। মুখের উপর এত কথা বলত না। এই দময়ন্তীটাই যেন কেমন! ওর জন্যেই আমার কদিন বেশ টেনশন করে কাটছে।  বাজার যাবার লোকের অসুবিধা, আমার বর বাড়িতে নেই, এখন বাইরে গেছে। আর ও না থাকলে আমরা এমনিই একটু রান্নাবান্না কম করে, মা মেয়ে যাহোক একটা করে চালিয়ে দিই। মায়ের তো এখন আবার অশৌচ চলছে। সেই বাবা তিনটে নাগাদ ফোন করলে, ওদিকের নিয়ম কানুন হলে মা তবে ভাত খায়। মায়ের তো এখন সব সিদ্দসিদ্দ খাবার!”

 

এরমধ্যে পিন্টু হাঁকতে হাঁকতে চলে গেল — “জলের দামে পাবেন ফলের রস। দশ টাকায় পাঁচটা হয় ছটা পাচ্ছেন। এক কাপ চায়ের দামই পাঁচ টাকা। এই লেবু কমলা দশ টাকায় ছ’টা। লাস্ট ঝুড়ি। এই ট্রেনেই আমি বাড়ি চলে যাব।”

 

আর এক দিদিমণি একটু এগিয়ে এসে ওই টপিকেই যোগ দিলেন — “আমিও আমার মেটারনেটি লিভ শেষ হওয়ার আগে একজনকে ঠিক করলাম ছেলের জন্যে। ভাবলাম মা তো থাকেই, তার সঙ্গে একজন থাকলে মায়ের একার উপর চাপ পড়ে না। কিন্তু সে এক মহিলা, বাচ্চার থেকে বেশি আমার আর আমার বরের যত্ন করতে থাকল। আমাদের খেতে দেওয়া, জল দেওয়া। সবজি কেটে দেওয়া। তারপর দুপুরে ভাত খেয়ে ভোঁসভোঁস করে একটা ঘুম দিত। মা বলত তুমি বাচ্চাকে কখন দেখছ? বাচ্চার তো কিছুই করো না। বাচ্চাও তেমনি, তার কাছে খেতেও চাইতো না, থাকতেও না। তার নাম শিউলি। কিন্তু তার গায়ে এত গন্ধ যে সারা ঘর গন্ধ হয়ে থাকত।”

 

অন্য দিদিমণিরা বলল — “তুমি কিছু বলতে না?”

 

— “বলব কি, তাকে সাবান, শ্যাম্পু সব দিয়েছিলাম। এসে ফ্রেশ হয়ে বাচ্চার কাছে থাকার জন্যে। কিন্তু সে যেটা করত এসেই শাড়িটুকু চেঞ্জ করত। বাড়ি যাওয়ার সময় সাবান, টাবান মেখে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি যেত। পরেরদিন আবার জাস্ট এমনি চলে আসত।”

 

— “সুবিধা হচ্ছে না দেখে অন্য একটা আয়া সেন্টারে ফোন করলাম। সেই সেন্টারের মহিলা শিউলিদির কথা শুনে বলল — ‘কোনো কোনো মহিলার গায়ে অমন গন্ধ হয়। যাদের মকর রাশি হয় তাদের কাছে টেকা যায় না। ঠিক আছে আমি আপনার জন্যে একটা ভালো মেয়ে পাঠাব।’”

গায়ের গন্ধ রাশি মেনে হয় জানা ছিল না।

— “পাঠাল?”

 

— “হ্যাঁ, পরেরদিন একজনকে পাঠাল। একটু অল্প বয়সি, বিবাহিত তার একটা ছ বছরের মেয়েও ছিল। ভাবলাম এ তাহলে একটু ভালো দেখাশুনো করতে পারবে। নিজের মেয়ে আছে। শিউলিদিরও ছেলে, তবে সে অনেক বড়। তখনই বলেছিল ইলেভেনে পড়ে। এ মেয়েটার নাম রত্না। রোগাসোগা। কিন্তু খুব চতুর। সেটা পরে বুঝেছি আমরা। প্রথম দিনেই তো ছেলের হাতের নখ কাটতে গিয়ে কাঁচা মাংস বের করে দিয়েছিল, ছেলের কি কান্না।”

 

— “সেকি! তুমি কিছু বলোনি?”

