
সাদিক হোসেন-এর কবিতা
‘হরিমলপর’ – কাব্য সিরিজের কয়েকটি কবিতা
১।
সাকিন বাখানা আদি হরিমল পুর
বাঁধা জলে বাঁধা গীত ভুবন গাহিছে
কতদূর ধুন আলো বেঁকে পড়ে আছে
ফল দাহ, দেহদাহ, সতী, টোপর পরিছে
রূপ তার কাঁসার পাত্র ঠকিছে ঠকাস
এলো বউ, রাত এলো, দাও মল্লিকা সুবাস
বদনে বদন ভেদ – সহসা চমক
টোপর খুলিল সতী ভানুমতী জ্ঞান
উড়িছে ভাসিছে আদি পুর হরিমল
টলিছে গতরবীজ ফুকারা ফুকারা
কাহাকে বলিবে তব ফুড়ুক ফিরিক
পুরাঙ্গানা পুরোগত মল্লিকা ছড়ায়ে
বাঁশরি বাজে না তব সাদা পাদোদক
ধুলি উড়ায়ে গিয়াছে নোদন নাগিনী
শব্দার্থঃ
বাখানা – বর্ণনা করা
ফুকারা – উচ্চস্বরে ডাকা
পাদোদক – পুজ্য ব্যক্তির পা–ধোয়া জল
নোদন – অপসারণ
২।
ফুফা কহে বনমালী নাচি হ’ এবার
নেয়াপাতি নেয়াপাতি দোলাও মরদ
বাগালে জুড়িছে গান রাগিণী বাগুড়া
বধিরে নেশায় দেখো কহিছে বদর
টাল খায়, বিষ খায়, দন্ড সোজা খাড়া
উঁচায়ে জাগিছে হনু বলো কী বা ধ্বক
বিথারা কেশব বাবু সাঁঝের আরতি
বলিছে বদরবাবা বাচাও সন্তান
ফুটিছে ভাঁট, মৌ, দোহে ছিন্ন বাঁই বাঁই
লন্ড ছার কুঞ্জ খার কেশর লটকা
শ্যামরায় শোক বড়ো শ্বিত্র সারাগায়ে
ধবল সন্ন্যাসী দোহে কহিবে সভায়!
শব্দার্থঃ
নেয়াপাতি – নরম ও গোলগাল
বাগাল – রাখাল
বাগুড়া – সুপারি নারকেল কলা প্রভৃতি গাছের সবৃন্ত পাতা
বদর – পিরবিশেষ – জলযাত্রা যাতে নির্বিঘ্ন হয় সেইজন্য মুসলমান মাঝিরা এঁর নাম স্মরণ করে
শ্বিত্র – শ্বেতি রোগ
৩।
বসিছ আসন পেতে সম্মুখে সালন
জাবর কাটিছ গলে সারং সারং
নেলাখেপা বলরাম নজরে বলভি
বেয়ারা তামাশা করে জালিম ডাগর
সরতা ভাঙিছে ঠুং লাজে সরসিজ
কাঁপে পাপড়ি তাহার – সরট ননদী
অদূরে ভ্রমরী ওড়ে, মাছি মনোরথ
আহারে আরাম প্রভু? পঙ্খে সুবিশাল
বিষ ঝাড়ে, সর্পবিষ, মাঠা মনোহরি
দাও প্রভু দাও দন্ড রসাতলে যাই
রসের অরূপ দেখি মুহুর্তে অতীত
তব দন্ড, রস নহে, শীর্ণ বলভি
প্রবেশে চমক ছিল মৎস খচিত
শব্দার্থঃ
সালন – লংকার ঝালযুক্ত মাছ–মাংস
সারং – সঙ্গীতের প্রাতঃকালীন রাগবিশেষ
বলভি – গৃহচূড়া
সরতা – সুপারি কাটার যন্ত্র, জাঁতি
সরসিজ – পদ্ম
সরট – টিকটিকি
মাঠা – ননি, মাখন
৪।
দুগ্ধ উছলিয়া ওঠে, সিনা টান টান
মুকুতা এমন প্রিয়, মুকাবিলা ভার
কুচকুম্ভ কন্ঠহারী, দাগ নেহারিল
যেমত রাধিকা রূপ এজমালি হল
গস্তানি শুনিছে বাঁশি সমুখে গোঁয়ারা
বরিষা বরিষা আহা কাদার নৃপতি
গোবদা মুকুট খুলে দেখিল গোডিম!
ছটে খায় ফটে পায় ঠাপন খলিশা
কোথা যাবে বলো প্রভু ভোজনরসিকা?
আহারে বসিছে খল কন্ট কাটে দাঁতে
দিয়াড়ি উন্মনা ছিল। রূপ ছালা-ছালা।
শব্দার্থঃ
এজমালি – একাধিক লোকের অধিকারভুক্ত
গস্তানি – কুলটা, ভ্রষ্টা নারী
গোঁয়ারা – হাসান–হোসেনের শবাধার বা মহরমের তাজিয়া
গোবদা – অশোভন
গোডিম – ডিম থেকে বেরোবার পর পক্ষিশাবকের অসহায় অবস্থা
দিয়াড়ি – মশাল
৫।
দেলেতে খরম পরে মেহমান ঘোরে
ঠোকন ঠোকন হাঁটে গোপন ঝিঁঝোটি
কেচ্ছা ফ্যাসাদ জমা তপশীল জাতি
উঠিতে না পারি তবু ঝাড়ফুঁক ঝাড়ি
চর্ম খাই মস্ত খাই ছানতা ছানতা
জমে না জলজ ছাতি চঞ্চল নোকতা
পটবাস ধ্বস খায় জমিনে ডালিয়া
ফুটিয়া রহিছে বপু – বাঁ হাতে বাইস
দাগাবাজ মালাউন করো হে হালাল!
গলে তব মালা দিব দলিত বাঁধন
খামোস পানিতে বুঝি কলসী ভরিছ?
উহা তো অছিলা জেনো বিথীকাবাসিনী
অঙ্গুলি বাজায়ে শ্যাম দিবে গো বাগুরা।
শব্দার্থঃ
ঝিঁঝোটি – সংগীতের সন্ধ্যাকালীন রাগিণীবিশেষ
ছানতা – ঝাঁঝরি, ছিদ্রযুক্ত হাতা
নোকতা – আরবি–ফারসি অক্ষরে যে বিন্দু সংলগ্ন থাকে
এমন সব আশ্চর্য কবিতা পড়া এক অভিজ্ঞতা। কবি সাদিক হোসেনের আরও কবিতার অপেক্ষায় রইলাম।