রাহুল দাশগুপ্ত-র গল্প স্বপ্নের ট্রাম

রাহুল দাশগুপ্ত-র গল্প স্বপ্নের ট্রাম

অর্জুনের মনে হলো, আজ হয়তো ওর আর বাড়ি ফেরাই হবে না।
একটু আগেই প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠিক বাড়ি ফেরার সময়। এক ছোট প্রকাশকের কাছে কাজ করে সে। রোজ সকালে তাকে বইপাড়ায় যেতে হয়। দোকান খুলতে হয়। ছোট্ট একচিলতে দোকান। সেই দোকানে যত বই আছে তাদের গায়ে লেগে থাকা ধুলো ঝাড়তে হয়। বিকেলে বিগ শপার ভর্তি বই নিয়ে বেরোতে হয়। বিভিন্ন দোকানে গিয়ে তাদের প্রকাশন সংস্থার বই দেখাতে হয়, যদি সেইসব বই তারা কেনে!
আজও দোকান বন্ধ করে বেরিয়েছে অর্জুন। দু’হাতে দু’টো বিগশপার ভর্তি বই। দক্ষিণ কলকাতার একটা দোকানে পৌঁছে দিতে হবে। কাল সকালে বইপাড়ায় আসার আগে গিয়ে দিয়ে আসবে। এতক্ষণে সেই দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বইগুলো নিয়ে আগে তো বাড়ি যেতে হবে! প্রচণ্ড ভারি দু’টো বিগ শপার। হাত যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বইগুলোর কোনও ক্ষতি হলে চলবে না। ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষমতা অর্জুনের নেই!
একটা শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ঝড়বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলো অর্জুন। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেছে সামনেটা। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর তারপরই প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ছে বাজ। একটার পর একটা বাজ পড়েই চলেছে। অর্জুন আগে কখনও এত বাজ পরপর পড়তে দেখে নি! রাস্তায় জল একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। গোড়ালি ভিজে গেছে অর্জুনের। নোংরা জল। প্রবল স্রোতে তার পা দুটো ভিজিয়ে বয়ে চলেছে।
খুব অসহায় লাগছিল অর্জুনের। প্লাস্টিক দিয়ে বিগ শপার দু’টোর মুখ সে ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু এইভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না, বুঝতে পারছিল সে। তার গায়ে বৃষ্টির ছিটে এসে লাগছে। ভিজে গেছে জামাকাপড়ের অনেকখানি।
প্রায় চল্লিশ মিনিট ওইভাবে দাঁড়িয়ে রইল অর্জুন। তারপর বৃষ্টিটা একটু কমে এলো। যদিও পুরোপুরি কমেনি। ঝিরিঝিরি করে পড়েই চলেছে। জল উঠে এসেছে হাঁটুর কাছে। কিন্তু আর দেরি করা চলে না!
অর্জুন রাস্তায় নামল। ছোট গলিটা দিয়ে প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর বড় রাস্তা। হাতে ভারি বোঝা বলে তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু বোঝাকে এখন বোঝা বলে ভাবলে চলবে না। সে প্রায় ছুটতে শুরু করেছিল। বৃষ্টিতে সে ভিজে যাচ্ছে। নিচের দিকে হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসা জল। সেই নোংরা জল ভেঙেই সে প্রায় ছুটছিল। যে করে হোক আগে বড় রাস্তায় পৌছতে হবে। তারপর একটা ফাঁকা অটো দেখে উঠে বসতে হবে।
ছোট গলি হলেও সেখানে তখন নারকীয় অবস্থা। বৃষ্টি একটু কমেছে বলে রাস্তায় নেমে এসেছে বহু লোক। সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া। তার ওপর হঠাৎ হঠাৎ সামনে এসে পড়ছে একটার পর একটা হাতে টানা রিক্সা। তখন আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। ভিড়ের মধ্যে এ ওকে ঠেলা মারছে। মুখের ভাষা লাগামছাড়া হয়ে উঠছে এদিক-ওদিক থেকে।
কোনওকিছুকে পরোয়া না করে অর্জুন ছুটছে। মনে হচ্ছে, যে কোনও মুহূর্তে হাতের বোঝা দু’টো নোংরা জলের মধ্যে খসে পড়বে। অথবা হাতের বোঝা দুটোকে বুকে আঁকড়ে সে নিজেই বসে পড়বে ওই নোংরা জলের মধ্যে। হু হু করে কেঁদে উঠবে। বলে উঠবে, আর পারছি না। তোমরা কেউ আমাকে একটু সাহায্য করো। হয়তো একটু পরেই সে চেতনা হারিয়ে ফেলবে। কোনও সংজ্ঞা থাকবে না তার। সেটাই বরং ভালো হবে। এইভাবে ছোটার চেয়ে রাস্তার মধ্যে, এই নোংরা জলের ভেতর লুটিয়ে পড়াই ভালো। তবু তো হাতের এই বোঝা দু’টোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে! তবু তো এইভাবে অন্তত আর ছুটতে হবে না!
অর্জুন সত্যিই আর পারছিল না। এরকম সময় অসম্ভব মনের জোর দরকার। কখনও বৃষ্টির জোর বাড়ছে। কখনও কমছে। কিন্তু বাজ পড়ায় কমতি নেই। বড় রাস্তার সামনে এসে পৌঁছাল অর্জুন। কিন্তু এখানে কোনও শেড নেই। হঠাৎ জোরে বৃষ্টি শুরু হলে কী হবে? তাছাড়া বিগ শপার দু’টো তাকে হাতেই রাখতে হচ্ছিলো। কোথায় নামিয়ে রাখবে সে? চারদিকে জলে থইথই করছে।
একটু পরে একটা অটো অবশ্য পাওয়া গেল। এবার সে মেট্রো স্টেশনের কাছাকাছি অন্তত পৌঁছতে পারবে। অটোয় আর কেউ নেই। পেছনের সিটে বসতে পেরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো তার। বিগ শপার দু’টোও হাত থেকে নেমেছে। এখন একটু হালকা লাগছে। কিন্তু শেষরক্ষা হবে কী?
