
রিনি গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাগুচ্ছ
১
জলপথ এখন আর ততটা তরল নয়,
বাঁধ পড়েছে স্রোতের মুখে।
মাঝে মাঝে যখন লকগেট খোলা হয়
জলের তোড়ে অনুভূতিরা ছত্রাখান হয়।
তবুও ভেসে যাওয়া ছাড়া নেই উপায়ান্তর-
জমা রাখা আছে মন ও শরীর,
দোহাই প্রেমের আতান্তর!
ফিরবি না কি মন?
করবি না কি একবার গতিমুখের বদল?
সময় গেছে অনেক,
রাগ করবে না ভৌগোলিক মহল।
খাতরেখা অবশ্য মুছে যাবে না কোনোদিনই,
আগাছার জঙ্গলে শ্যাওলাদের পা ছোঁয়াছুঁয়ি;
চাঁদের টানে কখনো কখনো অনুভূতিরা কাঁপবে;
নয়তো সবই নতুন রকম, নতুন পথে হাঁটবে।
২
তুমি আর ফিরে এসো না কখনো
আমার বিষণ্ণ দিন রাত্রির কাছে
আমি থেকে যাব অনুগত।
এবার হবো বাউল মন
ধুলো চিহ্ন রেখে যাব হেমন্ত-শস্যে
পৌষালি গোধূলি তোমার প্রাজ্ঞ ভুবনে।
নিরাময় রেখে যাব অপ্রয়োজন গোপনে
অস্ত আকাশের ক্লান্ত উচাটনে
অভ্যস্ত বিলাপের গানে ।
অবিকশিত কুঁড়ির হাহাকার ছেড়ে
অপেক্ষা রেখে যাব পর্ণমোচী পাতায়
প্রত্যাশাখানি আর দুলবে না হাওয়ায়
গর্ভাশয়ের জলে দাগ ফেলে গেছে যে সঞ্চয়
তার নরম মুঠি ভরে দেব দু একটা ভুল ঠিকানা
জন্মান্তরের মিথ্যে আস্তানা।
কেবল তোমার না চাওয়ার কাছে রেখে যাব
আমার অপূর্ব ভালো থাকা
আমার আগুন লাগা পলাশবেলা।
৩
যে মুহূর্তরা প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল
আমি তাদের গিলে ফেলেছি চিরমরণের মতো
ঠিক যেমন করে গিলে ফেলেছি আমার যুগব্যাপ্ত বিরহ
আমার নাছোড় প্রেম, আমার না লেখা কবিতার খাতা
আমার কপালের টিপ ও আমার মেয়েলি অহংকার
আমার মগজ ভরা রঙ-তুলি আর বাতাসে ট্রেনের গন্ধ
নাঃ, তোমার সঙ্গে দেখা হবে না আর কখনো।
৪
তুমি চলে গেছ, তাই ফুরিয়ে গেল একটিমাত্র অবিশ্বাস
যাকে তুমিই আহ্বান করে এনেছিলে
বিরহে যে প্রেমের পূর্ণতা
বিরোধে তারই তো সার্থকতা
সার্থকতা পেরোতে চেয়ে পেরিয়েছিলাম লোহিত নদী
আজ যদি বলি সে নদী তোমার পাশে হেঁটেছে সমান্তরাল
যদি বলি সে নদীর জলে থেকেছি ভেসে
এমনকি তোমার-আমার নিভৃত যাপনে
কবিতা হতে চেয়ে যে প্রেম রগরগে উপন্যাস হয়ে যায়
তার কাঁটাচিহ্নে লেগে থাকে এক ফোঁটা তৃষ্ণা।
৫
মুহূর্তরা বড়ো অভিমানী
খসে যেতে তাদের সময় লাগে মূহুর্ত
অথচ এই মুহূর্তটুকুই হারানো ছাড়া
আর কিছুই খোয়া যায়না জীবনে-যাপনে
গত দু’দশক জুড়ে এই তো সঞ্চয় করেছি বিস্তর
তবু আজও যেন সেই প্রত্যাশার পাত পেড়ে রেখেছি