 

— “না, সেদিন কিছু বলিনি, ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে। তারপর দেখলাম সে ছেলেকে বাইরে নিয়ে যেত যখন ছেলের দিকে নজর না দিয়ে বাইরের লোকের সঙ্গে গল্প করত। ছেলের দুটো পায়ে মশা কামড়ে ফুলিয়ে দিত তার কোনো হুঁশ থাকত না।”

 

— “তারপর কি করলে ছাড়িয়ে দিলে?”

 

— “আরে ছাড়িয়ে দিই নি। সে এক ঘটনা। একদিন আমার পিসি শাশুড়ি এসেছিল। ব্যাগে দুহাজার টাকা রেখেছিল। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি ফেরার সময় দেখে ব্যাগের টাকা হাওয়া। তারপর রত্নাকে জিজ্ঞেস করা হল – সে বলল পিসি যা ঘুমোয়, ওনার তো কোনো হুঁস থাকে না। খুব হেসে হেসে বলেছিল। তারপর আমার মা আবিষ্কার করল সারা মাসের এনে রাখা মশলার মধ্যে পোস্ত থেকে শুরু করে একের পর এক প্যাকেট মিসিং। সেদিন ছিল মাসের শেষ। ফলে তাকে আমরা মাইনেও দিয়ে দিয়েছি। পরের দিন থেকে দেখি সে আর আসে না।”

 

— “তা তুমি তো সেন্টার থেকে নিয়েছো তাদের কিছু বলোনি?”

— “দুদিন আসেনি দেখে ফোন করলাম। তখন তারা বলছে, ‘আপনি প্রথম দিনেই কেন কিছু বলেননি? যখন নখ কাটতে গিয়ে অমন করল। এখন আর কি বলি বলুন তো! আপনিও তো বলছেন কোনো প্রমাণ নেই।’ আমি  তখন বললাম – ‘হ্যাঁ আমার বাড়ির জন্যে ওকে কিছু বলার দরকার নেই, জাস্ট আর পাঠাতে হবে না। কিন্তু আপনি মাথায় রাখবেন ওকে যখন আবার অন্য বাড়িতে পাঠাবেন ওর এইদিকগুলো খেয়াল করবেন। সেটা বলার জন্যেই আমি আরও ফোন করেছি।’ তিনি তখন বললন, ‘হ্যাঁ থ্যাংক ইউ, এবং সরি ও এগুলো করার জন্যে। এই মূহুর্তে আমার হাতে আর কেউ নেই। থাকলে আপনাকে একজন ভালো মেয়ে দিতাম।’ আমি বলেছিলাম – ‘না না সে ঠিক আছে। আমি অন্য মেয়ে খুঁজে নেব।’ দূর! নমস্কার! আর আমি মেয়ে রাখিনি। ওই মা-ই একাই সামলেছে।”

 

এবার সবাই বলতে শুরু করল — “সবার আয়া ভাগ্য সমান হয় না গো। কেউ কেউ আছে খুব ভালো। কেউ কেউ আছে বাচ্চাকে ধরে মারে, তার খাবার খেয়ে নেয় কতরকম সব শুনি।” এই দিদিমণি আবার বললেন — “আরে আমার এক কলিগেরই বাচ্চার আয়া তো খুব ভালো। সেই হওয়া থেকে রেখেছে। তারা তো দুজনেই বেরিয়ে যায়। খুব ভালো ওর আয়া। স্কুলে দেওয়া নেওয়াও সে করত। তারপর তার পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল ব্যাস, ওর খুব অসুবিধা হয় এখন। এখন সে বাচ্চাকে পুলকারে দিয়েছে। পুলকার ক্রেশে পৌঁছে দেয়, আমার কলিগ ফেরার পথে বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ি যায়।”

 

ট্রেন থেকে নামতে নামতে ভাবলাম, এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের যে টানাপোড়েন — তার একটা দিক আজ শুনলাম। অন্যদিকের কথা অন্যদিনের জন্যে রইল।

 

 

 

স্টেশনে পৌঁছে দেখি বেঞ্চটা ফাঁকা নেই। দুটো মোটে সিট। এই জনবহুল দেশে সিট পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। তাই একটু এগিয়ে ব্যাগটা একটা কাঠের বাক্সের উপর রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর স্কুলের তিন দিদিমণি একসঙ্গে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন।

এক দিদিমণি শুরু করলেন, “অমৃতাদি ক’টা খাতা দেখলে?”