অটোটা একটু একটু করে এগোতে লাগলো। আর তার মধ্যেই আবার প্রবল জোরে শুরু হলো বৃষ্টি। রাস্তায় প্রচণ্ড যানযট। একের পর এক বাস, ট্যাক্সি, অটো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ একটুও নড়ছে না।
অর্জুনের মনে হলো, সে নিরাপদ একটা আশ্রয় পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই আশ্রয় নিতান্তই সাময়িক। একটু পরেই তাকে আবার নামতে হবে। তখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে? বইগুলোর কী হবে? কিভাবে তাদের রক্ষা করবে সে? বাড়িই বা ফিরবে কী করে? স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই তো তার সর্বস্ব ভিজে যাবে।
নির্দিষ্ট মোড়ে পৌঁছনোর পর অটোচালক বললো, এবার আপনি নেমে যান। আপনাকে একটা শেড দেখে নামিয়ে দিচ্ছি।
অর্জুন বলল, আপনি আমাকে একটু স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন?
অটোচালক রাজি নয়। সে বললো, আমি অন্যদিকে যাবো। আপনি নেমে যান।
অর্জুন লক্ষ্য করেছিল, একজন রিক্সাচালক ফাঁকা রিক্সা নিয়ে অটোটার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে।
দু’হাতে দু’টো বিগশপার নিয়ে দৌড়ে সে রিক্সাচালকটির কাছে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, আপনি আমাকে একটু স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন?
রিক্সাচালকটি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, পারবে না।
দেখুন, অর্জুন বলল, আমার অবস্থা খুবই খারাপ। হাতের বোঝা দু’টো দেখছেন তো? আমি আর পারছি না? একটু সাহায্য করুণ প্লিজ, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
রিক্সাচালকটি এবার কর্কশভাবে বলে উঠলো, আপনার কষ্ট হচ্ছে তো, আমি কী করতে পারি?
অর্জুন বলল, আপনিও তো একজন মানুষ। ঠিক আমারই মতো। একটু দয়া করুন আমাকে…
রিক্সাচালকটি এবার ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল, আপনি সরুন তো। তারপর নিজের মনেই যেন বিড়বিড় করে উঠল, দয়া চাইতে এসেছে! আমাকে কে দয়া দেখায়…
এদিকে বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেছে। অর্জুন প্রায় দৌড়ে দ্রুত রাস্তা পার হলো। তারপর ছুটতে শুরু করল স্টেশনের দিকে। বৃষ্টিতে সে এখন পুরোপুরি ভিজে গেছে। সবচেয়ে সমস্যা হয়েছে, তার পকেটের রুমালটা ভিজে গেছে। বৃষ্টির জলে চশমাটা ঝাপসা হয়ে গেছে। অথচ কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে সেই জল মোছার কোনও উপায় নেই। সামনে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। ফুটপাথেও গিজগিজ করছে লোক। তবু সে ছুটতে লাগলো। সে মনস্থির করে নিয়েছে, আর সে দাঁড়াবে না। তাতে যা হয় হোক।
বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেছে। অর্জুন ফুটপাথ দিয়ে প্রায় ছুটেই চলেছে। ফুটপাথের কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার। কোথাও শেড আছে, কোথাও বা খালি আকাশ। মাঝেমাঝে সরু গলি পড়ছে। সেগুলো পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। জল কোথাও গোড়ালি ভিজিয়ে দিচ্ছে, কোথাও হাঁটু। অর্জুন কোনওদিকে না তাকিয়ে শুধু এগিয়ে যেতে লাগলো। হাতের বিগশপারদু’টো যেন হাত দু’টি নিয়ে ছিঁড়ে পড়তে চাইছে। তবু সে শক্ত মুঠোয় সেগুলোকে ধরে আছে।
অর্জুন এখন অনেকটাই আন্দাজে আন্দাজে এগিয়ে চলেছে। চোখে সে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চশমার কাঁচটা পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গেছে। ভেতরের একটা অদম্য জেদে সে এগিয়ে চলেছে। এই জেদটাই যেন বলে চলেছে, কিছুতেই হেরে গেলে চলবে না। স্টেশনে তাকে পৌঁছতেই হবে। আর একবার ট্রেনে উঠতে পারলে… বাড়ি ফিরে স্নান করে এক কাপ গরম চা নিয়ে যখন সে এই মুহূর্তগুলোর কথা ভাববে, তখন একটু হলেও তাঁর ঠোটের কোণে কী মৃদু হাসি ফুটে উঠবে না?
যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে বাড়ি ফেরার আশা ত্যাগ করাই তার উচিত। আকাশে বারবার বিদ্যুৎ চমকে চমকে উঠছে। ঘন ঘন আকাশ ফাটিয়ে আছড়ে পড়ছে বাজ। ক্লান্তিতে, হাতের ভারে, বৃষ্টি আর ঝড়ের তাণ্ডবে হাল ছেড়ে তার মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কথা। সে এখন যদি মরেও যায়, কেউ আশ্চর্য হবে না। অথবা এই অবস্থায় কেউ যদি তাকে দেখে, তাহলে সে কী ভাববে? তাকে যেন সত্যিই এভাবে কল্পনা করা যায় না! সে একটা অকল্পনীয় দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে…
রাস্তায় কেউ কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। কারও মনে কোনও সহানুভূতি নেই। পাশ দিয়ে হুশহাশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার। বাসের জানলা দিয়েও দেখছে কেউ কেউ। এরা সবাই দেখছে, বৃষ্টিতে কাকভিজে হাতে প্রচণ্ড দু’টো ভারি ব্যাগ নিয়ে উন্মত্তের মতো, উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছে একটি মানুষ। অথচ সবাই কেমন নির্বিকার, উদাসীন, আত্মমগ্ন। এরা সবাই মানুষ? অর্জুন তাহলে মানুষকে নিয়ে, মনুষ্যত্ব নিয়ে এতো ভাবে কেন? মানুষের মধ্যে কী আদৌ কোনও মনুষ্যত্ব আর অবশিষ্ট রয়েছে?
