যশোধরা রায়চৌধুরীর কবিতা
সংবাদ
কোথা থেকে যেন খুব উচ্চকন্ঠ দুঃসংবাদে বাতাস ভরায়
ওসব শেখানো হয়। ত্রাস পয়দা করা চাই প্রতিদিন সাড়ে তিন সের
কোথায় এখন খুব কান্না হয় বন্যা হয় ত্রাণ হয় বলে
তীব্র সাইরেন শব্দে স্তব্ধ পাড়া কেটে কেটে যায় বলে বুঝি
সের সের উচ্চকন্ঠ বিলি হয় বিক্রি হয় ভোর থেকে ঘোর রাত্রিতক
যন্ত্রের মাধ্যমে। শুধু মণ মণ পাষাণ জমে ওঠে এ হৃদয়ে
প্রতিরাতে এক মণ ভয়ত্রাস মাটিতে নামিয়ে শুতে যাই
অবসন্ন মনটিকে পাম্প মেরে হালকা করি রোজ
ইগোর ছিদ্রপথে হাওয়া ভরি বেলুন ফোলাই
আবার যদিও কোন নয়া ত্রাস এসে সেই বেলুনে ফুটিয়ে দেয় পিন
হাসি হাসি সেলফি দিই পিকচার পোস্টকার্ড ছবি দিই
প্রতিষেধ নয় তবু আত্মপ্রচার আর জাঁক
পরস্পর কাটাকাটি করে যাচ্ছে ক্রমাগত ভয় ও আমোদ
পরস্পরে শূন্য করে দিয়ে একটা রাত্রি নামছে বিষাদী ও খাক
দিনকাল
পথ আবিল, পথ ঊষর, অসহ পথ। পা ফেলছি ধীর, কাঁপা।
মাটি খুঁড়ছি – সুড়ঙ্গ এক – বিনিদ্র আর শ্বাসরোধী, দমচাপা।
খুঁড়ে চলছি মস্ত রাত। পেরোচ্ছে সব আমারই মত এক পৃথিবী লোক।
বছরব্যাপী একটি রাত। রাত্রিময়, ভোরবিহীন, কোষের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে শোক।
অ্যাম্বুলেন্স হাঁকার দেয়, কী কাৎরায় জীবন- হাঁপ ধরা
দেখে ফেলছি বিশ্বরূপ। মৃত্যুরূপ। ভেসে উঠছে দর্পণে কার ছায়া।
ঝরে পড়ছে পিতার প্রাণ। একপ্রয়াণ প্রজন্মের মায়া।
চিতা জ্বলছে দিগবিদিক। ধোঁয়া উঠছে আকাশপানে। বদ্ধপ্রাণ। তবু ভাবছি, পারি।
আমাকে ছুঁতে পারবে না সে। হারবে ঠিক , হারবে এই মারী।
কান্নাসমূহ
নিজের ভেতর থেকে খসে পড়ে যাওয়া নিজেকে দেখতে দেখতে কান্না পায়, লরি চলে যাচ্ছে দূরে – আমি সেই দুধেভাতে শিশুকন্যা, হাত থেকে খসে গেছে প্রিয় যে পুতুল, ন্যাকড়ার পুতুল, বুকে চেপে ধরা অথচ সবাই টেনে হিঁচড়ে আমাকে নিল চলন্ত লরিতে আর পিছে রয়ে গেল চোখ উপড়ে যাওয়া পুতুলের মায়া,
আত্মা খুলে খসে পড়া আমার এই… নিজেই নিজের থেকে নিরুপায় চলে যাওয়া, দেখে যাওয়া শুধু আমি নিজেকে কীভাবে ফেলে গেছি শুধু বারে বারে বিভিন্ন বাঁকে। এ এক নিরাশ্রয় এই এক উচ্ছিন্ন পরিবার, এই এক মায়াছেঁড়া দেশভাগ, বিভাজন , বুকের ভেতর দিয়ে দু ভাগ হয়েছে রাস্তা, আমি একদিকে আর অন্য দিকে আমার স্বজন। আর অন্য অন্য আমি। শুধু আমি।
কোনদিন ঠিক করে বেঁচে থাকা হল না এবং, দিনের আলোয় সব বিশ্ব আলো হয়ে থাকা শেষ হলে সন্ধেবেলা যেভাবে ঘরের আলো ভাস্বর হয়েছে আমি সেইভাবে জ্বলে থাকতে চেয়েছি দূরের জানলা হয়ে বহু মানুষের কাছে
আশ্রয় আমারো চাই এবং আমারো হওয়া চাই কারো কারো আশ্রয় কিন্তু কোনটাই আজো কেন যেন সম্ভব হল না
এখন কুড়িয়ে নেব খুচরো পয়সার মত নিজেকে এবং খুব জোরে হর্ন বেজে উঠলে ঝম ঝম বৃষ্টি পড়লে ভোঁতা এক শব্দের ভেতরে আমি ঘুম ভেঙে জেগে উঠি দেয়ালা করার মত কেঁপে কেঁপে, আর
আত্মাবিহীন এক শুকনো খোল লেগে আছে নিজের ভেতরে।
পা -ছাড়া জুতোর মত, জুতোর ফিতের মত। ছেঁড়া ও পরিত্যক্ত। খুবই চোরা পথ তবু এই ফিরে যাওয়া আজো সম্ভব এখন মনে হয়।
দীর্ঘ পরিশ্রান্ত পথ, এত এত ভাঙা, বোমা পড়ে পড়ে উড়ে যাওয়া রাস্তার পাথর নুড়ি ঘেঁটে আর হেঁটে যদি ফিরে যেতে পারি চিহ্ন ধরে ধরে আবার নিজের কাছে কোনদিন
শান্ত ছায়ার মত অতীতে ফেরার আত্মরতি নয়, ভবিষ্যতের দিকে রাখা আছে আমাদের প্রশমন, ছিঁড়ে নেওয়া বুভুক্ষিত দেশভাগের অন্য প্রতিষেধ কোন, অপর মলম।
নতুন জন্মের মত , আশাআকাঙ্ক্ষার মত, যেখানে তথ্যের এই ক্রুর ভেঙে পড়া নেই, মাথার ওপরে এই চাপ চাপ অন্ধকার তত্ত্বের , টুকরোজানা, খুচরোপাপের মত জ্ঞান নেই… শুধু আছে শ্রবণ, লবণ।
দিন সেইদিকে যাচ্ছে আমি শুধু নিজের ভেতর থেকে খসে পড়া নিজেকেই নিতে নিতে চলে যাব, পুতুলের খোলা চোখ না পেলেও খুঁজে নেব একাকী বোতাম আর সুতো সূচে পরিয়েই হাতে হাতে জুড়ে নেব উচ্ছিন্ন সময়।
সবচেয়ে ভালো লাগল ‘কান্নাসমূহ’।
অনেক ধন্যবাদ
বাঃ! খুব ভালো লাগল। প্রত্যেকটি কবিতাই। নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিলে গেল।
তিনটিই ভালো লেগেছে। তবে কান্নাসমূহ অসাধারণ!
অনেক ধন্যবাদ
দমচাপা এই সময়ের কবিতা… পাঠককে সরাসরি ছুঁয়ে যায়..অসাধারণ!
কবিতাগুলি অবশ্যই বিষাদী ও খাক, কিন্তু তার মধ্যেই জেগে রয়েছে উচ্ছিন্ন সময়কে হাতে হাতে জুড়ে নেবার গোপন প্রতিজ্ঞা। সময়ের দলিল এরা, তবু নিখুঁত কবিতাও।