মেডিসিনে নারীর প্রবেশ এবং মেডিক্যাল কলেজে কাদম্বিনী <br />জয়ন্ত ভট্টাচার্য

মেডিসিনে নারীর প্রবেশ এবং মেডিক্যাল কলেজে কাদম্বিনী
জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 

৭ জুন, ১৮৬৭ সালে স্বয়ং ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল লেখেন – “in the Medical College Hospital at Calcutta, where it was founded, the Eurasian women who before would not lay their hands to anything, when they saw the Englishwomen doing it, began to do it too. And the Eurasian matron and Eurasian nurses make a very tidy staff now at Calcutta Medical College Hospital.” (Florence Nightingale on health in India, ed. Gerard Vallee and Lynn McDonald, 2006, পৃঃ ৯৫৬) সহজ কথা হল, হয় নতুন মহিলাদের নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক কিংবা শহুরে না গ্রামীণ ধাইদের প্রশিক্ষিত করা হোক। অর্থাৎ ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মতো ব্যক্তিত্বের তরফেও মেডিক্যাল কলেজে নার্সিং ট্রেনিং চালু করার একটি পরোক্ষ চাপ ছিল।

এরকম এক পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৭০ সালে সরকারের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ভারতীয় মহিলাদের নার্স হিসেবে প্রশিক্ষিত করার জন্য মেডিক্যাল কলেজে ক্লাস নেওয়া হবে। ১৮৭১ সালে ১০ জন ট্রেনিং-এর জন্য যোগদান করে। পরীক্ষায় ৪ জন পাস করে, একজন প্রশংসনীয় কাজ করে। (Centenary, পৃঃ ৪৬) মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষাক্রমে আরেকটি নতুন শাখা প্রসারিত হল শুধু তাই নয়, মহিলাদের প্রশিক্ষিত করার জন্য মেডিক্যাল কলেজের অন্দরমহল অবারিত হল।

“Initially, twelve women were enrolled for a one-year training course. As usual, concern was expressed that all women selected for the course should be “respectable.” Special purdah arrangements were considered necessary to attract such women, and extra vigilance was required to deter those of “bad repute.” (Meredith Borthwick, The Changing Role of Women in Bengal: 1849-1905, 1984, পৃঃ ৩২৭) ১৮৭৯ সালে শ্রীমতী জে এল ঘোষ এবং শ্রীমতী টি এম রায় ব্রাহ্ম পাবলিক ওপিনিওন পত্রিকায় (৭ আগস্ট, ১৮৭৯) এঁরা যে ১০৩ কলেজ স্ট্রিটে প্র্যাকটিস করছেন সে ব্যাপারে বিজ্ঞাপন দেন “midwives, holding diploma of the Calcutta Medical College Hospital”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২৭)

এ বিজ্ঞাপন থেকে অনুমান করা যায়, সেসময়ে সম্পন্ন গৃহে প্রশিক্ষিত দাইদের চাহিদা তৈরি হচ্ছিল। একইসঙ্গে প্রশিক্ষিত দাইদের কাজে নিযুক্ত হবার উপযুক্ত একটি মানসিকতরাও জন্ম হচ্ছিল, অনুমান করা যায়। শিক্ষা জুড়তে শুরু করল বাজারের সাথে, আয়ের নতুন উৎস হিসেবে। এক নতুন সমীকরণ তৈরি হল – মেডিক্যাল কলেজে আধুনিক ধাত্রীবিদ্যার শিক্ষা > সামাজিকভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রসবের আকাঙ্খা, অন্তত সমাজের ওপরতলার শিক্ষিত সমাজের মাঝে > হিন্দু সমাজের অন্তঃপুরে পুরুষ চিকিৎসকের প্রবেশাধিকার > সমাজের সাধারণ দাইদের প্রশিক্ষিত দাই করে গড়ে তোলা > তৈরি-হওয়া নতুন “মেডিক্যাল বাজার”-এ এদের চাহিদা > এর জন্য নতুন পত্রিকা এবং পুস্তকের প্রকাশ > সর্বোপরি সমাজের সব প্রান্তে ইউরোপীয় ধারণার বিস্তার। বইয়েরও নতুন বাজার তৈরি হল।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, GRPI-এ (General Report on Public Instruction), বিশেষ করে ১৮৭০-৭১ সাল থেকে, “ফিমেল এডুকেশন” নিয়ে রিপোর্টে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হচ্ছে। প্রধানত তিনটি স্তরে নারী শিক্ষার কথা বলা হচ্ছিল – প্রথম, পাঠশালা শিক্ষা; দ্বিতীয়, স্কুল শিক্ষা – নর্ম্যাল স্কুলে, জাতীয়তাবাদী স্কুলে বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি স্কুলে; তৃতীয়, কলেজে শিক্ষা। পরবর্তী ধাপে বিশবিদ্যালয় শিক্ষাও যুক্ত হয়। নারীদের মেডিক্যাল শিক্ষা আরও পরে শিক্ষাকাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৮৭৫-৭৬ সালের রিপোর্টে বলা হয়, বাংলায় ৫টি মেডিক্যাল স্কুল আছে – ইংলিশ এবং অ্যাপ্রেন্টিস ক্লাসের জন্য ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গলি ক্লাসের জন্য ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল, মিলিটারি ক্লাসের জন্য টেম্পল মেডিক্যাল স্কুল (বাঁকিপুর,পাটনা), ঢাকা মেডিক্যাল স্কুল এবং কটক মেডিক্যাল স্কুল। সম্ভবত ১৮৭৫-৭৬ সালে বিহার এবং উড়িষ্যা প্রশাসনিকভাবে বাংলার অন্তর্গত ছিল। এজন্য ওখানকার মেডিক্যাল স্কুলগুলোকেও বাংলার বলা হয়েছে।

মেডিক্যাল কলেজে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি প্রবেশ করলেন, পাশ করলেন এবং নারীদের মেডিক্যাল শিক্ষার পথ প্রশস্ত করলেন – এগুলো ইতিহাসের ঘটনা। কিংবা চন্দ্রমুখী বসু, অবলা বসু, সরলা দাস বা শ্রীমতী ডি’আব্রু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হলেন অথবা বাংলার বাইরে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গিয়ে ইতিহাস তৈরি করলেন – এ ঘটনাগুলোও এখন স্কুলপাঠ্য বিষয়। কিন্তু উপনিবেশিক ভারতে এ ইতিহাস গড়ে উঠল কিভাবে, সে ইতিহাস আমাদের কম জানা। এখানে পরস্পরসংযুক্ত একাধিক বিষয় একসঙ্গে কাজ করেছে – (১) ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক বোধের প্রতিসৃত (refracted) প্রবেশ ঘটেছে বাংলার তথা ভারতের ওপরতলার “আলোকপ্রাপ্ত” শিক্ষিত মানুষের মাঝে, (২) সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্থিত ব্যক্তি মানুষের বৈশিষ্ট্য ও উপস্থিতি অনুঘটক হিসেবে সামগ্রিক বিষয়কে ত্বরাণ্বিত করেছে, (৩) ঐতিহাসিক সমাপতন হিসেবে ইংল্যান্ডের কয়েকজন বিশিষ্ট নারী ১৮৬০-৭০-এর দশকেই বাংলার নারীদের নিয়ে তাঁদের কার্যকলাপ প্রসারিত করেছেন, এবং, সর্বোপরি, (৪) কলকাতার ব্রাহ্ম সমাজের একাংশ “pressure group” হিসেবে সমাজের অভ্যন্তর থেকে চাপ তৈরি করে এ ইতিহাসকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে।