অমৃতাদি বললেন — “আটটা।”

— “যাক উন্নতি হয়েছে। সাড়ে তিনটে থেকে আটটা।”

আরও এক দিদিমণি জিজ্ঞেস করলেন — “অমৃতাদি তোমাকে কটা জমা দিতে হবে যেন? পনেরোটা?”

অমৃতাদির গলায় বেশ বিরক্তি। “হ্যাঁ, মিনিমাম তো পনেরোটা। ম্যাক্সিমাম সবগুলো।”

— “হ্যাঁ হ্যাঁ, পনেরোটা না হলে তো তুমি ওই ফর্মটা ফিলাপ করতে পারবে না।”

প্রথমজন আবার বললেন — “শোনো, তার বেশি দেখা হয়ে গেলেও কিন্তু তুমি পনেরোটাই দিয়ো তার বেশি দিয়ো না। আমি একবার করেছিলাম। আমাকে পঞ্চাশটা খাতা দেখতে দিয়েছিল, প্রথমে তিরিশটা জমা দিতে বলেছিল, আমি তিরিশটাই জমা দিয়েছিলাম। বাকিগুলো নিয়ে যাইনি। জমা দিতে গিয়েছিলাম যখন তখন আমাকে বলেছিল, ‘আপনাকে তো এবারে কম খাতা দেওয়া হয়েছে, আরও কিছু দিই?’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘না না ম্যাডাম বাড়িতে বাকিগুলো এখনও দেখা হয়নি, তার ওপর আমার বাড়িতে একটু ঝামেলাও আছে।’ ”

 

এমন অভিনব পরামর্শ দিতে পেরে তাঁর মুখে আত্মতৃপ্তির মুচকি হাসি ফুটে উঠল।

 

অন্য দিদিমণি বললেন, “আমরা কি সব কু-পরামর্শ দিচ্ছি তাই না?” বলে হাহা করে হাসতে শুরু করলেন।

অমৃতা দিদিমণি ফোন করছিলেন। অন্য দিদিমণিরা জিজ্ঞেস করলেন, “সকাল সকাল কাকে এত ফোন করছ বলো তো?”

— “আঁকার স্যারকে।”

— “ও! কি ব্যাপার? কাল থেকে এত আঁকার স্যারকে ফোন করতে ব্যস্ত?”

 

ওনারা মজা করতে চাইলেন। কিন্তু অমৃতা দিদিমণির সমস্যা ছিল গুরুতর, তিনি সত্যি সত্যি সেটা বলতে লাগলেন।

 

তারপর আজকের হিউমিডিটি নিয়ে গল্প শুরু করলেন ওনারা।

 

ট্রেন আসতে দেখে আমরা এগিয়ে এলাম। ট্রেন হঠাৎ প্ল্যাটফর্মে ঢোকার একটু আগে দাঁড়িয়ে গেল। এক দিদিমণি বললেন, “সিঙ্গেল পায়নি, তাই দাঁড়িয়ে গেল।” আমি ভাবলাম শব্দটাই ভুল শুনলাম বুঝি। তারপর দেখলাম আর এক দিদিমণি বললেন, “ওই ডবল পেয়েছে, আবার আসতে শুরু করল।” বুঝলাম ভুল শুনিনি। এই স্থূল জোক হয়তো কাউকে নকল করেই।

 

ট্রেন এল। আমি অমৃতা দিদিমণির পিছু পিছুই উঠলাম। উনি আরও কি বলেন সেটা শুনে লিখব বলে। কিন্তু ওনার সঙ্গীরা ওনাকে চিৎকার করে ডেকে নিলেন, ওদিকে জায়গা আছে বলে। উনি চলে গেলেন। আমার পাশে অন্য এক দিদিমণি ছিলেন।

 