না, অর্জুন আর দাঁড়াবে না। বাড়ি ফিরে সে যাবেই। একটা বইয়েরও সামান্যতম ক্ষতি হতেও দেবে না। আর তখনই তো তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠবে মৃদু হাসি। নিশ্চিত ভরাডুবির সামনে থেকে মানুষ যখন নিরাপদে ফিরে আসে, তখন তার মুখে, ঠোঁটের কোণে ঠিক যে হাসিটা ফুটে ওঠে, ঠিক সেই হাসি। এই হাসিটা তাকে হাসতেই হবে।
অর্জুন শেষ পর্যন্ত স্টেশন চত্বরে ঢুকে পড়ে। তারপর অপেক্ষাকৃত ভিড় কম দেখে একটা কামড়ায় উঠে পড়ে। বসার কোনও জায়গা নেই। এমনকি ব্যাগ দু’টো রাখারও জায়গা নেই। অর্জুন অনেক কষ্টে একটা ব্যাগ নিজের দু’টো পায়ের ফাঁকে গুজে দেয়। কিন্তু আরেকটা ব্যাগ সে কোথায় রাখবে?
অর্জুন তখন প্রবলভাবে হাঁপাচ্ছে। তার সারা শরীর ভেজা। সামনের লোকটিকে সে বিনীতভাবে অনুরোধ করে, এই ব্যাগটা একটু কোলে রাখবেন?
লোকটি যেন আঁতকে ওঠে। তারপর বলে, ব্যাগটা তো ভেজা। তার ওপর প্রচণ্ড ভারি। না, আমি পারবো না। অর্জুন যেন ঠিক এই জবাবটাই আশা করেছিল। বাঁ পাশের লোকটির দিকে সে তাকায়। লোকটি ঘুমের ভাণ করে চোখ বুজে বসে আছে।
হঠাৎ কে যেন বলে ওঠে, ব্যাগটা আমায় দেবেন?
অর্জুন অবাক হয়ে তাকায়। তার সামনের লোকটির ডান পাশে বসে আছে ঠিক তারই বয়সী একটি ছেলে। প্রসন্ন একটা মুখ। অর্জুনের ব্যাগটাকে কোলে নেওয়ার জন্য সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুনিয়ায় এরকম মানুষও আছে তাহলে? অর্জুন কৃতজ্ঞ হয়ে দ্বিতীয় ব্যাগটি এগিয়ে দেয়। ছেলেটি ব্যাগটি কোলে নিয়ে কেমন যেন উদাসীন হয়ে যায়। শুধু কৌতূহলী দুটি চোখ দিয়ে মাঝেমাঝে অর্জুনকে দেখতে থাকে।
একই স্টেশনে ওরা নামে। এখানেও প্রবল বৃষ্টি। ছেলেটি জানতে চায়, অর্জুন কোথায় যাবে। শুনে বলে, সে একটা ট্যাক্সি নেবে। যাওয়ার পথে অর্জুনকে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবে। ছেলেটির কথা শুনে অর্জুনের আবারও মনে হয়, দুনিয়ায় এরকম মানুষও আছে তাহলে?
বড় রাস্তার পাশে ফুটপাথে একটা শেডের নিচে গিয়ে ওরা দাঁড়ায়। একটার পর একটা ট্যাক্সি চলে যাচ্ছে। কেমন যেন বেপরোয়াভাব তাদের। ওদের দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র করছে না। হঠাৎ একটা ফাঁকা ট্যাক্সি এগিয়ে আসে। কেমন যেন দয়ালু মনে হয় তাকে। ছেলেটি ট্যাক্সিটির দিকে এগিয়ে যায়। ট্যাক্সিটি কাছাকাছি এসে গেছে। ছেলেটি এবার সামনের জানলার আধখোলা কাঁচের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ ট্যাক্সিটি গতি বাড়িয়ে দেয়। আর নিমেষে দূরে অন্ধকারে উধাও হয়ে যায়।
ছেলেটি ফিরে আসে। মুখে কৌতুকের হাসি। বলে, দেখলেন তো ব্যাপারটা? এই হলো গিয়ে এখানকার অবস্থা…
ট্যাক্সি শেষপর্যন্ত পাওয়া যায়। ভেতরে ঢুকে বসে বহুক্ষণ পরে একটু স্বস্তিবোধ করে অর্জুন। এলিয়ে বসে সে। তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো…
দয়া করে ওটি জানাবেন না। ওটি বাদ দিয়ে আর যা কিছু বলতে চান বলুন, আমি ধন্য হয়ে যাবো…বলেই হো হো করে হেসে ওঠে সে।
অর্জুন একটু কৌতূহলী হয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে সে।
ছেলেটিই আবার কথা বলে, গতবার যখন এসেছিলাম, এই এক অবস্থা। আমার চতুর্থ দিদির শ্বশুরমশাইকে নিয়ে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। বেরোনোর সময় দেখি, প্রবল দুর্যোগ শুরু হয়েছে। ভদ্রলোককে বললাম, আপনি একটু বসুন। আমি এগিয়ে দেখি, যদি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায়। আমি তো বেরোলাম। তারপর হাঁটছি তো হাঁটছিই। একটা ট্যাক্সিরও দেখা নেই। হাত দেখালে কেউ থামে না। ফাঁকা ট্যাক্সিগুলো কাচ তুলে দরজা লক করে হুশহাশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মূল রাস্তায় ট্যাক্সি পাওয়ার আশা ছেড়ে এবার গলিঘুজি ধরলাম। ভাবলাম, এইসব অন্ধকার গলিতে অনেক সময় ফাঁকা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। একটা গলি থেকে আরেকটা গলিতে ঢুকছি, সেখান থেকে আবার আরেকটা গলিতে, আর এইভাবে যেন একটা গোলোকধাঁধার মধ্য দিয়ে পথ হাঁটছি। কিন্তু একটা ট্যাক্সিরও দেখা নেই। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে হাসপাতাল থেকে যে কতদূরে এসে পড়েছি, নিজেরই সে খেয়াল নেই। প্রতি মুহূর্তে ভাবছি, এই বুঝি ট্যাক্সি পেয়ে যাবো আর তখন হাসপাতাল পর্যন্ত ফিরে যেতে বেশি সময় লাগবে না। এদিকে বৃষ্টি কমে এসেছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ছাতা বন্ধ করেই হাঁটছি। এমন সময় ফোন। যার জন্য এতো খোঁজাখুঁজি, তিনিই ফোন করেছেন। আমার দেরি দেখে তিনি একাই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। আর তারপর বাড়িও পৌঁছে গেছেন। তাঁকে সাহায্য করতে গেছিলাম। শেষে মনে হলো, আমাকেই এবার কেউ সাহায্য করলে ভালো হয়। হাঁটতে হাঁটতে গোড়ালি খুলে আসার যোগাড়। একটা অন্ধকার চার মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে মনে হলো, হাউ হাউ করে কেঁদে উঠি…