১৮৬০ থেকে ১৮৮০-র দশক জুড়ে এরকম বিভিন্ন স্তরায়িত পারম্পর্যপূর্ণ ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে সমাপতিত হয়েছে। একে কেবলমাত্র ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলন বা প্রগতিপন্থী ইংরেজদের উদারতা এরকম দ্বিত্ত্বতায় দেখা সম্ভবত কালের বিচারে অনুচিত। এ ধরণের কোন সমসত্ত্ব (homogeneous) কার্য-কারণ সম্পর্কও এর মাঝে ছিলনা। ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা একসঙ্গে জুড়ে গেছে। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা আলাদা করে সামনে এসেছে – ইতিহাস লিখেছে সে কথা। এবার আমাদের জানার সময় এসেছে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক এবং ভারতবেত্তা জেমস মিল ১০ খণ্ডে সুবিপুল ভারতবর্ষের ইতিহাস (The History of British India) লিখলেন। ১৮১৭ সালে প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ১৮৫৮ সালে আরেক যশস্বী ভারততত্ত্ববিদ হোরেস হেম্যান উইলসনের সম্পাদনায় সবগুলো খণ্ড নতুন করে প্রকাশিত হয়। আমি ১৮৫৮ সালের সংস্করণটিকে ব্যবহার করেছি। মিল লিখেছিলেন – “The condition of the women is one of the most remarkable circumstances in the manners of nations. Among rude people, the women are generally degraded; among civilized people they are exalted … A state of dependence more strict and humiliating than that which is ordained for the weaker sex among the Hindus cannot easily be conceived.” (The History of British India, 1858, Vol. I, পৃঃ ৩০৯-৩১০)

সহজ করে বললে, মিলের মতে, সমাজে নারীর অবস্থান সভ্যতার মানদণ্ড বোঝায়। এক্ষেত্রে, মিলের ধারণানুযায়ী,  নারীদের অধঃপতিত অবস্থানের কারণে সভ্যতার মাপকাঠিতে ভারতের স্থান “সিভিলাইজড পিপল”দের অনেক নীচে। ১৮১৭ সালের প্রতিনিধিত্বকারী এরকম ধারণা ভারতকে বোঝার একটি “entry point” ছিল। এরপরে ইংরেজ শাসনকর্তাদের মাঝে কিছু বিশেষ পরিবর্তন যেমন আসে তেমনি ইংরেজি শিক্ষা ও প্রশাসনিকতার অভিঘাতে শিক্ষিত বাঙালি এবং ভারতীয়দের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গীরও পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু মিলের বলা কথার তাৎপর্য দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় নারী সম্পর্কে ব্রিটিশ অবস্থানকে প্রভাবিত করেছে। তবে সেসময়ে খোদ ইংল্যান্ডে যে নারীর সামাজিক অবস্থান খুব উজ্জ্বল ছিল এমনটা কিন্তু নয়।

ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারছি – “The legislative side of the British regulation of medicine, on the other hand, was a retarding factor. The Medical Act of 1858 stipulated that no foreign degree would qualify anyone for the medical register. Until the 1870s, all the medical doctorates won by women were foreign. Only in 1876, with the Russell Gurney Enabling Act, were women assured of medical legitimacy.” (Johanna Geyer-Kordesch, “Women in Medicine”, in Companion Encyclopedia of the History of Medicine, ed. W. F Bynum and Roy Porter, Vol. 2, 1997, পৃঃ ৮৯৮) অর্থাৎ, ১৮৭০ সাল পর্যন্ত নারীদের মেডিক্যাল প্র্যাকটিস করার অনুমতি ছিলনা। তাদেরকে বিদেশী বলে ধরা হত – খোদ ব্রিটেনে। ১৮৭৬-এর নতুন অ্যাক্টের পরে প্র্যাকটিস করার অধিকার পায়।

১৮৭৪ সালে প্রথম London School of Medicine for Women (LSMW) তৈরি হয়। এলিজাবেথ গ্যারেট অ্যান্ডারসন ইংল্যান্ডের প্রথম মহিলা মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট। তবে পাস করেছিলেন জুরিখ থেকে, ইংল্যান্ডে অনুমতি ছিলনা। তিনি এই স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে Isabel Thorne, Edith Pechey, Matilda Chaplin, Helen Evans, Mary Anderson, এবং Emily Bovell হলেন এডিনবরা থেকে পাস করা প্রথম ৬ জন ব্রিটিশ মহিলা ডাক্তার। (Bryan Christie, “First women to study medicine in the UK are honoured”, British Medical Journal, 2019; 365: l1635)

সাধারণ্যে গৃহীত “র‍্যাডিকাল” ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে মেয়েদের মেডিক্যাল শিক্ষার অনুমতি মেলে ১৮৭৮ সালে – “One of the special glories of the University of London is that it was the first British university to award degrees to women. In 1878 sex discrimination in the examinations was ended, and the first women graduates were produced in 1880. By contrast, women were not permitted to graduate at Oxford until 1920, or at Cambridge until 1923.” (N. B. Harte, The University of London, 1836-1986: An Illustrated History, 1896, পৃঃ ২৫),

আরেকটি ঐতিহাসিক তথ্য হল – “Inspired by Elizabeth Garrett, Sophia Jex-Blake, who had failed in her attempt to achieve admittance of women to the medical school in Edinburgh, founded the London Medical School for Women in 1874. Although initially no hospital or examining body would accept their students, in 1877 the Royal Free Hospital accepted their students for clinical work, and in the following year the university opened all its faculties to women, becoming the first university in Great Britain to grant medical degrees to women, though it was not until the late 1940s that all the medical schools in London opened their doors to women.” (F.M.L. Thompson, ed. The University of London and the World of Learning, 1836-1986, 2003, পৃঃ ১৩৬)