পরের স্টেশনে সামনের সিটটা ফাঁকা হতেই আমার ডানদিকে বসা একটা মেয়ে উঠে রেডি হচ্ছিল ওই সিটটায় বসবে বলে। কিন্তু আমার বাঁপাশে বসা দিদিমণি ঝপাং করে উঠে ওটায় বসে গেলেন। তিনি মোবাইল দেখতে ব্যস্ত ছিলেন, তাই একটু পরে বুঝলেন মেয়েটা ওটায় বসতে চাইছিল। তাই সঙ্গে হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি বসতে চাইছিলেন? বসবেন? সরি আমি বুঝতে পারিনি।”

 

মেয়েটা বলল, “না না ঠিক আছে আপনি বসুন।”

 

আর একটা স্টেশন এল। সামনের দরজা দিয়ে কিছু মহিলা, পিছনের দরজা দিয়েও অনেক মহিলা উঠলেন। সামনের দরজা দিয়ে উঠে এক মহিলা আমার সামনের সিটের চার নম্বর যাত্রী হতে যাচ্ছেন, প্রায় বসে পড়বে এমন অবস্থায়, মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো এক মাঝবয়সী মহিলা দৌড়ে এলেন, এবং সামনের সিটের আইল চেয়ারে বসা মহিলা সরে গিয়ে তাঁকে জায়গা দিলেন। দিয়ে অন্য মহিলার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি দিলেন। মাঝবয়সী দুই মহিলা বন্ধু। ওই মহিলা তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে জাস্ট বললেন, “এটা আপনার সঙ্গে হলে কেমন হত?”  বলতেই, যিনি এসে বসলেন তিনি তড়াক করে উঠে, “ও আপনি বসতে চান? বসুন, প্রবলেম কোথায়? বসুন বসুন।” বলে প্রায় ঝগড়ার মুডে চলে গেলেন।

 

অন্যদিকে দিদিমণি মোবাইলটা চোখ থেকে একটু সরিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “উনি যেটা করলেন, ঠিক করেননি। কালচার শেখা দরকার।”

 

ব্যাস! আবার সেই, ‘খাক তাতে দুঃখ নেই ওলো বলবে কেন!’

 

এবার সেই মহিলা প্রায় যুদ্ধংদেহী হয়ে শুরু করলেন, “হুম! কালচার শেখাতে হবে? কালচার তোমরা শেখো। বলেই উঠে বললেন নাও তোমরা রিলাক্স করে বসো। আমরা আনকালচার? তোমরা যত কালচার শিখে এসেছ? যাচ্ছ তো ওই রুরাল প্লেসে পড়াতে। ঢুকবে একটা জায়গায়, গিয়েই তো ষাঁড়ের মতো চেঁচাবে। কালচার শেখাচ্ছে। যত্তসব মুসলিম বাচ্চাদের নিয়ে কারবার। পড়াতে সাউথ পয়েন্টে, বুঝতাম। রুরাল প্লেসে যাচ্ছে আবার বড় বড় কথা।”

 

তিনি দরজার কাছে গিয়ে একতরফা চিৎকার করেই চললেন।

 

এর মধ্যেই অনেক কালো কালো প্যাকেট হাতে এসে গেল লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরা, দাড়িওলা এক ফেরিওয়ালা, কাঁধে একটা বড়ো ব্যাগ। ওই মহিলার গলার আওয়াজকে ছাপিয়ে জোরে জোরে বলতে থাকল, “কালো মাণিক আছে, কালো মাণিক। দাঁত ভালো রাখতে, দাঁতের গোড়া মজবুত রাখতে, মুখের পচা দুর্গন্ধ দূর করতে হাতটা বাড়িয়ে একবার প্যাকেটটা নিন। দশ টাকায় একশো, কুড়ি টাকায় দুশো। একটা তেলও আছে। দাঁতে ব্যথা হলে লাগাবেন। অন্তত একমাস ভালো থাকার জন্যে দিদিভাইরা একটা প্যাকেট নিয়ে যান। বুড়ো থেকে বাচ্চা যাকে খুশি মাজতে দিন। ভালো না থাকলে পয়সা ফেরৎ।” আমি ওনাকে আগে কখনও দেখিনি। সেদিনই প্রথম দেখলাম, তাই ভালো করে নিরীক্ষণ করলাম। দেখলাম তাঁর দাঁতে এতটুকু সাদা অংশ নেই। নিকোটিনের লাল-কালো মিলে পুরো ছাপা ছাপা দাঁত।