গল্প শেষ করে ছেলেটি হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, এরকম অভিজ্ঞতা আপনারও আছে নিশ্চয়ই…
অর্জুন বললো, আমার বাড়ি এসে গেছে। আর আপনার বাড়িও তো বেশি দূরে নয়। বৃষ্টিও কমে এসেছে। একবার আমার বাড়িতে আসুন না, একটু চা খেয়ে যাবেন না হয়…
ইতিমধ্যে ছেলেটির নাম জানা গেছে। হেমাঙ্গ। হেমাঙ্গ হেসে বলল, ঠিক আছে, চলুন।
অর্জুন একটা পুরোনো বাড়ির দেড়তলার চিলেকোঠার ঘরে ভাড়া থাকে। এটাই তার ঠাঁই। একাই থাকে। মফঃস্বলে থাকে রিটায়ার্ড বাবা। মা নেই। বাবা এখনও মাসে কিছু কিছু করে টাকা পাঠান। সামান্য চাকরি করতেন। কতদিন পাঠাতে পারবেন, ঠিক নেই। তার আগেই একটা পাকাপোক্ত চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্জুনের ঘরে ঢোকার আগেই থমকে দাঁড়ায় হেমাঙ্গ। তিন কোণা একটি ঘর। যে দেয়ালটি সবচেয়ে চওড়া, তার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পরপর কয়েকটি কাগজের সারি। চৌকো ফর্মের মতো দেখতে সব কাগজ। নানা রঙের সেইসব কাগজ। কোনওটা সরু, কোনওটা মোটা, কোনওটা বাংলায়, কোনওটা ইংরাজিতে।
ওইরকম কাগজের সারি দিয়েই পাশাপাশি দু’টো টুল বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারই একটাতে বসলো হেমাঙ্গ। তারপর জানতে চাইল, এগুলো সব কী?
অর্জুন মৃদু হেসে বলল, চাকরির দরখাস্ত।
কী বলছেন আপনি? চমকে ওঠে হেমাঙ্গ। তারপর বলে, এত দরখাস্ত করেছেন আপনি?
হ্যাঁ, রোজই একটা করে করি।
তারপর?
তারপর আর কী! একটা করে জেরক্স রেখে খামে ভরে মূল দরখাস্তটি পাঠিয়ে দিই। তারপর অপেক্ষা…
সেই জেরক্সগুলো জমেই কী…
হ্যাঁ, সত্যিই আর রাখার জায়গা নেই।
কিন্তু এতে তো অনেক খরচ…
শুধু খরচ নয়, অনেক হ্যাঁপাও। এটা চাই, ওটা চাই…
আপনি তো দরখাস্ত করেন টাকা রোজগারের জন্য…
হ্যাঁ, এদেশে লোকে রোজগার করবে ভেবেই দরখাস্ত করে যায়। কিন্তু তার বদলে দিনের পর দিন তার এত খরচ হয়ে যায়…একদম দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার যোগাড়…
এ যে একেবারে লুঠের ব্যবস্থা… করুণভাবে হাসে অর্জুন।
হেমাঙ্গ বলে, গরিব ছেলেমেয়েগুলোকে লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে তাদের যেটুকু সম্বল, সেই যথাসর্বস্বও কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা…
অর্জুন বলে, বেশ লাভজনক ব্যবসা, তাই না? চাহিদা, শুধু চাহিদা তৈরি করে যাও। সেই ফাঁদে পা দিতে তৈরি দেশের কোটি কোটি ছেলেমেয়ে। শুধু একটু পা রাখার জায়গা। একটু শক্ত জমি। যাতে কোনওরকমে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে পারে! কিন্তু এই চাহিদা যেমন কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়, তেমনই অবিরাম জিইয়েও রাখা হয়। এই চাহিদা বন্ধ হয়ে গেলে কতবড় ব্যবসা একটা বন্ধ হয়ে যাবে, ভাবুন দেখি…
হেমাঙ্গ বলে, ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে আপনার এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না। আপনি একজন স্কলার, ইউনিভার্সিটিতে এত ভালো রেজাল্ট, আপনার এই হাল হবে কেন? সবার জন্য সমান ব্যবস্থা করা যাবে না ঠিকই, কিন্তু যে উপযুক্ত, সেও যদি কাজ করার সুযোগ না পায়, তবে তো দেশেরই ক্ষতি…
অর্জুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বলে, আপনার মতো করে আর কে ভাবে বলুন! বিশেষ করে দেশের লাভক্ষতির মতো বিষয় নিয়ে!
হেমাঙ্গ বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সারা ঘরে ছড়ানো অজস্র অজস্র ফর্মের দিকে। তারপর বলে, আপনি এগুলো রেখে দিয়েছেন কেন? ফেলে দিতেও তো পারেন?
না, ভাবি, যদি কোনও ডাক আসে। আসতেও তো পারে, তাই না?
ডাক! কিন্তু…কয়েকটা হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের দিকে তাকিয়ে হেমাঙ্গ বলে, ওগুলো তো দেখে খুব পুরনোই মনে হচ্ছে…
হ্যাঁ, খুবই পুরনো। দশ-পনেরো বছর আগেকার তো হবেই।
তাহলে? ওসব রেখে লাভ কী?