ঐতিহাসিকভাবে, এর আগে কেমব্রিজে মহিলাদের শিক্ষার জন্য Girton College খোলা হয়েছিল ১৮৬৯ সালে। কিন্তু মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য নয়। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য – Ray Strachey, The Cause; a Short History of the Women’s Movement in Great Britain। অর্থাৎ, ১৮৮০ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েটরা পাস করে বেরোলেন। ১৯২০-র আগে অক্সফোর্ড এবং ১৯২৩-এর আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় মহিলাদের গ্র্যাজুয়েট হবার অনুমতি দেয়নি।

এখানে একাধিক নজর করার মতো বিষয় রয়েছে – (১) ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পরে প্যারিসের হাসপাতালগুলোতে অন্তত ২০০০ বছরের মেডিসিনের ইতিহাসকে অতিক্রম করে মেডিসিনের নতুন অধ্যায় “হসপিটাল মেডিসিন”-এর সূচনা হয়েছিল ৩টি স্তম্ভের ওপরে দাঁড়িয়ে (বেড সাইড পরীক্ষা, পোস্টমর্টেম, এবং চিকিৎসার পরিসংখ্যান তৈরি করা) উনবিংশ শতকের প্রথম ২৫ বছরের মধ্যে। ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ১৮৩৫ সালে ঐতিহাসিক কোন রূপান্তর ব্যতিরেকেই মেডিসিনের এই অধ্যায়ের সূচনা এবং সফল কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ভারতে আধুনিক মেডিসিনের দ্বারোদ্ঘাটনই হল “হসপিটাল মেডিসিন”-এর মধ্য দিয়ে। (২) যে শবব্যবছেদকে (এবং পরবর্তীতে ল্যাবরেটরি-নির্ভর মেডিসিনের চর্চা) মেডিসিনের আধুনিক হবার ভিত্তি ধরা হয়, ১৮৩৬ সালের প্রাথমিক জাড্য কাটিয়ে উঠে মেডিক্যাল কলেজে ইউরোপের যে কোন মেডিক্যাল স্কুলের চেয়ে বেশি ডিসেকশন হত এবং, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে, ছাত্রদের অ্যানাটমির জ্ঞান ইউরোপের স্কুলগুলোর ছাত্রদের তুল্য বা অধিক বলে মনে করা হত। (৩) শতাধিক বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডে মহিলাদের মেডিক্যাল শিক্ষার অধিকার এবং সুযোগ প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৭৮ সালে।  ইউরোপ-আমেরিকা তুল্য কোন সামাজিক অভিঘাত ছাড়া ভারতের ক্ষেত্রে সে ঘটনা প্রথম ঘটে মাদ্রাজে ১৮৭৫ সালে এবং ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ১৮৮৩ সালে। যদিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল ১৮৭৮ সালেই।

কোন দীর্ঘস্থায়ী সমাজ বিপ্লব/আন্দোলন কিংবা সমাজের নীচের তলা অব্দি আলোড়িত/মন্থিত (churned) না হয়ে এক নতুন ধরণের “engrafted” আধুনিকতার সবল সূচনা হল বাংলা তথা ভারতবর্ষে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

একটু বিষয়ান্তরে গিয়ে আমরা ১৮৭৮-৭৯ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনিটস-এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেখে নিই, যা আমাদের পরবর্তী আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয়।

২৭ এপ্রিল, ১৮৭৮-এ সেনেট মিটিংয়ে কয়েকটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল –

(১) “Female candidates shall be allowed to take up the subjects prescribed by the University of Calcutta for the B. A. Course, with the option of substituting French, German, Italian, or an Indian vernacular for the second language.”

(2) “Female candidates shall also be allowed to substitute Political Economy for the mathematical subjects in this examination.” (University of Calcutta: Minutes for the Year 1878-1879, ১৮৭৯, পৃঃ ৩)

এখানে লক্ষ্যণীয় যে মেয়েদের ক্ষেত্রে অংকের বদলে পলিটিক্যাল ইকনোমি নেবার সুযোগ থাকছে। এটা কি এরকম কোন ধরে-নেওয়া ইঙ্গিত বহন করে যে মেয়েরা অংকে স্বভাবতই দুর্বল যেজন্য তাদের ক্ষেত্রে পলিটিক্যাল ইকনোমি নেবার ব্যবস্থা থাকল?

সেনেটের মিটিংয়ে সরকারিভাবে প্রথমবারের জন্য নথিবদ্ধ হল মহিলাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বিষয়টি। এর অনেক আগে, ১৮৪৮-৪৯ সাল থেকে, নারীশিক্ষার প্রসঙ্গ বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাসংক্রান্ত আলোচনায় উঠে এসেছে। বেথুন তো ছিলেনই, এছাড়াও লর্ড ডালহৌসি ১ এপ্রিল, ১৮৫০-এ “নেটিভ ফিমেল এডুকেশন” নিয়ে ইতিবাচক মতামত দেন। (J. A. Richey, Selections from Educational Records, Part II, 1840-1859, 1922, পৃঃ ৫৬)

১৮৭৯ সালের ১৫ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের মিটিংয়ে ভাইস চ্যান্সেলর Alexander Arbuthnot বলেন – “I refer to the fact of the Senate having passed rules for the examination of female candidates, under the operation of which one Hindu young lady, educated at the Bethune School, passed the Entrance Examination with great credit. The young lady to whom I refer, Kadambini Bosu, obtained very high marks in Bengali, very tolerable marks in history; and even in the exact sciences – a subject which is not usually considered to be congenial to the female intellect – she acquitted herself very creditably.” মাত্র ১ নম্বরের জন্য তাঁর প্রথম বিভাগে পাশ করা হাতছাড়া হয়। (University of Calcutta – Minutes for the Year 1878-79, পৃঃ ১১০) ১৯ এপ্রিল, ১৮৭৯-র মিটিংয়ে মহিলা পরীক্ষার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল – (১) “একটি পৃথক স্থানে মহিলাদের তত্ত্বাবধানে মহিলা পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হবে। (২) পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই পরীক্ষার ফি একই থাকবে। (৩) অকৃতকার্য পরীক্ষার্থী জমা দেওয়া ফি ফেরত পাবেনা। (৪) মহিলা এবং পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই এন্ট্রান্স পরীক্ষা একই হবে। (৫) অংকের পরিবর্তে মহিলারা বোটানি নিতে পারবে।” (Minutes for the Year 1878-1879, ১৮৭৯, পৃঃ ১৪৭)

এখানেও ধরে নেওয়া হচ্ছে যে মেধার ক্ষেত্রে মহিলা এবং পুরুষ একই সারিতে নেই। অংকের জন্য যেহেতু সবল  মস্তিষ্ক প্রয়োজন সেজন্য তুলনায় দুর্বলতর সাবজেক্ট বোটানিকে বেছে নেবার সুযোগ রাখা হল মহিলাদের জন্য

