
রাহুল দাশগুপ্ত-এর কবিতাগুচ্ছ
অভিযান
ঈশ্বরের ছায়া শাদা
ঢেকে ছিল প্রীতিউপহারে
একটি নিপুণ শিশু
শুভেচ্ছার দিনলিপি খুলে
ভিতরে ঢুকেছে খুব
আর দেখে বিপুলা সে নদী
ঈশ্বরের ছায়া পড়ে
ভেসে গেছে দুধে ও পায়েসে
দিগন্তকরুণ সেই সাগরের মুখ থেকে
ফিরেছে সে বহুদূর
বজ্র যেথা খুলে গিয়ে পদ্মপাতে জমে আছে
একবিন্দু জল
খেলবে বলে এসেছিল
অথচ নিপুণ শিশু
ফিরে আসছে ভস্ম হয়ে
পুজোর আগুনে।
আত্মা
যারা বলেন আত্মাকে সংরক্ষণ করা উচিত
তাদের কলা দেখিয়ে
আমার বর্ধিত আত্মা
শরীরকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায়
অতিরিক্ত ছায়ার মতো…
আপনারা যারা জানেন না
তাদের অবগত করি–
প্রকৃত প্রস্তাবে আত্মা দেখতে
একটি হলুদ বেলুনের মতো
যার স্তনের মতো মস্তকটি
সর্বদাই আমার চুলের
অন্তিম ডগা অতিক্রম করে
অতিরিক্ত কিছু ছুঁতে চায়!
ফুলগাছ
শ্রাবণসম্পৃক্ত হাতে টবে একটি স্পষ্ট
ফুলগাছ পুঁতেছিলাম
পরদিন ভোরে দেখি
ফুলগাছটি ঘিরে একটি বাগান
তৃতীয় ভোরে দেখি
বাগানটি ঘিরে একটি গ্রাম
চতুর্থ ভোরে দেখি
গ্রামটি ঘিরে একটি আস্ত সভ্যতা!
সভ্যতার পরে কী আছে?
সংশয়ে শুতে গেছি রাতে,
ভোর ভোর উঠে দেখি
সভ্যতা, গ্রাম, বাগান কিচ্ছু নেই
সমস্ত জমিতে শুধু ছাই আর পোড়া গন্ধ
তবু তারই মাঝে সেই একা ফুলগাছ
একটুখানি মাথা তুলে
মৃদু মৃদু নাড়ছে, অস্পষ্ট, রহস্যময়…
রূপকথা
‘প্রতিটি শব্দ রক্তের ভিতর থেকে উচ্চারিত হোক’
এই ইচ্ছা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম…
একটু পরেই মনে হল শব্দের অনেক নীচে রয়ে গেছে রক্ত,
শব্দ ও রক্তের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অন্তহীন মিছিল
অনুচ্চারিত, বিনীত, স্পর্শহীন
অতঃপর উত্তাল শব্দগুলিকে শান্ত করে
রক্তের দিকে ঝুঁকতেই
লাল আস্তরণ উঠে একের পর এক ভাঙা ও আবেগহীন শব্দ
উন্মুক্ত হতে লাগল, মনে হল–
আরও অনেক নীচে টলমল করছে রক্ত
কীভাবে, কোন জাদুবলে, আত্মা–শব্দ–রক্তের এই
সমদূরত্ব রয়ে গেল না বুঝে
মনের ইচ্ছাকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলাম
আর সঙ্গে সঙ্গেই
রক্তে হাবুডুবু খেয়ে
ফোয়ারার মতো উঠে আসতে লাগল শব্দেরা…
যৌনতার পর
উঁচু উঁচু গাছগুলো পিষে দলে চলে গেছে প্রেত
নুয়ে আছে কারও মাথা, দ্বিখণ্ডিত কারোর শরীর
উদ্ধত শিশ্নের মুখ দানবের নখের আঘাতে
ছিন্ন হয়ে পড়ে যেন লঘুভার স্বপ্নের ভিতর
বনস্পতিহীন সেই খাঁ খাঁ করা বনের গভীরে
একটি অশুভ ছায়া ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে যায়।
নিশীথ আবহমান, মিশে থাকা ছায়ার বাতাসে
নির্ভার নির্জন এক সাধু বসে গোপন সন্ন্যাসে
হিমেও আড়াল নেই, ত্বক যেন প্রাচীন পাথর
অদ্ভুত শৈবাল মেখে ধ্যানমগ্ন শূন্যের সুবাসে
শূন্যেই উদ্ভূত ঘূর্ণি, স্পর্ধার পতন দলে পিষে
শিশুর কান্নার মতো ঘুরে ঘুরে গান হয়ে যায়।
উঁচু উঁচু গাছগুলো খাঁ খাঁ করা বনের ভিতর
স্মৃতির দূরত্ব পেয়ে শব্দহীন, বিলীন বাতাসে।
জিভ
সুবিধার নিচু দিক চেটে খায় আমার জিভেরা
গুহার ভিতরে কোনও বায়ু নেই, শুধু এক দমচাপা ঝড়
আছড়ে পড়বে সব ছিন্নভিন্ন করে দেবে সেই অপেক্ষায়
বসে থাকি, বাসি ফুল ইতস্তত পড়ে থাকে ছড়ানো ছিটানো
তার কোনও গন্ধ নেই, স্বাদ নেই, নেই কোনো স্মৃতির পাহারা
অপমান, শুধু এই। পুরোনো বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে আর
ভোরের কুয়াশা কোন ময়ূরের টুঁটি চেপে ধরে।
সুবিধার নিচু দিকে কখনও যায় না তার প্রাণ
শুশ্রূষার রাতগুলি নিভে গেছে দমকা বাতাসে
আমার জিভেরা শুধু পাক খায়, ভীরু, পলিমাটি মেখে আসে…
একদিন যে শহরে পেয়েছিনু মাথার আশ্রয়
তার আলো মুছে যায়, শুশ্রূষার শেষ চিহ্নগুলি
ঢেকে দিয়ে জলস্রোত নেমে যায় উৎরাই পথে।
ইস্পাততর্জনী ঝরে শব্দহীন বুকের ভিতর
বুক ঠেলে উঠে আসে আরও বুক, চুমুজল, ঢেউ
শহরের মোড়ে মোড়ে শিরা কেটে দেওয়াললিখন
সুবিধার নিচু দিকে গড়ে তোলা সাজানো বাগান।
তারপর জল বাড়ে লোলুপ জিভেরা নেমে আসে
বিপরীতদিকে ক্রমে, পড়ে থাকে উদাসীন পাতা।
তর্জনী মধ্যমা ঠেলে মাথা তোলে শত শত জিভ
শহরের মাটি ছেড়ে জল ভেঙে দূরে যেতে চায়…