অর্জুন আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে, আপনি জানেন, আমার এক কাকা কুড়ি বছর বয়সে একটা চাকরির দরখাস্ত করেছিল। সেই চাকরির চিঠি আসে, যখন ওঁর পঞ্চাশ বছর বয়স। মানে, ত্রিশ বছর পরে। আমাদের দেশে ত্রিশটা বছর কোনও ব্যাপারই নয়। মানুষের আয়ুর কোনও দামই নেই এখানে…
হেমাঙ্গ ওঠে। তারপর বলে, চলি তাহলে। বেশ ভালো লাগলো আপনার এখানে এসে। কাল আবার খুব ভোরে উঠতে হবে।
অর্জুন অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কেন?
আসলে একটা সম্বন্ধ দেখতে যাওয়ার ব্যাপার আছে। আর একটা দিদি। পাঁচজনের বিয়ে হয়ে গেছে। অবশ্য বড় ভাগ্নি রয়েছে। তারপরই মুক্তি… বলেই মুক্তি যেন পেয়েই গেছে এমনভাবে লম্বা শ্বাস ছাড়লো হেমাঙ্গ।
অর্জুন অবাক হয়ে বলল, আপনার ছয় নম্বর দিদির জন্য? আপনি কী আপনার একের পর এক দিদির বিয়ে দিয়ে চলেছেন নাকি?
সে আর একদিন না হয় হবে! অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন তো কিছুদিন এখানে আছিই। আমার বাড়িতেই চলে আসুন না হয়। এই রোববার, বিকেলের দিকেই আসুন না, বেশ গল্প করা যাবে?
অর্জুন সানন্দে রাজি হয়ে গেল। হেমাঙ্গ গেট দিয়ে বেরিয়ে ভেজা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল। বৃষ্টি কমে এসেছে। ক্রমে দূরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সে।
ঘরে ফিরে অর্জুন হিসাব করে দেখলো, সেই রাতে তাকে মোট একত্রিশটি ফর্ম ফিলাপ করতে হবে। নানা ধরনের চাকরির ফর্ম। তার মধ্যে ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ান থেকে শুধু করে হোটেলের সাফাইকর্মী, গ্রামের লাইব্রেরিয়ান থেকে শুরু করে মফঃস্বল শহরের স্টেশনারি দোকানের হিসাবরক্ষক, ইত্যাদি নানারকম রয়েছে। এ মাসে বাবা সামান্য যে টাকা পাঠিয়েছেন, তার অনেকটাই খরচ হয়ে যাবে শুধু এই এক রাতের ফর্মের পিছনে। কিন্তু এভাবে ক’দিন চলতে পারে?
লাল, নীল, কালো, সবুজ ইত্যাদি নানা রঙের কালি দিয়ে ফর্মগুলো ফিল আপ করতে লাগলো অর্জুন। যত দিন যাচ্ছে ততোই এই ফর্মগুলো ভর্তি করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কতরকম যে তথ্য চায় ওরা। সাফাইকর্মীর কাজে হয়তো চাইছে এম এ পরীক্ষায় কত পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিল, সেই তথ্য। রাতের পাহারাদারের কাজের জন্য হয়তো ফর্মেই লিখে দিতে হবে মহাকাশবিজ্ঞানের ওপর একটা দীর্ঘ রচনা। ম্যাসাজ পার্লারের রিসেপসনিস্টের জন্য যে ফর্ম, সেখানে লিখতে হবে মুঘল সম্রাটদের সংক্ষিপ্ত জীবনী। সারাদিনের পরিশ্রমের পর অর্জুন লিখতে শুরু করে। তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। তবু সে লিখে যায়। লিখতে লিখতে হঠাৎ একসময় তার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। হঠাৎ তার মনে হয়, তাহলে ফিরে আসতে পেরেছি আজকে? কিভাবে যে পারলাম! তবু, পেরেছি তো!
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ত্রিশটি ফর্ম পোস্ট করে দিয়ে আসে অর্জুন। ভোর পাঁচটায় খুলে যায় এখানকার পোস্ট অফিস। অজস্র খাম জমা পড়তে থাকে। আর সেগুলো নিয়ে একটার পর একটা গাড়ি চলে যায় রেল স্টেশনের দিকে।
শুধু একটা ফর্ম নিজের হাতে জমা দিতে হবে। সেখানে পৌঁছে অর্জুন দেখে, দেড় মাইল লম্বা লাইন। দেখেই আঁতকে ওঠে সে। প্রকাশকের ওখানে সে পৌঁছবে কী করে? অন্তত বারোটার মধ্যে গিয়ে তাকে যে দোকান খুলতেই হবে! ওই সময় থেকেই ক্রেতা ও এজেন্টদের ভিড় শুরু হয়ে যায়। এক টাকার ক্ষতি হলেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাকেই! অতএব দেরি করলে চলবে না।
লাইনে সে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। অর্জুন ঠিক বুঝতে পারে না, কী করবে! হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে, এত কষ্ট কেন করছেন?
অর্জুন তাকিয়ে দেখল, হেমাঙ্গ। সে জানতে চাইল, আপনি?
হ্যাঁ, এই ফিরছি।
এর মধ্যেই ফিরছেন?
হ্যাঁ, সেই ভোর চারটেয় রওনা হয়েছিলাম যে! কিন্তু লাভের মধ্যে, শূন্য। পছন্দ হয়নি ওদের।
অর্জুন বলল, কেন?
কী বলি বলুন! ছবি দেখে বলল, নাকের ফুটো দুটো একটু ছোট। ভুরুতে লোমগুলো একটু বড় আর ফ্যাকাশে।চোখের পাতায় কয়েকটা চুল কম। চিবুকে টোল পড়ে না। আর চোখে চশমা আছে, যার ফ্রেমটা নাকি বেশ সেকেলে। এরপর নাকি পছন্দ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না!
অর্জুন একটু রেগে গিয়ে বলল, পাত্রটিকে দেখলেন?
না, সে তখন বাড়িতে ছিল না। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
তাই নাকি!
আর বলেন কেন! মন খারাপ করে ফিরছি। স্টেশনের দিকে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা ছোট নার্সিংহোমের গেট দিয়ে কাকে যেন গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হচ্ছে।
অর্জুন কৌতূহলী হয়ে বলল, তারপর?