যাহোক, আমরা এ লেখার শুরুতে উল্লেখিত মিল সাহেবের লেখায় ফিরে যাই। ১৮১৭ সালে জেমস মিল যখন ভারতবর্ষে নারীদের অবজ্ঞাজনক অবস্থান নিয়ে কথা বলছেন প্রায় সমকালে ১৮২২ সালে গৌরমোহন বিদ্যালংকার নারী শিক্ষা বিস্তারের অভিপ্রায়ে লিখলেন স্ত্রী শিক্ষাবিধায়ক পুস্তিকা (এই পুস্তকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাধাকান্ত দেব।) যদিও ভাবার মতো এরকম কোন তথ্য আমাদের হাতে নেই যে গৌরমোহন মিলের লেখা ইতিহাস বই পড়েছিলেন। ১৮২২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে ১৮২৪ সালে পুস্তিকাটির ৩য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। আমি এই সংস্করণটি ব্যবহার করেছি। এর থেকে বোঝা যায় পুস্তিকাটি শিক্ষিতমহলে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পুস্তিকাটি দুজন নারীর মধ্যে কথোপকথন ছলে লেখা।

পুস্তিকাতে বলা হল – “কিন্তু প্রথম ইং ১৮২০ শালের জুন মাসে শ্রীযুত সাহেব লোকেরা এই কলিকাতায় নন্দন বাগানে যুবনাইল (juvenile) পাঠশাল নামে এক পাঠশালা করিলেন, তাহাতে আগে কোন কন্যা পড়িতে স্বীকার করিয়াছিল না, এই ক্ষণে এই কলিকাতায় প্রায় পঞ্চাশটা স্ত্রী পাঠশালা হইয়াছে। তাহাতে প্রত্যেক পাঠশালায় ন্যূন সংখ্যাতে ১৬ জন কন্যা গণনা করিলে ও ৮০০ কন্যার শিক্ষা হইতেছে, ইহাতে কাহার ও কিছু ক্ষতি কিম্বা অখ্যাতি হয় নাই।” (স্ত্রী শিক্ষাবিধায়ক, ১৮২৪, পৃঃ ৯-১০) আরও বলা হল – “স্ত্রীলোক যদি বিদ্যা অভ্যাস করে, তবে পুরুষাপেক্ষা অতিশীঘ্র বিদ্যাবতী হয়। অতএব তাহারদিগকে যেমন ঘরের কার্য্যাদি শিক্ষা করাণ তেমন বালককালে যাবৎ বয়স্থা না হয় তাবৎ বিদ্যাশিক্ষা করাণ উচিত হয়।” (পৃঃ ৩৯) এবং মেয়েরা যে দ্রুত শিক্ষা আয়ত্ব করছে এ কথাও জোর দিয়ে বলা হয়। (পৃঃ ৩৮)

প্রাথমিকভাবে যাঁরা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন সেসময়ের একমাত্র মহিলাদের কলেজ বেথুন কলেজের ছাত্রী। ২০ নভেম্বর, ১৮৬৬ সালে মেরি কার্পেন্টার ভারতে এলে নারীশিক্ষার ব্যাপারে গতির সঞ্চার হয়। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, মনমোহন ঘোষ এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনার পরে পরামর্শ দেন “of opening up a non-denominational normal school in the metropolis.” (রচনা চক্রবর্তী, “Women’s Education and Empowerment in Colonial Bengal”, in Responding to the West: Essays on Colonial Domination, and Asian Agency, ed., Hans Hagerdal, পৃঃ ৯২)

কেমব্রিজের Girton College-এর প্রথম ব্যাচের ছাত্রীদের একজন অ্যানেট অ্যাকরয়েড (Annette Akroyd) কলকাতায় আসেন ১৮৭০ সালে এবং কলকাতায় নারীশিক্ষা নিয়ে সদর্থক পদক্ষেপ নেন। তাঁর সুযোগ্য এবং পরিশ্রমী সহযোগী ছিলেন অবলাবান্ধব পত্রিকার সম্পাদক ও নারীশিক্ষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ প্রচারক এবং সংগঠক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি (যাঁর সাথে পরবর্তীকালে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন)। (Kamal K. Mishra, History of Brahmo Samaj: Adi Brahmo Samaj, 1957, পৃঃ ১৬৪-১৬৫)

অ্যাকরয়েড কলকাতায় এসে ১৮৭৩ সালে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় নামে একটি বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। (গোলাম মুরশিদ, সংকোচের বিহ্বলতা – আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণীর প্রতিক্রিয়া, ১৮৪৯-১৯০৫, ১৯৮৫, পৃঃ ১৩৫) পরবর্তীতে এই বিদ্যালয়ের নাম হয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় এবং বেথুন স্কুলের সাথে জুড়ে গিয়ে বেথুন কলেজে রূপান্তরিত হয়। মেরেডিথ বর্থউইক মন্তব্য করেছেন – “In Abalabandhab, a women’s journal run by the progressive Brahmos who had managed the Banga Mahila Bidyalaya, Girton College was again held up as the model for the education to be given at Bethune School.” (Meredith Borthwick, The Changing Role of Women in Bengal, 1849-1905, 1984, পৃঃ ৯৫)

মুরশিদ আরও জানাচ্ছেন যে অ্যাকরয়েডের এই স্কুল প্রতিষ্ঠা কলকাতার রক্ষণশীল সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি করেছিল দুটি কারণে – (১) ছাত্রীরা খুব সম্ভবত পাশ্চাত্য পোষাক পরবে, এবং (২) ছুরি-কাঁটা দিয়ে খাবে। মুরশিদের মন্তব্য – “যদিওছুরি-কাঁটা দিয়ে খাওয়ায় ছাত্রীদের নারীসুলভ গুণাবলী বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় নি।” (মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩৫)

 

(স্কুলের ছাত্রীদের পোষাক লক্ষ্যণীয়। ছবিটি সংগৃহীত হয়েছে Lord Bevridge-এর India Called Them (1947), পৃঃ ১১৮, থেকে)

এখানে লক্ষ্যণীয়, সে সময়কালে নারীশিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে নারীদের আদবকায়দা, রুচি, সামাজিকভাবে আত্মপ্রকাশের ধরণ, সাজপোষাকের মতো বিভিন্ন অনুষঙ্গ বদলে যেতে শুরু করল। “বাঙালি বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই বাঙালি মহিলাদের পোশাক কিভাবে উন্নত করা যায়, সে নিয়ে ১৮৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিতর্ক চলতে থাকে।” (মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২০৯)