 

অনেকদিন আগে বনফুল হীরালালের গল্প লিখেছিলেন। হীরালাল ট্রেনে দাঁতের মাজন বেচত। নিজের দাঁত ছিল না, তাই ঝকঝকে বাঁধানো দাঁত পরে থাকত। আজ আর মাজনের মাহাত্ম্য প্রচার করে বিক্রি করার জন্যে নিজের দাঁত ঝকঝকে দেখানোর প্রয়োজন হয় না। আমরা সবাই জানি সব বিজ্ঞাপন নকল।

 

এদিকে দিদিমণি আর সেই মহিলা আলোচনা করছেন, “খুব ইগোয় লেগেছে। যিনি কাজটা করলেন তিনি কিন্তু চুপ করে আছেন, কিচ্ছু বলছেন না। উনি তো বুঝেছেন, উনি কি করেছেন।”

 

— “আপনি কিছু বলুন আপনাকে পড়ানো নিয়ে অমন বলছে।”

— “ধুর! কি বলব, এসব গা সওয়া হয়ে গেছে, এক কান দিয়ে ঢোকাই আর এক কান দিয়ে বের করে দি। ওর কালচার কি বুঝতে পারছেন না?”

 

সেই মহিলা — “সকালবেলা মেজাজটা পুরো খারাপ করে দিল! কালচার শেখাতে এসেছে।”

 

অন্যরা সমর্থন করলেন — “হ্যাঁ সকাল সকাল কি সুন্দর চান-টান করে ঠাকুরের নাম করে মানুষ বেরোয়, এরকম হলে তো খারাপ লাগবেই।”

 

আমার সিটের পিছনে এক মাসি দাঁড়িয়ে ছিল, সে মোসাম্বি, কমলা বিক্রি করে দেখি আজকাল। তার হাতটা আমার মাথায় লাগায়, আমি ঘুরে তাকাতেই সে বলল, “ওই মহিলার মাথায় মনে হয় তার কাটা আছে, তাই চেঁচিয়েই যাচ্ছে। মুসলিমরা কি করল? মুসলিমরা বুঝি পিছনে বাঁশ দিয়েছে? ওই জন্যেই তো মরে মার খেয়ে।”

 

এবার নামার সময় হল। আমি গুটি গুটি করে উঠে এসে সেই মাঝবয়সী মহিলার পিছনে এসে দাঁড়ালাম। তিনি তখনও  থেমে যাননি। নেমে যাচ্ছেন বলে শেষবারের মতো আবার জোরে জোরে শুরু করলেন।

 

“সরকার টিচারদের মাইনেটা বাড়িয়ে দিয়েছে না, তাতেই রসটা হয়েছে। কাজ বলে তো কিছু নেই। যায়, গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা, মাসে মাসে মোটা মাইনেটা পাচ্ছে বলেই এত তেজ। কি পড়ায় সে তো জানাই আছে, এক সিলেবাস বছরের পর বছর এক জিনিস, আর ওই তো সব ছাত্র। তুই যেমন টিচার আমিও তেমনি অফিসে চাকরি করি। আমাদের অমন একঘেয়ে কাজ নয়। রোজ নতুন নতুন লোক নিয়ে ডিল করতে হয়। অনেক কালচার জানতে হয়। তোদের মতো নয়।”

 

সহকর্মী বন্ধুকে বললেন, “তাই না বলো? আমাদের পৌরসভার অফিসে কত নতুন নতুন লোকদের নিয়ে কাজ। কত কি জানতে হয়।” বলতে বলতে লাইনের ধার দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন।

 

আমি একটু এগিয়ে গেলাম। ট্রেনটাও যেন ওনার ঝগড়া শোনার জন্যে প্ল্যাটফর্ম ছেড়েই, একটু গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমি লাইন পেরোতে পারলাম না। দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, জীবনের ছোটোবড়ো এমন খোঁটা যেন গায়ে না লাগে।

 

 

 

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
410 Gone

410 Gone


openresty