মুখটা খুব চেনা চেনা লাগলো। একটু কাছে যেতেই বুঝলাম, এই ছেলেটিই ছিল সম্ভাব্য পাত্র। পকেট থেকে একবার ছবিটা বার করে মিলিয়েও নিলাম। ছেলেটা তখন প্যান্টের ধুলো ঝাড়ছে। ধাক্কা মেরে ওরা ওকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল।
তারপর?
কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? সে একটা করুণ হেসে বলল, তেমন কিছু নয়। আমি তবু জানতে চাইলাম, ঠিক কী ঘটেছে। ছেলেটি বলল, এরকম প্রায়ই হয়, এসব নিয়ে সে ভাবে না। চাকরিটা যে যায়নি, সে-ই তার অনেক ভাগ্য! আমি গলায় দরদ ঢেলে বললাম, এরকম প্রায় হয় কেন? সে বলল, এটা নির্ভর করে বসের মর্জির ওপর। তার নাইট ডিউটি ছিল। সারারাত জেগে সে টাইপ করেছে। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। আর তখনই একটা বানান ভুল হয়ে যায়। সেটা দেখেই বস সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান ডেকে বলেছে, একে এক্ষুনি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দাও। তবে সেইসঙ্গে এটাও বলে দিও, কাল নাইট ডিউটিতে যেন আবার ঠিক সময় আসে…
শুনে অর্জুন তাজ্জব বনে গেল। তারপর বলল, এরকমই ঘটে?
আরে ভাই, এর নামই তো চাকরি! একটু হেসে হেমাঙ্গ বলে, সেই জন্যই তো জিগ্যেস করলাম, এতো কষ্ট করছেন কেন? চাকরি যদি পানও, সুখী হবেন কী?
দারুণ একটা জরুরি কথা যেন মনে করিয়ে দিলো হেমাঙ্গ। সুখ! সত্যি, আজকের দিনেও কেউ সুখের কথা ভাবে নাকি? বারুদের ওপর বসে আছে সবাই। এরকম সময় সুখ নিয়ে ভাবাটা যেন নিছক বিলাসিতা!
যাওয়ার আগে হেমাঙ্গ বলে গেল, রোববার বিকেলে আসছেন তো?
অর্জুন বলল, চিন্তা করবেন না। আপনি ডেকেছেন, আমি যাবোই।
রোববার বিকেলে হেমাঙ্গর বাড়ি চিনে যেতে কোনও সমস্যাই হলো না। হেমাঙ্গ ওরই জন্য অপেক্ষায় ছিল। পুরনো আমলের ভাঙাচোরা একতলা বাড়ি। বাড়িটায় বহুদিন চুনকাম করা হয়নি। পুরোনো ইটগুলো যেন হাড়গোড় বের করে তাকিয়ে আছে। সামনে একফালি জমি, যা কখনই সাফসুতরো করা হয় না। তবু ঢোকার ঠিক মুখে সুন্দর একটা বারান্দা আছে। সেখানেই ওরা দু’জন বসলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জনের গল্প জমে উঠলো। হেমাঙ্গর হাতে ছিল একটা অ্যালবাম। প্রথম পাতাটা খুলে সে দেখাল, এই দেখুন, আমার বাবা-মায়ের ছবি।
মন দিয়ে ছবিটা দেখল অর্জুন। দেখলেই বোঝা যায়, ভালোমানুষ। অসম্ভব একটা সারল্যের ছাপ চেহারায়। অর্জুন বলেই ফেলল, খুব ভালো মানুষ ছিলেন, তাই না?
হেমাঙ্গর মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। তারপর সে বলল, না হলে সবাই এভাবে ওদের ঠকাতে পারতো? আমার বাবার একটা সোনার দোকান ছিল। যে ভাইকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে, সে-ই হাতিয়ে নিল সেই দোকান। বাবা-মা দু’জনের অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে। একে ভালোমানুষি ছাড়া আর কী বলবেন আপনি?
পাতা উল্টালো হেমাঙ্গ। পরের পৃষ্ঠায় অল্পবয়সি এক দম্পতির ছবি। হেমাঙ্গ বলল, আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। বাবা-মা চলে গেলেন। এই আমার বড়দি আর জামাইবাবু। এরাই আমাদের বাকি ভাই-বোনদের মানুষ করেছে। বড় ভাগ্নিকে রেখে এরাও অকালে চলে গেল…
অর্জুন বললো, দেখলেই বোঝা যায়, বড়ই ভালোমানুষ ছিল, তাই না?
হেমাঙ্গ বলে চললো, আমি আর আমার বড় ভাগ্নি পিঠোপিঠি। পাঁচ দিদি মিলে আমাদের মানুষ করেছে। খুবই সামান্য রোজগার। আর কত কষ্টই না করেছে! কেউ সেলাই করে, কেউ আয়ার কাজ করে, কেউ প্রাইভেট কোম্পানির এজেন্ট হয়ে, কেউ হোটেলের রিসেপসনিস্টের কাজ করে, আর কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে রান্না করে সংসার চালিয়েছে, আমাদের মানুষ করেছে। তখনই আমি ঠিক করি, এখানে আমি থাকবো না, যেভাবে হোক বাইরে চলে যাব, আর সুযোগও পেয়ে গেলাম, জাহাজের খালাসি হয়ে…
অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
হেমাঙ্গ বলে চলে, তারপর গত আট বছরে আমি চার বার দেশে ফিরে এসেছি। প্রতিবার এসেছি আর একজন করে দিদির বিয়ে দিয়ে ফিরে গেছি। আর একজন মাত্র দিদি। তারপর বড় ভাগ্নি। ব্যাস, আমার মুক্তি…
আপনার বয়স কত? হঠাৎ জানতে চায় অর্জুন।
হেমাঙ্গ নির্বিকারভাবে বলে, ত্রিশ।
অৰ্জুন বলে ওঠে, বলেন কী! ত্রিশ বছরে আপনি চার দিদির বিয়ে দিয়ে বসে আছেন?