শিক্ষাগ্রহণ শুধুমাত্র শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশের পথ হলনা, নারীর নতুন অস্তিত্ব তৈরির সহায়ক শক্তি হয়ে উঠল এবং সমাজকেও প্রভাবিত করতে শুরু করল। এতদিন পুরুষের চোখ দিয়ে নারী তথা সমাজকে দেখাই একমাত্র সত্যি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছিল। এখন নারীর চোখ দিয়ে পুরুষ তথা সমাজকে দেখার নতুন স্পেস তথা পরিসর তৈরি হল। এখানেই গোল বাঁধলো রক্ষণশীল সমাজের সাথে। নারীর চোখ দিয়ে কেন পুরুষকে দেখা হবে? সম্ভবত নারীর দৃষ্টিতে পুরুষ/সমাজকে দেখার মাঝে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছিল এক অজানা আশংকা ও অজ্ঞেয়তা এবং বহু শঠতা, বহুগামিতা ও মিথাচারের আবরণ উন্মোচিত হবার ভয়।

এরই প্রসারিত রূপ আমরা দেখব কাদম্বিনীর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি নিয়ে যে প্রবল বিরোধ এবং সংঘাত তার মাঝে। বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজে এর কাহিনী ধরা আছে। কিন্তু এর মাঝে অন্তর্লীন যে স্রোত প্রবাহিত ছিল সেটা দলিলে ধরা পড়েনা। আমাদের বুঝে নিতে হয়। এজন্য মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাস শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়। এর সাথে পরতে পরতে জুড়ে আছে সে সময়ের জাতীয়-আন্তর্জাতিক, সামাজিক-অর্থনৈতিক ঘটনা, শহর কলকাতার চলমান জীবনালেখ্য। প্রতিষ্ঠান-অতিরিক্ত অনেক ইতিহাস।

মালবিকা কার্লেকার তাঁর “Kadambini and the Bhadralok: Early Debates over Women’s Education in Bengal” (Economic and Political Weekly, April 26, 1986, pp. WS25-WS31) এ সমস্যাকে চিনেছেন এভাবে – “If women were excessively liberated there was no guarantee that they would either accept the moral straitjacket imposed on them or the sexual double standards allowed for men. These sub-conscious insecurities took a hysterical form occasionally as in the response to the educational and later professional successes of Kadambini, the first Indian woman doctor.”

সেসময়ে নারীদের মধ্যে শিক্ষার স্পৃহা, নতুন দুনিয়ায় প্রবেশের দুর্বার আকাঙ্খা এবং জেদের ইতিহাস ধরা পড়ে নারীদের জন্য স্কুলের ও ছাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধির মাঝে। ১৮৬৩ সালে বালিকা বিদ্যালয় ছিল ৯৫, ছাত্রী সংখ্যা ২,৪৮৬। ১৮৭১ সালে যথাক্রমে ৩৪৪ এবং ৬,৭১৭। ১৮৭১-তে ১,০৪২ এবং ৪৪,০৯৬। ১৮৯০ সালে সে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হল যথাক্রমে ২,২৩৮ ও ৭৮,৮৬৫। (মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৩)

মেডিক্যাল শিক্ষার অন্দরমহলে

১৮৮১-৮২ সালের রিপোর্টে (GRPI) বলা হয়েছিল – “সরকারি বেথুন স্কুলে এখন ১০৬ জন ছাত্রী আছে … Miss D’Abreu, who passed the F.A. Examination, and Miss Abala Das, who passed the Entrance Examination, in December 1881, both with first grade scholarships, have joined the Madras Medical College, where provision exists for the superior instruction of women in medicine. An application had previously been made to the Council of the Medical College in Calcutta for the

admission of the young ladies to that institution, to study the ordinary course presented for the degree; but it met with such determined opposition from the Professor of the College, though warmly supported by the Officiating Principal and subsequently by the Principal, that the proposal was for the time dropped.” (GRPI 1881-82, পৃঃ ৯২) ১৮৮১-৮২ সালে অবলা দাস এবং ডি’আব্রুর প্রথম শ্রেণীর স্কলারশিপ থাকা সত্ত্বেও মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকদের তথা কাউন্সিল অফ এডুকেশনের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে হয়ছিল, যদিও কার্যনির্বাহী প্রিন্সিপালের সম্মতি ছিল ভর্তির ব্যাপারে।

ভারতের মহিলাদের মেডিক্যাল প্রয়োজন মেটানোর জন্য ১৮৭২ সালেই মাদ্রাজের সার্জন জেনারেল ডঃ বালফোর মেয়েদের মেডিক্যাল শিক্ষার পক্ষে জোরালো মতামত দেন। কিন্তু, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের কলেজ কাউন্সিলের মতো, মাদ্রাজের ডিরেক্টর অফ পাবলিক এডুকেশন এ প্রস্তাব বাতিল করে দেন “entirely premature” বলে। “The proposal was vetoed for the time being.” ১৮৭৪ সালে ডঃ বালফোর পুনরায় এ প্রস্তাব রাখেন, এবং এ সময় মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ডঃ ফারনেল-এর কাছ থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন পান। ১৮৭৫ সালে ৪ জন ছাত্রী ভর্তি হয়। এদের সবাই ইউরোপীয় অথবা অ্যাংলো-ইউরোপীয় ছিল। এই ৪ জন “certificate class”-এ (৩ বছরের কোর্স, পরে বাড়িয়ে ৪ বছরের করা হয়েছিল) ভর্তি হন। “These four students were the first real women medical students in India”। (Margaret Balfour and Ruth Young, The Work of Medical Women in India, 1929, পৃঃ ১০৩)

এই ৪ জনের একজন ছিলেন ব্রিটিশ নারী Mary Scharlieb। তিনি মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এলএমএস পাস করেন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড এবং ভিয়েনায় লেখাপড়া করে এমবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের বন্ধু ছিলেন। ভারতে নারীদের দুরবস্থার, বিশেষ করে মেডিক্যাল সংক্রান্ত ব্যাপারে, রাণী ভিক্টোরিয়ার সাথেও সাক্ষাৎ করে তাঁকে অবহিত করেন। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় Elizabeth Francis Hoggan (এমডি)-এর লেখা Medical Women for India। এই বইয়ে লেখিকা বলেন যে মাদ্রাজে মেডিক্যাল শিক্ষার দরজা মহিলাদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে এবং মহিলারা উৎসাহ নিয়ে শিখছে। তখনও ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ মানচিত্রে স্থান পায়নি।

অবশেষে ১৮৮৩-৮৪ সালের রিপোর্টে বলা হল – “The admission of females to the classes of the Medical College during the year under report marks a new stage in the history of medical education in

Bengal.” (GRPI 1883-84, পৃঃ ১১৩) কিন্তু এর পশ্চাদপটে যে ইতিহাস রয়েছে তা দীর্ঘ সংগ্রামের, অসুখকর। এই রিপোর্টেই বলা হয় – ১৮৭৬ সালে প্রথম নারীদের মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষালাভের প্রসঙ্গ ওঠে। তদানীন্তন বাংলার লেফটন্যান্ট গভর্নর Sir Richard Temple এর পক্ষে ছিলেন। কিন্তু কার্যকরী হয়না। ১৮৭৯ সালে আবার এ বিষয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সে আলোচনাও বিফলে যায়। ১৮৮১ সালে মেডিক্যাল কলেজের কলেজ কাউন্সিলের কাছে প্রস্তাবটি রাখা হয়। এ সময়ের মধ্যে ছাত্রীদের অভিভাবকেরাও (বিশেষ করে কাদম্বিনীর শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি) ছাত্রীদের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করার ব্যাপারে আন্দোলন শুরু করেন। “The Council, however, refused sanction to the proposal on various grounds, the most solid being the undesirability of reducing the standard of qualification for admission to the college; one of the points in the proposal having been that women should be admitted after passing the Entrance examination only.”