দু-এক বিন্দু কোনোদিন অলক্ষে ঝরে পড়বে হয়তো
হয়তো আবারও সঞ্চয় হবে, কান্না হবে, হবে নিঃশর্ত প্রেম
যে প্রেম চলে গিয়ে রেখে যায় সুগন্ধী বিচ্ছেদ।
৬
কোনো কোনো মানুষ শিকড়হীন হয়
গোড়ায় স্নেহজল থাকে না
পুরোনো বাড়ি পুরোনো পাড়া
পড়ে থাকে সরীসৃপের খোলসের মতো
নতুন আবাস, তাও নড়বড় করে
এ পাড়া বেপাড়া জুড়ে থাকে অন্বেষণ
থিতু হওয়া মাটি আলগা রাখে মুঠো
কমলা আকাশ ধুয়ে দেয় স্মৃতি
পায়ের তলার বালি টান রাখে অবয়বে
ফানুসে কাটে ওড়াওড়ি।
৭
যে দুঃখ পেতে চেয়েছিলাম প্রেমের কাছে
সে দুঃখে নাম লেখাছিল কিশোর
আলো হয়ে ফুটে সে দুঃখ একদিন পশ্চিমে নামিয়েছে ঢল
মরা বিকেলের প্রখর আলো ভুরুকে করেছে বক্র কুটিল
দ্রুত হিম ঘরে ঢুকে চকচকে ত্বক সামলেছি
আর মনে মনে জেনেছি
আজ শুধু দুঃখের কাছে পেতে চাই কবিতা
সেই ভয়ানক বিরহ যা শেষে আত্মরতি হয়ে ওঠে
তার জন্যই জমা করে রাখি দু ফোঁটা অশ্রু।
৮
যে কোনো বৃষ্টি-পাতায় আজও লিখে রাখি তোমার নাম
খ্যাপা বৃষ্টি বুনে দেয় অঝোর অশ্রুজল
শিরশিরে হাওয়ায় কান পেতে থাকি
শুনি স্পর্শহীন বিগত সম্পর্কের স্বর
সে স্বর কবিতা হয়ে ওঠে না কোনো মাত্রাতেই
ছন্দ পেরিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে এলোমেলো শব্দজাল
শুধু বেদনা হয়, নাম রাখি বিষাদজল।
৯
তোমার বাগানে ফুটে থাকা ফুলের মতোই নিষ্পাপ মনে হয়েছিল তোমাকে
যুগ পেরিয়ে আবারও তোমার কাছে পৌঁছতে চেয়ে দেখলাম
আসলে একটি মিথ্যে ফুল গাঁথা ছিল মরা ডালে
বড়ো বেশি লাল রঙ শুধু প্রেমের নয়
বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য মাত্রাকে ব্যাহত করে
তোমার কথা বলতে গিয়ে এই সব সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করছি অঙ্কের মতো
বিনয়ের গণিত কবিতা হয়ে উঠেছিল বলে আমিও কবিতা হব এমন প্রত্যাশা করি না
শুধু তোমার বদলে যাওয়া ছাপ ফেলে যায় প্লাস্টিকের ফুলে।
১০
সহজ ভাবে মেনে নিতে পারি তোমার সব নিষেধাজ্ঞা
শাসনে শাসনে বেঁধে আমায় জাগিয়ে রাখতে পার রাতের পর রাত
অথবা চোখ বুজে পড়ে থাকাকেই ঘুম বলে মেনেছি বহুকাল
তারও মাঝে দু একটা ভুল কেমন করে যেন আমার খাতায় নাম লেখায়
আমি আপ্রাণ রবার ঘষি, তবু শাস্তির কড়া দাগ দগদগিয়ে ওঠে
সব শাস্তি শেষপর্যন্ত নিষ্পেষণ করতে চায় মননকে
বিসর্জি প্রতিমা যেন আধা শহরের ওই চাল বাড়ন্ত মেয়ে।