হেমাঙ্গ অন্যমনস্কভাবে অ্যালবামের পাতাগুলো উল্টাতে থাকে। আর একটার পর একটা ছবি দেখাতে থাকে। মুখে বলতে থাকে, এই দেখুন, আমার দ্বিতীয় দিদির বিয়ে হচ্ছে। এখন ওর দু’টো বাচ্চা। ভালোই আছে।
নিজেই সে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, আমার জামাইবাবুর ব্যবসা আছে। দেখতে-শুনতেও মন্দ নয়। এবার এলে আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো।
হেমাঙ্গ একটু চুপ করে থাকে। তারপর পরের পাতা উল্টায়। বলে, এই দেখুন আমার তৃতীয় দিদির বিয়ে হচ্ছে। এই জামাইবাবু সরকারি চাকরি করে। এদেরও দু’টো বাচ্চা।
অর্জুন হেমাঙ্গর মুখের দিকে তাকায়। সে মুখে গভীর তৃপ্তির ছাপ। হেমাঙ্গ পরের পাতায় আসে। তারপর বলে, এই যে, আমার চতুর্থ দিদি। আমার দিদিদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেখতে একেই। কয়েকদিন আগেই মা হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে খুব আনন্দেই আছে।
হেমাঙ্গর মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আবার সে পৃষ্ঠা উল্টায়। তারপর দেখায়, আর এই আমার পঞ্চম দিদি। দেখুন, মুখটা কেমন খুশিতে ভরে আছে। আমি ঠিক এটাই চেয়েছিলাম। কতদিন জাহাজে একা একা শুয়ে ভাবতাম, ওদের মুখে ঠিক এইরকম হাসি ফুটে উঠেছে! এখন ও মা হওয়ার অপেক্ষায়। বিয়েগুলো খুব একটা খারাপ দিইনি বলুন?
হঠাৎ হেমাঙ্গ তাকায় অর্জুনের দিকে। অর্জুন সেই দৃষ্টির সামনে একটু সঙ্কোচই বোধ করে। তারপর বলে, চমৎকার বিয়ে দিয়েছেন আপনি।
হেমাঙ্গর দিদিরা একজনও সেই অর্থে সুন্দরী নয়। কিন্তু ওদের সবার মুখেই কী যেন একটা আছে! কী আছে? সে কী শুধুই সারল্য? আন্তরিকতা? মানুষ এতো দুর্ভোগের পরও জীবনকে নিয়ে এত সন্তুষ্ট থাকে কী করে?
ঠিক সেই সময় সামনের গেট দিয়ে ঢোকে দু’টি মেয়ে। অর্জুন দেখেই বুঝতে পারে, এরাই হেমাঙ্গর ষষ্ঠ দিদি এবং বড় ভাগ্নি। এই দিদিটি অস্বাভাবিক ফর্সা। আর একদম শ্রীহীন মুখ। বড় ভাগ্নিটির গায়ের রং ঘোর কালো। তার মুখেও সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটা নেই।
অর্জুন প্রথমটায় একটু অস্বস্তিই বোধ করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের আন্তরিকতায় একদম মুগ্ধ হয়ে যায়। দিদিটি চা করতে যায়। ভাগ্নি প্লেটে করে মিষ্টি আর সিঙারা সাজিয়ে নিয়ে আসে। আর হেমাঙ্গ অবিরাম শুধু ওদের দু’জনের কথাই বলে যেতে থাকে।
বিশেষ করে, বড় ভাগ্নির প্রতি ওর অফুরন্ত স্নেহ। মা-বাবা কেউ নেই মেয়েটার। সে নিজেই যেন সমস্ত অভাব ঢেকে দিতে চায়। বড় ভাগ্নির কোনও সাধই অপূর্ণ রাখতে চায় না সে। তার নানা আব্দার-আহ্লাদ মিটিয়েও সে কখনও ক্লান্তিবোধ করে না।
হেমাঙ্গ বলে, ওর যাতে টাকা-পয়সার কোনও অভাব না হয়, তার সব ব্যবস্থাই আমি করে রেখেছি। আমার এ টি এম কার্ড, ব্যাঙ্কের চেক বই সব ওর কাছেই থাকে। ওকে বলাই আছে, যখন যা দরকার হবে ও যেন তুলে নেয়…
তারপর একটু থেমে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে আবার সে বলে, দিদির বিয়েটার এবার যেন কোনও বন্দোবস্তই করতে পারছি না। কিন্তু আমি আশাবাদী। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি কী বলেন?
অর্জুন বলে, কিন্তু আপনার দিদির বিয়ে হলে আর আপনি জাহাজে চলে গেলে এখানে আপনার ভাগ্নি একা থাকবে কী করে?
হেমাঙ্গকে একটুও চিন্তিত দেখায় না। সে সপ্রতিভভাবেই বলে, সে যখন ওসব হবে তখন দেখা যাবে। আগে থেকে ভেবে লাভ কী? এখন দিদির বিয়েটাই আগে জরুরি। তারপর আমি ভাগ্নিকে নিয়ে ভাববো…
অর্জুন নিজের ঘরে ফিরে আসে। একটা অদ্ভুত ঘোর লাগা অবস্থা হয় ওর। সারারাত ভালো করে ঘুমোতে পারে না। একবার শোয়, একবার ওঠে। বারবার জানলার দিকে তাকিয়ে জেগে বসে থাকে। আকাশে আজ অনেক তারা। পরিষ্কার আকাশ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। নিজেকেই ফিসফিস করে বলে, ওঃ, কি বিপন্ন সব মানুষ!
সে আরও বলে, হেমাঙ্গ কী সুখী? আমি কী অসুখী? সুখ ও অসুখের তফাতটাই যেন তালগোল পাকিয়ে যায় তার কাছে!