এরপরে সরকারের তরফে হস্তক্ষেপ করা হয়। এবং ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও একই মানের প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। শুধু তাই নয়, ৫ বছরের জন্য মাসে ২০ টাকা করে “special female scholarship”-এর ব্যবস্থা করা হয়। “In some subjects the young ladies attend separate, in others common lectures. All classes worked most successfully, and not a single hitch or difficulty has occurred.” (GRPI 1883-84, পৃঃ ১১৩)

এর বেশ ক’বছর আগে, ১৮৭৫ সালে, ব্রাহ্ম নীলকমল মিত্র মেডিক্যাল কলেজে Hospital Assistant কোর্সে ভর্তি হবার জন্য তাঁর নাতনি বিরাজের হয়ে আবেদন করেন। আবেদন নাকচ হয়। (West Bengal State Archives, Finance (Education), File no. 42, Proceedings 2-5, April 1875, pp. 103-105)

এরপরে ১৮৮২ সালের গোড়ায় অবলা দাস এবং Ellen Barbara D’Abreu-কে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করার সুপারিশ করে ডিরেক্টর অফ পাবলিক এডুকেশন A. W. Croft কলেজের প্রিন্সিপাল Dr. J. M. Coates-কে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির মর্মার্থ ছিল, মানুষের দুর্দশা মোচনের জন্য এদের মেডিক্যাল শিক্ষার অনুমতি দেওয়া হোক। (West Bengal State Archives, Letter from DPI to the Principal, Medical College, Calcutta, proposing admission of women, 5th May, 1882) কিন্তু যথারীতি, যেমন আমরা আগেই জেনেছি, কলেজ কাউন্সিল এর বিরোধিতা করে। (WBSA, General Education, 10th June, 1882) কাউন্সিলের অভিমত ছিল – (১) জনসমাজে মহিলা ডাক্তারের জন্য আলাদা করে কোন চাহিদা নেই, এবং (২) কলেজে ছেলে-মেয়ে একসাথে ক্লাস করলে নৈতিক অধঃপতন হবার সম্ভাবনা প্রবল।

কলেজের প্রিন্সিপাল ডঃ কোটস ফ্রান্স, সুইৎজারল্যান্ড এবং আমেরিকার অভিজ্ঞতার নিরিখে জানান যে এসমস্ত ধারণা অমূলক। (Bethune School & College, Centenary Volume 1849-1949, ed. Kalidas Nag, পৃঃ ৪৩) মেডিক্যাল কলেজের মিডওয়াফারি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ হার্ভেও মহিলাদের শিক্ষার স্বপক্ষে জোরালোভাবে প্রিন্সিপালকে সমর্থন করেন। মেটেরিয়া মেডিকা এবং ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের একজন ভারতীয় অধ্যাপক রুদ্রচন্দ্র চন্দ্র নারীশিক্ষার প্রবল বিরোধী ছিলেন। তাঁর বিরোধিতা অত্যন্ত তীব্র ছিল।

এবারে বাংলার তৎকালীন লেফটন্যান্ট গভর্নর Sir Augustus Rivers Thompson হস্তক্ষেপ করেন। এবং দৃঢ়ভাবে জানান যে ছেলেদের মতো একইভাবে, একই পদ্ধতিতে ছাত্রীরাও কলেজে ভর্তি হতে পারবে। মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার দরজা উন্মুক্ত হল নারীদের জন্য। অবশেষে ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী কলেজে ভর্তি হলেনমেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী

এখানে সঙ্গত প্রশ্ন উঠবে যে কেন কলকাতার প্রথম মেডিক্যাল কলেজে মহিলাদের মেডিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে এত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হল? আমি ওপরে এ বিষয়ে বেশ খানিকটা আলোচনা করেছি। তবে এক্ষেত্রে আমার জ্ঞানত মেডিক্যাল কলেজে মহিলাদের শিক্ষা নিয়ে সবচেয়ে সংহত এবং চিন্তাসমৃদ্ধ আলোচনা হয়েছে সমিতা সেন এবং অনির্বান দাসের প্রবন্ধ “A History of the Calcutta Medical College and Hospital, 1835–1936” (in Science and Modern India: An Institutional History, c. 1784-1947, ed. Uma Dasgupta, 2011, পৃঃ ৪৭৭-৫২২)। এই প্রবন্ধে বলা হয়েছে – “The notion of an irreducible physiological divide between the male and the female underpinned gender difference; and the assertion of masculine superiority presupposed the impossibility of a feminine gaze.” এর পরিণতিতে – “the discursive space of the medical classroom required exclusively male participation. The admission of women into that space, subjecting the male body to the female gaze, even if it was a ‘scientific’ scrutiny, was an especially threatening prospect.” (পৃঃ ৪২২) এঁদের মূল্যবান পর্যবেক্ষণ – “The question of equal ‘rights’ or equal access to education and employment opportunities found little space in this discourse.” (পৃঃ ৪৯৯) কথাগুলো বিবেচনার দাবী রাখে।

১৮৮৬-৮৭ সালের শিক্ষাবর্ষের রিপোর্টে জানানো হল ২১ জন পরীক্ষার্থী ফার্স্ট এলএমএস পরীক্ষায় বসেছিল। এদের মধ্যে ৫২% (১১ জন) পাস করেছে। সেকেন্ড এলএমএস পরীক্ষায় ২৬ জনের মধ্যে ৬৯% (১৮ জন) পাস করেছে। ফার্স্ট এমবি পরীক্ষায় পাসের হার ২১% – ৩৮ জনের মধ্যে ৮ জন পাস করেছে। সেকেন্ড এমবি পরীক্ষায় পাসের হার ৭১% – ১৪ জনের মধ্যে ১০ জন পাস করেছে। ৪ জন দেশীয় দাই মিডওয়াইফারি পাস করেছিল। এবং ৮ জন “pupil nurses” মিডওয়াইফ হিসেবে পাস করেছিল। (GRPI 1886-87, পৃঃ ৬৬)

রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে – মহারাণী স্বর্ণময়ী হোস্টেলের অর্ধেক কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। যে মহিলারা মেডিসিন পড়ছে তারা এই হোস্টেলে বাস করছে এবং হোস্টেলটি Managing Committee of the Countess of Dufferin Fund-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। হোস্টেল রক্ষণাবেক্ষণের অর্ধেক খরচ সরকার দিচ্ছে, অর্ধেক দিচ্ছে Branch Committee। নতুন কোন ছাত্রী ভর্তির খবর এই শিক্ষাবর্ষে নেই। একটি নতুন ডিসেকটিং রুম স্যাংকশনড হয়েছে, কিন্তু তৈরি হয়নি। কেমিক্যাল ডিপার্টমেন্টে নতুন যন্ত্রপাতি বসেছে, এবং “new evaporating closets have been put up.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬)

“Female Education” বিভাগে জানানো হল – সর্বমোট ২৪ জন তরুণী ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষালাভ করছে। এরা কলেজের পরিবর্তিত নিয়মের ফলে (ওপরে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে) পড়াশুনো করতে পারছে। এদের মধ্যে ৬ জন ইউরোপীয় এবং ১৫ জন ইউরেশিয়ান। F.A পরীক্ষা পাস করে ৩ জন ভারতীয় নারী কলেজের ইউনিভার্সিটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে মেডিক্যাল কলেজে মোট ছাত্রী সংখ্যা হয়েছে ২৪ জন। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫)

১৮৮৭-৮৮ সালের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে – সামরিক রেজিমেন্টের ডিউটির জন্য ৭ জন হসপিটাল অ্যাপ্রেন্টিস কলেজ ছেড়ে রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছে। ৫ জন বর্মার ছাত্র পাস করে বর্মায় ফিরে গেছে। (GRPI 1887-88, পৃঃ ৭৮)

এই রিপোর্টের সবচেয়ে আনন্দের এবং উল্লেখযোগ্য খবর হচ্ছে ফার্স্ট এমবি পরীক্ষায় ২ জন ১ম বিভাগে এবং ৭ জন ২য় বিভাগে পাস করেছিল। সবার শীর্ষে ছিলেন ছাত্রী ভার্জিনিয়া মেরি মিত্র। (GRPI 1887-88, পৃঃ ৭৮)

রিপোর্টে আরও জানানো হল – ৪৯ বছর কলেজের প্রথম পরীক্ষা থেকে এই শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ২৬৪ জন হসপিটাল অ্যাপ্রেন্টিস প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ৮০৫ জন ছাত্র ডিগ্রি কিংবা লাইসেন্স পেয়েছে মেডিক্যাল প্র্যাকটিসের জন্য। এরা সার্জারিও প্র্যাকটিস করতে পারতো। এই ৮০৫ জন ছাত্রের মধ্যে ২৬ জন সিংহলী, ৬ জন বর্মার এবং ৭৭৩ জন বাঙালি ছাত্র ছিল। ৭ জন দেশীয় দাই ইডেন হাসপাতাল থেকে মিডওয়াফারি পাস করেছে, যেখানে বিগত ২ বছরে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪ এবং ৩। ১৬ জন “pupil nurses” মিডওয়াইফারি পাস করেছে। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৮)

মহারাণী স্বর্ণময়ী হোস্টেলে ১৪ জন আবাসিক ছিল। ১৪ জনের মধ্যে ৬ জন ইউরোপীয়, ৩ জন ইউরেশিয়ান এবং ৫ জন দেশীয়। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৪)

১৮৮৮-৮৯ সালের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে – “Mrs. Ganguli, B.A., (কাদম্বিনী) has passed the special certificate examination.” (GRPI 1888-89, পৃঃ ৫৬)

এখানেও এক বেদনাবিধুর প্রত্যাখ্যানের কাহিনী আছে। আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারছি – “কাদম্বিনী মেডিক্যাল কলেজে পাঠ রীতিমত শেষ করিয়া শেষ পরীক্ষায় উপস্থিত হইলেন। তিনি মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্য বিষয়ের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়া পাশ নম্বর পাইলেন, কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে সে সময়ে এক বাঙ্গালী অধ্যাপক (ডঃ রুদ্রচন্দ্র চন্দ্র) ছিলেন। তিনিনারীশিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অধীত বিষয়ের কার্যকরী জ্ঞানের পরীক্ষার (practical examination) তিনি একটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় নম্বর দিলেন না।” (প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলার নারী-জাগরণ, ১৯৪৫, পৃঃ ৮৯) ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী তিনি এমবি ডিগ্রি পেলেন না, বঞ্চিত হলেন।

এদিকে কলেজের অধ্যক্ষ বিলক্ষণ জানতেন যে কাদম্বিনীর ঐ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা আছে। কিন্তু পরীক্ষকের অভিমতের বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা তাঁর ছিলনা। “কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হইবার পুর্বে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদিগকে গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ (জি, বি, এম, সি) উপাধি অধ্যক্ষই দিতেন, সে অধিকার বন্ধ করিয়া কোনও আইননামা হয় নাই। সে জন্য যদিও বহু দিন ওই উপাধি কাহাকেও দেওয়া হয় নাই, তবুও এ ক্ষেত্রে তিনি কাদম্বিনীকে উহা প্রদান করিয়া তাঁহাকে চিকিৎসা করিবার অধিকার দিলেন ও মহিলাদের জন্য নির্দ্দিষ্ট ইডেন হাসপাতালের চিকিৎসক নিযুক্ত করিলেন।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৯) কিন্তু দ্বারকানাথ এ ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না।

ফিমেল সার্টিফিকেট কোর্স ১৯ জন ছাত্রী নিয়ে এই শিক্ষাবর্ষে শুরু হয়েছিল। এরপরে প্রাথমিক পরীক্ষা পাশ করে আরও ৪ জন যোগ দেয়। এদের মধ্যে ১১ জন ৩ বছরের কোর্স শেষ করে পরীক্ষায় পাশ করে। ১ জন পড়া মাঝপথে বন্ধ করে দেয়। ফলে বছর শেষে ১১ জন ছাত্রী ছিল। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৯)

ইডেন হাসপাতাল থেকে ৯ জন দেশীয় দাই মিডওয়াইফারি পরীক্ষায় certificate qualification পেয়েছিল। আগের ২ বছরে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬ এবং ৭। ১১ জন “pupil-nurses” মিডওয়াইফ হিসেবে পাশ করেছিল।

স্বর্ণময়ী হোস্টেলে ১৭ জন আবাসিক ছিল – ৫ জন ইউরোপীয়, ৬ জন ইউরেশিয়, এবং ১ জন হিন্দু। এদের মধ্যে ৪ জন বিশ্ববিদ্যালয় মানের পড়ায় ছিল, ১০ জন সার্টিফিকেট কোর্সে ছিল (আরেকবার স্মরণ করানোর জন্য, বিশ্ববিদ্যালয় মানের অর্থ পুরো ৫ বছরের পড়াশুনো, সার্টিফিকেট কোর্স ছিল ৩ বছরের সংক্ষিপ্ত কোর্স), এবং ৩ জন ক্যাম্পবেল স্কুলে পড়ছিল। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৯)

“ফিমেল এডুকেশন” বিভাগে রিপোর্ট করা হল – “The most noticeable event in the history of female education in Bengal was the admission of two young native ladies to the degree of Bachelor of Medicine during the year under report. Both these ladies entered the Medical College as regular students alter passing the First Arts examination, and Miss Bidlhu Mukhi Bose and Miss Virginia Mary Mitter are to be congratulated on their success. Another young lady passed the Preliminary Scientific L.M.S. examination. Eleven young ladies of the certificate class of the Medical College also obtained the college license to practise medicine and surgery. The number that remained in the certificate class at the close of the session was 11.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৮)

পরবর্তীতে ফিমেল সার্টিফিকেট কোর্সের ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করা হল – (১) “Students will now be required to have passed the Entrance examination of the Calcutta or some other University” এবং (২) “the course of study is to be extended from three years to four”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৮)

এ শিক্ষাবর্ষে নারীশিক্ষার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রিন্সিপাল ডঃ জে এম কোটস অবসর গ্রহণ করেন। ১৭ জন ছাত্রী ফিমেল সার্টিফিকেট কোর্সে পড়ছিল। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৮)

স্বর্ণময়ী হোস্টেলে গত সেশনের ১৭ জন আবাসিক থেকে কমে এবারে ১৩ জন আবাসিক ছিল – ৫ জন ইউরোপীয়, ৫ জন ইউরেশিয় এবং ৩ জন বাঙ্গালি। বিশস্ববিদ্যালয় মানের পড়শুনো করছিল ৩ জন, সার্টিফিকেট কোর্সে ৭ জন এবং ৩ জন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে পড়ছিল। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৯)

আরেকটি তথ্যসূত্র থেকে জানা যাচ্ছে – “মেডিক্যাল কলেজে ২৪ জন ছাত্রী ছিল। এদের মধ্যে ৫ জন ইউনিভার্সিটি ডিগ্রির জন্য পড়ছিল, ১৯ জন স্পেশাল সার্টিফিকেট কোর্সের ছাত্রী ছিল।” (Accounts and Papers: Forty-Four Volumes, Session 11 February 1890 – 18 August 1890, Volume LIV, পৃঃ ৩৪)

১৮৯১-৯২ সালে নারীশিক্ষা বিরোধী শিক্ষক ব্রিগেড-সার্জেন আর সি চন্দ্র অবসর গ্রহণ করেন। সেশনের শেষে মিলিটারি ক্লাসে ৮২ জন ছাত্র এবং ফিমেল সার্টিফিকেট ক্লাসে ১৭ জন ছাত্রী ছিল। (GRPI 1891-92, পৃঃ ৭৭)

১৮৯৭-৯৮ সালের রিপোর্টে জানানো হল – “ln the female certificate class 10 female students remained over from the previous year, 5 were newly admitted, and 1 was received from the mat1iculated class. Two passed the examination and gained certificates, and 4 ceased to attend. The number of students in the class at the end of the year was therefore 10.” (GRPI 1897-98, পৃঃ ৮৮) অর্থাৎ একটি বছরে ৫ জন নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে।

সে সময়ের সরকারি রিপোর্ট তথা GRPI থেকে বোঝা যায়, যেসব মহিলা চিকিৎসকেরা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন তাঁরা কত বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের পেশাগত কাজ দায়িত্ব নিয়ে সামলাচ্ছেন। মেডিক্যাল কলেজের এক নতুন অধ্যায়ের উনবিংশ শতকীয় বৃত্তান্ত সমাপ্ত হল। পরের অধ্যায়ে আমরা ভারতের প্রথম মহিলা তথা বাঙ্গালি চিকিৎসক সুবিখ্যাত কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে মিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করব। বোম্বের আনন্দিবাই জোশিও কাদম্বিনীর সাথে একই বছরে পাশ করেছিলেন এবং এমডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তবে তাঁর লেখাপড়া আমেরিকার Women’s Medical College of Pennsylvania (ফিলাডেলোফিয়া) থেকে, ভারতে নয়।

 

 

 

 

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (6)
  • comment-avatar
    Sudipta Basu 1 year

    অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনার সান্নিধ্যে অনেক অজানা তথ্য জানার সুযোগ হয়েছে । আপনি প্রমাণ করেছেন ডাক্তারি শুধু অর্থোপার্জনের পথ নয় । আপনার মত চিকিৎসক এবং গবেষক আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের অত্যন্ত আবশ্যক। প্রণাম জানাই প্রচেষ্টা ও অবদানের।

  • comment-avatar
    Nabin Pal Chowdhury 1 year

    অসাধারণ লেখা। আপনার লেখা গুলো পড়ে অনেক অজানা জিনিস জানতে পারলাম। 🙏🙏

  • comment-avatar
    সুকুমার ভট্টাচার্য্য 1 year

    আমাদের লজ্জার ইতিহাস খুব ভাল আলোচনা করেছেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মহিলাদের ওপর পুরুষদের স্বার্থাণ্বেষী শাসন শিথিল করার চেষ্টা প্রায় দেড়শ বছর আগে শুরু হলেও এখনও কি সম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা তো সাধারণভাবে আজও ডাক্তার আর তাচ্ছিল্যের সাথে লেডী ডাক্তার বলে মহিলাদের আলাদা করি। 
    আপনার আলোচনা আমাদের সমাজকে সমৃদ্ধ করুক।

  • comment-avatar
    Dr Asis K Sinha 1 year

    Very well researched and illuminating write-up.

  • comment-avatar

    Anek kichu i Jana jay eta porey, jara janey na tara janbey.
    Recent past e Kadambini ke niey akta TV serial hoeyche. Kharap na. Sabai struggle tar andaj peyeche kichu ta.
    Samosamayik England ar USA te o meyeder struggle kichu Kom chilo na onek khetre i.

  • comment-avatar

    Anek kichu i Jana jay eta porey, jara janey na tara janbey.
    Recent past e Kadambini ke niey akta TV serial hoeyche. Kharap na. Sabai struggle tar andaj peyeche to certain extent.
    Samosamayik England ar USA te o meyeder struggle kichu Kom chilo na onek khetre i.

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    410 Gone

    410 Gone


    openresty