সেদিন রাতেই অর্জুন স্বপ্ন দেখে, একটা ট্রামে চেপে হেমাঙ্গের সঙ্গে সে চলেছে। আর হেমাঙ্গ ফিসফিস করে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কী যেন বলে চলেছে। ট্রামটা কখনও নদীর ধার দিয়ে যাচ্ছে, কখনও সমুদ্রের ওপর একটা লম্বা সেতুর ঠিক মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছে আর সে মাথা গলিয়ে দেখছে নিচ দিয়ে যাওয়া একটি জাহাজকে, কখনও দিব্যি একটা ছোট গলির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, কখনও পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভেঙে ওঠা-নামা করছে, কখনও মরুভূমির ভিতর দিয়ে দু’পাশে দু’টো উটকে নিয়ে সমান তালে ছুটে চলেছে আর মাঝে মাঝে একেকটা বাড়ির সামনে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য থামছে। ঠিক ওই থামার মুহূর্তগুলোতেই হেমাঙ্গর মুখ হাসিতে ভরে উঠছে।
সে ফিসফিস করে বলছে, এই যে, এটাই আমার এক দিদির বাড়ি। কী, কেমন খুঁজে বার করেছি, বলুন!
অর্জুনের মুখও তখন হাসিতে ভরে উঠছে।
পরদিন ভোরবেলাই রাস্তায় বেরিয়ে এলো অর্জুন। সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। এখন একটু হেঁটে মনটাকে হালকা করতে চায় সে। আর তখনই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হেমাঙ্গর। সে-ও মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে। তারও সারারাত ঘুম হয়নি। হেমাঙ্গ অর্জুনকে দেখেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তারপর করুণ হেসে বলল, কাল আপনি চলে গেলেন ঠিকই। কিন্তু কে জানত একটু পরেই আবার ফিরে আসবেন আর সারা রাত আমার সঙ্গেই কাটিয়ে যাবেন?
অর্জুন অবাক হয়ে জানতে চাইল, মানে?
হেমাঙ্গ বলল, আর মানে! কাল সারা রাত ধরে আপনার সঙ্গে ট্রামে চেপে কত ঘুরলাম! আপনি একেকটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন আর আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন, এই যে এখান থেকে ফর্ম তুলেছি। অথবা, এই যে এখানেই ফর্ম জমা দিতে এসেছিলাম। চারদিকে পিলপিল করছে ছেলে-মেয়েরা। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। অতি সামান্য মাইনের সব চাকরি। আর সে-সব স্থায়ী চাকরিও নয়। যেখানে যেখানে যাচ্ছি, কী প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার প্রতিটা লোকের! অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েগুলোর প্রতি কোনই মায়াদয়াই নেই। একদম নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করছে। কেউ কেউ এমন ভাব করছে, যেন দয়া দেখাচ্ছে। কেউ আবার করুণার ভাব নিয়ে বসে আছে। আড়চোখে দেখছে, নিজেদের মধ্যে খোশগল্প করছে আর মাঝে মাঝে ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে নানারকম ঠাট্টা-টিটকিরি, এইসবই চালাচ্ছে। তবু ওইটুকু নিরাপত্তা পাওয়ার জন্যই কেমন সব পাগল হয়ে উঠেছে! একে অন্যকে ঠেলে এগিয়ে যেতে চাইছে। কেউ কাউকে গ্রাহ্যই করছে না। সবার মধ্যে কেমন যেন একটা মরিয়া ভাব! মানুষকে লোভ দেখিয়ে, বঞ্চনা করে, প্রতারণা করে, অমর্যাদা করে একেবারে গরু-ছাগলের স্তরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আমার তো মনে হচ্ছিল, গলায় যতো জোর আছে সব দিয়ে চেঁচিয়ে উঠি অথবা মুখ ঢেকে বসে পড়ি…
অর্জুন শুনতে শুনতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। তারপর বলল, আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম। আসলে…একটু ইতস্তত করে সে বলল, আপনিও ট্রামে চেপেই ঘুরলেন?
মানে? এবার হেমাঙ্গ অবাক।
অর্জুন নিজের স্বপ্নের কথা খুলে বলল। তারপর মৃদু হেসে জানতে চাইল, এটাই আমি বুঝতে পারছি না। ট্রামই কেন?
হেমাঙ্গ বলল, সত্যিই আশ্চর্যের! আর ট্রাম তো কতদিন চড়ি না! আপনার মনে আছে, আমাদের শৈশবে, কাছেই একটা ট্রাম ডিপো ছিল। তখন মাঝেমাঝেই আমরা ট্রামে চাপতাম। আর কী ভালোই না লাগতো সেই সময়…
মনে আছে! একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল অর্জুন।
সেই ট্রামগুলো কোথায় গেল?
বোধহয় ভ্যানিশ হয়ে গেছে সব…
ওঃ, হঠাৎ বলে উঠল হেমাঙ্গ, এবার বুঝেছি…
বুঝেছেন তাহলে?
হ্যাঁ…
অর্জুন বলল, তাহলে বিদায়।
হেমাঙ্গ বলল, আপনি শুধু নৈরাশ্যে ভোগেন। ট্রামগুলো সব জোট বেঁধে হামলা চালালো, আমাদের একে অপরের স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে খেয়ালখুশিতে যথেচ্ছাচার করলো আর অমনি বলে বসলেন, ‘বিদায়’! আপনি-আমি অত সহজে ভ্যানিশ হচ্ছি না… লড়াই চালাতেই হবে…
অর্জুনের হঠাৎ সেই বৃষ্টির দিনটার কথা মনে পড়ল। ওইদিন রাস্তায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকলেও কেউ অবাক হতো না। কিন্তু সে এখনও বেঁচে আছে। তাহলে কী হেমাঙ্গর কথাই সত্যি?
ট্রামগুলোর কথা হঠাৎ আবার তার মনে পড়লো। ওই ট্রামগুলোর মতোই একটা সময় একটু একটু করে মরে যাচ্ছে। স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। সেই সময়ের ভেতর যারা বেঁচে আছে, তারাও একটু একটু করে মরে যাচ্ছে। কিন্তু কারও কোনও হুঁশ নেই।
তবু হেমাঙ্গও তো আছে। এরকম মানুষের সঙ্গেও তো কখনও কখনও দেখা হয়ে যায়!
অর্জুন হেসে বলল, ঠিকই বলেছেন। আবার কখন আমাদের দেখা হচ্ছে?

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes